জলধি / প্রবন্ধ / দগ্ধ-কাতর প্রেমিকের গান
Share:
দগ্ধ-কাতর প্রেমিকের গান

বিরহ/কবীর সুমন

বর্ষায় তুমি ভেবো না আমার কথা
ঝলমলে দিনে ভেবো
রোদ্দুরে তুমি আমার খবর নিও
আমিও খবর নেবো।

আকাশে মেঘের দাদাগিরি বিচ্ছিরি
ঠিক যেন সবজান্তা শাসকদল
আমিতো ওদের এড়িয়েই ঘুরিফিরি
মেঘেরা বলছে ‘তুইও ঝরবি চল’।

ঝেঁটিয়ে বিদায় দিতে ইচ্ছে করে
গোমড়া মেঘের বিদঘুটে দলগুলো
মেঘবিলাসীরা মারবে আমায় ধরে
ভালোবেসে যাই শুকনো পথের ধুলো।

বর্ষার গানে রবীন্দ্রনাথ একা
বিরহীর মতো সান্ত্বনা পান মেঘে
তিনিই আবার শরৎ আলোর পাখি
যে আছে তোমার বুকের মধ্যে জেগে।

আমি জেগে আছি তোমার বিরহে আজ
কামনায় বাঁধা খ্যাপা জন্তুর মতো
মনে করে নাও এটাই আমার কাজ
যদি দু-জনের একবার দেখা হতো।

[সুমনের গান পঞ্চম সংকলন, সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা, ২০০২।]


গানটি শুনে তার অর্থ-ব্যক্তির প্রশ্নে লক্ষ্য ও উপলক্ষ্য নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে যাবেন পাঠক, আমিও পড়েছি, বোঝা সহজ নয় যে এখানে ‘বিরহ’/বর্ষাই লক্ষ্য, নাকি প্রথম ও দ্বিতীয় স্তবকের উপলক্ষ্য মেঘের প্রতীকে উপস্থাপিত দলনীতিবিদদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশই এর আসল উদ্দেশ্য। গানটির শিরোনাম যেহেতু ‘বিরহ’, তাই এ-কথা ভাববার সুযোগ আছে যে এখানে ‘বিরহ’ই লক্ষ্য, উদ্দিষ্টা ‘তুমি’ও রয়েছে সামনে, গানের শুরুটাও হয়েছে সেই পরিচয়ে, একটি সহজ তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে :
    
বর্ষায় তুমি ভেবো না আমার কথা
ঝলমলে দিনে ভেবো
রোদ্দুরে তুমি আমার খবর নিও
আমিও খবর নেবো।

কিন্তু বর্ষায় প্রিয়তমাকে কাছে পেতে আপত্তিটা কোথায় এবং এতে তো দীর্ঘ দীর্ঘ কালের, আদি—মধ্য—অধুনার, বলা যায় চিরকালের প্রবণতাকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। মেঘদূত-এর সেই শ্লোকটির কথা কার না মনে পড়বে : ‘মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ/কণ্ঠাশ্লেষপ্রণয়িনি জনে কিংপুনর্দূরসংস্থে \’—মেঘ দেখে যেখানে সুখী ব্যক্তিও অস্থির হয়, সেখানে কণ্ঠাশ্লেষব্যগ্র প্রিয়তমা যার পাশে নেই, তার অবস্থা তো শোচনীয় হবেই। কারও মনে পড়ে যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের সেই আকুলতার কথা : ‘তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা/দূরের পানে মেলে আঁখি, কেবল আমি চেয়ে থাকি,/পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে’। এমন দৃষ্টান্ত তো বাংলা কবিতা ও গানে অসংখ্য, কিছু ব্যতিক্রম উদাহরণের মধ্যে বিষ্ণু দের ‘বর্ষা’ শিরোনামের একটি কবিতায় দেখতে পাচ্ছি একটু ভয় ও সংশয় : ‘ভয় হয় বুঝি বাজে বিদ্যুতে খেলা মেশে সংঘাতে—/ প্রেয়সী! এ যেন আমাদের ভালোবাসা।’, জীবনানন্দের ‘অন্ধকার’ কবিতায় বর্ষার উল্লেখ না থাকলেও রয়েছে ‘অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে’ না-ওঠার বার্তা, এই সব অভিজ্ঞতার বাইরে এসে বর্ষায় নয় রোদ্দুরে প্রিয়তমাকে তার খবর নেওয়ার কথা সরাসরিই বলছেন সুমন। অবশ্য বর্ষায় কাউকে কাছে পেতে, ব্যক্তিগতভাবে, কারও অপছন্দ থাকতেও পারে, সে-ক্ষেত্রে একজন শ্রোতাকে/পাঠককে দূর-ভাবনা বা দুর্ভাবনার আশ্রয়ই নিয়ে সেই প্রেমিকের দারিদ্র‍্যের চিত্র কল্পনায় আনতে হয় : হয়তো তার টিনের/নাড়ার চাল শিলাবর্ষণে ফুটো অথবা অন্য কোনো সংকট, হতে পারে ঋতুবৈকল্যও; কিন্তু এই সবকিছুই তো অতি/দূর-কল্পনামাত্র।  
     এমনিতে দ্বিতীয় স্তবকে দলনীতিবিদদেরকে শুরুতে যেভাবে মেঘের মাধ্যমে প্রতীকায়িত করে দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে সরাসরি বলে বসেন, ‘ঠিক যেন সবজান্তা শাসকদল’ তখন বোঝা যায় সমসময়ের প্রতি বিদ্রুপের তাৎপর্যে এতে উপলক্ষ্যের বাস্তবটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এড়ানো সত্ত্বেও যারা তাঁকে আহ্বান করে সেই শাসকদলের প্রতি তাঁর ক্ষোভ আর হুজুগে-অনুসারীদের প্রতি তাঁর মনোভাব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তৃতীয় স্তবকে :
   
ঝেঁটিয়ে বিদায় দিতে ইচ্ছে করে
গোমড়া মেঘের বিদঘুটে দলগুলো
মেঘবিলাসীরা মারবে আমায় ধরে
ভালোবেসে যাই শুকনো পথের ধুলো।

কিন্তু গানের চতুর্থ স্তবকে এসে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ কবিতার দলনৈতিক কল্পচিত্র ও তাকে কেন্দ্র করে উপরিউল্লিখিত ব্যাখ্যার পরিবেশ পাল্টে দেয়, মনে হয় এখানে দলনীতিটিতি কিছু নয়, এই কবিতার মূলাধার হলো প্রেম, নয়তো প্রেমের ছদ্মবেশে গানের শেষ মঞ্জিল : শিল্প।

প্রেমের ইশারা তো এখানে, বিশেষত শেষ স্তবকে, স্পষ্টই, আর শিল্পের প্রসঙ্গ এজন্য যে, বর্ষার গানে রবীন্দ্রনাথের একচ্ছত্র আধিপত্যের স্বীকৃতি দিয়ে এবং প্রেমিকার বুকে ‘শরৎ আলোর পাখি’রূপে তাঁর জেগে-থাকার-তথ্য প্রদান করে তিনি নিজে, শিল্পী হিসেবে, শিল্পী রবীন্দ্রনাথের পাশ থেকে তাঁর আসন সরিয়ে আনেন :

বর্ষার গানে রবীন্দ্রনাথ একা
বিরহীর মতো সান্ত্বনা পান মেঘে
    
‘একা’ শব্দের ব্যবহারে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের অনন্যত্বের স্বীকৃতি ও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব আর মেঘ ও বিরহী শব্দ দুটির কারণে কিছুক্ষণের জন্য কালিদাসের কথা মনে পড়তে পারে, কিন্তু ‘সান্ত্বনা’ শব্দে রয়েছে অশরীর ব্যঞ্জনা যা রবীন্দ্রনাথের বর্ষার অধিকাংশ গানেরই প্রবণতা। কিছু ব্যতিক্রম, যেমন ‘ভানু’র ভণিতায় ‘অবলা কামিনী’ আর ‘থরহর কম্পিত দেহ’ আর চম্পকমালে চুল বাঁধার কথা; অন্য গানে আছে সজল আঁখি ও আঁখি মেলে চাওয়ার কথা, কিন্তু এর বাইরে তো সেই অশরীর বর্ণনাই : কখনো পরানপুটে ব্যথা ফুটছে, কখনো হৃদয়কোণে কারও কথা জেগে উঠছে, কখনো-বা বৃষ্টি ও ঝড়ে তার মন ছোটে, হৃদয়ে অনুভব করেন কোখ-এক পাগলের অস্তিত্ব; এমনকি বর্ষার যে-গানটি শুরু হয়েছে ‘কাঁপিছে দেহলতা থরথর,/চোখের জলে আঁখি ভরভর’ বর্ণনার মধ্য দিয়ে, সেখানেও রয়েছে এমন পঙ্ক্তি : ‘নীরব হিয়া তব দিল ভরি কী মায়া স্বপনে যে, মরি মরি।’ রবীন্দ্রনাথের এইসব গানের সুর ও বাণী দীর্ঘদিন ধরে যেখানে শ্রোতাদের তৃপ্ত করছে, সুমন নিজেও যেখানে রয়েছেন সেই গায়নের শরিক, কিন্তু স্ব-রচনার ক্ষেত্রে এই সব অভিজ্ঞতা ধারণ করেও তিনি তাঁর নিজের পৃথক অবস্থানটা স্পষ্ট করেন এভাবে :
    
আমি জেগে আছি তোমার বিরহে আজ
কামনায় বাঁধা খ্যাপা জন্তুর মতো
মনে করে নাও এটাই আমার কাজ
যদি দু-জনের একবার দেখা হতো ।
    
এতে বর্ষার ঝড়-বৃষ্টি-উষ্ণতার গতি ও আভাস সত্ত্বেও তার মূল প্রবণতা যে স্থির-শান্ত জল-টলমল প্রকৃতি, তার বিপরীতে আজকের রৌদ্রপৃথিবীর দগ্ধকাতর/কামজর্জর প্রেমিকের অস্থিরতাটাই ফুটে উঠেছে। বর্ণনার তীব্রতার কারণে তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের ঈষৎ বিচলনের ঘটনায়, বাচ্যর্থের দোষ-গুণ নিজের ওপর দিয়ে কিছুটা বয়ে গেলেও, সময়-বাস্তবতার চিত্রায়ণে গানটি হয়েছে নিখুঁত ও অর্থময়।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান