জলধি / ভ্রমণ / আলপনা গ্রামঃ বরেন্দ্রভূমির শেকড়ের সংলাপ
Share:
আলপনা গ্রামঃ বরেন্দ্রভূমির শেকড়ের সংলাপ

আলপনা গ্রাম নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে ফেইসবুকে, পত্রিকায়  সেটাও আবার খুচরো খুচরো। কিন্তু লেখার চাইতে ইউটিউবসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে ভ্লগ হয়েছে খুব । এমনকি দেশের প্রধান কিছু টিভি চ্যানেলে আলপনা গ্রামের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। বার্জার রঙের  বিজ্ঞাপনে প্রথমে আলপনা গ্রাম সবার নজরে আসে, তা সেই ভিডিওটি হঠাৎই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দেশে এবং বিদেশে। বিদেশের কথা যখন উঠল তখন বলে রাখা ভাল, টিকইলের দাসু বর্মণের বাড়িতে রয়েছে একটি আলপনা পরিদর্শন খাতা। যারা সেখানে ঘুরতে যান তারা তাদের মন্তব্য বা মনের কথা ব্যক্ত করে যান। লেখেন স্বচক্ষে যা দেখেছেন তাই। সেই পরিদর্শন খাতা ঘেটে দেখা গেল, বিদেশী পর্যটকও এসেছেন এই গ্রামে। "  সুইটজারল্যান্ডের এক আলোকচিত্রী লিখেছেন, অসামান্য আতিথেয়তা, চমৎকার গ্রাম, বিস্ময়কর মানুষ, চমৎকার আলপনা। অস্ট্রেলিয়ার জিওনস নামের পর্যটক তাতে লিখেছেন, এটা বাংলাদেশের সম্পদ। একে আরো বড় প্রচার দরকার, যত্নে সংরক্ষণ করা উচিত। অপূর্ব। সত্যি এটা বাংলাদেশ তথা চাঁপাইনবাবগঞ্জের গর্ব এবং অহংকারের বিষয়। "


বলতে গেলে প্রথমে আমিও দেখে চমকে উঠছিলাম বার্জারের ভিডিওটা । আসলে  ভিডিওতে যে অঞ্চল দেখানো হচ্ছিল ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে প্রথমেই ভাবলাম বরেন্দ্রভূমি  চাঁপাইনবাবগঞ্জ হবে নিশ্চয় এবং তাই হয়েছিল।
জায়গাটা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের স্মৃতি বিজড়িত স্থান নাচোল উপজেলার, নেজামপুর ইউনিয়নের হাট বাকৈলের পাশের গ্রাম টিকইল। সেখানে লালমাটি অথবা পোড়ামাটির মাঠ চিরে পিচের  রাস্তা এবং দুপাশের আকাশমনি আর যুবতী আম গাছের সারি পেরিয়ে যেতে হবে। টিকইল ঢুকতেই  ধুতি পড়া অতি একজন বৃদ্ধকে আমাদের ভুটভুটি গাড়ি পেরিয়ে গেল। গ্রামটি হিন্দু প্রধান।  জাতিতে তারা রাজবংশী। সেখানে প্রায় নব্বইটির কাছাকাছি পরিবার বসবাস করে। সংখ্যায় তারা চারশো সাড়ে চারশোর কাছাকাছি। আলপনাকারী সবাই নারী শিল্পী। বয়স্ক থেকে যুবতী।

আলপনা করা  বাড়িগুলোর আকর্ষণ কি শিল্প? নাকি রঙের খেলা? নাকি মাটির বাড়ির শীতলতায় জড়িয়ে থাকা বরেন্দ্রভূমির লোকজ সংলাপ? নাকি খোদ মানুষের হস্তপ্রণয়!

কি সেটা? সেটার খোঁজে ঢাকা থেকে ছুটে এসেছিল বাংলাদেশি চলচ্চিত্র  নির্মাতা নুহাশ হুমায়ূন, এবং রাষ্ট্রপতির পরিবার।


আলপনার রঙের কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে নীল এবং লাল খয়েরী রঙ। নানান আঙ্গিকের রঙের খেলা যা আপনার চোখ ধাধিয়ে তুলবে।
জিজ্ঞেস করলে আদিম রীতিতে রঙ তৈরীর ব্যাপারটা তারা খুলে বললেন। যদিও তাদের রঙ তৈরীর সুত্র কিছু জানা ছিল।

বলে রাখি বরেন্দ্রর বেশিরভাগ বাড়ি মাটির, ধনীরা দোতলা বানায় আর গরীবরা কোনমতে একতলা বিশিষ্ট বাড়ি করে। কিন্তু তারা তাদের ঘরকে  আলপনা দিয়ে নিজের কল্পনার একটি রাজ্য সৃষ্টি করে। কল্যাণের জন্য সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য।  সেই আলপনার রঙয়ের উৎস কিন্তু  মাটি। "গ্রামবাসীর ভাষ্যমতে আগে গৃহিণীরা আলপনা আঁকতে গিরিমাটি, চক (খড়িমাটি), রং, তারপিন তেল ব্যবহার করতো। তবে ওইসব উপকরণে আঁকা আল্পনা বেশিদিন স্থায়ী হতো না। তাই বর্তমানে শুকনা বরই চুর্ণ আঠা, গিরিমাটি, আমের পুরাতন আঁটির শাঁস চুর্ণ, চকগুঁড়া, বিভিন্ন রং, মানকচু ও কলাগাছের কস দিয়ে তৈরি রংয়ের মিশ্রণ অন্তত ৪/৫ দিন ভিজিয়ে রেখে আলপনা আঁকা হয়। এ কারণে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় স্থায়ী হয় এসব আলপনা।"

আলপনায় যা যা স্থান পেয়েছে তা উৎসব বলতে লক্ষ্মী ও দূর্গা পূজার সময় আরো ফুটে ওঠে। বর্ষায় রঙের মেজাজ কিছুটা নষ্ট হয়, শীতে ভালো থাকে কিন্তু প্রতিবছর তাদের হাত দেওয়া লাগে। তাতে খরচ পরে ১০-১২ হাজার টাকার মতো। সেই পরিশ্রমের ভেতর যেমন ধরুন ধর্মীয় শ্লোক থেকে শুরু করে হিন্দু মিথ, জোড়া ময়ূর ময়ূরী, শঙ্খ,মাছ, মুরগী, স্কুল, শহীদ মিনার, মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কদমফুল, পাখি, নদী, মানুষ, ফুলের গাছ, গ্রামীণ গৃহস্থালি থেকে চাষবাসের ব্যাপারটি প্রাধান্য লাভ করেছে। তুলসী মন্ডপ, রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর, সাথে ঘরের এবং গলির উসরা / বারান্দা , গহিল ঘর সব জায়গায় রয়েছে আলপনার চমৎকার সব কাজ। মাটির সিড়ি সেজে উঠেছে চিত্তাকর্ষক রঙের বাহারে। আরো রয়েছে শঙ্খ সদৃশ মাছ, বিশাল ব্যপ্তি জুড়ে বুনো লতা, লক্ষ্মীর পদছাপ। আলপনার অন্দরে ঠাঁই পেয়েছে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম,  ইলা মিত্র, শেখ মজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ছবি৷


সম্প্রতি আলপনা গ্রাম খেতাব পাওয়া টিকইলের নারীরা তাদের বংশ পরম্পরায় নিজেদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে। উঠে যাচ্ছে মাটির বাড়ি, সাথে পাল্লা দিয়ে তৈরী হচ্ছে পাকা দালান। কিন্তু তারা কৃত্রিম রঙ দিয়ে হলেও সেই দেয়াল জুড়ে আলপনা আঁকার কথা বলে। নিজেদের টিকিয়ে রাখার কথা বলে। শেকড়ের সংলাপ বলে।

"চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এ কে এম তাজকির উজ জামান জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সৌরবাতি দিয়ে আলপনা গ্রামকে আলোকিত করা হয়েছে। দেখন  বর্মনসহ চারটি পরিবারকে ত্রাণের বাড়ি দেওয়া হয়েছে। গ্রামের মন্দির সংস্কারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আলপনা গ্রামের উন্নয়নে গ্রামের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। এ গ্রামের আলপনা ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নিতেও প্রস্তুত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন।"

নিজের চোখে আলপনা গ্রামের উন্নয়ন দেখে এলাম,দেখলাম দখনবালার আলপনা বাড়িতে সম্মাননা সূচক কিছু ক্রেস্ট।  চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন তার কথা রেখে চলেছে । বরেন্দ্র খ্যাত নাচোলের নারীরা  সমৃদ্ধ করুক নিজ তথা বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কালচার এবং আধুনিক সভ্যতায় তাদের আঁচড় পড়ুক গর্বের সঙ্গে।

টিকইল /আলপনা গ্রামের নারীদের জয় হোক।



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন