জলধি / ভ্রমণ / মরুভূমির দেশে এক অনন্য রাত
Share:
মরুভূমির দেশে এক অনন্য রাত

আজকের কাহিনি আফ্রিকার। আফ্রিকা বলতে যদিও স্বাভাবিক ভাবেই সবার মনে আছে আফ্রিকান সাফারি বা আফ্রিকার জঙ্গলের কথা কিন্তু আমার আফ্রিকাতে প্রথম বার পা রাখা মিশর দেখতে। সেই ভ্রমণেরই একটা অনন্য অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি। তবে এবার ডায়েরির পাতা তুলে দিচ্ছি না সরাসরি। কারণটা বোঝা যাবে লেখাটা পড়ার পরই।

২০১২ সালের অক্টোবর মাসে পুজোর ছুটির সময় গিয়েছিলাম মিশর। এখান থেকেই হোটেল এবং গাইডের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ভ্রমণ সংস্থা। এয়ারপোর্টেই আলাপ হল আমাদের ওই ক দিন মিশর বাসের গাইড আলির সঙ্গে। আলির একটা মস্ত বড় নাম আছে এবং সেই নামটা ও আমাদের বলেওছিল। সঙ্গে সঙ্গে এও বলেছিল যে ওকে সবাই আলি বলে ডাকে এবং আমরাও তাই ডাকতে পারি। দু দিনের মধ্যে আলির সঙ্গে খুব দোস্তি হয়ে গেল আমাদের। ও আমাকে কখনো মাম্মি কখনো কখনো ‘মাত’ (মিশরীয় ভাষায় ‘মাত’ বা ‘মাওত’ মানে মা। আমাদের সংস্কৃত ভাষায় মাতৃসম্বোধন ‘মাতঃ’ র কাছাকাছি শব্দটা ! কী পুলক যে জেগেছিল ! 

সবাই মিশরে গিয়ে যা যা দেখে মানে পিরামিড, স্ফিংস ইত্যাদি সেগুলো দেখা হল। দেখলাম কায়রোর বেশ কয়েকটা মিউজিয়ামও। আলির তত্বাবধানে মিশরের সাবেকি খানাও চেখে দেখা হয়ে গেছে একেবারে সাধারণ সব রেস্তোরাঁয়। দেখা হয়েছে ঈদের বাজারও, বিশেষ করে মহিলাদের পরিচালনায় বিশেষ একটা বাজার যেখানে পুরুষরা ঢুকতে পারে না (এই বাজারটা দেখা আমার আর ঊর্মির বিশেষ ব্যাপার ছিল। বাড়ির পুরুষটিকে মিশরের বিখ্যাত হুক্কা বার-এ বসিয়ে আমরা গিয়েছিলাম সেই বাজারে)। এবার আমাদের ট্রেনে করে অসোয়ান গিয়ে নীলনদের উপর দিয়ে লাক্সর প্রভৃতি পুরোনো সব শহর দেখে আবার কায়রো ফিরে আসার পর টার্কির প্লেন ধরার কথা। কায়রোতে শেষ দিনে আমাদের দ্রষ্টব্য ছিল একটু দূরে অবস্থিত মেম্ফিস শহর আর প্রাচীনতম পিরামিডগুলির অন্যতম সাক্কারা দেখা।

সাক্কারা দেখে ফেরার সময় আলি বলল, ‘আপনারা তো কাল চলে যাবেন কায়রো থেকে। আজ যাবেন একটা মরূদ্যান দেখতে ? ওখানে আমার বাড়ি। গাড়ি কিন্তু যাবে না ওখানে। উটে অথবা ঘোড়ায় চেপে যেতে হবে।’ আমরা তো এক পায়ে খাড়া। আলি বলল যে ও সন্ধে ছটা নাগাদ আসবে আমাদের নিতে। আজ ওই নতুন জায়গাতেই রাতের খাবারের ব্যবস্থা।

ঠিক সময়েই এল আলি। আমাদের হোটেলটা গিজার পিরামিড থেকে বেশ কাছেই। আমরা প্রায় আধ ঘণ্টা খানেক হেঁটে চললাম। আমাদের বাঁ দিকে গিজার পিরামিডের উপর শেষ বেলার আলো ফিকে হয়ে আসছিল তখন। শহর ছাড়িয়ে মরুভূমির কাছে এসে পড়লাম আমরা। কল্যাণ, ঊর্মি আর আলির জন্য তিনটে ঘোড়া প্রস্তুত আর আমাকে যেতে হবে জন্য উট বাবাজির পিঠে। এই রাস্তায় টুরিস্টরা যায় না। যায় স্থানীয় লোকেরা। মরুভূমির ভিতরে ভিতরে ছোট ছোট গ্রাম আছে। সেখানে বহু যুগ ধরে বাস করে উপজাতীয় কিছু পরিবার। গোটা গ্রাম জুড়ে থাকে একই গোষ্ঠীভুক্ত লোকজন। শহরে আসার আগ্রহ খুব একটা নেই তাদের। আলির মতো কিছু লোক আছে যারা সাবেকি জীবন ছেড়ে বেছে নিয়েছে নাগরিক পেশা।      

একটু পরেই শহরের আলো মিলিয়ে যেতে লাগল। স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল শুক্লা নবমীর চাঁদের আলোয় মরুভূমির রূপ। আদিগন্ত বালি যেন রুপোর পাতের মতো ঝকঝক করছিল। তার উপর পর পর ছায়া ফেলে চলেছে চার পাঁচটা ঘোড়া (আলির দু জন ঘোড়াওয়ালা বন্ধুও চলেছে আমাদের সঙ্গে) আর একটা উট। আর কোথাও কিছু নেই। দু একটা কথার টুকরো ভাসছে বাতাসে যার বেশির ভাগই বিস্ময়সূচক শব্দ। হঠাৎ একটা ভয় সাপের মতো ফণা তুলল মনের মধ্যে। এই ছেলেটা আমাদের মরুভূমির মধ্যে নিয়ে গিয়ে লুটপাট করবে না তো ? ঘোড়াওয়ালাগুলো হয়তো ওর সহকারী। যত সময় যাচ্ছে, যত মরুভূমির ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি, তত যেন ভয়টা বাড়ছে ! শহুরে সভ্যতা যে অবিশ্বাস আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে দিয়েছে ! একবার ভাবলাম কল্যাণকে বলি ফিরে যেতে কিন্তু তাকিয়ে দেখি কোন ঘোড়াতে কে বসে আছে, আবছা অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।

হঠাৎ দূরে দেখতে পেলাম সিগারেটের আগুনের মতো একটা আলোর বিন্দু। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সেটারই দিকে। অনেকটা কাছে আসতে বুঝলাম একটা গ্রাম সামনে। মরুভূমির দিকে পর পর কয়েকটা মশাল জ্বালানো আছে। এভাবেই হয়তো রাতের অন্ধকারে মানুষ পথ চিনতে পারে। আমরা ধীরে ধীরে ঢুকে পড়লাম ওই গ্রামে। ভয় ডর চলে গেছে ততক্ষণে, এসেছে একটা তিক্ত অনুশোচনা। ছি ! ছি ! কী ভাবছিলাম এতক্ষণ !

একটা ফাঁকা মতো জায়গায় এসে ঘোড়াগুলো থামল। ঘোড়সওয়াররাও নেমে পড়ল। আমার নামতে সময় লাগল। কারণ উট বাবাজির তখন বসার ইচ্ছে নেই মোটে। তিনি আগে একটা চৌবাচ্চায় মুখ ডুবিয়ে জল পান করলেন তারপর ধীরে সুস্থে বসলেন। ততক্ষণে বেশ কিছু লোকজন এসে ঘিরে ধরেছে আমাদের। ভাষা বুঝিনা কেউ কারো কিন্তু মনের ভাব বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাছাড়া আলি তো ছিলই। সাদর অভ্যর্থনা করে ওরা আমাদের নিয়ে গেল ওদের বাড়িতে। মাটির বাড়ি সম্ভবত, অন্ধকারে ভালো করে দেখতে পাইনি তবে পাকা বাড়ি নয়, এ কথা নিশ্চিত। আলির মা কলকল করে অনেক কথা বলছিলেন। আলি হাসতে হাসতে তার কিছুটা অনুবাদ করে দিচ্ছিল। বলছিল যে আমরা যে কষ্ট করে অতটা মরুভূমির পথ পেরিয়ে এসেছি, তাতে ওরা বেজায় খুশি। প্রথমে গ্লাসে করে এল ঘোল জাতীয় একটা পানীয় যদিও সেটা ঠিক ঘোল বা লসসি নয় কিছু পাতাও ছিল তার মধ্যে, যেগুলির অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ।

চাঁদের আলোয় মরূদ্যান দেখার সৌভাগ্য ক জনের হয় ? আমাদের হয়েছিল। আমরা গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটেছিলাম চাঁদের আলোয়। আমাদের গলার স্বর শুনে এখান ওখান থেকে বেরিয়ে আসছিল কিছু মানুষ। আলাপ করছিল আমাদের সঙ্গে। মহিলাদের মধ্যে খুব একটা পরদার প্রভাব আছে বলে মনে হল না। মাথাটুকু ওড়নায় ঢাকা সবার, এইটুকুই। কারো কারো ওড়নার তলা দিয়ে চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছিল রূপোলী টিকলির মতো গয়না।

ঘড়ি দেখার কথা মনে হয় নি কারোই। কিছুক্ষণ বাদে আলির বাড়িতে ফিরে এসে খেতে বসা। একটা মস্ত বড় থালাতে সবার জন্য পাতলা পাতলা বড় বড় রুটি আর নরম তুলতুলে মাংসের কাবাব জাতীয় একটা কিছু। সঙ্গে বাদাম আর দই দিয়ে বানানো একটা রায়তার মতো খাবারও ছিল। কোনো মিষ্টি ছিল না শেষ পাতে। আমরা তিন জন, আলি আর ওই ঘোড়াওয়ালা একসঙ্গে এক থালায় রাতের খাওয়া সারলাম। সেও এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ফেরার আগে আলির মা একটা রুমালে করে আমার হাতে একটা উপহার তুলে দিলেন। ছোট্ট একটা পাথরের তৈরি গুবরে পোকা। মিশরীয়দের কাছে গুবরে পোকা খুব শুভ জিনিস। ওরা মনে করে ওই রকম খেলনা গুবরে পোকা ঘরে থাকলে গৃহস্থের মঙ্গল হয়। খাবারের দাম দিতে চাইলে ওদের পরিবারের সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল। আমাদের কাছ থেকে এক পয়সাও নেবে না ওরা। আগ বাড়িয়ে বলে দিল যে আমাদের ওরা ভেড়ার মাংস খাইয়েছে। ওরা জানে যে ভারতীয়রা গরু খায় না আর ওখানে গরু পাবেই বা কোথায়। ওরা উটের দুধ খায়। তা থেকেই দই বানায়। আলির ভাই বলল যে ওর খুব ইচ্ছে একবার ইন্ডিয়াতে আসার। এলে যেন ওকে আমির খানের সিনেমা দেখাই আমরা। সে ভিডিওতে ‘রাজা হিন্দুস্থানি’ দেখে একেবারে ফিদা। ওই সিনেমার একটা গান গুনগুন করে শুনিয়েও দিল।

ফেরার পথে চাঁদটাকে আরো উজ্জ্বল, মরুভূমির রূপোলী বালিকে আরো সুন্দর লাগছিল। মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল আলির সঙ্গে আর দেখা হবে না ভেবে। তবে আলির সঙ্গে আমার যোগাযোগ এখনো পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যায়নি। মাঝে মাঝে মেইলে কথা হয়। কয়েকদিন আগেই ও মেইল করে জানিয়েছে আমরা যাতে সুস্থ থাকি আর পর্যটন যাতে আবার চাঙ্গা হয়, সেই মর্মে ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানিয়েছে।

                             



অলংকরণঃ তাইফ আদনান