জলধি / প্রবন্ধ / জীবনানন্দঃ অপূর্ণ ইচ্ছা ও আশা স্বপ্নের ধূসরতা
Share:
জীবনানন্দঃ অপূর্ণ ইচ্ছা ও আশা স্বপ্নের ধূসরতা

চলে যাব, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর

ভিক্ষা করে লয়ে যাবে,- সেদিন দু’দন্ড এই বাংলার তির-

এই নীল বাঙলার তীরে শুয়ে একা একা কী ভাবীব, হায়,-

 একটি পথ দুর্ঘটনা বা পূর্বঘোষিত মৃত্যুর কালপঞ্জি         

শরীর খুব অসুস্থ, কদিন ধরেই তেতে ছিলো অভব্য প্রতিবেশী ভাড়াটিয়ার কারনে । প্রতিদিনের মতই ১৪ অক্টবর বিকালে তিনি হাটতে বের হলেন । একা জীবনানন্দ । যখন বেরুচ্ছিলেন স্ত্রী লাবণ্য দেবি তাঁকে বেরুতে নিষেধ করলেন, শরীর অসুস্থ ছিলো কয়েকদিন ধরেই । লাবণ্যদেবির কথায় তাঁর নিষেধ না শুনেই জল দিয়ে মাথা ধুয়ে একাই বেড়িয়ে যান । ফেরার সময় বাড়ির কাছের লেক মার্কেট থেকে দুট ডাব কিনে নেন ।

হাঁটতে হাটতে জীবনানন্দ রাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগ স্থলের প্রায় কাছাকাছি  এসে গেছেন, তিনি আসছিলেন রাসবিহারী এভিনুয় এর দক্ষিণ দিকের ফুটপাথ ধরে,সংযোগ স্থলে এসে ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্তা অতিক্রম করার জন্য পথে নামলেন । রাস্তার এই অংশটা বেশ চওরা, ট্রাম যাতায়াতে জন্য রাস্তার মাঝখানে দুটো ট্রাম লাইন পাতা । ট্রাম লাইনের জমিটা ঘাসে সবুজ । তিনি ফুটপাথ থাকে নেমে মোটর, বাস, ট্যক্সি প্রভৃতির জন্য পিচ রাস্তার  অংশ অতিক্রম করে ট্রাম লাইনের কাছে এলেন, মনটা কিছুটা চঞ্চল ছিলোই, ভাবলেন ট্রাম আসার আগেই লাইন পার হয়ে যেতে পারবেন, এর আগেতো একটা স্টপেজ আছেই, এই সব ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়েই ট্রাম লাইন পার হতে লাগলেন ।

তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে, অন্ধকার অল্প অল্প করে জমছে । ট্রামটা আসছিলো, আগের স্টপেজে লোক ওঠা-নামার না থাকায় না থেমে জোড়ের সাথেই চলে এলো, ছুটন্ত ট্রামটি জোড়ের সাথেই এসে ধাক্কা দিলো কবিকে, জীবনানন্দ আর ট্রাম লাইন পার হতে পারলেন না ।  সংগে সংগে আহত ও অচৈতন্য হয়ে ট্রাম লাইনের সেই সবুজের উপর ছিটকে পরলেন, ট্রামের ক্যাচারের ভিতরে দেহটা ঢুকে গেলোরাসবিহারী এভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগস্থলের দক্ষিণে একটা জলখাবারের দোকান ছিলো, নাম ছিলো “জলখাবার” । মালিক চুনীলাল দে পরে সেখানে “সেলি কাফে” নামে রেস্টুরেন্ত খোলেন । জীবনানন্দের দুর্ঘটনার সময় এই চুনীবাবুই শুধু প্রত্যক্ষদর্শীই ছিলেন না, তিনি ছুটে গিয়ে অনেক সাহায্যও করেছিলেন । সেই চুনীবাবুর কথায়, “একটু পরেই হঠাত ট্রামের একটা শব্দ, বালিগঞ্জ মুখো একটা ট্রাম কাকে যেন চাপা দিয়েছে । সঙ্গে সঙ্গেই পথচারীদের অনেকেই এসে গেলেন । গেয়ে দেখি একজন লোক অচৈতন্য হয়ে ট্রামের ক্যচারের মধ্যে পড়ে আছেন । ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে । ট্রামের ড্রাইভার দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ভীড়ের মাঝে গা ঢাকা দিয়ে সরে পড়েছে । যাইহোক, আমি তখনি ট্রামের তলায় ঢুকে আস্তে আস্তে তাকে বেড় করলাম । সমবেত জনতার দু’একজনের কথা কানে আসছিল, ট্রাম লাইনের ঘাসের উপর দিয়ে এই ভদ্রলোক আনমনে আসছিলেন ।  ট্রাম ড্রাইভার হর্ণ দিয়েছিল, দু’একজন চিৎকার করলেও ভদ্রলোক কিসের চিন্তায় এমন বিভোর ছিলেন যে কিছুই তাঁর কানে যায়নি । যখন তাঁকে বেড়করা হলো, তখন তিনি অজ্ঞান । দু-তিনজনে মিলে জ্ঞ্ানহীন জীবনানন্দকে ট্যক্সিতে তোলা হলো, শম্ভূনাথ পন্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো ।

চুনীবাবু তাঁকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে রেখে এলেন, সাধারণ রুগির মতোই পড়ে রইলেন জীবনানন্দ দাশ । পড়ে আত্মিয়স্বজনের অন্যবিভাগে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁর শরীরের অবস্থার কারণে তা সম্ভব হয় নি আর । ট্রামের ধাক্কায় জীবনানন্দের বুকের কয়েকটা পাজর, কাঁধের হাড় এবং পায়ের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিলো । বিধান রায় তাকে দেখতে গিয়ে জানিয়ে দেন যে তাঁর আর বাচার আশা নেই, যতদিন থাকেন একটু শান্তিতে রাখবেন  । শম্ভুনাথ হাস্পাতেলেই যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন কবি, ১৪ অক্টবর রাত ৮টায় তাকে হাস্পাতালে ভর্তি করা হয়, ২২শে অক্টবর রাত ১১তা ৩৫মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ।  গোটা জীবন অশান্তি ও আতৃপ্তির যন্ত্রনার এইভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটলো । সবুজ ঘাস তার প্রিয় ছিলো, অন্তিম আঘাতেও তিনি ছিটকে পড়েছিলেন সেই সবুজ ঘাসেই ।

আশা স্বপ্নের ছাই ভষ্ম

 ১৯৫১র ২৮শে মে ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে উত্তর বাংলার জলপাইগুড়ি শহরের তরুণ লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক সুরজি্ত দাশগুপ্তকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে,একবার ঘুড়ে আসতে ইচ্ছে করে, সভাসমতি ইত্যাদি সবকিছুর হাত সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে তোমাদের মতো দুএকজনের সাহায্যে হিমালয়, চা-বাগান ইত্যাদি দেখে আসার লোভ জেগেছে মনে । পঞ্চাশর্ধ কবির আরো অনেক ইচ্ছার মতই এই ইচ্ছাও পূর্ণ হয়নি । আত্মদহনে ছটফট করতে থাকে এই মানুষটা তাঁর যাবতীয় অনিচ্ছা অতৃপ্তির সঙ্গে সহবাস করতে করতেই ইচ্ছাগুলোকে হারিয়ে ফেলছিলেন । এই হারানোর যন্ত্রাণাগুলোকে চেপে রেখে ব্যক্তিজীবনে আপোষকামী হয়ে যেন নিজেকেই কুড়েকুড়ে খাচ্ছিলেন তিনি । উল্লিখিত চিঠির সূত্রেই সুরজিত বাবু তাঁর শহরের কিছু নিসর্গ দৃশ্যের ফোটোগ্রাফ পাঠিয়ে দেন । ‘নগ্ন নির্জন’ শহরের ছবি ।  উত্তরে জীবনানন্দ লেখেন “এখুনি ঝিলের পারে ঘাসের ওপরে আকাশের মুখোমুখি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে । নদী,ঝিল, পাহাড়। বন, আকাশ। কোনো নিরালা জায়গা থেকে এসবের নিকট সম্পর্কে আসতে ভাল লাগে আমার । বসে থাকতে পারা যায় যদি এদের মধ্যে, কিংবা হেঁটে বেড়াতে পারা যায় সারাদিন, তা হলেই আমাদের সময় একটা বিশেষ দিক দিয়ে (আমার মনে হয়) সবচেয়ে ভালো কাটে

নির্জনতা ও বিষন্নতা আক্রান্ত জীবনানন্দের, প্রকৃতি ও মানবতার ছায়া-আচ্ছন্ন জীবনানন্দের ভালোলাগার ছোট ছোট টুকরোগুলো এমনই ছিলো । ঝিলের পাসে ঘাসের ওপরে আকাশের মুখোমুখি নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাওয়া কবির ভালোবাসার ইচ্ছেগুলোও ছিলো ভেসে বেড়ানো মেঘের মতো, শুভ্র ও খন্ডখন্ড, নিঃস্বার্থ ও উচ্চাশামুক্ত । এইসব ভালো লাগার জলভরা সতেজ বাতাস সজীব রেখেছিলো “শুদ্ধতম” কবি জীবনানন্দকে । এইসব ভালো লাগার ইচ্ছের অধিকাংশই ইচ্ছেপুরণের আনন্দে উত্তীর্ণ হয়নি, এই অতৃপ্তির যন্ত্রণার দহনেই দগ্ধ হয়েছেন তিনি নীরবে । জীবনানন্দকে ‘নির্জনতা’র কবি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, কিন্তু যে যন্ত্রণা এই নর্জনতার ভেতর তিনি বহন করেছেম তার খোজ অনেকেই রাখেন নি । জীবনন্দকে পাঠকের কাছে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায়নাসেই বুদ্ধদেব কবিকে নানা ধরনের অভিনব সমস্ত ভূষণে অলঙ্কৃত করেছেন । তাঁর কাছে জীবনানন্দ ‘নিছক রোমান্টিক’ কবি, যিনি ‘এই সংসারের অস্তিত্ব আগাগোড়া অস্বীকার করেছেন’ (১৯২৮); আবার কিখেছেন ‘জীবনানন্দ প্রকৃত কবি ও প্রকৃতির কবি, যার রচনায় আছে আধো আলোর লীলা, আধো ঘুমের মোহ –’(১৯৩৬), এর ৬ বছর পরে তাঁকে নিয়ে লিখলেন, ‘এক জন চিরকালের কবি... যার দেশ নেই, কাল নেই, জাতি নেই, গোত্র নেই, মানুষের সমস্ত সুখদুঃখ সভ্যতার উত্থান পতন পার হয়ে যার সুর...মনে এসে ঘা দেয়, আর মুহূর্তে উচ্চনিনাদী প্রকান্ড বর্তমান সমগ্র অতীত-ভবিষ্যতের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সব চেয়ে নির্জন, সব চেয়ে স্বতন্ত্র’ (১৯৪২)। নির্জন ও স্বতিন্ত্র এই কবির গোটা জীবন ধরে রক্তপথ যাত্রা তাকে যেনো আরো স্বতন্ত্র করে দিয়েছিলো, এই ব্যাক্তি যন্ত্রণা ও আশাভঙ্গের ধূসরতার দিকে না তাকালে তাঁকে সম্পূর্ণ রূপে জানা যাবে না ।

জীবনানন্দের  ৫৫ বছরের জীবনে ১৯১৯-এ “ব্রহ্মবাসী” পত্রিকায় প্রকাশিত (বৈশাখ ১৩২৬) “বর্ষা আবাহন”  কবিতা থেকে শুরু ধরলে কবিজীবন মাত্র ৩৪ বছরের, প্রকৃত বিচারে যদিও কবি জীবনানন্দের আয়ুষ্কাল আরো কম এই কবি প্রধানত ছোট কাগজের লেখক ভূমেন্দ্র গুহর ভাষায়, “ জীবননান্দ আজীবন ছোটো কাগজের দাবি মেনে চলেছেন  এবং মানতে ভালোবেসেছেন,  যদিও বড়ো কাগজে যথোপযুক্ত মর্যাদা সহকারে লেখা বের হোক, তাও তার কাম্য ছিলো এই কারনেই যখন প্রান্তবাংলার  এক লিটল ম্যগাজিন সম্পাদক লিখলেন, আধুনি সাহিত্য,বিশেষত, আধুনিক বাংলা কবিতার সঙ্গে উত্তরবংগের মানুষদের সম্পর্কে স্থাপনের  জন্য একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে চাই আপনার একটা কবিতা চাই জীবনানন্দের পর্যায়ের কবি এর উত্তরে কত অনায়াসে “শিরিষের ডালপালা লেগে আছে বিকালের মেঘে” মম্ফঃস্বলের নাম না জানা, না দেখা, সাক্ষাপরিচয়হীন সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত ছাত্রদের পত্রিকায়  প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দেন এর মধ্যে তাঁর চরিত্রের “আরো এক বিপণ্ণ বিষ্ময়” প্রকাশ পায়, যার অস্তিত্ব অর্থ , কীর্তি ও সচ্ছলতার অতীত জীবনানন্দকে জলপাইগুড়ি আসার আমন্ত্রন করা হয়েছিলো “জলার্ক”এর তরুণদের পক্ষ থেকে ১৯৫২র ২০ জানুয়ারি জীবনানন্দ সুরজিত দাশগুপ্তকে এক চিঠিতে লেখেন,”জলপাইগুড়ির ওদিককার অঞ্চল, পাহাড়, নদী, জংগল বেশ দেখবার মতো, ঘুরবার মতো, ঘুরে বেড়াবার মতো, আমার খুব ইচ্ছা করে, জল্পাইগুড়ির দিকে একবার যাব ভাবছি “ কিন্তু কবির এই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যার ১৯৫২তে লেখেন ”আমার এখন জলপাইগুড়ি যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই যেতে পারলে অবশ্য আনন্দিত হতাম ।“

অসুস্থতা, বেকারত্ব, পারিবারিক অশান্তিতে বিপর্যস্ত কবি যেন সেসময় তাঁর ভালো লাগার জগত থেকে ক্রমশঃ ছিটকে যাচ্ছেন । এমনকি, কবিতাও লিখতে পারছেন না ই সময় কবি কায়সুল হককে লেখা এইসময়ের একটি চিঠিতে তিনি একথা লিখেছিলেন ১৯৫২ সালের ২৬ জুন তিনি জানালেন,” নানা কারণে মন এত চিন্তিত আছে, শরীরও এত অ্সুস্থ যে অনেকদিন থেকেই কিছু লিখতে পারছি না “ আলোচ্য এই চিঠিগুলো জীবনানন্দ লিখেছিলেন ১৯৫১-৫২, যখন তাঁর অন্তরাত্মা চাইছিলো জলপাইগুড়ির মতো কোনো সবুজ নির্জনতা যেখানে তিনি আশ্রয় নিতে  চাইছিলেন তখন চারপাশ তাঁর কাছে  রূঢ় হয়ে উঠছিলোরূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি অসহায় অবস্থা তাঁর । প্রতিটি ইচ্ছা ও কামনার মৃত্যু পরখ করছেন প্রতিদিন । ১৯৫০-এর ২ সেপ্টেম্বর তিনি খড়্গপুর কলেজ অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন, সদ্য প্রতিষ্টিত কলেজে নামমাত্র মাইনে পেতেন । স্ত্রী লাবণ্য ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে বি.টি. পড়তে গুরু করেছেন এসময় । কিছুদিনের মধ্যেই তিনি “এলকাইনা” রোগে অসুস্থ হয়ে পরেন ১৯৫১-র জানুয়ারী, স্ত্রীর অসুস্থতার খবরে কলকাতা আসেন কবি । লাবণ্যদেবী সুস্থ হচ্ছেন না দেখে ছুটির সময় বারানোর আবেদন করেন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে, কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁকে বড়খাস্থ করে দেয় । এসময় সহকর্মী পুলিনবিহারিকে কবি লেখেন,”বড়ই বিপদের ভেতর আছি । খড়্গপুর কলেজে থেকে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে তিনশত টাকা পেয়েছিলাম । ফেব্রুয়ারি মাসে যে কাজ করেছিলাম, সে পাওনা আজ পর্যন্ত পাইনি । অন্তত পূর্বের মাইনে না পেলে এই দুর্দিনে কিছুতেই টিকে থাকতে পারবো না” ।

এ সময় চরম বেকারত্বের । তাঁর কাধেই সংসারের ভার । বাড়ি নিয়ে পরিবার নিয়ে তাঁর শত দুশ্চিন্তা । খড়গপুরের কলেজের সাড়ে পাঁচ মাসের মেয়াদি চাকরি চলে যাওয়ার পর সর্ম্পূর্ণ বেকারত্ব তাঁকে অসহায় অবস্থা্র মধ্যে ঠেলে দেয় । শুরু হয় আবার চাকরির খোজ । ১৯৫৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির রিসার্চ এসিস্ট্যান্টের জন্য দরখাস্ত করেন কবি । প্রার্থী হন চারুচন্দ্র কলেজে অধ্যাপনার জন্য । এসব ছেড়ে একসময় ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিতিবিরক্ত, হতাশ জীবননন্দ এ সময় তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ আত্মবিশ্বাসেও ফাটল ধরেছিলো । অধ্যাপনার বা পড়ানোর কাজ খুব একটা পছন্দের ছিলো না, তবুও হণ্যে হয়ে খুজেছেন । ভাইবোউ নলীনী চক্রবর্তীকে তিনি অধ্যাপনার সম্পর্কে লিখেছিলেন । “ অধ্যাপনা। শিক্ষা প্রতিষ্টান সে সবের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনি যা লিখেছেন ঠিকই । তবে অধ্যাপনা জিনিষটা কোনো দিনই আমার ভাল লাগেনি । যে সব জিনিষ যাদের কাছে যেমন ভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে- তাতে আমার বিশেষ আস্থা নেই ।ই কাজে মন তেমন লাগে না, তবুও সময় বিশেষে অন্য কোনো কোনো প্রেরনার চেয়ে বেশী জাগে তা স্বীকার করি ।  প্রভাতকুমার দাস এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহন করেও, সন্তুষ্ট ছিলেন না, সম্ভবত নিশ্চিন্ত কোনো শিক্ষকতা কোনো দিন পাননি   একটা কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে উঠেছিলেন, চিঠি লিখেছিলেন শিক্ষকতা/অধ্যাপনা চাকরির খোঁজের জন্য হরপ্রসাদ মিত্র, নরেশ গুহ কিংবা অনিল বিশ্বাসকে ।  হরপ্রসাদ মিত্রকে লিখেছিলেন ঃ অমৃতবাজার পত্রিকায় দেখা গেছে, কলকাতার কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর কলেজে ইংরাজি শিক্ষক নেওয়া হবে । কিন্তু কলেজের নামের পরিবর্তে পোষ্ট বক্স নম্বর ব্যবহৃত বলে বুঝতে পারছি না স্কটিশচার্চ অথবা সিটি কলেজের প্রয়োজনে এই বিজ্ঞাপন” ।

আর্থিক প্রয়োজনে জীবনানন্দ একসময় সিনেমার গান লেখবার কথাও ভেবেছিলেন । বন্ধু কবি অরবিন্দ গুহের কাছে একবার জানতে চেয়েছিলেন – সিনেমার গান লিখলে নাকি টাকা পাওয়া যায়? তুমি কিছু জস্নো এবিষয়ে ? অরবিন্দ বাবু তখন এবিষয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে বিষয়টি তুলতে পারেন নি কবি । এর পর অরবিন্দ বাবু শোইলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কথা বলেন । সিনেমার ডিরেক্টার শোইলজানন্দ বাবু জীবনানন্দের কাছের মানুষ চিলেন । কিন্তু এক্ষেত্রেও পূর্বের মতই কবি আর বিষয়টি তুলতে পারেন নি । কারণটি বেশ মজা করে অরবিন্দবাবুকে তিনি বলেছিলেন ঃ এরপর সকৌতক ভংগিতে তিনি বলেন, যদি শৈলজা আমার জন্য কোথাও একটা ব্যবস্থা করে দেয় তাহলেও আমি কেমন করে লিখব, “রাঁধে -এ -এ -এ, ঝাঁপ দিলি তুঁই মরণ যমুনায়” ।

এই কথোপকথনের কিছুদিনের মধ্যেই সেই মহা দুর্ঘটনা, ১৪ অক্টোবর ।

এমনই একদিন আড্ডার ছলে জীবনানন্দ অরবিন্দ গুহকে বলেছিলেন -

”আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না । আমি মানুষের নীতিবোধে বিশ্বাস করি ।”

এই বিশ্বাসের প্রতিফলন ছিলো জীবনানন্দের জীবন ও সাহিত্যে, কবিতায় ও কথায় । চুরান্ত বিপন্নতার মাঝেও তিনি এই বিশ্বাস ধরে রেখেছিলেন । গোটা জীবন যে আর্থিক অনিশ্চয়তা তাকে তারা করে বেড়িয়েছে তাই তার প্রধান বিপন্নতা ছিলো ।

মুর্শিদাবাদের সরকারি আমলা অনিল বিশ্বাসকে লেখা তাঁর চিঠির মধ্যেও কবির বিপন্নতা ধরা পরে ঃ বর্তমানে অত্যন্ত অসুবিধায় আছি, কাজ খুঁজছি । কলকাতায়  একটা সাধারন কাজও পাওয়া যাচ্ছে না । জংগীপুর কলেজে একজন ইংরেজি শিক্ষক নেওয়ার বিজ্ঞাপন দিয়েছে, আমার বর্তমান অবস্থা এমন যে কোনো রকম কাজ করতে আমি কোনোরকম দ্বিধা করবো না ।“ অথচ, আমরা জানি তিনি কলকাতাকে আঁকড়ে ধরেই থাকতে চেয়েছিলেন, বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছিলেন ঃ কলকাতার ওলিগলি মানুষের শ্বাস রোধ করে বটে, কিন্তু কলকাতার ব্যবহারিক জীবনে প্রান্তরের মত মুক্তি পাওয়া যায়; এখন যখন জীবনে কর্মবহুলতার ঢের প্রয়োজন, কলকাতা এই স্বচ্ছন্দ প্টভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা চলে না আর ।“ এখানে উল্লেখ করতে হয় নলিনী চক্রবর্তীকে লেখা তাঁর উক্তি ঃ “বরাবরই আমার আত্মোহতি ও জীবিকা নিয়ে কলকাতায় থাকার ইচ্ছে ।“ সাম্প্রতিক উদ্ঘাটিত তাঁর লেখা ডাইরিতে লেখা কথাগুলো জীবনানন্দের এই চাওয়া-পাওয়ার সংঘাত, অপছন্দের চেহারাটা চিনতে সাহায্য করবে –

9.8.31 Very often... I think that instead of frittering away my energy. I ought to just do that for wh I Hand & in wh I escel of delight & wh is my true vocation. Literature (press & publication) through  s profession or cslling wh nourishes it as I city coll or non Beng Jobs never will...

-Have I ever paid a single pice to coll street window or various other begaers ?

-The leper`s child & various other infants with duress appeal & reflections infinite on them.

-on `বসে থাকা”—বেকার কখনও বসে থাকেনা । they stand & run & throb & palpitute it is only I well-placed who have I etrenal charm of the easy chair or cushions, so for & bels for them.

ডাইরিতে এমন কথাটুকরো তিনি লিখেছিলেন খড়্গপুরের কলেজের চাকরি হারানোর অনেকদিন আগেই । ১৯৫১-তে যে দুর্বিসহ আর্থিক চাপ তাঁর উপর নেমে আসে তাতে একসময় বিপন্ন জীবনানন্দ জনৈক পরিচিতের সঙ্গে ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, যদিও তা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে যায় । খাঁ খাঁ বেকার সংসারের চাপে জীবনানন্দ প্রত্যহ খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের কলম থেকে বিভিন্ন কাজের খোঁজ নিয়ে আবেদন করতে থাকেন । তাঁর এরকম অসহয় জীবনের, অর্থাত কর্মহীন পর্বে একবার পরিচিতদের পরামর্শে দেখা করতে গিয়েছিলেন রাইটার্সে রেভিনিউ বোর্ডের সদ্য আউ সি এস সত্যেন ব্যানাজীর সঙ্গে । দেখা করতে গিয়ে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েন, রাইটার্স বিল্ডিংয়েই অবনীমোহন কুশারীর ঘরে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন ।

কিন্তু কোথাও চাকরি জোটেনি ইংরাজি সাহিত্যে এম.এ, সে সময়ের এই কবি যুবকের । অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য ব্যবসাও করতে পারেন নি । পরের বছর চাকরি পেলেন তাঁর স্ত্রী লাবণ্য । এ সময়ই চার মাসের জন্য চাকরি পান জীবনানন্দ, ১৯৫২-র নভেম্বর থেকে ১৯৫৩-র ফেব্রুয়ারী, বড়িশা কলেজে শিক্ষকতার । কিন্তু এখানেও থাকা হয়নি । স্বাভাবিক ভাবেই যখন তাঁর মন শিরীষের ছায়ায়, ঝিলের হাসেদের সঙ্গে ডুব দিতে চেয়েছে, তখন দারিদ্র ডুবে যাওয়া ব্যক্তিমানু্ষ জীবনানন্দকে দুঃস্বপ্নের মধ্যে থাকতে হয়েছে, অপূর্ণ অতৃপ্ত বা্সনাকে সঙ্গী করে । “নারীর হৃদয় প্রেম-শিশু গৃহ নয় সবখানি” এক অসহ্য যন্ত্রনাকে সঙ্গী করে “সবুজ পল্লবিত জারুলের ঐশ্বর্য, হেলিওট্রোপ রঙের ফুল, মেহেদিপাতার বনে স্বপ্নাতুর ঝি ঝি, ছাতিমের গাঙ শালিকের জীবনোচ্ছাস কৃষঞ্চূড়ার অজস্র কূড়ি, চারদিককার সফল প্রচুর জীবনের কালীদহ, কলরব কিছুই আমাকে সাহায্য করতে পারে না । (জামরুলতলা) এ সময়ের যন্ত্রণাদগ্ধ কবির আরো অণুরণন চিহ্ন ঃ এ যুগে কোথাও কোনো আলো, কোনো কান্তিকর আলো চোখের সম্মুখে নেই যাত্রীর/ নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার মায়ার মতো’ ।

এই সময়কালে তিনি এতটাই বিপন্ন ছিলেন যে কবিতাও লিখে উঠতে পারছিলেন না । এ সময়ের একটা ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে । সুরজিঠ দাশগুপ্ত একবার জলার্কের জন্য বুদ্ধদেব বসুর কাছে লেখা চাইতে গেলে তিনি প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লেখার জন্য পৃথক দর উল্লেখ করেছিলেন । সুরজিঠবাবু এ কথা জীবনানন্দকে জানিয়ে তাঁর কোন দর আছে কিনা জানতে চাইলে জীবনানন্দ লেখেন, “একটি কবিতার জন্য সম্মানমূল্য আমি সাধারণতঃ ২৫/৩০ তাকা থেকে ৫০টাকা পর্যন্ত পাই, তোমরা ২০টাকা দাও । আমি সময় করে ভালভাবে নতুন কবিতা লিখে পাঠাই । লেখার জন্য সময় ও সাধনা দরকার, গদ্যের চেয়ে কবিতার বেশি । ২রা নভেম্বর ১৯৫১তে তিনি এই চিঠিটি লেখেন ।

পূর্ববাংলার প্রকৃতি ছিলো তাঁর চেতনার গভীরে শেকড় গেড়ে । এর বীজ শৈশবেই রোপন করা হয়েছিলো । ভাই অশোকানন্দের ভাষায়- প্রকৃতির সৌন্দর্যে মগ্নচিত্ত সেই কিশোর আপনার পরিবেশকে বর্ণে, সুগন্ধে অপরূপ করে তুলবার সাধনায় ব্রতি হয়েছিলেন । উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় কলকাতার এক নার্সারি থেকে ফুলের চারা আনিয়েছিলেন, নিজের প্রার ঘরের ঠিক সামনে কিছুটা জমি ঘিরে ফুলের বাগান তৈরি করেছিলেন । যুই, চাপা, গন্ধ্রাজ, চামেলি, কাঠালচাপা, নীলজবা, হাস্নুহানা আর আশ্চর্য সুন্দর সব গোলাপ তা ছাড়া, কৃষ্ণচূড়ার নার্সারির ক্যাটালগে নাম ছিলো পন্সিয়ানা রিজিয়া । ... পন্সিয়ানা রিজিয়া গাছ বড় হয়ে গ্রীষ্মকালে অজস্র রক্তিম পুষ্পতে ভরে যেত, মনে হতো যেন লাল আগুন জ্বলছে । এই গাছটি দাদার অতি প্রিয় ছিলঅনেক সময় চেয়ার পেতে এই গাছট তলায় বসে লিখতেন । “আমার কামনা কি জান? বোইচি, ময়নাকাটা, বাবলা, ফনীমনসা, বন অপরাজিতার পাশ দিয়ে এক একটা সাদা ধুলোমাখা ভারী শুদ্ধ আঁকাবাঁকা গ্রামের পথ থাকে, তারই পাশে এক একটা প্রান্তরের অপরিসীম নিশ্বাসের বিস্তারের সবুজ ঘাস আছে সেখানে । তাদের ভেতর শষ্যপোকা আছে। দিয়ালি পোকা আছে, গঙ্গা ফড়িং আছে, কাঁচ পোকা আছে, সুদর্শন উড়িয়া আসে । হলুদ, কমলা, জর্দানীল রঙ্গের প্রজাপতি কাশফুলের ভেতর সমস্ত দুপুর ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেরায়, কোথাও হয়ত কতগুলো পলাশ, অর্জুন গাছ, উলু জঙ্গল, মাছ রাঙ্গার দাঙ্গার শিরশিরানি, এমনি এক যায়গায়, ঘাসের নরম গাছের কাছে, প্রান্ত্রের একটেরে বনের দেখা  আশ্বাদ যেখানে অনেকদিন হইতে ছায়া রচনা করিয়া বাঁচিয়া আছেন । রাত্রিদিন শালিক, বুলবুলি, কোকিল ও কাককে আশ্রয় দিতে আসিতেন, সেই খানে খড়ের একখানা ঘর তুলিয়া পড়ি, লিখি, চুরুট ফুঁকি কাটাইয়া দেই – ( সঙ্গ ঃ নিঃসঙ্গ, ৪২৪ পৃষ্টা)  জীবনানন্দের বেশিরভাগ কবিতা, পরবর্তিতে প্রকাশিত গদ্যসমূহে, ভীষণভাবে উপস্থিত নিসর্গ । এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর বহু-চর্চিত উক্তি , “তাঁর সমস্ত কবিতাই কোনো না কোনো অর্থে প্রকৃতির কবিতা  নিসর্গ এবং প্রকৃতির রকমফের আছে । তাঁর কবিতা আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ সহ পবিত্র সরকার লিখেছেন ঃ তাঁর নগর-নিসর্গের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত নষ্ট ও দরিদ্র সময়, ফলে এই নিসর্গ তাঁর অনুভবে স্বস্তি বা উজ্জীবন নিয়ে আসে না । জীবনানন্দকে পরিভ্রমণ করতেই হয়, ওই নাগরিকতার বাইরে ওই সময়ের অতিক্রান্তির ওপারে কোনো অনন্ত অতীত ভবিষ্যতে, তাঁর ভূগল ও ইতিহাস মিলিতভাবে পরস্পরকে আকীর্ণ বিস্তারিত করে তবেই তাঁর নিজস্ব নিসর্গকে আবিষ্কার করে ।

“ আমার ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিত মদের মতো

গেলাসে গেলাসে পান করি

এই ঘাসের শরীর ছানি-চোখে চোখ ঘষি,

ঘাসের পাখনায় আমার পলক

ঘাসের ভিতরে ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার

শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে"

জীবনানন্দের প্রকৃতিলালিত কবিমন উত্তপ্ত সমকাল প্ররোচিত করেছিলো ভিন্ন ধরণের নির্মানে । সময়কালের নিবিড় অনুভব প্রজ্ঞা থেকে কবি বোঝার চেষ্টা করেছেন চারপাশের মানুষকে, সভ্যতা, জীবন, জগত সময়কে । সালাহউদ্দিন আইয়ুবের ভাষায়, “তিনি দেখেছিলেন পৃথিবীর মানুষীর রূপ স্থূল হাতে ব্যবহৃত হয়ে হয়ে কি ভাবে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়, অন্ধকার সমস্ত অট্টহাসির ভিতর একটি বিড়াট তিমির মৃতদেহ নিয়ে কিভাবে স্ফিত হয়ে ওঠে, কিভাবে ঊর্বশীর শরীর ডাইনির মাংসের মতন বাদুরের খাদ্য হয়ে যায়; উন্নত পৃথিবীর একপিঠে তিনি দেখেছেন স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি উদ্যম, চিন্তার কাজ, অন্যপিঠে শত শত শূকরের চিঠকার, শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বড়ের মতো ভয়াবহ আরতি । মূমুর্ষ পৃথিবীর সূর্যাস্তকে তাঁর মনে হয়েছিলো বেহেড আত্মার মতো। “মূর্খ ও “রূপসীর ভয়াবহ সঙ্গম” এই রকম একটি বাক্যে বর্তমান সভ্যতার একটি মৌলিক অন্তর্বিরোধ তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তাঁর আশঙ্কা ছিলো –

“কবি তুমি ক্রমে ক্রমে হিম হয়ে পড়িতেছ বলে / সুন্দর যেতেছে মরে ধীরে ধীরে / শান্তি আর থাকিবে না।“ অথবা “বেলা অবেলা কালবেলা”য় “নিসর্গের কাছ থেকে স্বচ্ছ জল পেয়ে/ তবু নদী মানুষের / মূঢ় রক্তে ভরে যায়; সন্দিগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করে, নদী / নির্ঝরের থেকে নেমে এসেছ কি? মানুষের হৃদয়ের থেকে?” তাই তিনি দেখেন অধিকাংশ সৃষ্টিই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের রসদ সমৃদ্ধ, নিজস্ব যন্ত্রণার জটিল জীবনের আলো আধারিকে আশ্রয় করেই  ভাবনাগুলি প্রকাশ পায় । ফলে তার মননে থাকে আত্মগত উচ্চারণ । নিছক আত্মগত উচ্চারণেই থেমে থাকা নয়, তাঁর কথাসাহিত্যের অধিকাংশই আত্মজৈবনিক বলেও মনে হয় ।  ইতিপূর্বে কিছু চিঠির উল্লেখ করেছি, এমনি ১৯৫৭র জৈষ্ট মাসে কবি লেখেন “ বেশ ঠকে পড়েছি, সে জন্য বিরক্ত করতে হল আপনাকে । এখুনি পাঁচশ টাকার দরকার, দয়া করে ব্যবস্থা করুন ।  এই সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠাচ্ছি । পরে প্রবন্ধ ইত্যাদি (এখন কিছু লেখানেই) পাঠাবো । আমার একটা উপন্যাস (আমার নিজের নামে নয়-ছদ্ম নামে) পূর্বাশায়, কিন্তু টাকা এক্ষুনি চাই – আমাদের মত দু-চারজিন বিপদগ্রস্থ সাহিত্যিকের এরকম দাবি গ্রাহ্য করবার মতো বিচার বিবেচনা অনেকদিন থেকে আপনারা দেখিয়ে আসছেন- সেজন্য গভীর ধন্যবাদ । লেখা দিয়ে আপনার সব টাকা শোধ করে দেব, না হয় ক্যাশে । ক্যাশে শোধ করতে গেলে ছ-সাত মাস তার বেশি নয়, দেরী হতে পারে ।“ এক সময় তিনি, এই অবস্থায় পড়বার অনেক আগে অচিন্তকুমার সেনগুপ্তকে লিখেছিলেন “চারদিকে বে-দরদীর ভির । আমার যে েকটি সমানধর্মা আছি, একটা নিরেট অচ্ছেদ্য মিলন-সূত্র দিয়ে আমাদের গ্রথিত করে রাখতে চাই । আমাদের তেমন পয়সা-কড়ি নেই বলে জীবনে “creative comforts” জিনিসটা হয়তো চিরদিন আমাদের এড়িয়ে যাবে।“  বিভিন্ন জায়গায় কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছেন, বছরের পর বছর অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হয়েছে তাঁকে । খবরের কাগজের দপ্তরে কাজও করেছেন । স্বরাজ-এ প্রায় বেতনহীন অবস্থায় কয়েকমাস কাজ করেছেন, রবিবারের সাময়িকী দেখতেন । এই কাগজের চাকরি ছারার পরেই তীব্র আর্থিক দুরাবস্থায় পড়ে বাধ্য হন উপন্যাস লিখতের, রোজগারের জন্য, স্বাভাবিক ভাবেই অনেকাংশে তা তাই হয়ে উঠে আত্মজৈবনিক । নিজস্ব যন্ত্রণা-জটিল জীবনের আলো-আধার অনুসৃত সৃজনের পেছনে থেকেছে তার আত্মগত উচ্চারণ ।

জীবনানন্দের মৃত্যুর পর “জলপাইহাটি” তাঁর বৃহত্তম গ্রন্থ । পূর্ববংগের এক কল্পিত জনপদ “জলপাইহাটি। উপন্যাসের পান্ডুলিপির প্রথম পাতায় জীবনানন্দের নিজের দেওয়া তারিখ ৮/৪/৪৪, শেষ পাতায় ৯/৫/৪৮ । পূর্বপাকিস্থান ছেড়ে আসার পর কলকাতায়; ১৮৩, ল্যন্সডাউন রোডের বাড়িতে বসেই লেখা । মফঃস্বলের ছবি জীবনানন্দের অন্তরের গভীর থেকে গভীরতর উতসে ছিলো, তার ভাবনাগত প্রতিক্রিয়া দেখলে তা অনুভব করা যায় ঃ কলকাতার চেয়ে মফঃস্বলের প্রকৃতি, লোকেদের ভালো লাগে তার । সেই সব মানুষদেরও ভালো লাগে ”মফঃস্বলের গ্রামপ্রান্তর থেকে উপচে পড়ে যে সব মানুষ কার্তিকের বিকেলের রোদে, চোতবোইশেখের শেষ রাতের ফটিক জলের মত জোঠস্নায় ।এসব মানুষ সব ঋতুতে সবসময়ই ভালো ।“  অথবা  “ কি অপরাধ হতো জলপাইহাটিতে ছোট আশা, সাদামা্টা কাজ, খাঁটি শান্তি, বৃহত মমতার ভেতরে পড়ে থেকে একদিন পৃথিবী থেকে অণুর মত রেণুর মতো একটু খানি আশা মুছে ফেলে সময়ের নিরবিচ্ছিন্ন গতি-অগতি সাগরের অচেতনায় হারিয়ে গেলে ?” দেশবিভাগ জনিত বিষাদ, ব্যক্তি মানুষের নিঃসঙ্গতার বিপন্নতাকে ভিত্তি করে লেখা এই উপন্যাসটি সম্পর্কে কথাকার অমর মিত্র লিখেছেন ঃ তিনি ১৯৪৮-এর খন্ডিত বাংলা, স্বাধীন ভারতবর্ষ, কলকাতা শহর নিয়ে পৃথিবীর কথা বলতে চাইছেন তো বলার জন্য, ওই সব যুক্তির ধার ধারেননি। যুক্তি হয়তো কাহিনীকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করায় । আবার যুক্তিহীনতা যে পরে যুক্তির সমগ্রতা হয়ে দাঁড়ায় তা “জলপাইহাটি” পড়তে পড়তে টের পাওয়া যায় । ১৯৪৮ এর ৮এপ্রিল থেকে ওই সালের ৯মে- একমাসে ৫১৭ পাতার উপন্যাস লিখে ফেললেন ! হিসাবে প্রায় একলক্ষ তিরিশ হাজারের মতো শব্দ । কীভাবে সম্ভব হয়েছিলো ভাবতে গিয়ে থৈ পাই না । কখনো সন্দের জাগে সন তারিখ নিয়েো । আবার কখনো মনে হয়, এ যেন গভীর এক নিস্তব্ধতায় ডুবে গিয়ে লেখা । এমন এক তাড়না ছিলো তাঁর ভেতর যে না লিখে পেরে উঠেন নি  উপন্যাস লিখব বলে যেন লেখেন নি ‘জলপাইহাটি, এ যেন জোতস্নাতাড়িত হয়ে লেখা –’।

এক সময় যে কবি বুঝেছিলেন ‘এ যুগ অনেক লেখকের, একজনের নয় – কয়েকজন কবির যুগ;, বিংশ শতাব্দীর সূচনা পর্বের স্বপ্ন দেখা জগত স্বপ্ন দেখানো জগত, ক্রমশঃ শতাব্দীর বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাচ্ছিলো প্রকৃতির রূপ রস-এ নিমজ্জিত কবিও এই যন্ত্রণার বিবর্তন টের পেয়েছেন যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, কালোবাজারী, বেকারত্ব , সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থির করে তুলেছিলো, পরাধীনতার বেদনা ও স্বাধীনতার আকাঙ্খা এই সময়ের সর্বোচ্চ আলোড়ন । শতাব্দীর এই রাক্ষসী বেলায় আর বাস্তবের রক্ততটে জীবনানন্দের আগমন । যার কাছে বাংলার লক্ষ গ্রাম “নিরাশায় আলোকহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেজ”জীবনানন্দ যে যন্ত্রণায় তাড়িত হয়েছিলেন তা কি শুধু বাইরের জগতের, নাকি তাঁর অভ্যন্তরের, খবর কে রাখে?  তাঁর যন্ত্রণার চিহ্ন নিয়ে রয়ে গেছে তাঁর কবিতা ঃ

‘কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি,

হে নর, হে নারী,

তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনদিন;

...

গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;

আমাকে কেন জাগাতে চাও ?’

 তাঁর ‘আট বছর আগের একদিন’ পর্বের কবিতায় জীবনানন্দের যে আস্তিক্যবোধের স্পর্শ পাই, সংশয়ের চিহ্ন দেখি তা পরবর্তিতে ‘মহাজিজ্ঞাসা’ইয় দৃঢ় হয়ে ওঠে । জীবন যার কাছে ছিলো ‘অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকা’, আবার তিনিই লেখেন, ‘তবু চারিদিকে রণক্লান্ত কাজের আহ্বান । / সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে – এ-পথেই পৃথীবীর ক্রমমুক্তি হবে;’ ।  জীবনের প্রতি প্রত্যাশা মুক্ত কবিকে ক্রমশ মৃত্যু বোধ আচ্ছন্ন করছিলো । যিনি একসময় লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর ভরাট বাজার লোকসান / লোভ পচা উদ্ভিদ কুষ্ঠ মৃত গলিত আমিষ গন্ধ ঠেলে / সময়ের সমুদ্রকে বারবার মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে যেতে ব’লে ।’ (পৃথিবীতে এই) তিনিই লেখেন ‘কোথাও মৃত্যু নেই – বিরহ নেই / প্রেম সেতুর থেকে সেতুলোক- / চলছে – জ্বলছে দ্যাখ । (আমি) স্বেচ্ছা ধ্বংসের যে ধুসর ছায়ায় তিনি বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলেন,  সেই শান্তি তাকে দিয়েছিলো মৃত্যু, স্বেছা আহূত কি সেই মৃত্যু? যেখানে কবি ‘কোনোদিন জাগিবে না আর / জানিবার গাড় বেদনার / অবিরাম – অবিরাম ভার/ সহিব না আর’ ।

 #

সূত্র -

এই সময় ও জীবনানন্দ - শঙ্খ ঘোষ । সাহিত্য অকাদেমি

জীবনানন্দ দাস- বিকাশ প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

জীবনানন্দ দাসঃ প্রভাতকুমার দাস

করতলে মহাদেশঃ আবদুল মান্নান সৈয়াদ

জীবনানন্দ দাসঃ ঘুম ও জাগরণ, জহর সেন মজুমদার

জার্নালঃ  শঙ্খ ঘোষ

বাংলা কাব্যে দূরহতা ও সুঋয়ালিজমঃ শুদ্ধস্বত্ব বসু

আধুনিক কবিতার ভূমিকাঃ সঞ্জয় ভট্টাচার্য

দ্বিতীয় ভুবনঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

‘চরিত্র’ ৩য় সংস্করণ । সাক্ষাৎকার , অশোকানন্দ দাশ

কবি জীবনানন্দ / বিনির্মানের প্রস্তুতিপট

জীবনানন্দ /  সম্পাদনা , পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় , সাহিত্যলোক

প্রসঙ্গ জীবনানন্দ / শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়

বিভাব (জীবনানন্দ সংখ্যা) । কোরক । অমৃতলোক । অনুষ্টুপ । সাক্ষাতে সুরজিৎ দাশগুপ্ত ।



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন