জলধি / ভ্রমণ / চীনের বসন্ত উৎসব: মধুর স্মৃতি
Share:
চীনের বসন্ত উৎসব: মধুর স্মৃতি

চীনে বসন্ত উৎসব দেখার অভিজ্ঞতা আমার জীবনের স্মরণীয় স্মৃতিগুলোর একটি। চীনা নবর্ষ উদযাপনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল বেইজিংয়ে বেশ কয়েক বছর আগে। তখন আতশবাজির যে খেলা দেখেছিলাম তা মনভোলানো, চোখ ধাঁধানো। প্রথমেই বলে নেই চীনা নববর্ষ সম্পর্কে কিছু কথা। তাতে পাঠকের ধারণা করতে সহজ হবে।

চায়নিজ নিউ ইয়ার বা চীনা নববর্ষ বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি হিসেবে সারা বিশ্বেই স্বীকৃতি। এই নববর্ষ শুধু যে চীন দেশে হয় তা নয়। কোরিয়া, সিংগাপুর, মালোয়েশিয়া, ভিয়েতনামেও একই সময়ে বা কাছাকাছি সময়ে এই উৎসবটি পালন করা হয়। আর সানফ্রান্সিসকো, নিউইয়র্ক, সিডনি বা যে কোন বড় শহর যেখানে চায়না টাউন রয়েছে সেখানে এই উৎসব পালন করেন চীনা বংশোদ্ভুত মানুষরা। চীনা নববর্ষকে ইউনেসকো অবস্তুগত সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে সম্মানিত করেছে।

চীনের লোকজ সংস্কৃতি অতি সমৃদ্ধ। পাঁচ হাজার বছরের সভ্য এ দেশটিতে রয়েছে নানা রকম সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠান। রয়েছে বিশেষ রীতিনীতি। বলতে গেলে, বিশাল দেশটিতে উৎসব অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শেষ নেই। চীনে ৫৬টি জাতিগোষ্ঠির মানুষ বাস করে। এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো হান জাতি। আরও রয়েছে ইয়াও, ই, বাই, দাই, মিয়াও, তাজিক, কাজাখ, হুই, মঙ্গোল, উইগুর, উজবেকসহ নানা জাতির মানুষ।

সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জাতির সংস্কৃতির পাশাপাশি রয়েছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠিগুলোর বিশেষ সংস্কৃতি। প্রতিটি জাতির রয়েছে বিশেষ উৎসব,  বিশেষ পুরাণ কাহিনী, কিংবদন্তি।

চীনের নিজস্ব সংস্কৃতির সবচেয়ে বর্ণাঢ্য প্রকাশ দেখা যায় চাইনিজ নিউইয়ারে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে চীনের পাঁচ হাজার বছরের সংস্কৃতি। এটি মূলত হান জাতির সংস্কৃতি হলেও অন্যান্য জাতির মানুষরাও নিজের নিজের বৈশিষ্ট্যে এই উৎসব পালন করে। কিছু কিছু রীতিনীতি চীনের প্রায় সকল জাতিই মেনে চলে। যেমন লাল লণ্ঠন জ্বালানো, দরজায় মন্ত্র লেখা লাল কাগজ ঝুলানো, বিশেষ ধরনের কিছু ওয়াল হ্যাংগিং টাঙানো ইত্যাদি। 

চীনে নতুন বছর শুরু হয় বসন্ত উৎসব দিয়ে। উত্তর চীনে ঘোর শীতের মধ্যে। চারিদিকে তুষার। এরই মধ্যে শুরু হয় নতুন বছরের উৎসব যার নাম বসন্ত উৎসব। অবশ্য দক্ষিণ চীনে তখন অত শীত থাকে না। সাধারণত জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে চায়নিজ নিউ ইয়ার হয়। একে নববর্ষ বা ‘নিয়ান চিয়ে’ বলা হয়। নববর্ষ উৎসবের অনেক নাম। কেউ বলে কুয়ো নিয়েন, কেউ বলে নংলি শিননিয়েন, কেউ বলে ছুন চিয়ে বা বসন্ত উৎসব। বসন্ত উৎসব চীনের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ সময় চীনারা সব ঘরমুখী হয়। বসন্ত উৎসবে বাড়ি না ফিরলে অমঙ্গল হয়।

অনেকেই জানেন চীনের বছর হলো চান্দ্র বৎসর। আর ওদের একেকটা বৎসর একেকটা রাশির প্রতীক। ১২ বছর পর পর রাশিগুলো ঘুরে ঘুরে আসে।  চীনে অফিশিয়াল কাজকর্ম অবশ্য গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ধরেই হয় সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কিন্তু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসবগুলো হয় তাদের নিজস্ব পঞ্জিকা অনুসরণ করে। এই পঞ্জিকাকে বলা হয় চায়নিজ লুনার ক্যালেন্ডার। নববর্ষের আগের সন্ধ্যার সময়(নিউ ইয়ার ইভ) পরিবারের সকলের একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খাওয়ার মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন শুরু হয়। এই ডিনার হলো নববর্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ সময় দূর দূরান্ত থেকে প্রবাসীরা বাড়ি ফিরে আসে। বৃদ্ধ বাবা মা আত্মীয় স্বজন, পরিবারের গুরুজনদের সঙ্গে বসে সকলে ডিনার করে। এটি চীনাদের সমাজে পারিবারিক পুনর্মিলনের আনন্দ নিয়ে আসে।

এখানে নববর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পৌরাণিক কাহিনীটিও জানিয়ে রাখি।

চীনা উপকথা অনুযায়ী নিয়ান হলো এক পৌরাণিক জন্তু। সে খুবই ভয়ানক।প্রাচীনকালে নববর্ষের প্রথম দিনে নিয়ান গ্রামে এসে পশুপাল, শস্য খেয়ে ফেলতো। নিয়ান গ্রামবাসী বিশেষ করে শিশুদেরও খেয়ে ফেলতো। এজন্য গ্রামবাসী নিয়ানের জন্য খাদ্য তৈরি করে দরজার সামনে রেখে দিত। তৈরি খাদ্য পেলে নিয়ান আর শিশুদের খেত না। তারপর এক নববর্ষে নিয়ান গ্রামে এল। লাল কাপড় পরা একটি শিশু সে সময় তার সামনে পড়লো। নিয়ান লাল পোশাক পরা শিশুটিকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে পালিয়ে গেল।

তখন গ্রামবাসী বুঝতে পারল নিয়ান লাল রঙকে ভয় পায়। তখন থেকে চীনের মানুষ নিয়ানকে ভয় দেখানোর জন্য দরজা জানালায় মন্ত্র লেখা লাল কাগজ ঝুলিয়ে রাখে বা আঠা দিয়ে সেঁটে রাখে। লাল লণ্ঠন ঝুলানো হয়। আর নিজেরাও লাল কাপড় পরে। তাই নিয়ান আর কখনো গ্রামে আসে না। নিয়ান ও অন্যান্য অশুভ প্রেতাত্মাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্য এসময় লাল রঙের ওয়াল হ্যাংগিং ঝুলানো এবং বাজি পোড়ানোর নিয়ম রয়েছে। বাজির শব্দ আর আলোতে নাকি প্রেতাত্মারা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। বাজি পোড়ানো হয় প্রায় পনের দিন ধরে। নববর্ষের রাত ১২ টায় শুরু হয় মূল আতশবাজির খেলা আর শেষ দিন অর্থাৎ ১৫ দিনের দিন সন্ধ্যায় অসংখ্য বাজি পোড়ানো হয়।

 বাজি পোড়ানোর কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়াতে চীনা সরকার বাজি পোড়ানোকে নিরুৎসাহিত করছে আজকাল। বাজির পরিবর্তে লাউডস্পিকারে শব্দ সৃষ্টি করা হচ্ছে হুবহু বাজির মতো। এতেও নাকি অশুভ প্রেতাত্মারা একই রকম ভয় পাবে। আর আতশ বাজির বদলে এলইডি লাইটের খেলাও চলে অনেক জায়গায়। আগে ডিনারের পর পরিবারের সকলে মিলে বাজি পোড়াতো। তার বদলে এখন ডিনারের পর সকলে একসঙ্গে বসে টিভি অনুষ্ঠান দেখে। এ সময় চীনের টিভি চ্যানেলগুলোতে বছরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়।

নববর্ষ উপলক্ষে উপহার দেওয়ার রীতি রয়েছে। সাধারণত লাল খামে করে টাকা উপহার দেওয়া হয়।  বড়রা ছোটদের লাল খাম উপহার দেয় স্নেহ ও আশীর্বাদ হিসেবে।

নববর্ষের ১৫ দিনের দিন লণ্ঠন উৎসব হয়।

চীনের নববর্ষে একেকদিন একেক রকম অনুষ্ঠান চলে পনেরো দিন ধরে। এর মধ্যে গৌতম বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়র উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠান রয়েছে, রয়েছে কনফুসিয়াস ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান, আবার রান্না ঘরের দেবতার উদ্দ্যেশ্যেও রয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান। আরও রয়েছে বিভিন্ন লোকাচার যা সব ধর্মের অনুসারীরাই মেনে চলেন। এমনকি যারা কোনো ধর্মই মানেন না তারাও নববর্ষের পনের দিন উৎসব অনুষ্ঠান লোকাচার রীতি রেওয়াজ পালন করেন উৎসাহের সঙ্গে।

নববর্ষের রাতে বিশেষ খাওয়া দাওয়া তো রয়েছেই। নববর্ষের আগের রাতে পরিবারের সবাই একসঙ্গে বিশেষ ডিনার খেয়ে থাকেন সেকথা আগেই বলেছি। সেই ডিনারে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার থাকে। একধরনের মাছের স্যুপ খাওয়া হয়। মুরগির মাংস, বিশেষ ধরনের নুডুলস, ভাত ইত্যাদিও থাকে। থাকে দুয়েক রকম হালকা মিষ্টি পদ। নববর্ষে  উত্তর চীনে চিয়াওজা বা ডাম্পলিং খাওয়ার রীতি রয়েছে। আর দক্ষিণ চীনে নিয়ান কাও (এক ধরনের খাবার)খাওয়া হয়। নববর্ষের ১৫ দিনের দিন  ইউয়ান শাও খাওয়া হয়। ইউয়ান শাও গোল বলের মতো আকারের হয়। চালের গুঁড়োর তৈরি ইউয়ান শাওয়ের ভিতরে নানা রকম জিনিসে পুর দেওয়া হয়। এটি মিষ্টি বা ঝাল হতে পারে। ছোট ছোট বলের মতো তৈরি করে ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করা হয়। এটা নববর্ষে পূর্ণিমায় বিশেষভাবে খাওয়া হয়।

এই রাতে লণ্ঠন জ্বালানো হয় ঘরে ঘরে।

চীনের ডাম্পলিং খুব সুস্বাদু খাবার। এর চীনা নাম চিয়াওজা। উত্তর চীনে নববর্ষের সময় ডাম্পলিং খাওয়া হয়। নানা রকম পুর ব্যবহার করা হয়। মাংস, সবজি, ডিম ইত্যাদির ডাম্পলিং হতে পারে। নববর্ষের ডিনার চিয়াওজা ছাড়া হবে না।

ছুনজুয়ান নামে এক ধরনের খাবার রয়েছে।এটি নববর্ষের সময় সাধারণত খাওয়া হয়। এটি কুয়াংচৌ(বাঙালির উচ্চারণে গুয়াংজো) শহরের বিশেষ ডিশ। এর ইংরেজি নাম স্প্রিং রোল। এর ভিতরে মাংস, বা সবজির পুর দেওয়া হয়।

নববর্ষের আগে ঘরবাড়ি পরিস্কার,পূর্ণিমায় লণ্ঠন জ্বালানো, একেকদিন একেক রকম লোকজ খাদ্য পরিবেশন ইত্যাদির প্রথা নববর্ষ উৎসবেরই অংশ। ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা হয় নববর্ষের আগে। কারণ নববর্ষের দু’তিন দিন ঝাড়ু দেয়া নিষেধ। মনে করা হয়, নববর্ষের দিন ঘর ঝাড়ু দিলে সৌভাগ্যও ঝেঁটিয়ে বিদায় হয়ে যাবে।

নববর্ষের আরেকটি অংশ হলো মন্দির মেলা। নববর্ষ উপলক্ষে মেলা বসে শহরের বিভিন্ন স্থানে। সেসব মেলায় চীনের ঐতিহ্যবাহী উশু বা লায়ন ডান্স পরিবেশন করা হয়। এসব মেলায় আরও নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালন করা হয়।আর নানা রকম দোকান বা স্টল থাকে, খাবারের দোকান থাকে, থাকে নাগরদোলাসহ অনেকরকম খেলার ব্যবস্থা। 

এ বছর বসন্ত উৎসব বা চীনা নববর্ষ শুরু হচ্ছে ১২ ফেব্রুয়ারি। এ বছরটি হচ্ছে বৃষ বর্ষ। তাই গরুর ছবি, পুতুল, কার্টুন, ওয়াল হ্যাংগিং দেখা যাচ্ছে সব জায়গায়। বিশেষ ধরনের নকশা কাটা লাল ও সোনালি রঙের ওয়াল হ্যাংগিংও চীনের বিশেষ ঐতিহ্য। আরও রয়েছে লাল কাগজ বিশেষ পদ্ধতিতে কেটে নকশা করা। এই নকশা করা লাল কাগজ বাড়িতে রাখা হয়। আর নববর্ষ উপলক্ষে নানা রকম ধাঁধাঁ, শ্লোক, কবিতা ইত্যাদি লাল কাগজে লিখে রাখা হয়। এক ধরনের ধাঁধাঁর খেলাও প্রচলিত আছে। সেখানে কোন কোন শব্দ দিয়ে প্রশ্ন করা হয়।

চীনের সঙ্গে অনেক বছরের সম্পর্রকের ফলে নববর্ষের অনেক রকম অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তারপরও অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। কত জাতির কত রীতিনীতি সেদেশে। তার ক’টাই বা জানতে পেরেছি।

তবে সি আর আই বা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বেইজিং অফিসে কাজ করার সময় মজার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছেল। সেটি এখানে সংক্ষেপে বলি। সে বছর আমি প্রথম চীনে গিয়েছি। শীতে শুনলাম সিন চুন খোয়াইলা।

‘সিন চুন খোয়াইলা’ কথাটা শুনে প্রথমে বেশ খটমটে মনে হলেও চীনারা এটা বলে চমৎকার এক সুরে। সুরটা আমিও রপ্ত করে নিলাম। না নিয়ে বা উপায় কি। নববর্ষে কথাটা চেনা অচেনা অনেকের কাছ থেকে শুনতে যেমন হচ্ছে তেমনি বলতেও হচ্ছে।

এরপর দেখলাম আতশবাজির খেলা।সে যে কী ব্যাপার তা না দেখলে বলে বোঝানো কঠিন। নববর্ষের কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয় বাজির ধুম। নববর্ষের কয়েকদিন আগে সন্ধ্যায় আমি আমার ঘরে বসে লেখাতে ব্যস্ত। এমন সময় পিলে চমকানো বিকট ধুম ধাড়াক্কা শব্দে চমকে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।তখন একই এপার্টমেন্টে থাকি আমরা তিন জন। একজন রুমানিয়ান নারী নিনা গেরমান আরেক জন পোল্যান্ডের তরুণী আগাথা। যার যার বেডরুম থেকে ছুটে বেরিয়ে আমরা লিভিংরুমের বিরাট জানালার কাছে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি বিষয়টা কি। আমি ভাবছি গুলি ছুঁড়ছে নাকি কেউ। নাকি বোমা পড়ছে কোথাও। আগাথা তো বিড়বিড় করে বলতে লাগল ‘হ্যাজ দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার স্টারটেড?” একটু পর বুঝলাম, না গোলাগুলি নয় আতশবাজি।

আর নববর্ষের রাত ১২টায় যে কাণ্ডটা হলো তা অবর্ণনীয়।  আশেপাশের বিভিন্ন বাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে শুরু হলো অজস্র আতশবাজি পোড়ানো। সারা আকাশ রঙিন আলোয় ভরে উঠতে লাগলো ক্ষণে ক্ষণে। কত রঙের আর কত ধরনের যে বাজি তা বলে শেষ করা যাবে না। ফল্গুধারার মতো আগুন আর রঙের খেলা। রাস্তায় বিদেশী, চীনা, ছেলে, বুড়ো, নারী পুরুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখছে এই অপূর্ব খেলা। কনকনে শীত। মাইনাস ১২ বা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হাত পা জমে যাচ্ছে  ঠাণ্ডায়। তবু ঘরে ফিরতে মন চাচ্ছে না কারও। আতশবাজির এমন অপূর্ব খেলা দেখে তো আমি আনন্দে আত্মহারা। আতশবাজিতে বায়ুদূষণ হয়। সম্পদের অপচয়ও হয়।

বায়ুদূষণ, সম্পদ অপচয় সবই বুঝলেও আতশবাজির দৃশ্য যে অপূর্ব সুন্দর তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি তীব্র শীত উপেক্ষা করে সেই অপরূপ দৃশ্য প্রাণভরে দেখলাম। মনে হলো চক্ষু সার্থক।

নববর্ষ উপলক্ষে আমার কর্মস্থল চীন আন্তর্জাতিক বেতার বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। একদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। সেখানে বাংলা বিভাগের চীনা ও বাঙালী কর্মীরা বাংলা গান গেয়ে শোনালেন। ঠেকায় পড়ে আমার মতো বেসুরো মানুষকেও কোরাসে যোগ দিতে হলো।

নববর্ষ উপলক্ষে উপহার দেওয়ার রীতি রয়েছে তা আগেই বলেছি।। আমরাও উপহার পেলাম চীন বেতারের কাছ থেকে। তবে টাকা নয়, বাস্কেট ভরা বাদাম,পেস্তা, কিসমিস আর অন্যান্য শুকনো ফল। নববর্ষে শপিং মলে নানারকম খেলনা আর লাল কাগজ বিক্রির ধুম। কাগজের তৈরি চীনা লন্ঠন ঝুলছে বাড়িতে বাড়িতে। আমি নিজেও ঘর সাজালাম এসব খেলনা দিয়ে।

নববর্ষ উৎসবের অংশ হিসেবেই এক সন্ধ্যায় যেতে হলো সিসি টিভি টাওয়ারে। এটি চীনের কেন্দ্রীয় টিভি ও রেডিও টাওয়ার। ৪০৫ মিটার উঁচু টাওয়ার। এটা বেইজিংয়ের সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার। এজন্য এক বেইজিং টাওয়ারও বলা হয়। এখান থেকে পুরো বেইজিং শহর দেখা যায়। ২৩৫ মিটার উঁচুতে একটা বেইজডেক রয়েছে। সেখান থেকে বেইজিং শহরের বিভিন্ন অংশ দেখা যায় টেলিস্কোপের সাহায্যে। এই টাওয়ারের উপর রয়েছে একটি রিভলভিং রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্ট ধীরে ধীরে ঘোরে। এখানে বুফেতে রয়েছে কয়েক হাজার আইটেম। এই রেস্টুরেন্টে আমাদের মতো শখানেক বিদেশী অতিথির উপস্থিতিতে তৈরি হবে ইউয়ান শাও। আমরা ইউয়ান শাও বানানো দেখলাম, শিখলাম, নিজেরা বানালাম এবং খেলাম। খেতে কেমন? পুর দেওয়া ছোট পিঠার মতো, নেহাত মন্দ নয়। পিঠা তবে তেলে ভাজা নয়, ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ।

সিসিটিভি টাওয়ারে সেদিন বিদেশী অতিথিরা যার যার জাতীয় পোশাক পরে নাচ অথবা গান পরিবেশন করলেন। দেশের সম্মান রাখতে আমাকেও নৃত্য পরিবেশন করতে হলো। ঠেকায় পড়লে মানুষ কি না করে। সেই ছোটবেলায় স্কুলে শেখা নাচ মনে করতে হলো। তবে প্রশংসা পেয়েছিলাম, এটাই যা সান্ত্বনা। পুরো অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হলো সিসিটিভি থেকে। নববর্ষ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। সেসব মেলাতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও হয়েছে বইকি। চমৎকার সব আয়োজন থাকে এসব মেলায়। এখানে পরিবেশিত হয় চীনের ঐতিহ্যবাহী সিংহ নাচ, ড্রাগন নাচ এবং আরও নানা রকম সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।

চীনের বসন্ত উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার জীবনেরও বসন্ত দিনের স্মৃতি। তাই বসন্ত উৎসব শুনলে মনটা ভরে ওঠে আনন্দে।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান