জলধি / প্রবন্ধ / গ্রাম বাংলার লোকগান অবলুপ্তির পথে
Share:
গ্রাম বাংলার লোকগান অবলুপ্তির পথে

প্রাচীনকাল থেকে বাংলার জেলায় জেলায় কবিগান, শব্দগান, পাঁচালীগান ও আখড়াই গানের প্রচলন ছিল। বিষাদময়, ধর্মবিষয়ক ও শাসকের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গবিদ্রুপের নানা দৃশ্য এবং ঘটনা যোগ করে গাওয়া হতো।কখনও কখনও বিশেষ পূজা-অনুষ্ঠান উপলক্ষে এই সব গানের আসর পড়ত। আবার সামন্ত ভূস্বামীদের গৃহে কিংবা মণ্ডপে এই লোকগানের আসর বসত। তবে রাজা জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে অনেক সময় আসরগুলো স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলত এবং পরিণত হত কৃত্রিম ভণ্ডামিতে।
লোকায়ত জীবনযাত্রাকে নিজেদের মৌলিক ভাষা ও সুরের দ্বারা গেঁথে যে গানের জগৎ সৃষ্টি তাই-ই লোকসংগীত। আঞ্চলিক জীবনের হৃদস্পন্দন ধ্বনিত হয় লোকশিল্পীদের মুখনিঃসৃত লোক সংগীতের মধ্য দিয়ে। বাংলার বিভিন্ন শ্রেণি বা গোষ্ঠী ভুক্ত সম্প্রদায়ের জনজীবনের প্রকাশ ঘটে এই বাংলার বিবিধ লোকগানের মধ্য দিয়ে।
গ্রাম বাংলার জল হাওয়ায় মিশে আছে এই লোকগানের সুরের যাদুতে। প্রতিদিনের মেঠো গন্ধ ভরা সেই সব গান নিজস্ব গুনেই সম্পদ হয়ে উঠেছিল গ্রামবাংলার লোকজীবনে ।এই গান বিভিন্ন ঋতুতে জমে উঠত।রাঢ়বঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম জেলার গান --- যেমন,ভাদু,টুসু, ঝুমুর প্রভৃতি। উত্তর বঙ্গের ভাওইয়া, ভাটিয়ালি ও গম্ভীরা ইত্যাদি। মধ্যবঙ্গের মুর্শিদী,বোলান,গাজন জারি। এবং দক্ষিণবঙ্গের বনোবিবি ,সত্য পিরের গান ও একদিল পিরের। চিরায়ত গ্রাম বাংলার সেই সব হারিয়ে যাওয়া  লোকগানগুলোকে নিয়ে দু-চার কথায় লেখার চেষ্টা করব মাত্র।
ধান ভানার গীত। মূলত গাঁ -গেরামের মহিলারাই ধান ভানার গীত গেয়ে থাকে। এই গীত বেশির ভাগ সময় সমবেত কণ্ঠে গায়। একসময় গাঁ -গেরামের সর্বত্রই এই গীতের প্রচলন ছিল।কৃষক মাঠের পাকা ধান কেটে আনলে বউরা মেতে ওঠে ধান ভানার কাজে।তার জন্য আগে থেকেই ঢেঁকিশালা প্রস্তুত থাকে।ঢেঁকিতে অর্থাৎ গড়ে ধান ফেলে ধান কুটতে কুটতে পল্লি বধুরা এই বলে গীত শুরু করে ---
     "ও বউ ধান ভানেরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে
      ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়ে দুলিয়ে।"

ঢেঁকির ছন্দময় শব্দ আর পল্লি বধুর মুখের গীত পাড়া মাতিয়ে রাখত। কালের বিবর্তে বা আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে এই গাঁ-গেরামের ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি ও ধান ভানার গীত। নাম গান। আল্লা বন্দনা বা ভক্তি মুলক গান।পাড়ার মোড়ে,হাটে, খোলা জায়গায় এই গানের আসর বসে।নাম গানের শিল্পীদের এখনও কোথাও কোথাও দেখা যায়। একসময় একাধিক গ্রামে এই গায়কদের দেখা মিলত।যা এখন সচরাচর দেখা যায় না।নাম গানের শিল্পীরা ভিন্ন রীতিতে গান গাইত।সব দলই ৮/১০ জন শিল্পী থাকে। নতুন হাট বসানোর কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে এদের ডাক আসত । মুর্শিদাবাদের বাগড়ির বিভিন্ন প্রান্তে নাম গান শোনা যেত।এলাকা বিশেষে এই গান ছন্দ ও নাম নামে পরিচিত ছিল।
নামগান অনুষ্ঠিত হয় এক অভিনব কায়দায়। এই গানের আসরে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হত না ।মূল গায়ক এবং দোয়ারী থাকে।মূল গায়কের হাতে ও দোয়ারীর হাতে থাকে বিভিন্ন রঙের রুমাল। এই নাম গানের সমস্ত পালাই আল্লা ভক্তি বা বন্দনা সমবেত সংগীত ধর্ম গান বিশেষ। গানের তালে তালে হাতে একটা রুমাল নিয়ে দর্শকদের দিকে মুখ রেখে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে থাকে।এরা কিছুটা গোল্লাছুট খেলার আকারে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে গান করে। আবার ভিন্ন চিত্রও দেখা যায়।রামনগরের শিল্পীরা ফাঁকা জায়গায় দূরত্ব বজায় রেখে গোল হয়ে গোড়ালির উপর ভর দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আর মূল গায়ক দাঁড়িয়ে গান ধরলে দোয়ারীরা গানের ধুয়া ধরে। জীবন যাত্রা বা কারবালা প্রান্তের করুণ কাহিনি পরিবেশন করে । এই গান সাধারণত অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম গ্রামগুলোতে।মুসলিমরা এই গানকে সমাদরের চোখে দেখে।

হাপু গান।হাপু গান লোকসঙ্গীতের বিশেষ একটি ধারা।"হাপু" শব্দের অর্থ --- হাহাকার, দুর্ভাবনা বা দুশ্চিন্তা। এই গানের সঙ্গে গায়ক এক বিশেষ মাত্রা ব্যবহার করে।'হা' আর 'পু' এই দুই মাত্রায় গায়ক মুখ দিয়ে শব্দ করে এবং গানের তালে তালে তার হাতে থাকা লাঠি পিঠে আঘাত করে।এক কথায় রুটি রোজগারের জন্য কঠিন কসরত করে। এই গান শোনা যেত মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বাঁকুড়া পুরুলিয়ায়। এই গানে কোনো বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার দেখা যায় না। অঙ্গিভঙ্গী করে মুখ দিয়ে "হা" আর "পু " শব্দ আর লাঠি ছাড়া কিছুই থাকত না। মোদ্দা কথা, শারীরিক কসরত করে ক্ষুন্নি বৃত্তি করে। এই গানে কথাই মুখ্য। গানগুলো এই রকম ---
    ১।এক পয়সার নুন
        বিয়ার কথা শুন।
   ২।এক পয়সার হলদি
       বিয়ার কথা জলদি।
   ৩।বুড়ো যায় মাছ ধরতে, শুধু আনে পুঁটি,
      দুই সতীনে ঝগড়া করে, ধরলো বুড়োর টুটি।
   ৪।বুড়ো যায় মাছ ধরতে, ধরে আনে ব্যাঙ,
       দুই সতীনে ঝগড়া করে, ধরে বুড়োর ঠ্যাং।
   ৫। বুড়ো গেল মাছ ধরতে, মেখে এল কাদা,
       দুই সতীনে হ্যাঁচকা মেরে,বলল বুড়ো গাধা।

গানের তালে তালে মুখে বলে আররু ফু আর হাতের লাঠি দিয়ে পিঠে মারে। গাজীর গান। গাঁ-গেরামে গাজীর দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়।এরা সমাজকে বার্তা দেয় দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক গানের মাধ্যমে ঐশ্বরিক বাণী। অবশ্যই বিনিময়ে গেরস্ত বাড়ি থেকে চাল ডাল অর্থাদি ভিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে। এদের মাথায় থাকে পাগড়ি, হাতে তসবি , গলায় মালা,পরনে এবং গায়ে থাকে কালো ঢিলে আলখাল্লা পোশাক।গাজীদের গানে অসাম্প্রদায়িকতা লক্ষ করা যায়।যেমন ---
   "মুসলমান বলে গো আল্লা হিন্দু বলে হরি
    নিদানকালে যাবে রে ভাই একি পথে চলি।"
    আবার,
     " আমি তোমার কলঙ্কিনী গো সুন্দরী রাধা
      আমি তোমার কলঙ্কিনী গো
      তোমার লইগ্যা কাইন্দা ফিরি
      হাছন রাজা বাঙালি গো।
      হিন্দুরা বলে তোমায় রাধা
      আমি বলি খোদা
      রাধা নামে ডাকলে
      মুল্লা মুন্সীর দেয় বাধা।
      হাছন রাজা বলে আমি না রাখিব জুদা
      মুল্লা মুন্সী কথা যত সকলই বেহুদা।"
                      ছাদ পেটানোর গান।
       " বধুঁর বাড়ী আমার বাড়ী মাঝে নীলের বেড়া,
         হাতে হাতে পান দিতে,দেখলো দেওর ছোড়া,
         সজনে গাছে গাব গোবাগুব কুলু ছুড়ির বিয়ে,
         মামা আমার পান খেয়েছে, শাশুড়ী বাধা দিয়ে ,
         লাগ লাগ লাগ লাগলো মজা, লাগলো নতুন হাটে।"

এই গান কর্ম সঙ্গীতের অন্তর্গত। একজন গায়েন হাতে মুগুর নিয়ে কাজ করতে করতে গান ধরে। এবং বাকি সকলে ছাদ পেটাতে পেটাতে গানের ধুয়া ধরে। একসময় কড়ি বরগার উপর ছাদ নির্মাণ করা হত। এখন চুন সুরকির বদলে সিমেন্ট, বালু, পাথর ও সিক সহকারে কংক্রিট ঢালাই-এ তৈরি তাই আর ছাদ পেটানোর গান শোনা যায় না। কোথাও কোথাও কংক্রিট ঢালাই-এর ছাদে,জল ছাদ করার জন্য এই শিল্পীদের দেখা যায়। এই গানের সুর ও তাল হয় চটুল। কিংবা হালকা চালের। গানের কথা বেশির ভাগ ঠাট্টা, তামাসা, রঙ্গ রসিকতামূলক।এক ঘেয়েমি কাটানোর জন্য স্ফূর্তি সঞ্চার করাই একমাত্র কারণ। ছাদ পেটানো গানের আরও একটি নমুনা ---
         "শুন ললিতে কই তোমারে
         শ্যাম পীরিতের লাঞ্ছনা
         হায় পীরিত আমারে ছাইরো না।
   (হায় গো) পীরিত রতন পীরিত যতন গো
          (হায় গো)পীরিত গলার হার।
          পীরিত কইরা যে জন মরে
          সফল জীবন তার।।
          লোহার সনে কাঠের পীরিত গো
         (হায় গো)-জলে ভাসে দুই জনা।
          ---জলের সনে মরনের পীরিত
          জল বিনে মীন বাঁচে না।।
          ---এক পীরিত কইরা ছিল গো
          ( হায় গো)রাঁধে কইতে পরে
          --- নন্দের ছেইলা ভাইগ্না লইয়া
          ফিরছিল বনে বনে গো
          (হায় গো) রাঁধের সনে কানু
          কোন যুগে করছিল পীরিত
          আইজো জুরে তনু গো।
                     পটের গান।
      "রবির পুত্র যম রাজা ধর্ম নাম ধরে,
      বিনা অপরাধে পাপীদের দণ্ড নাহি করে।
       কালদূত ও বিষ্ণুদুত যমের প্রহরী,
       যাকে যখন হুকুম করে,তারে করে ঘাড়ি।
       একজনা বলিতে ওরা দুইজনে যায়,
       কেওবা ধরে মুঠি, কেউবা দেখায় ভয়।
        চিত্রগুপ্ত মহরী তার,দিবা- রাত্র লেখে,
        যার যেমন কপালের ফল,এরা দুজন দেখে।
       দেবতার ফল যে জন চুরি করে খায়,
       তপ্ত শাড়াশী করে তার জিহ্বা টেনে নেয়।
       নিজের পতি থাকতে যে জন পরে পতিতে ধায়,
       খেজুর গাছে উলঙ্গ করে তাহাকে ছেচরায়।
      ... জগন্নাথের পুরীতে মা জাতীয় বিচার নাই,
        শূদ্র দেয় প্রসাদ সকল জনে খায়।"

ছবি আঁকার উপযুক্ত মোটা বস্ত্র খণ্ডে পট শিল্পীরা পৌরাণিক কাহিনী ভিত্তিক ছবি অঙ্কন করে। তারপর বাড়ি বাড়ি পটের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে যে গান বাঁধে তাই শোনায়।
প্রাচীন সংস্কৃতে "পট" শব্দের অর্থ কাপড়।যে কাপড়ের উপর চিত্র আঁকা হত সেই বস্ত্রখণ্ডকে পট বলা হত। এই কারণে যারা এই পট আঁকে তাদের পটুয়া নামে অভিহিত হতে দেখা যায়।পটের চিত্র গুলো বিষয় হয় রাধাকৃষ্ণ,বধূনির্যাতনের,পনপ্রথা, বৃক্ষ রোপন, নিরক্ষরতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রভৃতি। কাপড়ের উপর চিত্র এঁকে বাড়ি বাড়ি এই ছবি দেখিয়ে ও গান শুনিয়ে কিছু উপার্জন করত।এরা মিশ্র সংস্কৃতির জনগোষ্ঠী,পটুয়ারা না হিন্দু না মুসলমান। এদের দেখা যেত মেদিনীপুর, পুরুলিয়া প্রভৃতি জেলায়। এই গানের আর একটা নমুনা ---
        "কেন গেলাম জলের ঘাটে,জল ভরা সই হলো না,
        নিতুই বাজে শ্যামের বাঁশী,আর কেন বাঁশী বাজে না।
        জল ভরা তোর হলো না রে,ডুবে কলসি উঠল না
        শাড়ি পরা আর হলো না তোর,সায়া পরা হলো না।
        সাবান মাখা হলো না তোর,মাথায় ঘসা হলো না।
         সেমিজ পরা হলো না তোর, ব্লাউজ পরা হলো না।
         কেন গেলাম জলের ঘাটে,জল ভরা সই হলো না।"

বোলান গান। প্রাচীন এক লোকগান। বর্তমানে কালের গহ্বরে ঢাকা পড়েছে।গাজন উৎসবে এখনও বোলান গানের শিল্পীদের দেখা যায়।বোলান শব্দের আভিধানিক অর্থ হল প্রবচন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে গাওয়া এই পালা গান তাই বোলান গান নামেই পরিচিত।দলে একজন ওস্তাদ তুল্য ব্যক্তি থাকে। তিনি ঢোলের তালে তালে গান গাইতে থাকে আর বাকিরা দোয়ার বা ধুয়ে ধরে। এই লোকগানের অংশ বিশেষ নিম্নে উদ্ধৃত করা হল ---
      "নমঃ নমঃ বন্দে নমঃ নমঃ নারায়ন।
      প্রথমে বন্দিব আমি গণেশের চরণ।।
      গণেশ দেবা থাকতে যেবা অন্য দেবা পুজে।
      নানা বিঘ্ন হয় তার সিদ্ধি না হয় কাজে।।
      ঘরে হতে বেরিয়ে আঙিনায় দিলাম পা।
      আমার লজ্জা শরম রক্ষা কর বসুমতী মা।।
        ....................................................."

শব্দ গান। মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম সাংস্কৃতিক সম্পদ শব্দ গান। এই গানের প্রচলন বেশি বাগড়ি অঞ্চলে। শব্দ গানের মাধ্যমে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অর্থাৎ খোদার এবাদৎ বা স্মরণ করা কিংবা ধর্মীয় চেতনা যুক্ত গানই শব্দগান। শব্দগানের বিষয় ধর্মীয় হলেও --- জাতপাত, নারীপুরুষ,কামপ্রেম সম্পৃক্ত এবং লোকজীবনের যাপিত জীবনের প্রতি সম্বলিত হয়। এই গানকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায় ---‌ যেমন,শরিয়ত ও মারেফতের ফল্গুধারা বয়ে যায়। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ধারনা না থাকলে শব্দগানের সারমর্ম উপলব্ধি করা যায় না। এই গানে সুফিবাদের নিশানা পাওয়া যায়। আঙ্গিকে র দিক থেকে আলাদা হলেও শব্দগানের সঙ্গে কবিগান ও নাম গানের সাদৃশ্য মেলে।নাম গান বা ছন্দ গান ছাড়া শব্দ গানে ও কবিগানে প্রতিপক্ষ দল থাকে।থাকে গায়েন ও শব্দ গানের পোশাক সুনির্দিষ্ট।পরনে থাকে সাদা লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি।মাথায় টুপি থাকে না।বাদ্যযন্ত্র হিসেবে থাকে একতারা, দোতারা খোল খমক। অবশ্য কট্টরপন্থী ও রক্ষণশীল অনেক মুসলমান এই গানকে পাত্তা দেয় না। তারপরও বলব --- এই গানের সমঝদার মুসলিম খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষগুলো। পৃষ্ঠপোষকতার লোকের অভাব পড়ায় বা কৌলিন্য লাভ করতে পারেনি বলে আজ শব্দ গান কালের গহ্বরে মুখ থুবড়ে পড়েছে। শব্দ গানের নমুনা তুলে ধরছি ---
    " ও আমার জাত গেলো রে,তে জাতের সঙ্গেতে
        তোরা কি পারবি যেতে এক পথে।
         ও আমার জাত গেলো রে,তে জাতের সঙ্গেতে।
        ছয় জনা আছে খুনে,তারা সব কুটিল মনে,
       তাদেরকে দুশমন জেনে চল সব এক পথে।
      তাদের নাইতো আচার জাতের বিচার,জাত মেশে খুদার জাতে।
   আল্লা মহম্মদ আদম তিনেতে বইছে একদম।
  ধরে মুর্শিদের কদম,হওনা এখন বেজেতে।
আমার হচ্ছে সন্দ ভালো মন্দ এখন দুই হবেরে দুই জেতে।
  আলেফ কয় কর্ম পূণ্য সব দেখি একই বর্ণ
    নাই কোন ভিন্ন ভিন্ন ,খোওদা তালার সাক্ষাতে ।
যারা জাতির বড়াই করে বেড়ায় তারা বিকোয় না এককরাতে ।"

ডাকসুর গান । বাগড়ি অঞ্চলে বকনা গাভীর বাচ্চা হওয়া  বিষয়ে হাঁচোর গান এবং ডাকসুর গানের মুসলমানদের মধ্যে প্রচলন না থাকলেও নিছক হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সঙ্গীতের প্রচলন ঠিকই ছিল । বিজ্ঞানের অগ্রগতি , সমাজ রাজনৈতিক অবস্থার পুনঃপুন পরিবর্তনের সঙ্গে গ্রামীণ সমাজেও দ্রুত পরিবর্তন ডাকরা পুজোর মতো লৌকিক বিশ্বাসের অবনতি ঘটেছে।গোচারন ভূমিতে বকনা কিংবা বাছুরকে বেঁধে দিলে ডাকরা নামক ভূত প্রেত অশরীরী নামক ডাকরায় ধরে বা ভর করলে তার চিকিৎসা করার জন্য গুনিন ওস্তাদ বা ওঝার ডাক পড়ে। একসময় পাড়ায় পাড়ায় এই রকম ওস্তাদের দেখা মিলত।যা এখন আর দেখা যায় না।হ্যঁচোর গান ও ডাকসুর গান শোনা যায় না। একটি ডাকসুর গান নিম্নে উদ্ধৃত করা হল ---
      "হরি হে তোমার বৃন্দাবন ধামের
      কেবল নাম আছে গোপালের
      তোমার সৃজন তালবন তমালবন
      মধুর নিকুঞ্জবন গিরি গবর ধন।
      হরি সেই বনে করেছিলেন গোচারণ,
      তোমার বিচরণ তাই সেই বৃন্দাবন।
      ব্রজ বৃন্দাবন কাননে নাই সেই ভ্রমণ।
      সৌরবহীন ফুল আজ,নাই কোকিলের স্বর।
       ব্রজ বৃন্দাবনের ময়ূর -ময়ূরী কাঁদছে,
       কাঁদছে গো ভগবতী,গোয়ালিনী কাঁদিছে।
      জলহীন সরোবর ফলহীন তরুবর ওহে বংশীধর,
      গোক্ষের দোহাই রক্ষা করো গোহাল মুনিবর।"

ভাদুগান।ভাদু পুজো বা ভাদু গান রাঢ় অঞ্চলের প্রাচীন এক লোকগান বা লোকসংস্কৃতিমূলক লোকোৎসব। ভাদুগান মূলত অতীতের মানভূম,ঝাড় গ্রাম জেলায় উৎপত্তি হয়ে হয়েছিল। এখন এই গান বিস্তার প্রসার লাভ করেছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া অবিভক্ত বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদে এবং আরও বেশ কিছু এলাকায়। ভাদুগান নিয়ে কিংবদন্তি রয়েছে। সেই অনুসারে ভাদুর পরিচয় নিম্ন রূপ--- মানভূমে কাশীপুরের নীলমনি সিং দেও -এর একমাত্র কন্যা ছিল ভদ্রাবতী বা ভদ্রেশ্বরী।আর একটি জনরব হল--- পালরাজা, রামপাল দেবের পুত্র মদন পাল, ভিন্নমতে মহেন্দ্র সিংহ এবং রানি পদ্মাবতীর একমাত্র কন্যা ভদ্রাবতী বা ভদ্রেশ্বরী গ্রামবাংলার ভাদু নামে পরিচিত। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে ভাদুর জন্ম।তাই তার এমন নাম।ভাদু ছিল খুব দয়ালু। অতিরিক্ত গরমে বর্ষায় ফসল নষ্ট হলে তার পিতার নিকট আরজি করেন, গরীব প্রজাদের খাজনা মুকুব করার। একমাত্র মেয়ের আরজি রাখতে রাজা খাজনা মুকুব করেছিলেন। সেইজন্য প্রজারা ভাদুকে সাক্ষাৎ ভগবতী রূপে মানত। সেই থেকে ভাদুর গানের প্রচলন হয়। এই লোকোৎসব চলে ভাদ্র মাসের প্রথম দিন থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত। মহিলারা নিজের গৃহে মাটির মূর্তি নির্মাণ করে। এই মূর্তিকে কন্যা বা জননী রূপে পুজে।ভাদুগুল এইরকম ---
   ১।মোদের ভাদুর আগমনে
      পূজা করবো সারা রাত্রি
      জ্বালিয়ে সবাই মাটির বাতি,
      ফল দিয়ে করব পুজো ভাদুর চরণে।
    ২।আমার ঘরকে ভাদু এলেন
       কুত্থকে বসাব,
       পিয়াল গাছের তলায়
       আসন সাজাব।
       না,না, না আমার সোনার ভাদুক্
       কোলে তুল্যে নিব।
     ৩। আমার ভাদু চলেছেন লাচ্যে লাচ্যে
         ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ নেপুর বাজে।
         ভাদুর উপের (রুপের) বাহার দেইখ্যা
        উইঠলো জুয়ার মনের মাঝে।
      ৪।ভাদু আমার কলেক যাবে গো, পড়াতে তার ঝোঁক ভারি,
         খাতা কলমের ধার ধারে না,ডান হাতে বাঁধা ঘড়ি।
        ভাদু খেতে ভালোবাসে গো কচি শশা আর গরম মুড়ি।
       পাল পার্বনের লুচি পুরি গো,বাদলা দিনে খিচুরী।
       ভালুকে নিয়ে এলাম গো মৌরক্ষী পারে বাড়ি।
       এই খানেতে সাঙ্গ করি বদনে বলুন হরি।

রাঢ় বাংলায় এই লোকসংগীত এখনো মরে বর্তে টিকে আছে।নাচে গানে ভরপুর হয়ে ওঠে আসর। এই উপলক্ষে শোয়ে শোয়ে মানুষ এসে জড়ো হয়। গাড়োয়ালি গান। এই গান গ্রাম্য লোকজীবনের এক ধরনের ভাওয়াইয়া গানের মত। গাড়োয়ানরাই এগানের গায়ক, তাদের অনুভূতি --- প্রেম - বিচ্ছেদ,হাসি- কান্না, আনন্দ - বেদনা,আবেগ - উচ্ছ্বাস,সুখ -দুঃখ নিয়ে রচিত হয় থাকে।ধীর লয়ের উদাস সুরের গ্রাম্য মেঠো পানের পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলার পল্লির মাঠে- ঘাটে -পথে এক সময় গরু মহিষের গাড়ির ব্যাপক প্রচলন ছিল।মইষ গরু হাঁকাতে হাঁকাতে গাড়োয়ান তার মানের খেয়ালে এই গান গেয়ে উঠতেন। গরু মইষের গাড়িও নেই,গাড়োয়ানও নেই।তাই এই গান আধুনিকতার ধাক্কায় আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
         " ধিকো ধিকো।
           ধিকো মইষাল রে
           আরে ও মইষাল রে ধিকো তোমার হিয়া
          কোন প্রাণে যাইছেন মইষাল
          আমারে ছাড়িয়া মইষাল রে
          .........................................'

জমি চাষের গান। আধুনিক সরঞ্জামের সাহায্যে চাষাবাদ হবার আগে কৃষকরা লাঙ্গলের সাহায্যে চাষাবাদ কলত।আর হাল বাইতে বাইতে কৃষকরা হদ্দ হয়ে উঠলে ক্লান্তি দূর করার জন্য গান গাইতেন। এই গান শুনে অন্য কৃষক জানতে পারতেন যে অমুক চাষি অমুক ভূঁইয়ে চাষ করছে।সাধারণত চাষিরা ভোররাতে হালের বলদকে জাবনা খাইয়ে কাঁধে লাঙ্গল জোয়াল নিয়ে মাঠের পানে রওনা দিত। এবং দুপুর পর্যন্ত হাল চাষ করত।ধীর লয়ের উদাস সুরের পরিচয় পাওয়া যায়। এখানেও সুখদুঃখ, আবেগ উচ্ছ্বাস,হাসি কান্না নিয়ে গান রচিত হয়। এই তো সেদিনও ঈশুর পাড়ার আরমান চাষি মাঠকে গানের সুরে মাতিয়ে তুলতেন।যা এখন হারিয়ে গেছে। চদর বদর গান। উত্তর বঙ্গের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর লোকগুলো চদর বদর পুতুল নাচকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল একদিন।ভাঙা ঘর থেকে পুতুলের বাক্স আর মাটির সুর নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সারা রাজ্য। এই চদর বদর গান আজ কালের গহ্বরে মুখ ঢেকেছ। যতদূর জানা যায় এই গানের প্রবক্তা হল--- দিনাজপুরের ইটাহার এলাকার সাঁওতাল আদিবাসীরা। কাঠের পুতুল বানিয়ে বাঁশের খোপে যত্নসহকারে রাখে। পুতুল গুলো হাত পা শরীর ফোল্ডিং আকারের হয়। সুতোয় বেঁধে আঙ্গুলের সাহায্যে নাচায়।আর তালে তালে গান গাইতে থাকে। অবশ্যই গানে আদিরসের পরিচয় পাওয়া যায়। এবং রাধা কৃষ্ণ ভক্তি মুলক হয়েও থাকে।চদর বদর গানের পোশাকী নাম --- চাঁদনি বাঁধন।কখন বিকৃত হয়ে চদর বদর নামে পরিচিত লাভ করেছে।এগানের শিল্পীদের এখন দেখা পাওয়া ভার।

চট্কাগান।"চুটকি" শব্দ থেকে চটকা শব্দ এসেছে বলে অনেকের ধারণা। আবার অন্যভাবে বলা যায় চটকা গান হল লোকজীবনের ভাবগম্ভীর অবস্থা থেকে সাময়িক বিচ্যুতি। ভাওয়াইয়া গান যেমন অনুভূতির দ্বারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করার গান, গানের গায়কি অনুযায়ী চটকা গান সেই জাতীয় গান নয়। এই সঙ্গীত ভাওয়াইয়া গানের পাশাপাশি চলে, তবে ভাওয়াইয়া বিকৃত চটকা গান নয়।গায়কি শ্বাসাঘাত প্রধান হওয়ায় চটকার সুরের কাঠামো চটুল বা দ্রুত লয়ের হলেও ভাবগম্ভীরতায় একে কেবল চটুল গানের পর্যায়েই ফেলা যায় না। মোদ্দা কথা ভাওয়াইয়া গানের আর একটা ধারা বলে গণ্য করা যায় চটকা গানকে। এই সঙ্গীত রংপুর, কুচবিহার, দিনাজপুর থেকে শুরু করে গোয়াল পাড়া পর্যন্ত প্রচলিত আছে।চটকা গানের উদ্ধৃত করা হল ___
        "হাত ধরিয়ে কও কন্যা রে
        কন্যা না করেন আর গোসা
        তোমার বাড়ীতে যাইতে কন্যা
                             পায় পড়ালা ফুসা "
আবার,
        "প্রেম জানেনা রসিক কালাচাঁদ
                   ওসে ঘুইরে মরে
        কতদিন বন্ধুর সনে হরি দরশন বন্ধুরে।"
                       চটকা সঙ্গীতের এখনও দেখা মেলে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে এবং বাংলাদেশের রংপুর জেলায়।
                    জারিগান। জারি গানের বন্দনা পর্ব এই রকম,
       " হায় হোছেন ___
                পর্থমে বন্দনা করি প্রভু নিরঞ্জন
        যাহারি কুদরতে পয়দা এ দিন ভুবন।
        তারপরে বন্দনা করি নবীজীর চরণ
        যাহারি পিয়ারে পয়দা এ তিন ভুবন।
        সবশেষে বন্দনা করি ভদ্র পঞ্চ জন
        কারবালার কাহিনি এবার করি
                                                 নিবেদন।"
                      জারি গানের আরও একটি নমুনা ___
                  
       "আলিজির মহলে ছিল যত বিবিগণ,
        ঘোড়ার গলা ধরে জুরিল কাঁদন,
        শনরে দুলদুলি ঘোড়া, শুনতো মেরিয়া,
        আজ হতে হওগো দুলদুলি ইমামের জননী।
       ভোখলা -গিলে দিও খান,পিয়াসে দিও পানি।
       ছুটে গিয়ে খবর দিল,এজিদ এরও সামনে ,
      হজরত আলীর বেটা ইমাম আইল রনে।"

জারি শব্দটি আরবী ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে।জারির অর্থ বিষাদপূর্ণ কান্না। আগে পাড়ায় পাড়ায় গাওয়া হতো। এখন কেবল মহররম পর্ব উপলক্ষে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা গেয়ে থাকে। বিশেষ করে যেখানে ইমামবাড়া আছে সেখানে এ গানের প্রচলন বিদ্যমান। এই সঙ্গীতে বীর রসের আধিক্য লক্ষ করা যায় বলে,পুরুষেরাই পরিবেশন করে। জারি গানের দলে ৮/১০ জন নিয়ে গঠিত।দলের প্রধানকে বয়াতি আর সমবেত ভাবে যারা সঙ্গে গানের ধুয়া ধরে তাদের দোহার বলে। কখনও বসে কখনও দাঁড়িয়ে বুকে করাঘাত করে।

ঝুমুর গান। ঝুমুর গান মূলত বাংলার পশ্চিম প্রান্ত --- পুরুলিয়া,ধানবাদ, বাঁকুড়া,ধলভূম প্রভৃতি অঞ্চলের লোকগান।এ গানেও যাদু আছে। ঝুমুরের সুরে মানুষের মনকে মুগ্ধ করে। ঝুমুরের বিষয় রাধাকৃষ্ণ। ঝুমুর গানে বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাব আছে।উৎস নিয়ে নানা জনের নানা মত প্রচলিত রয়েছে। কৃষক রাযেমন,কেউ কেউ বলেন ' জম্ভালিকা' থেকে ঝুমুরের উৎপত্তি।কেউ কেউ বলেন ' ঝুমুরি ' থেকে ঝুমুর হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন প্রাচীন 'ঝোম্বড়াই ' এখন পরিচিতি পেয়েছে ঝুমুর নামে। ঝুমুর গানে বাজনা হয় 'ধামসা-মাদল' । ঝুমুর গানকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়।যথা,ভাদুরিয়া ঝুমুর,দাঁড়শালি ঝুমুর,কাঠি নাচের ঝুমুর,টাঁড় ঝুমুর প্রভৃতি।

ধান কাটার গান। চাষের সময় বা ধান কাটার সময় কৃষকরা মনের আনন্দে যে গান গাই তাকে ধান কাটার গান বলে।এক জমির চাষি বা কৃষক গান ধরলে পাশের জমির কৃষক সেই গানের কলি সমভাবাপন্নভাবে সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে চলে সারা বেলা।তখন মনে হয় যেন সারা মাঠের কৃষকরা এক যোগে গান গাইছে। লাঙ্গলও নেই আউশ আমন ধানও নেই আর সেই ধান কাটার গানও শোনা যায় না।এখন ধান কাটে মেশিনের সাহায্যে।

ধান ভানার গান।ধান কাটার সঙ্গে ধান ভানার সম্পর্ক আছে। কৃষক যখন মাঠ থেকে ধান কেটে গোলায় তোলে তখন কৃষানীরা অর্থাৎ গ্রামের বধূরা আনন্দে মেতে ওঠে আর ধান ভানার কাজে মেতে ওঠে। পল্লির মহিলারাই এই গান গেয়ে থাকে।
       "বউ ধান ভানে রে
       ঢেঁকিতে ফেলিয়ে..."

এখন আর লাঙ্গল,ঢেঁকি কিছুই নেই। ঢেঁকি ছাটা চালও নেই। আমরা এখন ঠোঙ্গা খাওয়া লোকে পরিণত হয়েছি। সারি গান। একসময় অবিভক্ত বাংলার বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় নদী -নালা,হাওড়-বাওড়ের আধিক্য ছিল। এখন অনেক নদী তথা জলাশয় মজে গেছে। একসময় এই সমস্ত জলাশয়গুলোর বুকে অবিরাম বৈঠা তালে তালে অপূর্ব মূর্ছনার সৃষ্টি করে এই উদ্দীপনামূলক সুরকেই সারি গান বলা হত ।এগান পূর্ববাংলায় বেশ সমাদৃত ছিল।

ভাঁজো গান।শস্যকেন্দ্রিক মিলন ব্রতের উৎসব যে গান গাওয় হয় তাকে ভাঁজো গান বলে। সেই অনুষ্ঠানে ঘিরে সধবা এবং কুমারী মেয়েরা এই গান গেয়ে থাকে। গানের নমুনা __
     "ভাঁজোইলো সুন্দরী , মাটিলো সড়া,
     কাল ভাঁজো কে নিয়ে যাবে,ঐ নদীর গাবা।
      ও পাড়ার ভাঁজোই গুলো গরুতে খেয়ে নেয়,
      আমাদের ভাঁজোই সোনার বরণ পায়...
      একদিনের ভাঁজো আমার দুয়ে দিলেন পা,
      তবুও সোনার ভাঁজো গা তোলে না।
      গা তোলে গা তোলো ভাঁজো,বসতে দিব শীতল পাটি,
       পেতে দেবো ননি, জন্ম সফল হোক,মা বলো তুমি।"

ভাঁজো উৎসবের সূচনা হয় ভাদ্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে। শেষ ঐ পক্ষের দ্বাদশীতে। ভাঁজো উৎসব বা ভাঁজো গান পালনে লাগে ছোলা,মুগ,মটর,অড়হর,কলাই প্রভৃতি।শস্যগুলো একটি পাত্রে এই উপাচার এক সঙ্গে কিছু পরিমাণ ভিজিয়ে রেখে পরদিন ষষ্ঠীপুজো সেগুলো নৈবদ্য সাজিয়ে দিতে হয়। কিছু শস্য রেখে দিয়ে সরষে ও ইঁদুর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে প্রতিদিন স্নানের পর ব্রতীরা তাতে ফোটা ফোটা জল ঢালে শস্য গুলোকে। ভাঁজো গানের আর একটা নমুনা ---
       "ভাঁজোর লো কলকলানি, মাটির লো
        সরা
        ভাঁজোর গলায় দেব মোরা পক্ষফুলের
       মালা
       এক কলসি গঙ্গাজল,এক কলসি ঘি
       বছরান্তে একবার ভাঁজো
                             নাচেবে না তো কি।"