জলধি / সাক্ষাৎকার-এবং-অন্যান্য / নোবেলজয়ী ফরাসি লেখক আনি এরন্যু’র সাক্ষাৎকার
Share:
নোবেলজয়ী ফরাসি লেখক আনি এরন্যু’র সাক্ষাৎকার

সানডে বুক রিভিউ, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টে কী কারণে জানি ট্রেন থেমে থাকলো ৭মিনিট, তারপরেই প্যারিস মেট্রো- পেরিয়ে যাবে কনকর্ড, শাতলে, মিউজিয়াম ল্যুভ, সেন্ট পল, বাস্তিল...

বাস্তিল! ট্রেন চলে যাবে ফরাসি বিপ্লবের দিকে

এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। এখনও পৃথিবীতে বৃষ্টি নামে! কেন? বৃষ্টির কী দরকার? আমাদের দরকার তেজস্ক্রিয়তা! জ্বলে ছাড়খার হয়ে যাওয়া দেশ! বৃষ্টি নামে কি বিমান হামলায় তামা হয়ে যাওয়া শরণার্থী শিবিরগুলোর জন্য? বোমায় বিধ্বস্ত আরোগ্য নিকেতনের জন্য? বৃষ্টির জল কি আজলা ভরে পান করলো কেউ? গণহত্যার ছবি দেখে দেখে আমরা বৃষ্টির গান শুনি বলেই কি... 

এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ ইলিয়াসকে মনে পড়ল; আর সেই কুকুরটিকে, কুকুরটি ধূসর; লিখছেন ইলিয়াস- এই রূপচাঁদ লেন, শুকলাল দাস লেন রূপলাল দাস লেনের সঙ্গমে টিনের ড্রামের ডাস্টবিনে মুখ থুবড়ে আটকে রয়েছে ১টি ঢুসর কুকুর। কুকুর মৃত এবং বয়সে নবীন। তার সামনের পাজোড়া আটকানো ডাস্টবিনের মাথায়। হঠাৎ মনে হয়, সামনের পায়ে ডাস্টবিনের দেওয়াল ধরে চাঁদ দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে সে মুখ থুবড়ে মরে গেছে।     

মন কী আশ্চর্য জিনিস, হঠাৎ মনে হলো বেঁচে থাকা ব্যাপারটাই বিস্ময়কর! এতো এতো মৃত্যু, গণহত্যা... বাস্তিল পার হতে হতে... বাবার আঙুল ধরে সেই যে কতকাল আগের ছেলেবেলার এক সন্ধ্যায় আমরা পথ হেঁটেছিলাম! মায়ের শরীরের আশ্চর্য ঘ্রাণ পেয়েছিলাম আমরা। 

ভেতরে কে যেন এখন বাঁশি বাজায়। কে যেন গায়-

ওম মানি পদ্মে হাম ওম মানি পদ্মে হাম

বাস্তিল পার হতে হতে হঠাৎ মনে পড়ে, আজ ভুল করবো, আজ যেখানে নামার কথা, মন আমাকে ভুলিয়ে দেবে সব, এই গভীর রাতে মেট্রো রেল আমাকে নিয়ে যাবে মঁপার্নাস, যেখানে বোদলেয়ার শুয়ে আছেন কিংবা পৌঁছে যাব গাজার সেই আরোগ্য নিকেতনে যেখানে মানুষের অসামান কীর্তি মুহূর্তে কেড়ে নিয়েছে কয়েক হাজার প্রাণ; আহ, মেগাডেথ! সাগরে ভাসছে রণতরী, আর আমাদের মাথায় নিদ্রাকুসুম! বসে আছেন সব নেতা মহানেতা পারমাণবিক বোমার বোতামটি টিপবেন, তার অপেক্ষায়; এদিকে ঘড়ির কাটায় টিক টিক টিক টিক... শ্বাসরুদ্ধকর সময়...আসছে বোমারু বিমান...এবার ঘুমোও...    

ঘরে ফিরে, মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়- বেঁচে থাকাটা কী দারুণ আনন্দের!

ওম মানি পদ্মে হাম, ওম মানি পদ্মে হাম;

ওম মানি পেদ্মে হাম...

উত্তর-প্যারিসে, রাতের বাস থেকে নামতে নামতে মাতাল লোকটি চিৎকার করছিল... প্রচণ্ড ক্রোধে মদের খালি বোতলটি হিটলারের ফ্রাঙ্কফুর্টের মতো ধ্বংস করে ফেলে নীরবতার মুখে ভাষা দিচ্ছিল লোকটি। মনে হচ্ছিল ইতিহাসকে অনাবৃত করছে সে। স্মৃতি আর বিস্মৃতির দোলাচলে টলছে।

সামনে- মাহমুদ দারবিশ স্কোয়ার, ভেতরে- অবর্ণনীয় একাকীত্বের অনুভূতি। স্মৃতি। বিস্মরণ। সাহিত্য না কি বিস্মরণের বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই!

এই লড়াই নিয়ে ডায়েরিতে লিখছিলেন নোবেলজয়ী আনি এরন্যু- ‘আমাদের মৃত্যু হলে ছবিগুলো হারিয়ে যায়, আর এই হারিয়ে যাওয়া থেকেই আমার লেখার শুরু। আমার সমস্ত লেখার অনুপ্রেরণা হচ্ছে- সবকিছু হারিয়ে ফেলার অনুভূতি, কারণ আমরা সব কিছু ভুলে যাই। ভুলে যাই বলে সব হারিয়ে যায়। মুছে যায়। আমাদের জীবনে স্মৃতির চেয়ে বিস্মরণ বিপুল। আমার লেখা হলো বিস্মরণের বিরুদ্ধে লড়াই।

নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় আনি এরন্যুর এই ছোট্ট কিন্তু আসামান্য সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয় গত ১২ নভেম্বর।

সানডে বুক রিভিউ:

এখন কী পড়ছেন? খাটের পাশের টেবিলে কোন বইগুলো এনে রেখেছেন?

আনি এরন্যু:

এই মুহূর্তে ৬০ বছর আগে পড়া একটি বই আবার পড়ছি, মিগেল দ্য উনামুনোট্র্যাজিক সেন্স অফ লাইফ’; সেই সঙ্গে একটি আখ্যানও পড়ছি যা সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে- ‘আকাশ থেকে পতিত’ (Tombé du Ciel), একটু একটু করে লেখাটি পড়ছি, বাবাকে জানার জন্য সন্তানের অনুসন্ধান সম্পর্কিত লেখা যার বাবা ভবনের ছাদে স্লেটপাথরের ফালি বসাবার কাজ করতেন, ৩০ বছর বয়সে ছাদ থেকে পিছলে পড়ে মারা যান।

সানডে বুক রিভিউ:

এগুলো শেষ করে কোন বইটি পড়বেন বলে ভাবছেন?

আনি এরন্যু:

সুইডিশ লেখক সারা স্ট্রিডবার্গের একটি উপন্যাস পড়ব; সারারদ্য অ্যান্টার্কটিকা অফ লাভ' আমার অসম্ভব প্রিয় একটি বই।

সানডে বুক রিভিউ:

সর্বশেষ কোন শ্রেষ্ঠ বইটি আপনি পড়েছেন?

আনি এরন্যু:

নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বইটি 'বিষণ্ণ বাঘ', নেইজ সিনোর উপন্যাস; তিনি একজন ফরাসি লেখক, এখন মেক্সিকোয় থাকেন; 'বিষণ্ণ বাঘ' লিখতে সিনো ২০ বছর লেগেছে- সৎ বাবার দ্বারা তার উপর সংঘটিত সাত বছরের ধর্ষণের বিবরণ। বইটি এই গ্রীষ্মে ফ্রান্সে বেরিয়েছে, এমন শক্তিশালী এবং গভীর উপলব্ধির একটি বই আমি আর পড়েছি কি না জানি না যার প্রতিটি বাক্য আমাকে বলে চলেছে- একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দ্বারা কীভাবে কারও শৈশবকাল ধ্বংস করে দেওয়া যায়

সানডে বুক রিভিউ:

এমন কোনও ক্ল্যাসিক উপন্যাস আছে কি যা আপনি এই প্রথম বার পড়লেন?

আনি এরন্যু:

না, এরকম কিছু পড়িনি।

সানডে বুক রিভিউ:

আপনার এমন একটি প্রিয় বইয়ের নাম বলুন যার কথা অনেকেই জানে না!

আনি এরন্যু:

মারগানিতা লাস্কিরলিটল বয় লস্ট’; উদ্ধত মনে হতে পারে, তবুও বলছি- আজ অনেকেই এই লেখক সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না।

সানডে বুক রিভিউ:

আজকের কোন লেখকের (ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সমালোচক, সাংবাদিক, কবি) কাজ আপনার ভালো লাগে? আপনি যার লেখার প্রশংসা করেন?

আনি এরন্যু:

মারি দাইয়ি, জুলিয়া ওথসুকা, ফ্লোরন্স য়ুবিনা, পিটার হান্ডকে।

সানডে বুক রিভিউ:

আত্মজীবন অবলম্বনে ফিকশন লেখেন, এমন কয়েকজন লেখকের নাম বলবেন?

আনি এরন্যু:

কামিই লুরোঁ, মারিয়া পোরশে, এদুয়া লুই।

সানডে বুক রিভিউ:

সমকালীন কোন কোন ফরাসি লেখক আরও বড় পাঠক পরিসর পাওয়ার দাবি করেন?

আনি এরন্যু:

দমিনিক বারবারিস, পাসকাল কুইনার।

সানডে বুক রিভিউ:

আমাদের জীবনে স্মৃতিকথাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন কোন কোন লেখক?

আনি এরন্যু:

এক্ষেত্রে, অবশ্যই প্রুস্ত! তারপর- পাত্রিক মদিয়ানো।

সানডে বুক রিভিউ:

কোনোদিন বিশেষ কোনও এটি বই পড়াকে লজ্জাজনক মনে করেছিলেন?

আনি এরন্যু:

না; অতীতের সমস্ত পাঠ এবং আজ যে বইগুলো পড়ব, সবই আমার কাছে গভীর আনন্দের বিষয়।

সানডে বুক রিভিউ:

বইয়ের কারণে কারও সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক কিংবা দূরত্ব তৈরি হয়েছে?

আনি এরন্যু:

কেউ একজন যাকে আমি খুব একটা পছন্দ করি না, তিনি যদি এমন একটি বই পছন্দ করেন যা আমারও ভীষণ প্রিয়, তখন তার প্রতি কিছুটা আবেগ জন্ম নেয়, তিনি আমার প্রিয় হতে থাকেন। একটি কথা বলি- আমি এতো বিশাল কিছু হয়ে যাইনি যে একটি বই কারও সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরাবে বা দূরত্ব তৈরি করবে।

কখনও খুব মন খারাপ করি যখন কেউ আমার প্রিয় বইটিকে পছন্দ করে না, আবার আমার অপছন্দের বইটিকে যখন কেউ প্রশংসা করে। আসলে বিশ্বকে আমরা কেউই একভাবে দেখি না, নিজেদের মতো করে দেখি; সবার দেখাটা কিন্তু এক নয়, সমান নয়। ব্যাপারটি আসলে এক গভীর মতবিরোধ, আর আমি এই মতবিরোধের বিষয়টি সব সময় মাথায় রাখি, কখনওই ভুলে যাই না।

সানডে বুক রিভিউ:

সম্প্রতি পড়া কোনও বই থেকে মনে রাখার মতো তাৎপর্যপূর্ণ কিছু পেয়েছেন?

আনি এরন্যু:

না, আমি কখনওই মনে করি না যে বই পড়ে বিশেষ কিছু শিখছি কিন্তু একটা কিছু এমন তো হয়, ভেতরে ভেতরে, যতক্ষণ পড়ি, যতক্ষণ পাঠ চলতে থাকে, আমার ভেতরে আর বাহিরে তখন একটা গভীর আলোড়ন, অদল বদল- জীবনেরই এক একটি অভিজ্ঞতা।

সানডে বুক রিভিউ:

সাহিত্যকর্মের কোন দিকটি আপনাকে তুমুল আলোড়িত করে?

আনি এরন্যু:

এমন কিছু একটা ঘটে, টেক্সট বহুকিছু ভেঙে দেয়, বদলে ফেলে- এটাই আমাকে বেশি আলোড়িত করে।

সানডে বুক রিভিউ:

সংগ্রহের বইগুলো শেলফে কীভাবে রাখেন?

আনি এরন্যু:

ফরাসি সাহিত্য, অন্য দেশের সাহিত্য, গদ্যলেখা, কবিতা সংগ্রহ, চিত্রকলা, অন্যান্য- পদ্ধতিতে আলাদা আলাদা করে, তারপর বর্ণানুক্রম পদ্ধতিতে বইগুলোকে মিলিয়ে রাখি; তাতে হয় কী, যে-বইটি খুঁজছি, খুব সহজে তাকে পেয়ে যাই।

সানডে বুক রিভিউ:

আপনার বুক শেলফে কোন বইটি দেখে যে কেউ বিস্মিত হবে?

আনি এরন্যু:

কে কোন বই দেখে বিস্মিত হবে তা তো আমার জানা নেই; এটা তাদের ব্যাপার, আমার কিছুই করার নেই।

সানডে বুক রিভিউ:

উপহার হিসেবে পাওয়া আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ বই কোনটি?

আনি এরন্যু:

লা রশেরশ দু তঁ প্যেরদু’ (হারিয়ে যাওয়া সময়ের খোঁজে), ২৫ তম জন্মদিনে আমার স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছিলাম।

সানডে বুক রিভিউ:

শৈশবে আপনি কী কী বই পড়তেন? ছেলেবেলার কোন কোন বই এবং লেখক এখনও মুগ্ধ করেন?

আনি এরন্যু:

আমি একজন চির-অতৃপ্ত পাঠক যার পড়ার বিষয় বই, নারী বিষয়ক ম্যাগাজিন, স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা আর স্মৃতির কথা বলতে গেলে- শার্লট ব্রন্টির জেন আয়ার, ডিকেন্সের ওলিভার টুইস্ট, মার্গারিট মিশেলের গন উইথ দ্য উইন্ড; এগুলোর কথা এখন আর তেমন করে ভাবি না, তারা আমার দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি থেকে চলে গেছে, আমি ভেবেছিলাম লেখকরা এমন কিছুর কথা বলেছেন যাদের সত্যিকার অস্তিত্ব ছিল।

সানডে বুক রিভিউ:

ধরুন শুধুমাত্র লেখকদের জন্য আপনি নৈশভোজের আয়োজন করছেন, তো সেখানে কোন তিন জন (জীবিত কিংবা বেঁচে নেই) লেখক আমন্ত্রিত হবেন?

আনি এরন্যু:

ফ্লবের, ভার্জিনিয়া উলফ, কামু।

সানডে বুক রিভিউ:

আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলুন, ঠিক কোন পরিবেশে পড়তে পছন্দ করেন?

আনি এরন্যু:

প্রথম শর্তই হচ্ছে- নীরবতা, কখন পড়ছি কোথায় পড়ছি- তা কোনও সমস্যা নয়। আবার দেখুন, বইটিকে দু-হাঁটুর উপর রেখে এমনভাবে আমাকে বসতে হবে যেন স্বচ্ছন্দে পাতার পর পাতা পড়ে যাওয়া যায়, কিন্তু টেবিলে নয়। বই থাকবে হাঁটুর উপর, আর অবশ্যই একটি কাঠপেন্সিল থাকতে হবে যাতে পড়তে পড়তে আমাকে বইটির বিভিন্ন জায়গায়, পরিচ্ছেদে পরিচ্ছেদে অধোরেখা টানতে পারি, পাশে লিখে রাখতে পারি নানান উপলব্ধি। বইটির গভীর উপলব্ধির জায়গায় পৌঁছাতে হলে সময় নিয়ে পড়তে হবে , পাঠের আনন্দ পেতে হবে যদিও আরও বহু অপঠিত লেখা পাঠকের অপেক্ষা করছে। 



অলংকরণঃ তাইফ আদনান