জলধি / সাক্ষাৎকার-এবং-অন্যান্য / বিষয় তারেক মাসুদ
Share:
বিষয় তারেক মাসুদ

বেঁচে থাকার জন্য দরকার গল্প বলা; ... এই সমাবেশ, সে অর্থে ‘গল্প-পোষ্য’ হওয়ার আয়োজনই বটে। ফরিদপুর ভাঙা উপজেলার মোড়ে, নূরপুর গ্রামে যাওয়ার আগে একটি নির্দেশনা লিপি দেখা যায় গত কয়েক বছর   ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের বাড়ি।’ ... তারেক মাসুদ এখন বন্ধনী দ্বারা আবদ্ধ : ‘ ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬ - ১৩ আগষ্ট ২০১১’ ; ভাবি মানুষ কত দ্রুত সন-তারিখের অঙ্কে নিখোঁজ হয়ে যায়! মিডিয়া স্টাডিজ’এর ভাষায়,  ...  এই মুহূর্ত, একটি ‘লাইভ প্রোগ্রাম’ বটে; সভায় তারেক মাসুদের জননী এবং সহোদর উপস্থিত আছেন, আর তাঁদের সামনেই তারেক মাসুদ সম্পর্কে আমাদের অস্পষ্ট কথা বলার সাহস সংগ্রহ করতে হবে, জননীর সামনে, সহোদরের সামনে আমাদের বক্তব্যে যেন যথেষ্ট ‘বুদ্ধিমত্তা’এর ছাপ প্রকাশ পায়। যে মা তারেকের মৃত্যু হয়েছে জেনেও,  ... অস্বীকার করে বসেন, তারেক মাসুদ ‘এখনও জীবিত’ - তাঁর সামনেই আমাদের বলতে হবে, ...তারেক মাসুদ ২০১১’এর আগস্টে মৃত্যুবরণ করেন। কখনও ভেবেছি --- তারেক মাসুদ সম্পর্কে আমার কথা বলার যোগ্যতা কী? প্রথম ব্যাখ্যা, ওঁর ছবিগুলো কখনও আমরা একদিন দেখেছিলাম, অর্থাৎ আমি তাঁর একজন অচীন দর্শক শ্রোতা; আর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা, আমরা দু’জনই, বিগতকালের ঢাকা শহরে  ‘মুহম্মদ খসরু’ নামক দীর্ণ-বিদীর্ণ এক-আশ্চর্য চলচ্চিত্র চাক্ষুষ করি একত্রে   আমি বলতাম মুহম্মদ খসরু আমাদের চলচ্চিত্র দেখার চক্ষুদান করেছিলেন, আর তারেক মাসুদ বলতেন, মুহম্মদ খসরুর ওভারকোর্ট থেকেই আমরা চলচ্চিত্রের নাম লেখাই। তারেক মাসুদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় মুহম্মদ খসরুর পৌরহিত্যে, সেই আশির শেষ-শেষ --- ছবি প্রদর্শনী, দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রেট্রোস্পেকটিভ, ওয়ার্কশপ ইত্যাদির পাঁকে। কখনো -প্রায়-প্রায়ই দেখা হয়, কখনো দীর্ঘ বিরতির পর, আবার কখনো হঠাৎই এক চলচ্চিত্র শেষের পর চায়ের অনুষ্ঠানে। আগস্টের রোড ট্রাফিক এ্যাক্সিডেন্ট, অথবা জননী নুরুন্নাহার মাসুদের ভাষায় রাস্তায় সংগঠিত গোপন হোমিসাইডে, তারেক যখন মৃত্যুর আহ্বান গ্রহণ করতে উদ্যত, তখন একই মোটরযানে ছিলেন ওঁর শিল্প-নির্দেশক সুখ্যাত শিল্পী ঢালী আল মামুন--- তাঁকেও এই সব ছবি দেখার বিবিধ মেলাতেই আবিষ্কার করি একই সঙ্গে। তারেক মাসুদ ছবি তৈরির জন্য প্রাণান্ত করছেন, গল্পে-গল্পে বুঝতে পারি; ... খুব সামান্যই ওঁর সঙ্গে কথা হয়, আমার ঊনমেধার কারণে, কিন্তু যোগাযোগটা অনেকখানি অব্যাহত থাকে ঢালী আল মামুন এবং দিলারা বেগম জলি, ... এই দম্পতির সাথে, বিশেষত তাদের অসামান্য ঔদার্যের কারণে। ওঁর সোনার বেড়ি, আদম সুরত, মুক্তির গান, রানওয়ে - ... এই চলচ্চিত্রের সিনেমাটোগ্রাফি, এই চলচ্চিত্রগুলোর ফর্ম, এর সার্থকতা-ব্যর্থতা, শট-বিভাজন, ... এই প্রসঙ্গে নিশ্চয় আমি কথা বলার অধিকার রাখি না; অন্য ভাবে, আজকের সমাবেশ, এই সমাবেশের যে প্রধান অভিমুখ, ... আপনারা নিশ্চয় মানবেন, এ প্রসঙ্গে বলা-বলিটা খুব বাঞ্জনীয় নয়। ... ওঁর ছবি নিয়ে, ছবির কারিগরী নিয়ে, ফোটোগ্রাফি নিয়ে, শুধুই আলাদা কোন সিম্পোজিয়াম- ওয়ার্কশপ হতে পারে কখনও।

এই মুহূর্তে আপনাদের সামনে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ প্রকাশিত ষাট-বাষট্টি পৃষ্ঠার একটি পকেট-বই  তারেক মাসুদ সম্পর্কে, ওঁর বন্ধু আলম খোরশেদ বলেছেন পনের পৃষ্ঠা আর বেশীর ভাগই মায়ের কান্না ভেজা-স্মৃতি এবং লড়াইয়ের গল্প, সেইসব কথা অনুলিখন করেই এই পুস্তিকা - শূন্যের ভেতর এত ঢেউ (জননী ও সখার স্মৃতি)। আলম খোরশেদ বন্ধুর কথাই বলেছেন, ... আর বাকি অংশ, এই পুস্তিকার বৃহত্তর অংশটুকু তারেক মাসুদ উপলক্ষ্য হলেও, আমি দেখি জননী নুরুন্নাহার মাসুদের বিপুল অভিজ্ঞান ও সাধনা-ই যেন সব চেয়ে উজ্জ্বলতর। মা শুরু করেছেন তাঁর শৈশব দিয়ে। কলকাতা গেছেন, বোনের কাছে বড় হচ্ছেন আত্মজার আদরে, ... আর তখনই শুরু ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং --- বোন ভেবেছেন, দাঙ্গায়  ‘যে সব কাণ্ড হচ্ছে তা দেখে ও ভয়ে মারা যাবে।’

কোলকাতার রক্তপাত তাঁকে ঘরে ফেরায়; ... বোনের সঙ্গে দীর্ঘদিন অবস্থানের কারণে নিজের জননীকে ‘মা’ সম্মোধনে দ্বিধান্বিত হচ্ছেন। ক্লাশ ফোর অবধি পড়ার পর, ... লেখাপড়া ক্ষান্ত এবং তাঁর যখন বিয়ে হচ্ছে তখন বয়স পনের। তিনি বলছেন - ‘আমার ভাসুরের মেয়েরা তখন আমার বয়েসী.. । বিয়ের ছয় মাস পর মায়ের মৃত্যু এবং কী ভেবে, শোকগ্রস্ত তারেকের বাবা, ভাঙ্গা হাই স্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক, যিনি কবি নজরুলকেও দেখেছিলেন কাছ থেকে, তিনি বদল হতে হতে তাবলিগের কাফেলায়  নাম অন্তর্ভূক্ত করেন। বাবা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তারেককে পড়তে হবে মাদ্রাসায়। বাবার অনুপস্থিতে মা তাকে  হাতে খড়ি দেন - ‘ ওকে আমি অ আ ক খ আর এ বি সি ঘরে বসিয়ে চুরি করে শিখিয়েছি।’ মা বলেন মাটির ময়না ওর জীবন নিয়েই তৈরি। একটি মৃত্যুদৃশ্য আছে তারেকের শৈশবে, যেখানে পুরো দৃশ্য-ই যেন চলচ্চিত্র! বোন আসমা অসুস্থ। বাবা হোমিওপ্যাথের পক্ষে। ( আপনাদের আরোগ্য নিকেতন মনে আছে - তারাশঙ্করের, ... অসুখ হলে কবিরাজ জগদ্বন্ধু না ডাক্তার-কবিরাজ জীবন মশায়, - জগৎ খাবি না জীবন খাবি ...?) চিকিৎসা বিভ্রাটে অবশেষে বোনের মৃত্যু হয় এবং সেই মৃতদেহ নিয়ে নৌকা যাত্রা। জল থই থই। দুটি নৌকা পাশাপাশি। কবর দেয়ার জন্য শুকনো মাটির আশায় নৌকা ভেসে যাচ্ছে, আর নৌকায় আসমার বাক্সবন্দী মৃতদেহ। শৈশবের তারেক সহোদরার বাক্সের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখার জন্য একবার বায়না করে। বারবার নৌকা বদলায়। কান্না করে, তারপর আবার ছিটকে যেয়ে অপর নৌকায় বাক্সের ছিদ্র দিয়ে বোনকে স্পর্শ করার আয়োজন নেয় --- লাইফ মাই সিস্টার, হয় কি, পাস্তারনাক কখনও আমার কাছে এই ভাবে সাড়া দেয়!

বইয়ের এই অংশ থেকে বেরিয়ে দেখি, এবার তারেক চলেছেন বিদ্যাচর্চার খেলাধুলায় --- কওমি মাদ্রাসায় ম্যাট্রিক ...  তারপর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট ... নটরডেম হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে ইতিহাস বিভাগের ছাত্রকাল পর্যন্ত এই ভ্রমন তারেকের নিজস্ব উজান স্রােত। তারেক ১৯৭১’এ ১৫-১৬ বছরের তরুণ যুবা, ... দেখা যাবে মুক্তিযোদ্ধা কাজিনের সঙ্গে মাঝে মাঝে পলায়ন করছে। মা বলছেন, তাঁর মামা শ্বশুর ছিলেন রাজাকার, কিন্তু ‘ভাল রাজাকার’ । এই দাদাকে বাঁচাতে পারেন নি তারেক। মা বলছেন - ‘বাচ্চারা যাতে ছবিওয়ালা কাপড় না পরে ...’  সে ব্যপারে ওঁর বাবার সজাগ থাকতেন। একবার সেজো মেয়ের গায়ে হাঁসের ছবি দেখে, সেই জামা তিনি আগুনে পুড়িয়ে ছিলেন। ‘সত্যজিতের পথের পাঁচালির সিডি এনে তারেক একবার বাড়ির সবাইকে দেখিয়েছিল। দেখানোর আগে আমাকে বলে গিয়েছিল মা তুমি কাঁদবা না। কারণ ওখানে অপুর বোন দূর্গা মারা গিয়েছে। ঠিক এরকমই আমার মেয়ে আসমা মারা গিয়েছিল।’ তারেক সেটা অনুভব করে ভেবেছে আমি হয়তো কাঁদবো।

মা কি সেদিন ফুঁপিয়ে উঠেছিলেন সামান্য, নাকি তিনি আরও শক্তি ধারণ করেছিলেন? মা চোখের জল আড়াল করতে করতে তখন বললেন - ‘তারেকের বিয়েটা আরেক ঘটনা।’ আমরা এই অঘটন-ঘটনের পুরোহিত হিসেবে পাই মহাত্মা আহমদ ছফাকে। এক লাখ একটাকা কাবিনে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ক্যাথরিন’এর সঙ্গে জড়িয়ে ফেললেন জীবন-গাঁথা। আলম খোরশেদের ভাষ্য - ক্যাথরিন আসলে একটা আশির্বাদ হিসেবে এসেছে তারেকের জীবনে...।’ দু’জনে অর্থ জোগাড়ে নেমেছেন। জমি বিক্রি হল মিরপুরের সাড়ে তিন কাঠা। সব সঞ্চয়ের টাকা একত্র করেছেন চলচ্চিত্রের জন্য। ২৫ বছর পর ওদের সন্তান নিষাদ। ঘরের-বাইরের কাজ দু’জনা ভাগ করে নিয়েছে। এর মধ্যেই ক্যাথরিনের পিয়ানো বাদন --- সেই দৃশ্যে মা বলেন - ‘ ও রকম মেয়ে কী বাংলাদেশে আছে !’

মোটা দাগে --- ভাঙ্গা উপজেলার নূরনগর গ্রামে চিরশায়িত তারেক মাসুদের ইতিহাস-পঞ্জী এইভাবে চিত্রিত করা যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, লিয়ার লেভিন’এর ষাট লাখ টাকা যোগাড়ে সে হত্যে দিয়েছিল। আদম সুরতের কালে সুলতানের কাজ সংগ্রহের জন্য কলকাতা-পাকিস্তান করেছেন, যখন বাংলাদেশ জুড়ে স্বৈরাচারী আন্দোলন তুঙ্গে। চলচ্চিত্রের ওম খুঁজতে খুঁজতে, কবে ১৯৮৯, চলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্র; তারেকের চাকুরি, নিউইয়র্কের সুবিখ্যাত পুরনো বইয়ের দোকানে, ... স্ট্রান্ড বুক স্টোর, ... এখানে বই পাশাপাশি দাঁড় করালে হবে আট মাইল; এই অদৃশ্য আট মাইল গ্রন্থাগারে, তাঁর পাওনা ছিল ঘন্টা প্রতি ৭-৮ ডলার। আলম খোরশেদের ভাষ্যে, গ্রিনিচ ভিলেজের বেইসমেন্টে ছবি দেখার কথা পাই, আর এক আশ্চর্য কান্নার গল্প  নিকারাগুয়ার বিপ্লব ধ্বংস হওয়ার পর তিনি কান্না করেছেন। লক্ষ্য করি, পরিণত সময়ে তারেক মাসুদ লাতিন আমেরিকার ফিল্ম মেকারদের মত ছবি ফেরি করেছেন। চলচ্চিত্র নিয়ে এরকম ‘সমবায়’ ভাবনা, উপমহাদেশে আমরা একমাত্র আদুর গোপাল ও আব্রাহামের জীবন-যাপনেই খুঁজে পাই।

মায়ের জবানে, তারেক মাসুদকে এবার আমি নানান বয়ানে ভাবতে শুরু করি; ... ভাবনা করছি তা হয়ত নয়, নানান অনুষঙ্গ আসলে সামনে আসতে শুরু করে   বাবা-মা একত্রে তাহাজ্জুদ পড়ছেন, আর তারেক বলছেন সিনেমা আমার ধর্ম। অধিক সখ্যতা থাকলে, কখনও কী ওঁর ‘ফাদার কমপ্লেক্স’ নিয়ে প্রশ্ন করতাম? ... প্রতি বছর সেইন্ট যোজেফ’এর সম্মানে ১৯ শে মার্চ ‘ফাদার্স ডে’ আসে, আর গ্রিটিংস-ইন্ডাস্ট্রি কয়েক লক্ষ-কোটি মুদ্রার ব্যবসা ছড়িয়ে দেয় জগৎ-সংসারে। নিৎসের কথা --- ভাল বাবা না থাকলে, অবশ্যই তোমাকে একজনকে সৃষ্টি করতে হবে। তারেক সামনে থাকলে, ওকে তুর্গেনিভের ‘ফাদার এন্ড সন্স’ এর পাঠ প্রতিক্রিয়া জিজ্ঞেস করতাম; হয়ত কৃত্রিম পান্ডিত্য প্রকাশের জন্য বলতাম, সাড়ে সাতচল্লিশ পৃষ্ঠার ঐ চিঠির কথা মনে পড়ে? - ... কাফকার  (লেটার্স টু ফাদার) - ... বাবা সম্পর্কে এক জায়গায় লিখছেন, ...  dearest Father, … what was always incomprehensible to me was your total lack of feeling for the suffering and shame you could inflict on me with yours words and judgement ;অথবা The First Man’এর ১ম পরিচ্ছেদ - আলবেয়ার কামু বাবাকে খুঁজছেন … Search For Father - জিজ্ঞেস করা হয় না; দেখি - জগত সংসার ঘুরে এসে তারেক তাঁর ১০০ বছরের বাবার গায়ে সর্ষের তেল মেখে স্নান করাতে বসেছেন। বাবাকে ক্ষমা করার এই শক্তি-ই হয়ত, আমার ধারণা, তারেককে দেয় অপার জীবনীশক্তি --- পরিকল্পনা করছেন কাগজের ফুল, এবং নিমজ্জিত হয়েছেন তিন ‘দিন’ কে নিয়ে অপর এক চলচ্চিত্রের স্বপ্নে জয়নুল আবেদীন, জসীমউদ্দিন আর আব্বাসউদ্দিন। আমার ধারণায় এই আয়োজনের অপর নাম ‘বাঙালী মুসলমানের মন - পুনর্বিবেচনা।’ - ... এই অভিমুখেই তাঁর ঐতিহাসিক সত্তা কী ধাবিত হচ্ছিল? হয়ত একটি ছবি-ই মানুষ শেষ পর্যন্ত বানায়,  একটি গ্রন্থ-ই রচনা করে শেষ পর্যন্ত ... ছোট-বড় নানান ভাংচুরের পরেও। হয়ত সকল ছবিই একাধারে স্বপ্ন ও সঙ্গীত। কোথাও কী এমন পড়েছিলাম? ... সিনেমায় সব চেয়ে কঠিন - কুসংস্কার, স্বজ্ঞা ,ভাগ্য, আশঙ্কা এবং স্বপ্ন বর্ণনার করণ কৌশল সঠিক বুঝতে পারা। মনে মনে বলি, ক্যামেরা কবির চোখের মত, নাকি পুরো জীবন-ই চলচ্চিত্র দেখার মত। চলচ্চিত্রও একটি ভাষা, ‘লেখা’ তৈরির মত-ই অন্তর্গত ধ্যানমগ্নতা। চলচ্চিত্রকার যখন ‘লেখক’ হয়, সর্বাগ্রে তিনি নিজেই হন ‘লিখিত’। হাঁটুমুড়ে থাকা আমাদের নির্জনতাকে ‘চলচ্চিত্রকার-লেখক’ জাগ্রত করে। তারেক মাসুদ এই ভাবেই ‘অথার-ফিল্মমেকার’এর স্বপ্নে বুঁদ হয়েছিলেন। আমি বলি - সকল শিল্পীর মত আমরা অপরাপর বন্ধুদের আত্মাকেও সারাজীবন ধারণ করি। মা যখন বলেন, ‘রানওয়ে’র জন্যই ওর মৃত্যু অথবা হত্যাযজ্ঞ - আমরা বলি ওঁর মৃত্যু আমাদের খানিকটা অংশের মৃত্যুও বটে! ফলে কোন মানুষেরই ‘পূর্ণ’ মৃত্যু হয় না কখনো, বড় অংশ কবর-ঘাস-কফিন ভেদ করে বাইরে আসে; জীবনের ইতি হয় বটে, কিন্তু সম্পর্কের জগৎ শেষ হয় না।  তারেক মাসুদ যা চিন্তা করেছিলেন, যা হতে চাইতেন, যা হতে পারতেন, যা একদিন ভেবেছিলেন, যা তাঁর সম্পর্কে অপরে ভাবতো - ... এর সব ক’টা পরীক্ষা উতরে, তিনি বেঁচেছিলেন; ভীষণভাবে বেঁচেছিলেন - কারণ বেশির ভাগ মানুষই জানে না সে বেঁচে ছিল কিনা! আমাদের এই সব হোঁচট খাওয়া এলোমেলো শূন্যস্থান, আমি ভেবেছি, অপরাপর বিবিধ সৃজনশীল প্রকরণের মত পূরণ করে সিনেমা।

তারেক কী জীবনের স্বপ্ন প্রসঙ্গে কখনও ভেবেছিলেন? - ... ‘টু মেক আ ফিল্ম এ্যান্ড গো-ব্যাক টু মাই মাদার্স উম্ব’; গুণী শিল্পী হিরন মিত্র, এরকম করে ভাবলেও, তারেক মাসুদকে সহসা জিজ্ঞেস করার অবকাশ হয় না। হয়ত এই নিখোঁজ গল্প বলার জন্যই আমরা বেঁচে থাকি, বেঁচে থাকার অমলীন স্বপ্ন নির্মাণ করি। ‘ শূন্যের ভেতর এত ঢেউ ’- খুঁজে পেতে আবিস্কার করার জন্য অপর মাদ্রাসা ত্যাগী, ‘মিডিয়া ইজ দ্যা ম্যাসেজ’ পড়ুয়া যুবক ইব্রাহিম খলিলকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে।

অজুত কৃতজ্ঞতা জননী নুরুন্নাহার মাসুদকে, যিনি তাবৎ ক্ষতি-শূন্যতা স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে ধারণ করে, আমাদেরকে বুঝিয়েছেন - পুরো জীবন একটি চলচ্চিত্র বটে, যখন প্রায়শ: ভালবাসার সঙ্গীত হয়ে যায় বেদনার, আর বেদনার সঙ্গীত হয়ে যায় ভালবাসার। - ‘তারেকের দেখানো পথে চলো - ভাল থাকবা।’ - মায়ের এই পরামর্শপত্র এবার আমরা বুক পকেটে সঞ্চয় করি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ম্যাজিক লন্ঠন’ আয়োজিত ‘শূন্যের ভিতর এতো ঢেউ’ -

এই পুস্তিকা প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তৃতার অনুলিখন ও পরিমার্জন, ০৩/৯/২০১৯



অলংকরণঃ তাইফ আদনান