জলধি / সাক্ষাৎকার-এবং-অন্যান্য / হারুকি মুরাকামি’র নিউইয়র্ক টাইমস সাক্ষাৎকার
Share:
হারুকি মুরাকামি’র নিউইয়র্ক টাইমস সাক্ষাৎকার

‘বাতাস যেখানে গান গায়’ নামে মুরাকামি প্রথম উপন্যাসটি লিখেছিলেন ’৭৯ সালে, তারপর টানা ৩ দশক ধরে তিনি মানুষের মনোজগতকে আশ্চর্য দক্ষতায় পর্যবেক্ষণ করেছেন। শুধু জাপানেই নয়, হারুকি মুরাকামি বিশ্বজুড়ে পরিচিত নাম। বিশ্বের কয়েক কোটি পাঠক পড়েছেন তার লেখা। ইতোমধ্যে পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার বইগুলি। সেসব বইয়ে পাঠককে তিনি অদ্ভুত ও পরাবাস্তব পরিস্থিতির মুখোমুখি করতে চেয়েছেন। ২০০৫-এ বেরিয়েছে তার বহুল আলোচিত উপন্যাস 'কাফকা অন দ্য শোর', এবং ২০১৭ সালে সঙ্গীত নিয়ে সেজি ওযাওয়া'র সঙ্গে আলাপচারিতার বই 'এবসোলিউটলি অন মিউজিক'।

মুরাকামি টোকিও'র ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চলচ্চিত্রের প্রতি প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল, যদিও তার পাঠ্য বিষয় ছিল 'নাটক'।    

জে.ডি স্যালিঞ্জারের 'দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই', এফ. স্কট ফিটজেরাল্ডের 'দ্য গ্রেট গ্যাটসবি', ‘দ্য লাস্ট টাইকুন’সহ বিশ্বসাহিত্যের বহু উল্লেখযোগ্য রচনা তিনি অনুবাদ করেছেন, তাঁর মাতৃভাষায়। ফিটজিরাল্ডের উপন্যাসটিকে লেখক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই মনে করেন মুরাকামি।  

লেখালেখির শ্রমসাধ্য দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে তিনি ভিডিও গেমস প্রোগ্রামিংয়ের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, 'লিখতে বসে কখনও মনে হয় ভিডিও গেম ডিজাইন করছি। আমিই প্রোগ্রামার, আমিই প্লেয়ার। এক বিচ্ছিন্ন খেলোয়াড়'। দৌড়বিদ হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। ২০০৮-এর জুনে দ্য নিউইয়র্কারে মুরাকামি'র 'দৌড়বিদ উপন্যাসিক' লেখাটি প্রকাশিত হয়, একই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর জীবনস্মৃতি 'হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং'।   

তাঁর জন্ম ১৯৪৯ সালে, জাপানের কিয়োটো'য়। তিনি উপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক, সাংবাদিক। ড্যান্স ড্যান্স ড্যান্স, আফটার দ্য কোয়েক, সাউথ অব দ্য বর্ডার, ওয়েস্ট অব দ্য সান, আফটার ডার্ক, দ্য স্ট্রেঞ্জ লাইব্রেরি, ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইম্যান, এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ, নরওয়েজিয়ান উড, দি উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল, স্পুটনিক সুইটহার্ট, ওয়ানকিউএইটফোর, কিলিং কমেন্ডাটোর ইত্যাদি তাঁর অন্যতম সৃষ্টি। 

অনূদিত এ-সাক্ষাৎকারটি নিউইয়র্ক টাইমসের সানডে বুক রিভিউ-এ ছাপা হয় ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর ‘হারুকি মুরাকামি’ শিরোনামে।  

 

নিউইয়র্ক টাইমস: খাটের পাশের টেবিলে এখন কোন বইগুলো আছে?

মুরাকামি: শক্ত মলাটে বাঁধানো মাইকেল কনেলি’র ‘দ্য ব্রাস ভার্ডিক্ট’, হনুলুলু’র পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে মাত্র ১ ডলারে কিনেছিলাম। বইটি এমন একটি আশ্চর্য বই, যাকে একবার পড়তে শুরু করলে শেষ করতেই হয়। আমি পড়েই যাচ্ছি। পাঠে বিরতি নেওয়া কঠিন। বইয়ের দাম মাত্র ১ ডলার। এই দাম অবশ্যই সবকিছু নয়। এ দামে, আর কি কোনও জিনিস আছে, যা আমাকে আনন্দের এমন আশ্চর্য অনুভূতি দিতে পারে?

 

নিউইয়র্ক টাইমস: সর্বশেষ কোন শ্রেষ্ঠ বইটি আপনি পড়েছেন?

মুরাকামি: এফ. স্কট ফিটজেরাল্ডের ‘দ্য লাস্ট টাইকুন’। জাপানি ভাষায় আমার অনূদিত এ বইটি এ বছরের (২০২২ সালে) শুরুতে প্রকাশ হয়েছিল। অনুবাদ হচ্ছে চূড়ান্ত পর্যায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ পাঠ। প্রতিটি বাক্যের মর্মার্থ উপলব্ধি করে করে, আমি যখন এ-উপন্যাসটি পড়ি, তখন- এ-লেখাটি যে কতোটা আশ্চর্যজনক, তা আবিস্কার করে আমি বারে বারে কেঁপে কেঁপে উঠেছি, মুগ্ধ হয়েছি। এই বইয়ের শ্রেষ্ঠত্বের জায়গাটি কখনোই হারিয়ে যাবে না। বইটি জরুরি সব কথাই বলেছে, যা আসলেই বলা দরকার। ফিটজেরাল্ড এমন এক লেখক, যিনি তাঁর মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত একজন খাঁটি লেখকই ছিলেন। আমি জানি এখন কথাটি বলা অর্থহীন– আমার কেবল একটিই আক্ষেপ, তিনি যদি উপন্যাসটিকে শেষ করতে পারতেন!

(ফিটজেরাল্ডের ৫ম ও অসমাপ্ত উপন্যাস দ্য লাস্ট টাইকুন সমাপ্ত করেন এডমান্ড উইলসন এবং এটি ফিটজিরাল্ডের মৃত্যুর ১ বছর পর, ১৯৪১ সালে প্রকাশিত হয়)। 

নিউইয়র্ক টাইমস: এমন কোনোও ক্ল্যাসিকের কথা বলবেন, যাকে যা আপনি এই প্রথমবার পড়লেন?

মুরাকামি: দস্তইয়েভ্‌স্কি'র ‘আ রো ইয়ুথ’; এর একটি পেপারব্যাক সংস্করণ সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি, হাঁটছি। সব সময়ই হাতে এই বই। এ বইটির ভেতর দিয়েই আমি আমার লেখার পথ খুঁজে বের করছি। দস্তইয়েভ্‌স্কি'র আরও বেশ কিছু লেখা আছে যাদের আমি এখনও পড়ে উঠতে পারিনি। বালজাকের ক্ষেত্রেও তাই- এখনও বহুকিছুই অপঠিত, গভীর মর্মমূলে এখনও পৌঁছাতে পারিনি।  

নিউইয়র্ক টাইমস: কোন লেখক– ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সমালোচক, সাংবাদিক, কবি– যিনি এখনও সমান সক্রিয়, আপনি যার বিশেষ অনুরাগী, শ্রদ্ধাবোধ করেন? 

মুরাকামি: তিনি ঔপন্যাসিক কাজুও ইশিগুরো– আমি যার মুগ্ধ অনুরাগী; তাঁর নতুন বইয়ের জন্য সবসময় অপেক্ষায় থাকি। তিনি একজন প্রীতিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

নিউইয়র্ক টাইমস: একবার কোথাও বলেছিলেন- তরুণ লেখক ছিলেন যখন, সেই সময়ে- শ্যান্ডলার, এবং সম্ভবত হেমিংওয়ে সহ পশ্চিমের আরও কয়েকজন লেখককে অনুবাদ করে আপনি আপনার নিজস্ব স্বর খুঁজে পেয়েছেন। তাদের লেখাপত্রে আপনি কী এমন খুঁজে পেয়েছিলেন যা আপনাকে লেখক হওয়ার পথ দেখিয়েছে? তাদের লেখা কি এখনও সেই আগের মুগ্ধতায় পড়েন?

মুরাকামি: শ্যান্ডলারের সমস্ত উপন্যাসই আমি অনুবাদ করেছি কিন্তু নিজ হাতে এখনও হেমিংওয়ের কিছুই করা হয়নি। আমি রেইমন্ড কারভার পুরোটিই অনুবাদ করেছি- তাঁর গল্পগুলো, কবিতা এবং গদ্যলেখা; এবং অবশ্যই, এই অনুবাদ করতে গিয়ে নিজেকে ঋদ্ধ করার মতো বহু কিছু পেয়েছি। শ্রেষ্ঠতম যে-শৈলীটি আমি শিখেছি, তা হচ্ছে- অসামান্য একটি লেখার মধ্যে থাকতে হবে একটি নির্দিষ্ট ধাবমান গতি। পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি। উপন্যাসের যাত্রাপথটি যেন কোথাও বাধাগ্রস্ত না হয়, যেন ক্রমাগত এগিয়ে চলে।  

আমি উপন্যাস লিখছি যখন, তখনও, সমান তালে-  কথাসাহিত্য অনুবাদ করছি। এই অনুবাদ হচ্ছে আমার নিজের লেখার গতির এক চমৎকার পরিবর্তন। লেখকের মানসিক অবস্থা পরিবর্তনের একটি চমৎকার উপায়। অনুবাদ মস্তিস্কের একটি অংশকে ব্যবহার করছে, অন্য অংশে তখন উপন্যাস এগিয়ে চলেছে। তাতে লাভ- লেখক পরিশ্রান্ত হচ্ছেন না, তাঁর মস্তিস্ক উদ্ভাবনশীল থাকছে।

নিউইয়র্ক টাইমস: আজকের জাপানকে কেউ যদি বুঝতে চায়, তাকে কোন বইটি পড়তে বলবেন?

মুরাকামি: বই পড়ে বুঝতে চাওয়ার প্রবণতা নতুন নয়, বহু বই সারা দুনিয়ায় লেখা হয়েছে কিন্তু এখানে, জাপানের নারী লেখকরা–বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের– উপন্যাস প্রকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয়। তারা এ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন, তারা বিশাল এক পাঠক গোষ্ঠীও তৈরি করতে পেরেছেন। আমি, বিশেষ করে- মিয়েকো কাওয়াকামি’র ‘নাৎসু মনোগাতারি’ (গ্রীষ্মকালের আখ্যান) উপন্যাসের নাম বলবো। যে-সংবেদনশীলতা একজন লেখকের থাকা দরকার, সবই তাঁর আছে। তিনি একজন অত্যন্ত নিবেদিত গল্পকার। ধ্যানমগ্ন। তাঁর এ-উপন্যাস অনূদিত হয়েছে, ইংরেজিতে; ২০২০ সালে, ‘ব্রেস্টস এন্ড এগস’ নামে। 

নিউইয়র্ক টাইমস: যখন উপন্যাস লিখছেন; লেখার মধ্যেই আছেন, সেই সময়ে কী কী পড়েন? কোন ধরনের লেখা তখন এড়িয়ে যান?

মুরাকামি: আপনার এ প্রশ্নটি শুনতে চমৎকার, কিন্তু সত্যিকার অর্থেই এ নিয়ে আমি মনে হয় কোনোদিনও ভাবিনি। দীর্ঘ একটি উপন্যাস লেখা এমন এক কাজ- বহুদূরের এক অজানা অচেনা পথ পাড়ি দেওয়ার মতোই লেখকের কাছে সময় এবং একরোখা ধৈর্য্য দাবি করে। বিপুল ধৈর্য্য। আমার মনে হয়- উপন্যাস লেখার সময় যদি পড়া বন্ধ করে দিই; যা পড়তে চাই, তা না পড়ি- তাহলে এই না পড়াই আমার লেখার জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে; তাতে লেখা এগোবে না, ভেতরের সুর কেটে যাবে, লেখা ভোকাট্টা হয়ে যাবে। এ আমি ভাবতেই পারি না। যা কিছু পড়তে ইচ্ছে করে, তা পড়িই, কিছুতেই নিজেকে আটকে রাখি না। উপন্যাস লিখবার কালে, লেখালেখির যতগুলো ধরন আছে, ঘরানা আছে, সেই সব ঘরানার বইই আমি পড়ি। এ আমার নিত্যদিনের অভ্যেস। এভাবে পড়লে মনে হয়- এই পাঠ আমাকে লিখতে থাকা উপন্যাসের জন্য মাঝেমাঝেই কিছু সূত্র দিচ্ছে, ঝিলিক দিচ্ছে, আর আমি এগিয়ে যাওয়ার পথটি আবছায়া হলেও খুঁজে পাচ্ছি; যদিও, আমি কিছুতেই প্রভাবিত হই না, প্রভাবিত হওয়া না-হওয়া নিয়ে আমি কিছু ভাবিও না। 

নিউইয়র্ক টাইমস: আপনি কি এমন একটি বই পাঠের জন্য বেছে নিবেন, যে-বইটি আপনাকে আবেগতাড়িত করবে কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক সংবেদনা দিবে? 

মুরাকামি: কোনও একটি বইয়ে আমি যা খুঁজি, তা হলো- গল্পের প্রবাহ। (ঠিক একই কথা যখন আমি নিজে লিখছি, তখনও সত্য।) আমার নিজের লেখার ক্ষেত্রেও তাই। তাই, মাঝে মাঝেই, কিছু কিছু উপন্যাস পড়তে গিয়ে বিপদে পড়ে যাই। পড়তে ভীষণ কষ্ট হয়, যেমন— বুদ্ধিবৃত্তিক (ইন্টেলেকচুয়াল) উপন্যাস; এসব উপন্যাসকে আপনি নির্দ্বিধায়  ইন্টেলেকচুয়াল উপন্যাস বলতে পারেন, —যেখানে, সেই বর্ণনার প্রবাহ অনুপস্থিত। ন্যারেটিভ যেন তরঙ্গিত নয়। কোনও প্রবাহই থাকে না, বারবার তাই আমার পাঠ বাধাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু এর উলটো দিকটিও ভেবে দেখা জরুরি। খুব আরামে, খুব আয়েশ করে পড়া যায় যে সব উপন্যাস, যাতে গল্পের প্রবাহের কোনও কমতি নেই, খরস্রোতা প্রবাহে গল্প ধাবমান- সেইসব উপন্যাস কিছুতেই আমার সংবেদনে নাড়া দিতে পারে না। আমাকে কিছুতেই গল্পের ভেতর ঢুকতে দেয় না, এমনই মসৃণ। ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তির জন্ম দেয়। এই ক্ষেত্রে, সম্ভবত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং রেইমন্ড শ্যান্ডলার- এ দু’জন কিংবা এ দু’জনের মিশ্রণে অন্য আরেকজন, তারাই আমার কাছে আদর্শ ঔপন্যাসিকের উদাহরণ। আমার নমস্য লেখক। 

নিউইয়র্ক টাইমস: কোন ধরনের বা ঘরানার বই আপনি বিশেষ আগ্রহে নিয়মিত পড়েন, কোন ধরনগুলো এড়িয়ে যেতে চান?

মুরাকামি: যখন থেকে, ঠিক যখন থেকে আমি সঙ্গীতে ডুবে যেতে শুরু করলাম, তখন থেকেই আমি সঙ্গীতজ্ঞদের জীবনী কিংবা তাদের নিজেদের লেখা স্মৃতিকথাও পড়তে শুরু করে দিলাম; এই তো, এই ক’দিন আগেই পড়ে শেষ করলাম (বইটির ভেতর এতো আনন্দ) ব্রুস স্প্রিংস্টিনের লেখা ‘বর্ন টু রান’।

নিউইয়র্ক টাইমস: ঘরের বইগুলো গুছিয়ে রাখেন কীভাবে?

মুরাকামি: সংগ্রহের গানের রেকর্ডগুলো খুবই যত্ন সহকারে গুছিয়ে রাখতে পারি কিন্তু বইগুলো কিছুইতে পারি না; বইগুলো চিরকালের মতো অগোছালো আর এলোমেলোই থেকে যায়! বইগুলো প্রতিদিনই সুকৌশলে নিজেদের লুকিয়ে ফেলে! যে বইটি এখনই পড়ব বলে ভেবেছি, পড়া জরুরিও, খুঁজতে গেলে তাকে আর কোথাও দেখা যায় না; সে আমাকে যেন এড়িয়ে যেতে চায়! আবার, এ কথাও সত্য- বই সংগ্রহে আমি খুব একটা আগ্রহী নই; একবার পড়ে ফেললে, সে বই হারালো কি আত্মগোপন করলো, সাধারণত সেসব নিয়ে আমি আর ভাবিই না, খবরও রাখি না।

নিউইয়র্ক টাইমস: আপনার বইয়ের তাকে কোন বইটি খুঁজে পেয়ে যে কেউ হতবাক হবে?

মুরাকামি: হ্যাঁ, এ রকম একটি দু'টি বই আছে। খুঁজলেই পেয়ে যাবেই টম লর্ডের ৩৪ খণ্ডের বই ‘দ্য জ্যাজ ডিসকোগ্রাফি’ (মিউজিকাল রেকর্ডিংয়ের একটি বর্ণনামূলক ক্যাটালগ)। খণ্ডগুলো অনেক বেশি জায়গা নেয়। আমার মনে হয়- অনেকেই এই ডিসকোগ্রাফির খণ্ডগুলো নিজস্ব সংগ্রহে রাখাটিকে অপ্রয়োজনীয় ভাববেন, কিন্তু জ্যাজ যাদের ধ্যানজ্ঞান, সেইসব জ্যাজ সংগ্রাহকদের জন্য এটি একটি বহুমূল্য ধন; ডিসকোগ্রাফিটি বহু বছরের শ্রমসাধ্য ফল। আজকের দিনে তো আপনি আন্তর্জালে খুঁজলেই পেয়ে যাবেন, কিন্তু অতীতে- একমাত্র উপায় ছিল নিজের হাতের কাছে সবগুলো খণ্ড কিনে নিয়ে আসা। এ আমার কাছে বিরাট কিছু, যেখানে আমি কেবল সঙ্গীতে ডুবে যাবার ধ্যান করি আর মাঝেমাঝেই পৃষ্ঠাগুলি এলোমেলোভাবে উলটোতে পছন্দ করি। 

নিউইয়র্ক টাইমস: ছেলেবেলায় আপনি কেমন পাঠক ছিলেন? ছেলেবেলায় পড়া কোন বইগুলো এবং কোন লেখক এখনও মুগ্ধ করেন?

মুরাকামি: সে বয়সে আমি সর্বগ্রাসী পাঠকই ছিলাম, যে কোনও একটি বই হলেই চলে যেত; অন্য কাজের চেয়ে পড়তেই বেশি পছন্দ করতাম (এখানে বলে রাখি- ইশকুলের পড়াশোনা আমার মধ্যে কোনোদিনও আগ্রহ তৈরি করে নি)। তখন, সৌভাগ্যক্রমে, আমাদের বাড়িটি ছিল বিচিত্র বইপত্রে ঠাসা- সেইসব পড়ে পড়েই আমি নিজের পথটি খুঁজে পেয়েছিলাম। এখনও, যে-বইটির কথা সবচে বেশি মনে পড়ে, সে বইটি হচ্ছে- উয়েদা আকিনারি’র ‘উগেৎসু মনোগাতারি (জ্যোৎস্না ও বৃষ্টির আখ্যান); ছোটদের উপযোগী একটি বিশেষ সংস্করণ; ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত ভূতের গল্পের সংকলন। মনে আছে, এই গল্পগুলো কী ভয়ানক রকমের ভয় পাইয়ে দিত! আমি মনে করি- অদেখা জগৎ আমাকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করতে পেরেছে। 

নিউইয়র্ক টাইমস: কীভাবে আপনার পাঠের রুচি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে?

মুরাকামি: যখনই, আমার নতুন কোনও বই প্রকাশ পেয়েছে, তখনই আমার মধ্যে কথাসাহিত্য পাঠের চেয়ে ভিন্নপাঠের (নন-ফিকশন) প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। 

নিউইয়র্ক টাইমস: ধরা যাক, আপনি একটি নৈশভোজের আয়োজন করছেন, সেখানে মৃত কিংবা জীবিত কোন তিনজন লেখককে আমন্ত্রণ জানাবেন?

মুরাকামি: অত্যন্ত দুঃখিত। এরকম নৈশভোজের পক্ষে আমি এখনও উপযুক্ত হতে পারিনি। 

নিউইয়র্ক টাইমস: হতাশাজনক, অতিমূল্যায়িত, একদমই মানহীন- কোন বইগুলোকে এ রকম মনে হয়েছিল, কিংবা মনে হয়নি? মনে আছে- শেষ কোন বইটিকে আপনি না পড়েই রেখে দিয়েছিলেন?  

মুরাকামি: যে-বইগুলোকে এখন আমি আর হাতেই নিতে চাই না, পড়তে তো চাই-ই না, সে-বইগুলো আমি নিজেই লিখেছি, প্রকাশও করেছি। যখনই বইগুলো ফিরে পড়তে গেছি, তখন, সব সময়ই এমন কিছু পেয়েছি যা আমাকে কেবল হতাশই করেছে, অসন্তুষ্ট করেছে। যদিও এই ব্যাপারটি আমাকে পরবর্তী লেখার বিষয়ে ভাবিয়েছে- ভালো লিখতে হবে। নিজের লেখাপত্র নিজে খুঁটিয়ে না পড়া একটি বিশেষ সমস্যা, যদিও আমি যা কিছু এযাবৎ লিখেছি, ক্রমাগত সেসব ভুলে গেছি। কিছুই মনে রাখিনি। সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীরা মাঝেমাঝেই আমাকে আমার বিভিন্ন বইয়ের নির্দিষ্ট কিছু অংশ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, যা আমাকে বিব্রত করে, বিভ্রান্ত করে। এসব কি সত্যিই আমি লিখেছি? ভেবে বিস্মিত হই!

অন্যদেরও এমন কিছু বই আছে, ঠিক একই ব্যাপার; মন না জাগলে তাদেরও আমি ফেলে রাখি। এরকম বই বহু, অসংখ্য (যদিও আমি আজ এখানে কোনও বইয়েরই নাম উল্লেখ করব না)। যখন আমি বয়সে তরুণ, ভাল কি মন্দ যা-ই লাগুক, শেষ পর্যন্ত পড়া চালিয়ে যেতাম, কিন্তু এখন তো বয়স বেড়েছে; এখন আর সেই জোর নেই, এখন আর তেমন করে পড়তে পারি না। এখন মূলত- সময় নষ্ট করতে চাই না। 

নিউইয়র্ক টাইমস: কনেলি শেষ করে, কোন বইটি পড়বেন বলে ভেবেছেন?

মুরাকামি: এখন যে বইটিকে অবিরাম পড়ছি, তা পড়া শেষ করার পর, পরবর্তী পাঠের মাঝখানে খানিকটা বিরতি নিব; একটু সময় নিয়ে কোন বইটি পড়ব তা নিয়ে ভাবব। মধ্যবর্তী এই সময়টিতে আমি ভেতরে নানারকমের আলোড়ন টের পাই, যেন বহুকিছু ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে উঠছে। ভেতরে তখন অন্যরকম এক প্রত্যাশা তৈরি হয়। আমি বিরতির সময়টুকুতে সেই প্রত্যাশাকে ধরে রাখতে চাই। পরের বইটি কী হবে তা বেছে নেওয়ার আনন্দই সেই প্রত্যাশা। একটা দারুন উত্তেজনা, পরের বইটি বেছে নেওয়ার আনন্দময় অনুভব- বিষয়টি ভেতরে প্রবলভাবে কাজ করে।



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন