জলধি / প্রবন্ধ / গিয়াস শামীমের উপন্যাসের শিল্পস্বর : নিরীক্ষার অনাস্বাদিত সারবত্তা
Share:
গিয়াস শামীমের উপন্যাসের শিল্পস্বর : নিরীক্ষার অনাস্বাদিত সারবত্তা

বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির ফলে আমাদের সভ্যতার রথ এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। এরই সমান্তরালে জীবনের বিচিত্র চৈতন্যে দীপ্ত অন্তর্গত উপলব্ধি শিল্পীর রচনার উপজীব্য হয়েছে। বর্তমানে বাংলা ও বাঙালির সর্বাধিক পাঠকপ্রিয় শিল্পমাধ্যম উপন্যাস। ভালোবাসায় আর্দ্র, ব্যর্থতায় নীল, হিংসায় জ্বলজ্বল কিংবা জিঘাংসায় প্রমত্ত জীবনের বৈচিত্র‍্য সুচারুরূপে ফুটে উঠে উপন্যাসে। Water Allen লিখেছেন, " We find here a close imitation of man and manners ; we see the very web and texture of society as it really exists, and we meet it when we came into the world. " অর্থাৎ সমাজের বুননে মানুষ ও মানুষের রীতিনীতির পরিস্ফুটনই উপন্যাসে আমরা প্রত্যক্ষ করি। জীবনের সাথে যোগ রয়েছে বলে, উপন্যাস নিয়ে হয়েছে বিভিন্ন নিরীক্ষা, নানামুখী গবেষণা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জনপ্রিয় অধ্যাপক ড. গিয়াস শামীমের ' উপন্যাসের শিল্পস্বর ' সেই গবেষণাধারার বিশিষ্ট ও মূল্যবান সংযোজন। উপন্যাসবিষয়ক সাতটি প্রবন্ধের সংকলন এটি। শিক্ষকতা ও গবেষণাসূত্রে অর্জিত অভিজ্ঞতার বাঞ্ছিত সম্মিলনে প্রবন্ধগুলো রচিত। নানা অনুসন্ধিৎসা ও নতুন নতুন দিক উন্মোচনের বহুমাত্রিকতাকে সরলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রবন্ধগুলোতে।

'উপন্যাসের শিল্পস্বর' গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধের নাম 'হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাঞ্চনমালা : ইতিহাসের শিল্পরূপ'। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একজন বিদগ্ধ ভারততত্ত্ববেত্তা হিসেবে অর্জন করেছেন প্রভূত খ্যাতি। নানাক্ষেত্রে তাঁর অবদান থাকলেও বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রাচীন নিদর্শন 'চর্যাপদে'র আবিষ্কারক হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। বহুপঠন, সনিষ্ঠ অনুশীলন ও শিল্পের প্রতি বিশ্বস্ততা তাঁকে গবেষণার পাশাপাশি উৎসাহী করেছে সৃজনশীল সাহিত্য রচনায়। বিশুদ্ধ সত্যের আলোকে শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তিনি রচনা করেছেন তাঁর প্রথম উপন্যাস 'কাঞ্চনমালা'। সম্রাট অশোকের জীবন ও রাজত্বকালের খণ্ডিত অংশকে কেন্দ্র করে এটি রচিত। প্রাবন্ধিক লিখেছেন, " প্রথম উপন্যাস 'কাঞ্চনমালা'য় তিনি অবলম্বন করেছেন বৌদ্ধ ধর্মেতিহ্য, এবং অসাধারণ নৈপুণ্যে সুদূর অতীতের আলো - অন্ধকারময় জীবনবাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছেন শিল্পরসে জারিত করে। "মূলত ভারততত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সাহচর্যই প্রাচ্য বিশেষত বৌদ্ধ শাস্ত্রে তাঁকে আগ্রহী করে তোলে। প্রবন্ধকার উপন্যাসের সারাংশ রচনা ও চরিত্রচিত্রণে সীমাবদ্ধ না থেকে, শাস্ত্রী মহাশয়ের 'Causes of the Dismemberment of the Maurya Empire' প্রবন্ধ আলোচনাপূর্বক উপন্যাসটির ঐতিহাসিক পাঠ বিশ্লেষণে প্রয়াসী হয়েছেন। অবশ্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সকল গবেষণালব্ধ তথ্যই যে আপ্তবাক্য ছিল এমন নয়। সেজন্য আধুনিক গবেষকদের সঙ্গে শাস্ত্রী মহাশয়ের মতের পার্থক্যের জায়গা ও বিষয়ও নিরূপণ করেছেন প্রাবন্ধিক। আর উপন্যাস পাঠের সময় প্রাবন্ধিক যে নির্মোহ থাকতে পেরেছেন, তার প্রমাণ প্রবন্ধের একেবারে শেষের দিককার চাঁচাছোলা মন্তব্য। তিনি লিখেছেন, "হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রথম শ্রেণির ঔপন্যাসিক নন। ভারততত্ত্ববেত্তা হিসেবেই তাঁর পরিচিতি সর্বপ্রসারী। প্রাচীন ভারতবর্ষের যাপিত জীবন ও আচরিত ধর্ম সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে বৌদ্ধধর্ম ও জীবনবিষয়ক যে আগ্রহ তাঁর অন্তর্লোকে সঞ্চারিত হয় তারই শিল্পিত স্বাক্ষর কাঞ্চনমালা। "

এ - গ্রন্থের দ্বিতীয় প্রবন্ধ 'রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি : প্রেম, মনস্তত্ত্ব ও শিল্প'। প্রবন্ধকার এতে স্পষ্ট করেছেন 'চোখের বালি' রচনার পূর্বে রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস রচনা করলেও, সেগুলো ছিল নিছকই বঙ্কিমচন্দ্রের 'ঘটনাপ্রধান সমাজসমস্যাশ্রয়ী' ধারার অনুবর্তন, শিল্পের সাথে তার কোনো যোগ ছিল না। 'আঁতের কথা' উন্মোচনের বাসনায় মনস্তত্ত্বের প্রলেপ লাগিয়ে তুলির নিখুঁত আঁচড়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন 'চোখের বালি'কে। তবে মনস্তত্ত্ব 'চোখের বালি'র প্রধান উপজীব্য বিষয় হলেও, মনোচিকিৎসকের 'কেস স্টাডি ' যে এই উপন্যাসে আরোপিত হয়ে তার শিল্পহানি ঘটায়নি সেটিও প্রাবন্ধিক নিশ্চিত করেছেন। তিনি উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহকে ৫টি স্তরে বিন্যস্ত করে এর গঠন - পরিকল্পনা যে আসলে নাট্যাশ্রয়ী সেটির উপরে আলোকপাত করেছেন। আর এই পাঁচটি স্তরেই আমরা দেখি বিনোদিনীর সরব উপস্থিতি। প্রাবন্ধিক লিখেছেন, "বিনোদিনীকে কেন্দ্রে রেখে ঔপন্যাসিক এ - উপন্যাসের উৎসমুখ যেমন উন্মোচন করেছেন, ঠিক তেমনি করে তুলেছেন বিকশিত ও পরিণামমুখী। উপন্যাসের পরিণাম আর বিনোদিনীর পরিণাম যেন সমান্তরাল ধারানুবর্তী।"রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'চোখের বালির গল্পকে ভিতর থেকে ধাক্কা দিয়ে দারুণ করে তুলেছে মায়ের ঈর্ষা'। রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্য নিয়ে গবেষক - সমালোচকরা স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। তাঁরা নিজেদের মতেই থেকেছেন অনড়। সেদিক থেকে গবেষক গিয়াস শামীম অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও দিতে পেরেছেন মৌলিক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। তিনি লিখেছেন, "চোখের বালির ঘটনাংশকে দারুণ ও উপভোগ্য করে তুলেছে একমাত্র মায়ের ঈর্ষা - একথা রবীন্দ্রনাথ বলেননি। এক্ষেত্রে নানা অনুষঙ্গ - প্রসঙ্গ পালন করেছে কার্যকর ও সহায়ক ভূমিকা। মহেন্দ্রের অপরিণামদর্শী আচরণ, সংসারধর্মে আশার অনভিজ্ঞতা, বিনোদিনীর সপ্রাণ উপস্থিতি, বিহারীর শৈত্যস্বভাব প্রভৃতির মিলিত সমবায়ে উপন্যাসে নির্মিত হয়েছে আবেগময় পরিপ্রেক্ষিত ; কিন্তু রাজলক্ষ্মীর ঈর্ষাবিষ সবকিছু ছাপিয়ে উপন্যাসটিকে করে তুলেছে দ্বন্দজটিল, উপভোগ্য ও আকর্ষণীয়। "

তৃতীয় প্রবন্ধ 'পথের পাঁচালী : জীবনশিল্পের বয়ান'কে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী'র পুনর্মূল্যায়ন বলা যেতে পারে। এতে বেশ কিছু নতুন বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন গবেষক। এটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত : বল্লালী - বালাই, আম - আঁটির ভেঁপু, অক্রূর সংবাদ। তিনটি খণ্ডে বাস্তবতার আবেষ্টনী অতিক্রম করে লেখক উপন্যাসটিতে  মানুষ ও প্রকৃতির আত্মিক বন্ধন সৃষ্টি করেছেন। শুধুমাত্র 'Botanical Novel' বলে যে দায় এড়ানো সম্ভব নয় প্রাবন্ধিক সে বিষয়ে সুস্পষ্ট মত দিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠিত সমালোচকই 'বল্লালী - বালাই' ও 'অক্রূর সংবাদের' অপরিহার্যতা নিয়ে দ্বিধাদীর্ণ ছিলেন ; এমনকি এই দুই অংশের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। কিন্তু গবেষক গিয়াস শামীমের প্রবন্ধ পাঠ করলে আমরা অবগত হই, ভিক্টোরীয় রীতিতে বিভূতিভূষণ উপন্যাসটি রচনা করলেও, পৌরাণিক আবহ সৃষ্টি করে তিনি এই উপন্যাসটিকে আধুনিকতার স্বাতন্ত্র্য দান করেছেন। এই দুই রীতি বিভূতিভূষণের হাতে লাভ করেছে অখণ্ড বিভূতি। ফলে খণ্ড দুটো নেহায়েত ফেলনা, বাড়তি অংশ নয়। প্রাবন্ধিক লিখেছেন, "পথের পাঁচালীর 'বল্লালী - বালাই', 'আম - আঁটির ভেঁপু', 'অক্রূর সংবাদ' নামাঙ্কিত তিনটি অংশের পরস্পরিত গ্রন্থনায় পৌরাণিক সংগঠন সৃষ্টির নিভৃত প্রণোদনা কার্যকর। 'বল্লালী - বালাই' ও 'আম - আঁটির ভেঁপু'র পর 'অক্রূর সংবাদে' পৌঁছলে বিভূতিভূষণের পুরাণলগ্ন অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।" তবে প্রাবন্ধিকের যে দিকটি আমাদের মুগ্ধ করে এবং এই প্রবন্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর আত্মজৈবনিকতার সপক্ষে অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করা। প্রাবন্ধিক এখানে আঙ্কিক নিয়মেই প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন যে বিভূতিভূষণের শৈল্পিক সংস্করণই আসলে অপু। এভাবে ছড়িয়ে থাকা সূত্রগুলো একত্র করলে নিতান্ত অর্বাচীন পাঠকও এটির আত্মজৈবনিকতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে পারে। আর এখানেই প্রাবন্ধিকের কৃতিত্ব।

বাংলা সমালোচনা সাহিত্য এখনো যে নিজস্ব ভূমিখণ্ড আবিষ্কারে সমর্থ হয়নি, তার কারণ সবকিছুকে ইজমের ছাঁচে ফেলার অনুবর্তী প্রবণতা। যে কোনো কিছুর উপর ইজম আরোপ করতে পারলে আমাদের সমালোচকরা পরম শ্লাঘা অনুভব করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য বিচার করার ক্ষেত্রে ফ্রয়েডীয় লিবিডোতত্ত্ব কিংবা মার্ক্সবাদকে তুলাদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে তত্ত্বের ঘেরাটোপে আটকে থাকলেও, মূল বিষয়ে প্রবেশ করা আমাদের ভাগ্যে খুব একটা হয়ে ওঠে না। জনৈক মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক মন্তব্য করেছেন, 'ফ্রয়েড যৌনবিকারগ্রস্ত অসুস্থ মনের পরীক্ষার দ্বারা সমস্ত মানুষের সুস্থ মনের সাধারণ প্রকৃতি সম্বন্ধে তত্ত্ব জাহির করেছেন। এ মনস্তত্ত্ব ভুল হতে বাধ্য।' সুতরাং মার্ক্সবাদী বাঙালি চিন্তকদের একটা সাধারণ প্রবণতা হল ফ্রয়েডীয় প্রকল্পকে ভ্রান্ত, বুর্জোয়া ইত্যাদি তকমা সেঁটে সমাজ - প্রগতির অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা। আবার ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের কোনো কোনো চিন্তককে দেখা যায় মার্ক্সবাদের সঙ্গে ফ্রয়েডীয় চিন্তাধারার সুচিন্তিত সংযুক্তি সাধনে ব্যতিব্যস্ত থাকতে। তত্ত্ব নিয়ে এ ধরনের বিতর্কের জন্য প্রায়শ মূল বিষয়ই থাকে উপেক্ষিত। এগুলো বিবেচনা করে গবেষক গিয়াস শামীম রচনা করেছেন এ - গ্রন্থের চতুর্থ প্রবন্ধ 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিহ্ন : ইজম নয়, ইমেজ'। 'চিহ্ন' উপন্যাসটির বিষয় ভারতবিভাগের অব্যবহিত পূর্বকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা হলেও, এই উপন্যাসে রাজনৈতিক তৎপরতার চেয়ে সংঘশক্তির সক্রিয় উত্থানই মুখ্য হয়ে উঠেছে। একথা অনস্বীকার্য যে, শ্রেণিদ্বন্দ্বের কথা এই উপন্যাসে জোরালোভাবে রয়েছে। কিন্তু তাই বলে ঢালাওভাবে এটিকে মার্ক্সীয় তত্ত্বের শিল্পরূপ হিসেবে আখ্যায়িত করা সমর্থন করেন না গবেষক। মানিক তত্ত্বপ্রেমিক নন ; আর তাঁর সাহিত্য 'Propagandish Literature' নয়। তাই গবেষকের স্থির সিদ্ধান্ত, "মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অস্তিত্ব ও অস্তিত্বের বিনষ্টি বিশ্লেষণ করেছেন ; সেই সঙ্গে এই বিনষ্টি, পতন ও অবক্ষয়ের নিরাকরণ কাম্য মনে করেছেন। এজন্য তিনি তত্ত্ব থেকে তত্ত্বান্তরে গেছেন ; যে তত্ত্ব জীবনের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিতে পারে না তা ছুঁড়ে ফেলেছেন, রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু চিহ্নে শেষাবধি কোনো রাজনৈতিক দীক্ষাই বড়ো হয়ে ওঠেনি। ১৯৪৫ - ১৯৪৬ সালের ঘটনা নিয়ে ১৯৪৭ - এ তিনি চিহ্ন লিখেছেন, কিন্তু জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে থেকেও তিনি ছিলেন নিরাসক্ত, নিঃস্পৃহ ও সুস্থির। কোনো মতাদর্শে তিনি শৃঙ্খলিত নন, কোনো একক মতবাদের অনড় - অচল বিন্দুতে তিনি স্থিত থাকেননি। চিহ্ন কোনো 'ইজম' নয়, 'ইমেজ' ; সমাজচৈতন্য - পরিস্রুত ব্যক্তিচেতনার চিত্রকল্প"

সাহিত্য মানবজীবনের সরল অথচ বিপ্রতীপ ঘটনার প্রতিভাস। চলন্ত জীবনের প্রবহমানতা আজকে সাময়িক হলেও, একদিন সেটিই ধ্রুপদী বলে পরিগণিত হয়। সাহিত্য চলমান জীবনের সজীব গতিধারা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সময় ও সমাজ - বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো সাহিত্যিকই মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করতে সমর্থ হয় না। সুতরাং সামাজিক জীবনের পটভূমিতে নতুন মূল্যবোধ ও চিন্তাধারা - উদ্ভুত বাস্তবতার সরব উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায় শিল্পীর রচনায়। 'সরদার জয়েনউদদীনের উপন্যাসে সমাজবাস্তবতা' প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে নতুন পরিবর্তনের হাওয়া কীভাবে পুরাতন মূল্যবোধের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে তার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তিনি লিখেছেন, "বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ছোটগল্পগ্রন্থ - প্রকাশনাসূত্রে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে সরদার জয়েনউদদীনের আত্মপ্রকাশ। এ সময়কালে সংঘটিত বিবিধ সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা তাঁর জীবনবোধ ও শিল্পাদর্শকে করেছে গভীরভাবে প্রভাবিত। সমাজ - পরিবর্তনের দীপ্র - আকাঙ্ক্ষা হয়তো তাঁর ছিলো না, কিন্তু যে - সমস্ত বিষয় সামাজিক শান্তি - স্থিতি - শৃঙ্খলাকে সংহত - সুন্দর অথবা বিনষ্ট করে তা অঙ্কনেও তিনি পরাঙ্মুখ ছিলেন না। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে লগ্ন হয়ে তিনি তাই তাঁর উপন্যাসে সমাজজীবনের সে - সব অসঙ্গতি চিত্রিত করেছেন, যা সময়ে - অসময়ে আমাদের অন্তর্জগৎ আলোড়িত করে, বিক্ষত ও বিপন্ন করে।"সরদার জয়েনউদদীন সাতটি উপন্যাস লিখেছেন : 'আদিগন্ত', 'পান্না - মোতি', 'নীল রঙ রক্ত', 'অনেক সূর্যের আশা', 'বেগম শেফালী মীর্জা','শ্রীমতী ক ও খ এবং শ্রীমান তালেব আলি' এবং 'বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ'। এগুলোর মধ্যে 'নীল রঙ রক্ত' ব্যতীত অপর ছয়টি উপন্যাসকে প্রাবন্ধিক আলোচনায় এনেছেন। সেগুলোর মধ্যে একদিকে তিনি সমাজ ও সামাজিক ইতিহাসের উপকরণ অনুসন্ধান করেছেন ; অন্যদিকে সরদার জয়েনউদদীনের উপন্যাসে প্রকাশিত সাম্প্রতিক জীবন ও মূল্যবোধের স্বরূপ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা - উত্তরকালের সমাজ - জীবনের বিপর্যস্ত ভাবকে উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

কৃতঘ্ন আততায়ীর মতোই কাল বিস্মৃতির নির্মম ছুরিতে আঘাত হানে আমাদের স্মৃতিসত্তার উপর। বাঙালি সবচেয়ে বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি হিসেবে পরিচিত। হুমায়ুন আজাদ তাই মন্তব্য করেছেন, 'বাঙালি প্রায়ই আন্দোলন করে, অধিকাংশ সময়ই ব্যর্থ হয়, মাঝে মাঝে সফল হয় ; যখন সফল হয়, তখন তারা ভুলে যায় কেন আন্দোলন করেছিল।' কিন্তু এখনো অন্তর্লীন অনুভব ও প্রেরণায় উজ্জ্বল হয়ে আছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ। তাই বাংলা সাহিত্যে বিশেষত উপন্যাসে বারবার এসেছে এই প্রসঙ্গটি। মাহমুদুল হকের 'জীবন আমার বোন' একটি পাঠকনন্দিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের ঘটনাপ্রবাহ হয়ে উঠেছে এর উপজীব্য। তবে নিরীক্ষা - প্রিয় ঔপন্যাসিক মাহমুদুল হক শৈল্পিক একনিষ্ঠতার দরুন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই সন্ধান করেছেন আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের জাতিসত্তার উন্মেষের উজ্জ্বল ও রক্তাক্ত আলেখ্য 'জীবন আমার বোন'। আর বাঙালি সেসময় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার স্বপ্নের জাল বুনছিল একদিকে, অন্যদিকে নিজেদের করে তুলছিল প্রস্তুত। প্রাবন্ধিক তাই তাঁর প্রবন্ধটির নাম দিয়েছেন, 'মাহমুদুল হকের 'জীবন আমার বোন' : মুক্তিযুদ্ধের প্রাকপ্রস্তুতির শিল্পিত আখ্যান '।

এ গ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধের নাম 'বাংলাদেশের উপন্যাসের প্রকরণশৈলী'। শিল্প - সাহিত্যের বাস হল উৎপাদিকা শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের সম্বন্ধের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মূল কাঠামোর উপর দাঁড়ানো উপরিকাঠামোতে। যুগে যুগে মূল কাঠামোর পরিবর্তনের ফলে,উপরিকাঠামোতে ঘটে নানামাত্রিক পরিবর্তন। আর তার ছাপ পড়ে শিল্প - সাহিত্যে। ফলে কালভেদে শিল্প - চরিত্র পরিবর্তিত হয়। এমনকি একই লেখকের বিভিন্ন লেখাতেও কালগত পার্থক্যের জন্য পরিলক্ষিত হয় যুগান্তরের চিহ্ন। সেজন্য উপন্যাসের আঙ্গিক ও প্রকরণশৈলী নিয়ে বারবার নিরীক্ষা হয়েছে এবং কালান্তরের প্রভাবে এভাবেই উপন্যাসে সাধিত হয়েছে জটিলতর রূপান্তর। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। ভারত - বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানকেন্দ্রিক যে সাহিত্যধারা গড়ে উঠেছে, তাকেই প্রাবন্ধিক বাংলাদেশের সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বিভাগোত্তরকালে বেশ প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই এগিয়েছে বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্য। মাত্র কয়েক দশকের পথ - পরিক্রমায় ভাষা আন্দোলন, আটান্নর সামরিক শাসন, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ,পঁচাত্তরের পট পরিবর্তন, আবার সামরিক শাসন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনাপুঞ্জ প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করেছে ঔপন্যাসিকদের মনোজগৎকে। প্রাবন্ধিক এই উপন্যাসে দুইটি পর্বে বাংলাদেশের উপন্যাসের প্রকরণশৈলী নিয়ে আলোচনা করেছেন। একটি ভারতবিভাগের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ধারা এবং অন্যটি স্বাধীনতা - উত্তর ধারা। প্রথম পর্বে তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শামসুদদীন আবুল কালাম, আবু ইসহাক, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, শওকত ওসমান, শহীদুল্লা কায়সার, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সরদার জয়েনউদদীন, সত্যেন সেন, জহির রায়হান, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখের উপন্যাস বিশ্লেষণ করেছেন। এগুলো বিশ্লেষণ করে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন : "বিভাগোত্তরকালে বাংলাদেশের উপন্যাসে প্রকরণশৈলী নিয়ে যে পরীক্ষা - নিরীক্ষা হয়েছে তা পরিমাণগত দিক থেকে নিঃসন্দেহে স্বল্প। অধিকাংশ উপন্যাসে গৃহীত হয়েছে আদি - মধ্য - অন্ত্যযুক্ত সমগ্র - আয়তনিক কাহিনি ; অনুসৃত হয়েছে উনিশ শতকীয় বর্ণনা - বিবৃতিধর্মী আঙ্গিক। উপন্যাসে প্রায়শ ব্যবহৃত হয়েছে ঔপন্যাসিকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ, কখনো কখনো পার্শ্ব চরিত্রের দৃষ্টিকোণ। গতানুগতিক শিল্প - অনুসৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন স্বল্পসংখ্যক ঔপন্যাসিক। "স্বাধীনতা - উত্তরকালের উপন্যাস বিবেচনায় শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, শামসুদদীন আবুল কালাম, শওকত আলী, আহমদ ছফা, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন প্রমুখের উপন্যাসকে গ্রহণ করেছেন প্রাবন্ধিক। খুব বেশি শিল্পমানঋদ্ধ উপন্যাস রচিত না হলেও, এই সময়কালে প্রকরণশৈলী ও বিষয়ভাবনায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে বলে গবেষক মনে করেন।

গিয়াস শামীম একজন সমাজমনস্ক বুদ্ধিবাদী গদ্যকার। জীবনের সঙ্গে, সমাজের প্রবাহের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে বলেই, তিনি কেবল উপন্যাসের নন্দনতাত্ত্বিক পাঠ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং সেসব উপন্যাসে প্রতিভাসিত সমাজ ও জীবনধারার বিচ্ছিন্ন কথামালাকে সাজিয়ে নিয়েছেন সুরম্য অট্টালিকার মতো। সাহিত্য ও সংস্কৃতি মূল্যায়নের নতুন পরিপ্রেক্ষিত সৃজনে তিনি সমর্থ হয়েছেন। স্বচ্ছন্দ, সহজ ও গতিশীল অথচ গভীর চিন্তা - উদ্দীপক ভাষার মিশ্রিত সমবায়ে রচিত 'উপন্যাসের শিল্পস্বর' তাই প্রবন্ধসাহিত্যের প্রথাগত অনতিক্রান্ত বৃত্ত ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। বাচনসর্বস্বতার পরিবর্তে যুক্তি ও মননের বুননে রচনা করায় 'উপন্যাসের শিল্পস্বর' লাভ করেছে আকরগ্রন্থের মর্যাদা। সুতরাং এই গ্রন্থটি সাহিত্যমনা  পাঠকদের অবশ্যই পাঠ করা উচিৎ।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান