জলধি / প্রবন্ধ / বঙ্গবন্ধুর রসবোধের বিচক্ষণতা
Share:
বঙ্গবন্ধুর রসবোধের বিচক্ষণতা

জগতকে যাঁরা জয় করেছেন যাদুকরী নেতৃত্বের পরশ পাথরে, যাঁরা জনতার হৃদয়ের মণিকোঠায় জেগে আছেন ধ্রুবতারা হয়ে তাঁদের সবারই প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের দক্ষতা ছিল অসাধারণ, এই প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের বলেই তাঁরা বিরূপ পরিস্থিতিকে এনেছেন নিজের করায়ত্বে | যে কোন উদ্ভূত বিড়ম্বনাকর পরিস্থিতিকে মোকাবেলার সহজাত দক্ষতা হতেই প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের মতো জরুরি ও অসাধারণ গুণের সূচনা হয়| মহাকবি কালিদাস তাঁর বাবাকে বিড়ম্বনা হতে বাঁচাতে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ঝলকানি| উইনস্টন চার্চিল, জর্জ বার্নার্ড শ', রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখ কে না উইটের ব্যবহার করেছেন ? উইটের ব্যবহারে রাজনীতিক বঙ্গবন্ধুও পিছিয়ে ছিলেন না কখনো, বরং অনেকের চেয়ে এগিয়েই ছিলেন বলা যায় ।

যাঁরা যাদুকরী নেতৃত্ব দিয়ে জনতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন, তাঁরা তাঁদের চলনে বলনে,বচনে ভাষণে প্রচুর উইটি উপাদান সন্নিবেশ করেন| এই উইটি উপাদান ব্যবহারের স্বতঃস্ফূর্ততায় অনেক কঠিন বিষয়ও বোঝানো সহজ হয়ে ওঠে| বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে, আড্ডায় এরকম প্রচুর উইটি উপাদান রাখতেন বলেই মানুষের মনের গভীরে তাঁর কথাগুলো দাগ কেটে যেত| অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতেও বক্তৃতায় উইটি এলিমেন্টের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবহার দেখা গেছে এবং 'পুট ডাউন' হিউমারের সন্নিবেশ নজরে এসেছে| বাহাত্তর সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনে মনোনিবেশ করেন| তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সংক্ষেপে তুলে ধরতে বলেছিলেন, 'সবাই পায় হীরার খনি, সোনার খনি আর আমি পেলাম চোরের খনি|' বঙ্গবন্ধু আসলে ছোট্ট একটা বাক্যে যুদ্ধকালিন লুন্ঠনের শব্দচিত্র উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন সার্থকতার সাথে| একথার পিঠাপিঠি বঙ্গবন্ধুর আরো একটা কথা উল্লেখযোগ্য| একবার এক কৃষক বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন| নিচতলার সিকিউরিটি তাকে যেতে দিচ্ছিল না ওপরে| শেষমেষ কৃষক ওপরের তলায় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া বিশ টাকা হতে দশ টাকা কথা মোতাবেক দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হন, কিন্তু এ কথা বঙ্গবন্ধু জানার পর সখেদে বলেছিলেন,'যে দেশে দুই তলা থেকে নিচতলায় যেতে বিশ টাকা দশ টাকা হয়ে যায় সে দেশে উন্নয়ন কঠিন|'স্বাধীনতার পর বক্তৃতা দিতে যেয়ে ভুট্টোকে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ' ভুট্টো সাপ এখন দাঁড়াস হয়ে গেছে| ' তাঁর এই একটা মন্তব্যে বক্তৃতাটি মনের গভীরে ঢুকে গেছে শ্রোতার|

 

ঘরোয়া বৈঠকে বঙ্গবন্ধু একবার তাঁর কাছের লোকজনকে উইট সহকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশে তেল আছে| সবাই একটু অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকালে তিনি বলেছিলেন, যাদের তেল আছে তারা মুসলিম দেশ| তাদের রাষ্ট্রপ্রধান অবশ্যই একজন শেখ| বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এদুটো শর্তই পুরোপুরিভাবে  বর্তমান|' যদিও কথাটা আড্ডার ছলে বলা| কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখি, বাংলাদেশে অল্প হলেও সত্যি সত্যি হরিপুরে তেল পাওয়া গেছে| সংযুক্ত আরব আমিরাতে সফরকালে সুলতান নাহিয়ান বলেছিলেন, তাঁরা উভয় রাষ্ট্র প্রধানই শেখ| বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে জবাবে বলেছিলেন, 'ইউ আর রিচ শেখ অ্যান্ড আই অ্যাম ভেরি পুওর শেখ|' কিন্তু পুওর দেশের রাষ্ট্র প্রধান হলেও বঙ্গবন্ধুর মন ছিল উদার । ঊনিশ্শো তিয়াত্তর সালে চাঁদপুরে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন নির্বাচনী সফরে| দুপুরে ওয়াপদার রেস্ট হাউজে আহারের সময় রুই মাছের মাথাটা খন্দকার মোশতাকের পাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, 'তুই তো সব সময় আমার মাথা খাস নে এবার এই রুই মাছের মাথাটা খা|' খন্দকার মোশতাক যে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সত্যিকারের প্রাণ সংহারকারী হবেন দৈব কি বঙ্গবন্ধুকে কোনভাবে তা জানিয়ে দিয়েছিল?

বঙ্গবন্ধু একই সফরে চাঁদপুরের জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদানকালে যুদ্ধোত্তর দেশ হতে চোর-ডাকাত-মুনাফাখোর কমানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, 'আমার চাঁনপুরের ভাইয়েরা,তোমরা তো চর দখল নিয়ে মারামারি করতে পার। তোমরা কি পার না এদেশ হতে চোর-ডাকাতদের দূর করতে? তোমরা কি পার না ?' বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের মধ্যে লুকিয়ে আছে তাঁর বেদনা একদিকে আর অন্যদিকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, চাঁদপুরের মানুষজনের খোর-খবর তিনি রাখেন । ঊনিশ্শো সাতষট্টি সালের কোন একদিন শেখ মুজিবুর রহমান নৌপথে ঢাকা হতে চাঁদপুর হয়ে যাচ্ছিলেন টুঙ্গিপাড়া| রাত দুটোয় যাত্রা বিরতিতে চাঁদপুর লঞ্চঘাটে এসময় নেতার সাথে দেখা করতে যান চাঁদপুরের সর্বজন বিদিত আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আব্দুল করিম পাটোয়ারি, জনাব সিরাজুল ইসলাম, তরুণ ছাত্রনেতা মুনীর আহমেদ এবং শানু মাইক সার্ভিসের রেহান মিয়াসহ আরো কয়েকজন| ঐদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ও পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুনীর আহমেদের ভাষ্য হতে জানা যায়, মুনীর আহমেদ নেতাকে যখন জিজ্ঞেস করলেন, নেতা আবার কবে চাঁদপুর আসবেন, তখন শেখ মুজিব খুনসুঁটির ছলে মুনীর আহমেদের পেটে হাল্কা গুঁতো দিয়ে বলেছিলেন, '... যেখানে তোমার মতো তরুণরা আছে, সেখানে আমার কি আসতে হবে?' লীডারের এই উইটি উত্তরে তরুণ ছাত্রনেতা মুনীর আহমেদ এতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি আজো সে উত্তর ভোলেননি|কোলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়াকালিন বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে রাজনীতির তাত্বিক পাঠে অংশ নিতেন| তবে সাংগঠনিক দায়িত্বের কারণে সব সময় উপস্থিত থাকতে পারতেন না| একদিন বাম তাত্বিক আবুল হাশিম এর ক্লাস না করায় বন্ধুরা তাঁকে উল্লেখ করে কিছু একটা বলায় তিনি সে প্রসঙ্গে তাঁর বন্ধুদের ঠাট্টা করে বলেছিলেন, 'তোমরা পণ্ডিত হও| আমার অনেক কাজ| আগে পাকিস্তান আনতে দাও তারপরে বসে বসে আলোচনা করা যাবে|' বঙ্গবন্ধুর এ রঙ্গরস হতে এটা বুঝা গেছে যে তিনি রাজনীতির ফলিতরূপকেই প্রাধান্য দিতেন বেশি কেননা জনকল্যাণে রাজনীতির ফলিত দিকের তাৎপর্যই গুরুত্ববহ| তাত্বিক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা তখনই যদি ফলিতরূপের ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকে|

বঙ্গবন্ধু কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় রাজনীতি ও সমাজসেবায় সময় দিতেন বেশি| এতে কলেজে নিয়মিত আসতে পারতেন না| মাঝে মাঝে যখন কলেজে আসতে পারতেন তখন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল জুবেরী সাহেব ব্যাজোস্তুতির ছলে জিজ্ঞেস করতেন, 'কি সময় পেয়েছ কলেজে আসতে?' তরুণ শেখ মুজিব তাঁর প্রিন্সিপ্যালের এই স্নেহমাখা সেন্স অব হিউমার মনের মধ্যে গেঁথে রেখেছিলেন আজীবন|

সুদীর্ঘ কারাজীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই জেলে কারাবন্দী হিসেবে মহিউদ্দিন আহমদ একসময় জেল খেটে একসাথে অনশন ধর্মঘট পালন করেছেন। ঐ সময় মহিউদ্দিন আহমদ স্বস্তি প্রকাশ করেছেন  যে শেখ মুজিবের সাথে মুক্তি পাওয়ায় তার গলাতে একটা নিদেন পক্ষে মালা হলেও জুটবে। বঙ্গবন্ধু তখন তাকে আশ্বস্থ করেছিলেন এই বলে যে, 'তোকে আমি মালা পরিয়ে দেবো।' এই আশ্বাসের মধ্যে একদিকে আছে সহমর্মিতা ও অন্যদিক আছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার, তাঁর সাথে কারাবন্দী হিসেবে কারাযাপন করায় যদিও এখানে সেন্স অফ হিউমারেরও একটা দিক ফুটে ওঠে। অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র একশ পঁচিশ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু নিজের জবানিতে বলেছেন, একদিন তিনি ও কাজী আলতাফ হোসেন সাহেব নৌকা যোগে মাওলানা শামসুল হক সাহেবের সাথে তাঁর বাড়িতে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। রাত দশটায় একমাঝির নৌকায় মধুমতী দিয়ে। কারণ তাঁর বাড়ি মধুমতীর পাড়ে। নদীটা এক জায়গায় খুব চওড়া। এই স্থানে এলে ডাকাতি হয়। এটা মুজিবের জানা ছিল। যারা পানির দেশের মানুষ নৌকায় ঘুমাতে তাদের কোন অসুবিধা হয় না। বঙ্গবন্ধুও অভ্যস্ত চিলেন নৌকায় ঘুমাতে। সারাদিনের ক্লান্তিতে বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়েই পড়েছিলেন। কাজী সাহেব তখনও ঘুমাননি। এমন সময় একটা ছিপ নৌকা তাদের নৌকার কাছে ভিড়ল। ছিপ নৌকায় চারজন। ওরা নৌকার মাঝির কাছে আগুন আছে কি না জানতে  চাইল। আগুন চেয়েই এরা নৌকার কাছে আসে। এটাই এদের পন্থা। জিজ্ঞেস করে নৌকা কই যাবে? মাঝি বলল টুঙ্গিপাড়া। নৌকায় কে? মাঝি মুজিবের নাম বলল। ডাকাতরা মাঝিকে ভীষণভাবে বৈঠা দিয়ে একটা আঘাত করে বলল, 'শালা আগে বলতে পার নাই, শেখ সাহেব নৌকায়'। এই বলে তারা নৌকা বেয়ে চলে গেল। মাঝি মার খেয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে নৌকার ভিতর ঢুকে পড়ল। মাঝির চিৎকারে মুজিবের ঘুম ভেঙে যায়। কাজী সাহেব জেগে ছিলেন। ভয়ে তিনি তার আংটি,ঘড়ি,টাকা সব লুকিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি শৌখিন মানুষ ছিলেন। মুজিব জেগে জিজ্ঞেস করলেন,ব্যাপার কী? মাঝি ও কাজী সাহেব ঘটনা জানাল। কাজী সাহেব বললেন,ডাকাতরা আপনাকে শ্রদ্ধা করে। আপনার নাম করেই বেঁচে গেলাম। না হলে উপায় ছিল না। মুজিব বললেন, 'বোধ হয় ডাকাতরা আমাকে তাদের একজন ধরে নিয়েছে।' দুইজনে এতে খুব হাসাহাসি হলো।

গুরু শহিদ সাহেবের সাথে রাজনৈতিক প্রয়োজনে দেখা করতে মুজিব গেলেন লাহোর। জীবনে প্রথমবার। কিন্তু লাহোর গিয়েও শান্তি নেই। তিনি জানতেন, তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্যে গোয়েন্দা পুলিশ খুঁজছে। মরুময় লাহোরে গ্রেপ্তারের ভয় নিয়েও তিনি বলে উঠেছিলেন রঙ্গ করে, 'পূর্ব বাংলার জেলে ভাত পাওয়া যাবে। পাঞ্জাবের রুটি খেলে আমি বাঁচতে পারব না। তাই যা হবার পূর্ব বাংলায় হোক।' প্রথমবার করাচী দর্শনকালে মরুভূমি দেখে মুজিবের মন ওঠে হু হু করে। মুজিব নিজেই যেন স্বগতোক্তি করে ওঠেন, 'বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়'। আসলে যে একবার সবুজ শ্যামল বাংলার প্রকৃতিতে বড় হয়েছে তার কাছে ঊষর মরুময় প্রকৃতি যেন প্রাণহীন। একারণেই বঙ্গবন্ধু বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানীরা গাছহীন নদীহীন প্রকৃতির জন্যেই মায়াহীন আর আমরা মায়াভরা, মমতামাখা।

টাঙ্গাইলের রাজনীতিবিদ শামসুল হক, মাওলানা ভাষাণী এবং শেখ মুজিবুর রহমান একবার একসাথে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ঊনিশ্শো ঊনপঞ্চাশ সালের ডিসেম্বরে তাঁদের তিনজনকে এগার অক্টোবরে ঢাকার নাজিরা শোভাযাত্রার ঘটনার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়। তাদের একসাথে রাখার ব্যবস্থা হলো। শামসুল হক সাহেব মাত্র দেড় মাস হলো বিয়ে করেছেন। তার পত্নীর নাম ছিলো আফিফা বেগম। আটক হওয়ার পরে তিনি শেখ মুজিবকে দোষারোপ করতেন তার নিজের কারাবন্দী হওয়ার জন্য। মুজিব এ কারণে তাকে 'বউ পাগলা' বলে ক্ষ্যাপাতেন। তিনি ক্ষেপলে মাওলানা সাহেবকেও উল্টাপাল্টা বলতেন। পরবর্তীতে জেলখানায় রাতে শামসুল হক সাহেব জিকির করতেন। জিকিরের শব্দ মুজিবের কানের কাছে বাজতো। এতে রাতে তাঁর ঘুম হতো না। অথচ রাতে না ঘুমাতে পারলে তাঁর শরীর ভেঙে যায়। কয়েকবার অনুনয় করার পরও যখন শামসুল হক সাহেব মুজিবকে ভয় দেখালেন তখন মুজিবও পাল্টা ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন, 'আপনি যখন জিকির করবেন তখন আমি উঠে মাথায় পানি ঢেলে দিব। পরে যা হয় হবে।' মুজিবের এই অসময়ের কষ্টের মাঝেও তাঁর সেন্স অব হিউমার কাজ করে গেছে তীক্ষ্ণভাবে।

সেলের ডেফিনেশন প্রসঙ্গে মুজিব একবার ঠাট্টা করে বলেছিলেন,'জেলের মধ্যে জেল তাকেই বলে সেল।' শেখ মুজিব কারাজীবনে যে বার দীর্ঘমেয়াদে আটক ছিলেন সেবার তাঁকে ঢাকা হতে নারায়ণগঞ্জ হয়ে গোপালগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হলো। গোপালগঞ্জ থেকে যাবেন মাদারীপুর। রাতে গোপালগঞ্জ থানায় তাকে রাতযাপন করতে হলো। থানার এক কামরায় ঘটাং ঘটাং তীব্র আওয়াজে চলছিল ওয়্যারলেস্ মেশিন। অন্য কামরায় মুজিবের শোয়ার ব্যবস্থা হলো। কিন্তু মশার জ্বালায় ঘুমানো সম্ভব নয়। সেই রাতেই তিনি তাঁকে পাহারা দেওয়া পুলিশ সদস্যকে বললেন, '-গোপালগঞ্জের মশা নামকরা। একটু সুযোগ পেলেই আর রক্ষা নেই।'

গোপালগঞ্জ থেকে মাদারীপুর যাওয়ার সময় সিন্ধিয়াঘাটে থেমে রাত যাপন করতে হয়েছিল ইরিগেশন ডিপার্টমেন্ট এর ডাকবাংলোতে। তিন নদীর মোহনায় এবং তিন নদীর পাড়ে ছিল এ ডাকবাংলো। রাতে অনেক সময় ধরে মুজিব ডাকবাংলোর বারান্দাতে বসে নদীতে নৌকার আনাগোনা দেখছিলেন। সাথে ছিলো পূর্ণিমার আলো। তাঁকে পাহারারত পুলিশদের তিনি বললেন, 'আমার জন্যে চিন্তা করবেন না। ঘুমিয়ে থাকেন। আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলেও যাব না। ' এতে কর্তব্যরত সকলেই হেসে দিয়ে বলেছিল, আমরা তা জানি।

ঊনিশ্শো সাতান্ন সালে দিন পনেরোর জন্যে মুজিব গেলেন চীন। সাথে ছিল অন্যান্য সফরসঙ্গী। চীন যাওয়ার আগে তাঁরা হংকং ছুঁয়ে গেলেন। কিন্তু হংকং এর বাজার ঘুরে মুজিবের মনে এলো বিরক্তি। তিনি হংকং এর অবস্থা দেখে হিউমার করে বললেন, 'হংকং এর নাম হওয়া উচিৎ ছিল ঠগিবাজি শহর। রাস্তায় হাঁটবেন পকেটে হাত দিয়ে,না হলে পকেট খালি'। পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছিল ঊনিশ্শো সাতচল্লিশে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ঊনিশশো ঊনপঞ্চাশে। মাত্র আট বছরে চীন নিজেকে গড়ে নিয়েছিলো প্রগাঢ় দেশপ্রেমের প্রচণ্ড শক্তিতে। নয়াচীন দেখে মুজিব এত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে সেখান থেকেই দ্বিতীয় বিপ্লবের বীজ নিয়ে আসেন মাথায় করে। এসময় তিনি দেখলেন, চীনে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই, হাঙ্গামা নেই। যে যার কাজের মাধ্যমে দেশ গঠনে অবদান রাখছে। এই চীন দেখে মুজিবের সেন্স অফ হিউমার জাগ্রত হয়ে গেছে যেন। তিনি বলে উঠলেন খুশিতে, 'আফিং খাওয়া জাত যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আফিং এখন আর কেউ খায় না, ঝিমিয়েও পড়ে না'। চীন ভ্রমণে বেশ কিছুদিন পার হলে শেখ মুজিব টের পান, দেশে ফিরলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তাই তিনি ঠাট্টা করে তাঁর সফরসঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বলেন, '...বেশি দেরি করার উপায় নাই। আমাদের দেশের সরকারের যে মনোভাব তাতে ভবিষ্যতে আর চীন দেখার সুযোগ পাব কি না জানি না। বেশিদিন দেরি হলে  সরকার সোজা এয়ারপোর্ট থেকে সরকারি অতিথিশালায় নিয়ে যেতে পারেন।'

মাঝে মাঝে দলীয় নেতাকর্মীদের সম্পর্কে মুজিব দারুণ উইটি মন্তব্য করতেন। এরকম আলোচনা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ থেকে বিতাড়িত দলের নেতা ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) সম্পর্কে মুজিব বলেন, 'তাকে অনেকে Evil Genius বলে থাকেন। যদি ভালো কাজে তার বুদ্ধি ও কর্মশক্তি ব্যবহার করতেন তাহলে সত্যিকারের দেশের কাজ করতে পারতেন।' সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একবার ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর ক্ষেপে গিয়ে তাকে আপদ আর বিপদের দারুণ সংজ্ঞা দিয়েছিলেন উইটি উত্তরে। তেমনি বঙ্গবন্ধুরও আপদ-বিপদ-মুসিবত ছিল। তবে তারা তাঁর তিনজন অতি স্নেহভাজন সাংবাদিক। সাংবাদিক ফয়েজের নাম স্নেহভরে তিনি রেখেছিলেন আপদ, এবিএম মুসা ছিলেন বিপদ আর আব্দুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন মুসিবদ। এদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর স্নেহ ছিল ফল্গুধারার মতো। একবার আদালতে দেখা হয়েছিলো সাংবাদিক ফয়েজের সাথে। তখন পাকিস্তানী সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর বিচার করছে। বঙ্গবন্ধুর সাথে কারও কথা বলা সরকারি নিষেধাজ্ঞা। সাংবাদিক ফয়েজ গিয়েছিলেন আদালতে সংবাদ কাভার করতে। ফয়েজকে দেখে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'ফয়েজ কেমন আছিস্ ?' কিন্তু নিষেধাজ্ঞার ভয়ে ফয়েজ উত্তর দেয়া দূরে থাক চোখ তুলেও চায় নি। এতে মুজিব বলে উঠেছিলেন বিচারকের দিকে তাকিয়ে, 'এদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলেই থাকতে হবে।'

পাকিস্তানের কোয়েটা সফরকালে বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল, ছয়দফা বাস্তবায়িত হলে তো পাকিস্তান ভেঙে যাবে। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক উত্তর দিয়েছিলেন, 'ইয়্যু হ্যাভ সাক্ড আওয়ার ব্লাড ফর টুয়েন্টি থ্রি ইয়ারস্। নাউ ইয়্যু উ্যইল ফেস্ দ্য মিউজিক।' তিনি তাৎক্ষণিক জবাবে তাঁর গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও ছাড় দেননি। একবার ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রশ্নে কমিটিতে আনোয়ারকে অন্তর্ভূক্তি নিয়ে গুরু-শিষ্যের দ্বিমত হয়। গুরু রেগে মুজিবকে বলেছিলেন, হু আর য়্যু? য়্যু আর নো বাডি'। জবাবে এ মন্তব্য মাটিতে পড়ার আগেই মুজিব উত্তর দেন, 'ইফ আই অ্যাম নো বডি দ্যান য়্যু আর অলসো নো বডি। ইফ আই অ্যাম নো বডি দ্যান হোয়াই হ্যাভ য়্যু কল্ড মী?'বঙ্গবন্ধুর যাদুকরী নেতৃত্বের ভিত্তি আর নেপথ্যে ছিল তাঁর সাহস, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সংগ্রামে নিষ্ঠা, সততা এবং সর্বোপরি তাঁর জায়গামতো সঠিক কথা বলতে পারার অনন্য গুণ আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। এই প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং উইট ব্যবহারের শালীন শোভন সক্ষমতা তাঁকে একদিকে যেমন করে তুলেছিল ব্যক্তিত্বময় পুরুষ তেমনি অন্যদিকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সত্যিকারের জনতার মুজিব ভাই। জাতির জনকের জন্মশতবছরের এই উৎসবকালে করোনা আমাদের দমিয়ে রাখলেও তাঁর জন্মোৎসব ইতিহাস হয়ে গেছে। এই জন্মশতক-স্মারক মুজিববর্ষে রক্তাক্ত পনর আগস্ট আবার এসেছে। কিন্তু এ আগস্টে আর শোক নয়। এ আগস্টে আমরা আলোক সম্পাত করি জনকের অমৃত জীবনের ওপর। সেই অমৃত সমুদ্র মন্থনে খুঁজে পাওয়া স্মৃতির মণিমুক্তো দিয়েই নিবেদিত হোলো তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। জাতির জনকের প্রতি পরম শ্রদ্ধায় আনত হয়ে বলি,

'মুজিব হলো উদার আকাশ

ইতিহাসের বট

হাজার বছর ধরে আঁকা

কালের চিত্রপট'।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান