জলধি
/ সাক্ষাৎকার-এবং-অন্যান্য
/ লেখক ও পাঠকের দৃষ্টিতে একজন ফয়জুল ইসলাম
লেখক ও পাঠকের দৃষ্টিতে একজন ফয়জুল ইসলাম

"গ্রামের বাড়ি কোথায়?"
"গাজীপুরের কালিয়াকৈরে।"
"ও কাইলাকুর? কাইলাকুরের লোক আপনি ! তো এত সুন্দর করে 'কালিয়াকৈর' বলছেন কেন?" - প্রিয় কথাসাহিত্যিকের এমন রসিকতায় না হেসে পারিনি আবার ভীষণ অবাকও হয়েছিলাম । তবে ফয়জুল ইসলামের লেখার সাথে পরিচিত ছিলাম বলে কথাটার মর্মার্থ ধরতে পেরেছিলাম সাথে সাথে । তাঁর লেখা গল্পে তিনি বাংলাদেশের একেকটি আঞ্চলিক ভাষার যে একটি মিষ্টতা ও হাস্যরসাত্বক দিক আছে তা নিখুঁতভাবে তুলে আনতেন । কিন্তু রাজশাহী জেলার পাবনার মানুষ হয়ে যোজন যোজন দূরের কালিয়াকৈরের স্থানীয় জনমানুষের কথ্যভাষায়ও দখল রাখবেন তা অভাবনীয় ছিল আমার কাছে। আঞ্চলিক কথ্য ভাষা নিয়ে তিনি ভাবতেন এবং জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করতেন তা গল্প পড়ে বুঝেছিলাম কিন্তু তা এতোটা সম্মৃদ্ধ ছিল সেটা এই একটি কথায় বুঝেছিলাম ।
কর্মে মুক্তি কর্মেই পরিচয় - ইহজগতের গতিশীল সময়ের জীবনধারায় এ এক অবধারিত বাস্তব সত্য । তাই পাঠক হিসেবে মহান কথাসাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মই সর্বাগ্রে বিবেচ্য হলেও - যখন কোনো সাহিত্যিকের ব্যক্তিত্বটিও অনুসরণীয় হয় তখন দুটো দিক মিলে পাঠকের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অনন্য - চিন্তা চেতনায় ফেলেন স্থায়ী প্রভাব । কথাসাহিত্যিক ফয়জুল ইসলাম ছিলেন তেমনই একজন । ব্যক্তি ফয়জুল ইসলাম ও লেখক ফয়জুল ইসলাম - দুটো সত্ত্বা নিয়েই পাতার পর পাতা লেখা যাবে । তিনি চমৎকার কিছু গুণের আলোয় আলোকিত মানুষ ছিলেন ।
বিনয় তাঁর অন্যতম এক গুণ ছিল । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন দেশের বাইরে । সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো ছিলেন । কর্মজীবনে ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের চ্যায়ারম্যান ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন - শিক্ষা ও কর্মজীবনে এহেন সাফল্যের শিখরে পৌঁছেও তিনি মাটি ও জনমানুষের কাছাকাছি থেকেছেন সর্বদা - ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ জেনেছেন ও পড়েছেন । দিনশেষে জনমানুষের হতে চেয়েছেন । তা-ই তো গল্প উপন্যাসে মানবজীবনের বিচিত্র সুখ দুঃখগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন । সৃষ্টি করেছিলেন 'বখতিয়ার খান' এর মতো শক্তিশালী চরিত্র - না থেকেও যিনি পাঠকের হৃদয়ে ক্রিং ক্রিং বেল বাজান । ২০১৬ সালে 'খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক' নামক বইয়ের জন্য অর্জন করেন প্রথম আলো বর্ষ সেরা পুরস্কার । যে বইটি পাঠকমহলে আজও আলোচিত । কর্মজীবনের সফলতা নিয়ে বলতে গেলে সহাস্যে বিনয়ের সাথে বলতেন " আমি , আপনি আমরা সবাই-ই এক ।"
কৌতুহলী মন তাঁর কীট পতঙ্গের জীবন পর্যবেক্ষণপূর্বক 'ঋতুরেখায়" নামক অসাধারণ এক গল্প লিখিয়ে নিয়েছে । গল্পের বিষয় কীটপতঙ্গ ঘিরে কিন্তু অসাধারণ দক্ষতায় সম্পূর্ণ বিপরীত পতঙ্গ জীবনের সাথে মানবজীবনের তুলনা করে গভীর এক মেসেজ দিয়েছেন , জীবন নিয়ে হতাশ মানব মানবীদের জন্য । অভাবনীয় ভাবনা আর চরিত্রগুলোর ব্যতিক্রম নামকরণ সম্পন্ন গল্পটি আমার দৃষ্টিতে বর্তমান সময়ের অসাধারণ একটি ছোটো গল্প - যে গল্পের নাম আলাদাভাবে বলা যাবে সব সময় ।
ভিন্ন মতের প্রতি সম্মান তাঁকে অন্য উচ্চতায় রাখবে চিরকাল । তাঁর সাথে কথা হতো বাংলা সাহিত্য নিয়ে । একদিন 'জাদুবাস্তব' গল্প নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা করতে গিয়ে শহীদুল জহীরও বাদ গেল না আমার তরফ থেকে । তখন জানতাম না শহীদুল জহীর তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধার একজন । তিনি মনোযোগ দিয়ে আমার সব কথা শুনলেন কিন্তু তাঁর সুহৃদের সমালোচনায় আমি অপ্রিয় হলাম না । বলেছিলাম " ফয়জুল ভাই , জাদুবাস্তব গল্প ঘিরে আমার দীর্ঘ বছরের ধোঁয়াশা কেটে গেছে , মিলে গেছে আমার সকল প্রশ্নের জবাব । জাদুবাস্তব গল্পের মাস্টারকে খুঁজে পেয়েছি আমি ।" পাল্টা প্রশ্ন করে আমার যুক্তিগুলো শুনেছিলেন এবং বলেছিলেন - আপনার কথায় যুক্তি আছে । আমি পড়তে চাই আপনার জাদুবাস্তব গল্পের মাস্টার সেই ইউসুফ শরীফকে ।
অতঃপর শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ইউসুফ শরীফের 'প্রান্তিকজনের গল্প' বইটি কিনেছিলাম তাঁকে উপহার দেবো বলে । ঠিকানা লিখে কুরিয়ারের জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম কিন্তু বইটি সময় মতো দেয়া হয়নি । সে বইটি এখন কোন ঠিকানায় পাঠালে তিনি পাবেন তা আমি জানি না , পৃথিবীর কেউ জানে না ।
রসবোধ ছিল তাঁর অত্যন্ত সুক্ষ্ণ । দু'চোখের কোণে একটি শিশুসুলভ নির্মল হাসির ঝিলিক থাকত সব সময় । একদিন মজা করে লিখেছিলাম " ফয়জুল ভাই চুল পাকার বয়স আপনার শেষ । আর চিন্তা নেই । এ চুল আর পাকবে না, আপনি আর বুড়ো হবেন না ।" সত্যিই ফয়জুল ভাই আর কখনো বুড়ো হবেন না । অসময়ে চলে যাওয়া তাঁকে যখনই মনে পড়বে চোখের সামনে ভেসে উঠবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন , স্টাইলিস্ট , প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হাসিখুশি ফয়জুল ভাইয়ের মুখটি ।
অসময়ে বিদায় ঘন্টার সংবাদ পেয়ে সদা হাস্যোজ্জ্বল ফয়জুল ভাইয়ের মনে কেমন ঝড় বয়ে গিয়েছিল তার খানিকটা বুঝতে পারি পরিবারের সদস্যদের বয়ানে । হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি প্রশ্ন করতেন " আমি কি মরেই যাবো?" - প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা হাসিখুশি মানুষটির এহেন প্রশ্ন শুনে যমদূতও বোধ করি থমকে গিয়েছিল । তবু আমার মনে হয় অসময়ে চলে যাবার অসীম বেদনা থাকলেও প্রিয় কথাসাহিত্যিকের মনে একটি আত্মতৃপ্তি ছিল । তিনি জানতেন , তিনি সম্মানের সাথে মানুষের হৃদয়ে থেকে যাবেন আজীবন - কারণ লোভ-লালসা, হিংসা , অহংকারের বিরুদ্ধে তিনি জয়ী মানুষ । অসাধারণ হয়েও তিনি ছিলেন বিনয়ী, সজ্জন । এমন একজন মানুষকে ভুলে যাবে সে সাধ্য কার ? তিনি ফিরে ফিরে আসবেন বার বার হৃদয় থেকে হৃদয়ে ।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান