জলধি / প্রবন্ধ / সাংবাদিকতায় কবি নজরুলের অবদান
Share:
সাংবাদিকতায় কবি নজরুলের অবদান
বিদ্রোহী কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম সমধিক পরিচিত হলেও তিনি  একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে র্সবদাই ছিলেন সোচ্চার। তার কবিতা ও গানে যে  মনোভাব প্রতফিলতি হয়েছে তা প্রভ ফেলেছে   সাংবাদিকতায় অবলীলায । অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি , সাম্যের  কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সংগীতে যেমন ছিলেন সিদ্ধ হস্ত  ঠিক তেমনি সাংবাদিকতা ও পত্রিকার সম্পাদনর ক্ষেত্রেও  তিনি ছিলেন অগ্রগামী ও  দক্ষ সৈনিক । সমকালীন রাজনীতি সচেতনতা থেকেই তিনি সাংবাদিকতায় এসেছিলেন যা তাঁর লেখা সাহিত্য ও সম্পাদকীয় থেকে সহজেই অনুমান করা যায় । তিনি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শকে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই সাংবাদিকতা করেছিলেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলোতে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যে বিদ্রোহী সত্ত্বার পরিচয় আমরা নজরুলের লেখায় পাই সেটা তাঁর সাংবাদিক জীবনেও প্রবল ছিলো। তাঁর সকল সাহিত্য ও শিল্পকর্মেও রাজনৈতিক মননেরও বাঙালি জাতীয়তা বোধের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হননি। রাজনীতির মাধ্যমে তিনি সমাজ পরিবর্তন, উন্নয়ন ও নবজাগরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন।
 
নজরুল যখন ‘নবযুগ’ প্রকাশের ইচ্ছে ব্যক্ত করলেন তখন রাজনীতি করবেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে মুজফফ্‌র আহমদকে বলেছিলেন, তাই যদি না করি তবে ফৌজে গিয়েছিলাম কিসের জন্য? রাজনীতি করবো তবে সাহিত্যের মাধ্যমে। তাই মুজফফ্‌র আহমদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘তিনি করতে চাইলেন রাজনীতিক সাহিত্য।’” নজরুলের সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পত্রিকা নবযুগ, ধুমকেতু, লাঙল । পত্রিকাগুলো বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রয়েছে। সাহিত্য, সমকালীন রাজনীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মুখপত্র হয়ে উঠেছিলো কাজী নজরুল সম্পাদিত পত্রিকাগুলো। প্রেম ও দ্রোহের কবি,  সাম্যের কবি , মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।  কবিতা ও  গানের পাশাপাশি সাংবাদিকতার মাধ্যমেও কাজী নজরুল ইসলাম বিপ্লবী ধারার সূচনা করেন।  অনেকেই হয়তো জানেন না কবি নজরুল  সাংবাদিক হিসেবে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় ব্যয় করেছিলেন।
 
শৈশবে অভাবের তাড়নায় পড়া ছেড়ে রুটির দোকানে কাজ করছেন। সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। করেছেন  সাংবাদিকতাও। অত্যাচারী বিদেশি শাসক, দেশীয় তোষামোদকারী ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও প্রতিবাদী  সম্পাদকীয় লিখে শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন নজরুল । ইংরেজ শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে যে গণবিপ্লব হয়, তা এগিয়ে নিতে  কাজী নজরুল ইসলাম ‘নবযুগ’ পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতার জগতে আবির্ভূত হন সেই সময়ে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে।যখন ১৯২০ সালে  যুদ্ধ শেষ হয়  ব্রিটিশ সেনার ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে যায় তখন  নজরুল কলকাতায় চলে আসেন। প্রথমে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের রমাকান্ত স্ট্রিটের বোর্ডিং হাউসে উঠেছিলেন। কিছুদিন পরই তার মুসলমান পরিচয় জেনে ওই বোর্ডিংয়ের পরিচারিকা তার বাসন ধুতে অস্বীকার করেন। এরপর ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। এটি ছিল এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমেদের আস্তানা। মুজফ্ফর আহমেদের কাছেই কবি নজরুলের সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি। তাদের যৌথ উদ্যোগে ও সম্পাদনায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হয়। সব মিলিয়ে নবযুগে পাঁচ মাস কাজ করেন কবি  নজরুল। কাগজের প্রধান পরিচালক হিসেবে ফজলুল হকের নাম ছাপা হতো। তবে সব কাজই আসলে করতেন নজরুল ও মুজফ্ফর দুজনে। এই কয়েকমাসে অসংখ্য সম্পাদকীয় লিখেছিলেন তিনি। যার সঙ্কলন যুগবাণী নামক বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে।
 
যুগবাণীতে নজরুলের লেখা মোট ২১টি সম্পাদকীয় নিবন্ধ পাওয়া যায়। তবে বইটি প্রকাশের পরই ব্রিটিশ সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করে। এরই মধ্যে নব্যযুগের পাশাপাশি মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। বিদ্রোহী কবি নজরুলের কাছে এক সময়  পত্রিকা হয়ে ওঠে বিপ্লবের আরেক নতুন  অস্ত্র। নজরুল ছিলেন শোষিতের পক্ষে ।   সে কারনেই  নবযুগে শ্রমিকের, কৃষকের, সংখ্যালঘুর স্বর জোরালো হয়ে উঠেছিল প্রথম থেকেই। এই  পত্রিকাকে সামনে রেখে নজরুল একটি ভেদাভেদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক স্বর গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন এই স্বল্প সময়েই। ১৯০৫ সালের মার্চ মাসে সন্ধ্যা পত্রিকার পাতায় লেখা হয়, ‘আমরা কী চাই? আমরা চাই পূর্ণ স্বাধীনতা। আমরা দেখতে চাই আমরাই আমাদের দেশের মালিক হয়েছি।’ এর ১৭ বছর পরে ধূমকেতু-তে ‘ধূমকেতুর পথ’ নামক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে নজরুল দাবি তুলবেন, ‘সর্ব্ব প্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।’ নবযুগ পত্রিকায়  নজরুল একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে। ব্রিটিশ শাসকের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ঘৃণার চরিত্রটিকে চিহ্নিত করেন নজরুল। ‘কালা আদমিকে গুলি মারা’ নামক সম্পাদকীয়টিতে নজরুল স্পষ্ট বলছেন, ব্রিটিশরা এ দেশের মানুষকে কুকুরেরও অধম মনে করে। ধূমকেতু সম্পাদনার সময়কাল নজরুলের সাংবাদিক সত্তার সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্ব। কবি নজরুল ১৯২০ সালে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারি শুরু হয়। কবির  নবযুগ ছাড়ার দু’বছর পরে ১১ আগস্ট ১৯২২ থেকে পথচলা শুরু করে ধূমকেতু। সপ্তাহে দু’বার প্রকাশিত হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লবী বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরীসুন্দরী ঘোষ, বীরজাসুন্দরী সেনগুপ্ত, সরোজিনী নায়ডু' র আশীর্বাদ নিয়ে শুরু হয়েছিল এই কাগজের পথ চলা।  বিদ্রোহী নজরুলের ধূমকেতু সম্পর্কে জনতার আগ্রহের কথা উঠে আসে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর কল্লোলযুগ গ্রন্থে। তিনি লিখছেন ‘সপ্তাহান্তে বিকেলবেলা আরও অনেকের সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, হকার কতক্ষণে ধূমকেতুর বাণ্ডিল নিয়ে আসে। হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কাগজের জন্য। কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে লেখা সেই সব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ। শুনেছি স্বদেশীযুগের সন্ধ্যাতেও এমনই ভাষাতে লিখতেন।’ 
কাজী নজরুল বাঙালি নারীর স্বাধীনতা, অধিকার প্রকাশের হাতিয়ার বানিয়েছিলেন পত্রিকাকেই। নজরুল ধূমকেতু সম্পাদনার প্রথম দিন থেকেই এই ধরনের গোঁড়ামিমুক্ত হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যাতে ‘নারীকল্যাণ’ বিভাগে ‘নারীর সত্য স্বাধীনতা কিসে?’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন বিরজাসুন্দরী দেবী। ধূমকেতুর দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ নামের একটি কলামে নারীর জাগরণ বিষয়ে তর্কে মাততে দেখা যায় নারীদের, সময়ে সময়ে মতামত দেন কয়েকজন পুরুষও। নবযুগ, ধূমকেতু ছাড়াও দৈনিক, অর্ধসাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বাৎসরিক পত্রিকা মিলে নজরুল ইসলাম লাঙল, গণবাণী, নওরোজ, সেবক, সওগাত, বুলবুল, মোহাম্মদী, বসুমতী, ভারতী, বঙ্গবাণী, আত্মশক্তি, নকীব, অভিযান, সাম্যবাদী, মোয়াজ্জিন, দরদী, শান্তি, শিক্ষা, কবিতা, গুলিস্তা, দিলরুবা, উপাসনা, সহচর, প্রবর্তক, নারায়ণ, বিজলী, কল্লোল, কালি-কলম, প্রগতি, প্রবাসী, উত্তরা, ভারতবর্ষ, নূর, মানসী ও মর্মবাণী, অলকা, শক্তি, যুগের আলো, শিখা, নাচঘর, স্বদেশ, আজকাল, আজাদ, মাহে-নও, বৈতালিক, মোসলেম ভারত, বকুল, জয়তী, বাংলার কথা, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা এরকম প্রায় শতাধিক পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পত্রিকাগুলোর কোনোটির পরিচালক, সম্পাদক বা ফরমায়েসি লেখক হিসেবে তিনি যুক্ত ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবিতা-গানে, নজরুল যেমন তার মনোভাবকে অকুণ্ঠভাবে প্রকাশ করতে ভয় পাননি, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তেমনি তিনি জনতার কাতারে থেকেছেন সব সময় ।পিছ পা হন নি কখনো। নজরুল পত্রিকার অনেক সংবাদের শিরোনাম দিতেন কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান ও কবিতা থেকে তিনি উদ্ধৃত করেছেন। যেমন: রবীন্দ্রনাথের একটি গানের লাইন, ‘তোমারই গেহে, পালিছ স্নেহে/আমি ধন্য ধন্য হে’ সেখান থেকে নজরুল তাঁর নিজের মতো করে একটি সংবাদের শিরোনাম করলেন, ‘তোমারই জেলে, পালিছ ছেলে/আমি ধন্য ধন্য হে’। তেমনি তাঁর সম্পাদকীয়র ধারা ভিন্ন ছিলো এবং এগুলোর ভাষাও অত্যন্ত তেজস্বী ও বিপ্লবী ছিলো।”ধূমকেতুর অষ্টম সংখ্যা থেকে সম্পাদক শব্দটির পরিবর্তে ‘সারথি’ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়া শুরু হল। ধূমকেতুর সারথি কাজী নজরুল ইসলাম। পত্রিকার সম্পাদককে সারথি হিসেবে চিহ্নিত করা নজরুলের একান্তই নিজস্ব ধরণ। বাংলা সংবাদপত্র বা পত্রিকার ক্ষেত্রে নজরুলের ‘ধূমকেতু’র আগে বা পরে এই ধরনের ব্যবহার আর কোথাও দেখা যায়নি। ‘নবযুগ’ দিয়েই কবি কাজী নজরুলের সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয় আবার পরবর্তীকালেও ‘নবযুগ’ দিয়েই তাঁর সংবাদিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে। তিনি  তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে স্বাধীনতার বাণী প্রচার করেছেন।  ফলে ইংরেজি শাসকের কারাগারে তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। নজরুল কিন্তু কবি পরিচয়ের জন্যই শুধু কারাবরণ করেননি। সাংবাদিকতার জন্যও গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ধূমকেতুর দ্বাদশ সংখ্যার সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। ১২৪ (ক) ও ১৫৩ (ক) ধারায় স্থিতাবস্থা নষ্টে ইন্ধনের অভিযোগে নজরুলকে গ্রেফতার করা হয় সে সময় । নজরুল ইসলাম তখন শাসকশ্রেণীর সঙ্গে কোনোরূপ আপোস করেননি। 


অলংকরণঃ তাইফ আদনান