জলধি / প্রবন্ধ / যে কারনে বঙ্গবন্ধু লাহোর ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করলেন
Share:
যে কারনে বঙ্গবন্ধু লাহোর ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করলেন
১৯৭৪ সালের ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ইতিহাস-বিজড়িত লাহোর নগরীতে ‘ইসলামী সম্মেলন সংস্থা’র দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী ‘এই ভুখণ্ডে পাকিস্তানী সৈন্যদের নারকীয় তাণ্ডবের তাজা স্মৃতি’, বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মৌলিক স্তম্ভের একটি স্তম্ভ ‘ধর্মরিপেক্ষতা’, ‘পকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার অমিমাংসীত বিষয়াদির সমাধান হয়নি’- এমন অবস্থায় ঐ সম্মেলনে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগদান করেন, এটা নিয়ে সে-সময়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য না হলেও প্রতিবেশী দেশে এ নিয়ে কিছুটা উষ্মা দেখা দেয় এবং কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর কুশপুত্তলিকা দাহও করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে এদেশে নিছক সমালোচনার জন্য ঐ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অংশগ্রহণকে উদ্ধৃত করে বেশ কিছু মেঠো-আলোচনা হয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম এ-সকল আলোচনা পড়েছে, জেনেছে; কিন্তু তাদের জানানো প্রয়োজন স্বাধীনতার মাত্র দুই বছর পরে কেন পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ঐ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যোগদান করেছিলেন।
 
অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট: ১৯৭১’র ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছান। সদ্য-স্বাধীন একটি দেশের সরকারের নির্বাহী প্রধান হিসেবে তিনি প্রধান যে চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হন তা হচ্ছে: ১. দেশের সংবিধান প্রণয়ন ২. স্বাধীন দেশের জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সপক্ষে গণসমর্থন, যার জন্য প্রয়োজন ছিল গণভোট, ৩. বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ৪. সামরিক বাহিনি পুনর্গঠন, ৫. সরকারের কাছে মুক্তিবাহিনির অস্ত্রসমর্পন, ৬. প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ৭. আটক দালাল, রাজাকার, আল-বদর বাহিনির বিচারের লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন ও তাদের বিচার, ৮. দেশ থেকে ভারতীয় বাহিনিকে সম্মানের সাথে বিদায়দান, ৯. পাকিস্তানে আটকে-পড়া শতশত সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকদের ফিরিয়ে আনা ১০. পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রসমূহের কাছ থেকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়, ১১. জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তি, ১২. ভারতে বন্দী ৯৩০০০ পাকিস্তানী সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির বিচার।
 

উপরোক্ত বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনার মাধ্যমে ‘ইসলামী সম্মেলন সংস্থা’র দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা যেতে পারে।

অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট:
১. সদ্য স্বাধীন দেশ পরিচালনার জন্য দেশটির সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় সাংবিধানিক পরিষদ দ্রুত সংবিধান প্রণয়ন শুরু ও সম্পন্ন করে, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদীয় শাসনব্যবস্থা সম্বলিত সংবিধান গণপরিষদে অনুমোদিত হয়। প্রথম জাতীয় সংসদে দেশের সংবিধান অনুমোদিত হয়, উক্ত সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। তবে জাতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়, প্রথম জাতীয় সংসদে সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদনের পূর্বে প্রবাসী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার এবং ’৭২এর ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বে সরকার ও গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত সকল সিদ্ধান্ত বৈধ বলে আইনগতভাবে স্বীকৃত হয়ে যায়।    

২. ১৯৭০ সালের যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তা ছিল মূলত সামরিক জান্তার অধীনে পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো আসনে জয়লাভকারী দল আওয়ামী লীগ ১৭ এপ্রিল দেশের অভ্যন্তরে বৈদ্যনাথতলাতে (পরবর্তীতে মুজিবনগর) অস্থায়ী সরকার গঠন করে, সেই সরকারের অধীনে ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এবং যুদ্ধজয়ের পরে সেই দল সরকার করে দেশ পরিচালনা করবে- এটাই সর্বজনস্বীকৃত। তথাপি একটি গণভোটের মাধ্যমে সরকারের স্বীকৃতি অর্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ১৯৭৩ সালের ৭মার্চ দেশে প্রথম সংসদীয় নির্বাচন অনষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে বাংলাদেশ আৗয়ামী লীগ ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়লাভ করে।
৩. পাকিস্তান শাসনামলে যে-সকল বাঙালি বেসামরিক কর্মকর্তাগন ঊর্ধ্বতন মাঝারি পদে চাকরিরত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন ও যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারীদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে বঙ্গবন্ধু খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেন, এই প্রশাসন সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।
৪. স্বাধীনতার পরে মুক্তিযোদ্ধদেরকে নিজ নিজ বাহিনিতে ফিরিয়ে নিয়ে সামরিক বাহিনি, বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর), ও পুলিশ বাহিনি গঠন করা হয়। তবে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী স্থায়ীত্বশীল কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এদেরই বড়ো একটা অংশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করে; জাসদ সশস্ত্র পন্থায় ক্ষমতায় আরোহনের লক্ষ্যে গণবাহিনি গঠন করে- যা দেশকে চূড়ান্ত অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়।
৫. পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাধীনতা অথবা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার পতনের পরে সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনি গঠিত হয় এবং দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। কিন্তু স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রনে ও বিচ্ছিন্নভাবে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, সকলকে সরকারের কাছে অস্ত্র সমর্পনের আহবান জানান। ১৯৭২ সালে ৩১ জানয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু নিজে অস্ত্র গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব এতই প্রবল ছিল যে, স্বাধীনতার পরে কোনো মিলিশিয়া-বাহিনি গড়ে ওঠেনি। পর্যায়ক্রমে গোটা দেশে মুক্তিবাহিনির সদস্যবৃন্দ অস্ত্র সমর্পনের করে। যদিও কিছু বামপন্থী কট্টর ও ভ্রান্ত উপদল, গ্রুপ অস্ত্র-সমর্পন থেকে বিরত থাকে। পরবর্তীতে দুই দশকের মধ্যে তাদের রাজনীতি দেশ থেকে বিলীন হয়ে যায়।
৬. স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৯৯ লাখ টন (বর্তমানে সাড়ে ৩ কোটি টনের বেশি)। ওই সময় দেশের ৮৮ ভাগ মানুষই ছিল দরিদ্র। মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। নবগঠিত সরকার প্রথম বাজেট দেয় মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার। যুদ্ধের ভয়াবহতায় যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ে। কোনো নদীঘাটে ফেরি ছিল না, ব্রিজগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, দুটো বন্দর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কল-কারখানা ধ্বংস অথবা পরিত্যক্ত হয়েছিল। ফলে ১৯৭২ সালে ’৭০ সালের তুলনায় শিল্পোৎপাদন হ্রাস পায় ৩০ শতাংশ। দেশের রিজার্ভে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। ফলে বার্টার পদ্ধতিতেও আমদানী-রপ্তানী করতে হয়েছে। তবে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে ও প্রশাসনে কিছু মেধাবী অর্থনীতিবিদ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদেরকে দিয়ে  ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত পাঁচশালা অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করেন। দেশের উন্নয়ন-ব্যবস্থায় এই পদ্ধতি পরবর্তী ৩ দশক অনুসৃত হয়েছে।
৭. ২৫ মার্চের পরে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনি তাদের সহায়তা করার জন্য নানা নামে প্যারামিলিশিয়া বাহিনি গঠন করে। এছাড়া তাদের প্রতি অনুগত জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগারদের নিয়ে সারা দেশে জেলা ও থানা পর্যায়ে  পিস কমিটি নামে এক বেসামরিক দালালগোষ্ঠী তৈরি করে, যাদের কাজ ছিল মূলত তাদেরকে তথ্য-সহায়তা দেয়া। পৃথিবীর অনেক দেশে এ-ধরনের দালাল ও দেশীয় শত্রুকে যুদ্ধশেষে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তা করা হয়নি। তবে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে এই সকল বেসামরিক ও প্যারামিলিশিয়া সদস্যদের বিচারের দাবি প্রবল হতে থাকে। তাদের অনেকে জেলখানায় অন্তরিনও ছিল। সরকার জনঅনভূতি ধারণ করে ‘রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে (অধ্যাদেশ) দালাল আইন, ১৯৭২’র ২৪ জানুয়ারি “দ্যা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার” জারি করে। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই আইনের আওতায় ২,৮৮৪টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় সাজা দেওয়া হয় ৭৫২ জনকে। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড-, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও ছিল। (১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে সামরিক সরকার দালাল আইন বাতিল করে)।
৮. বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেন বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনির অবস্থান বহুমুখী সমস্যা সৃষ্টি করবে। ’৪৭ সালে পাকিস্তান গঠিত হবার পর থেকেই দেশের মানুষ প্রথম থেকেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনিকে বিদেশী বাহিনি হিসেবে বিবেচনা করেছে। একইভাবে অত্যল্পকাল পরেই ভারতীয় বাহিনির প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। খুলনা অঞ্চলে সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব) জলিল ভারতীয় বাহিনির সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী মুসলিশ দেশসমূহের স্বীকৃতি অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে-  এ-সকল বিষয়াদি বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় বাহিনিকে বাংলাদেশ ত্যাগ করাতে সক্ষম হন। তারা ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে এবং অল্পকালের মধ্যেই তা শেষ হয়।

 
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: ইস্টার্ন কমান্ডের সেনাপতি জেনারেল নিয়াজী পরাজয় মেনে নিয়ে আত্মসমর্পনে রাজি হন, তবে তিনি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের প্রধান ভারতীয় জেনারেলের কাছে আত্মসমর্পনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কেননা, তিনি আশংকা করছিলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পন করলে তারা ৯ মাস এদেশে যে বর্বরতা চালিয়েছে, সে-কারণে মুক্তিবাহিনি প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারে। পক্ষান্তরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পন করলে ‘জেনেভা কনভেনশন’ অনুযায়ী তারা যুদ্ধবন্দীর মর্যাদা পাবে এবং  মুক্তিবাহিনির রোষানল থেকে বাঁচতে পারবে। স্বভাবতই ভারতীয় পক্ষও এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি; একটি দেশের সেনাবাহিনি অপর দেশের কাছে এমন লজ্জাজনকভাবে আত্মসমর্পন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে আর ঘটেনি। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পনের পরে ২০ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদেরকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়; এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ পক্ষের ভূমিকা ইতিহাসের অনুদঘাটিত অংশ।
 
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে আসার পরে ’৭৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়, সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন জাতীয় সংসদ গঠিত হয়, বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক-বাহিনি পুনর্গঠিত হয়। অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনায়নের লক্ষ্যে পাঁচশালা উন্নয়ন পরিকল্পনা গৃহীত হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ’৭৩ মাঝামাঝি নাগাদ যে বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা হচ্ছে: সৌদি আরব, ইরান, ও তুরস্কসহ বেশ কিছু শক্তিশালী আরব দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান থেকে বিরত থাকে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ গ্রহণে চীনের পুনঃ পুনঃ ভেটো প্রদান, আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে পাকিস্তানে আটক প্রায় ৪ লক্ষ সামরিক ও বেসামরিক বাঙালির ওপরে রাস্ট্রীয় নিপীড়ন-নির্যাতনের খবর এবং ভারতে আটক ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী ও তাদের মধ্যে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারে অনিশ্চয়তা।
 
এমতাবস্থায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ৪টি অমিমাংসিত ইস্যু উঠে আসে: ১. যুদ্ধবন্দী প্রত্যর্পন, ২. বাংলাদেশ থেকে বেসামরিক উর্দুভাষী পাকিস্তানীদের প্রত্যাবাসন, ৩. পাকিস্তান থেকে সামরিক ও বেসামরিক বাংলাদেশীদের প্রত্যাবাসন, ৪. যুক্ত পাকিস্তানের সম্পদ ও দায়-এর ভাগ-বন্টন।
 
ভুট্টো পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই এই মর্মে আন্তর্জাতিক প্রচারণা চালাতে থাকে যে, ভারতে আটক যুদ্ধবন্দীদেরকে অবিলম্বে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে। কেননা, ভারত পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে পাকিস্তানী সামরিক ও বেসামরিক মানুষকে বন্দী করে নিয়ে এসেছে, তারা ভারতীয় অংশে ধৃত হয়নি। পাকিস্তানের বড়ো বড়ো নগরীগুলোতেও ক্ষমতাসীন দলসহ সকল দলই ভুট্টোর দাবির সপক্ষে জনসমাবেশ অব্যাহত রাখে, যা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে প্রচারিত হতে থাকে। অপরদিকে বাংলাদেশেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ মন্ত্রীবর্গও বিভিন্ন জনসমাবেশে বড়ো অপরাধে অভিযুক্ত ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিচারের দাবি জানিয়ে বক্তব্য দিতে থাকেন। পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী আটক রাখায় ভারত আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় নিপতিত হয়। কেননা, তদানিন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে যুদ্ধরত ভারতীয় নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনির কাছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তৈরি আত্মসমর্পন দলিলে পাকিস্তানী বাহিনি বিনা-শর্তে আত্মসমর্পন করেছে এবং সেই দলিলে যুদ্ধবন্দীদের বিচারের প্রসঙ্গটি নেই। তাছাড়া আত্মসমর্পনের পরে যুদ্ধবন্দীদেরকে কোনো কারণ ছাড়াই দীর্ঘদিন আটকে রাখাও আন্তর্জাতিক রীতিনীতির খেলাপ। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভারতের জন্য বিষয়টি অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এমতাবস্থায় ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সিমলা নগরীতে এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন, দুই নেতার শীর্ষ বৈঠক ২৮ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত চলে। বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছাড়াই দুই দেশের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়; যা ইতিহাসে ‘সিমলা চুক্তি’ নামে অভিহিত। এই চুক্তির দরুন যুদ্ধবন্দীদের বিচার, পাকিস্তান থেকে সামরিক ও বেসামরিক বাংলাদেশীদের দ্রুত প্রত্যাবাসন, বাংলাদেশ থেকে বেসামরিক উর্দুভাষী পাকিস্তানীদের প্রত্যাবাসন ও যুক্ত পাকিস্তানের সম্পদ ও দায়-এর ভাগ-বন্টন একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
ভারত ও পাকিস্তানের দুই নেতার দীর্ঘ আলোচনার পর যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তার মূল ধারাগুলো হচ্ছে:  ভারত ও পাকিস্তান তাদের সকল বৈরিতার অবসান ঘটাবে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়সহ সকল ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্ধে পাকিস্তানের (পশ্চিম ফ্রন্টে) যে ভুখণ্ড ভারতীয় বাহিনি দখল করেছিল তা বিনা শর্তে ফিরিয়ে দেয়া হবে, ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরে সীমান্তের যে অবস্থানে যে দেশের সৈন্য অবস্থান করছিল, সেই অবস্থান ‘লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি)’ হিসেবে স্বীকৃত হবে এবং ভারত বাংলাদেশে আটক সকল পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিকে বিনাবিচারে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাবে।
সিমলা চুক্তির বলে ভারতে আটক যুদ্ধবন্দী; বিশেষত, গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিচারের প্রশ্নটি ম্লান হয়ে যায়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় অপর ৩টি ইস্যুতেও অচলাবস্থা দেখা দেয়। ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকার মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিচারের কথা ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবন্দীদের বিচারের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলে পাকিস্তান ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’-এর কাছে এই মর্মে প্রতিবাদলিপি পাঠায় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সংঘটিত কোনো ঘটনার জন্য পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের এক্তিয়ার বাংলাদেশ সরকারের নেই। এবং, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে আটক সৈনিকদেরকে দীর্ঘদিন ভারতে আটকে রাখার এক্তিয়ারও ভারতের নেই। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যেই বলা হয় যে, সে-দেশে আটক বাঙালিদেরকে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা পরিচালনার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রদ্রোহিতা ইত্যাদি অভিযোগে পাকিস্তানে বিচার করা হবে। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর উদ্বেগ অনুধাবন করেন এবং সমঝোতামূলক কূটনৈতিক পন্থায় সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
আমরা জানি যে, ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’-এ যে কোনো বিষয়ের বিচার একটি প্রলম্বিত বিষয়। ওদিকে তাৎক্ষনিকভাবে পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশীদের ওপরে পাকিস্তান সরকার নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সেনানিবাসে আটক সেনা-কর্মকর্তা ও সৈনিকদের রেশন কমিয়ে দেয়া হয়, বাড়ির বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় (পূর্বাহ্নে অনুমতি ব্যতিরেকে সেনানিবাসের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল), সামরিক ও বেসামরিক বাংলাদেশীদের ব্যাংক-অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয় (করাচীতে কয়েক লক্ষ শ্রমজীবী ও মৎস্যজীবী বাঙালীদেরকে নিজ নিজ এলাকায় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়)।
ঠিক একই সময়ে ‘অরগানাজাইজেশান অব ইসলামিক কনফারেন্সে (ওআইসি)’-এর আসন্ন দ্বিতীয় শীর্ষসম্মেলনে সোভিয়েত ঘরানার কিছু মুসলিম দেশ, বিশেষত মিশর ও আলজেরিয়ার উদ্যোগে ওআইসি’র মহাসচিব ১৯৭৪ সালের ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোর নগরীতে সংস্থাটির দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর সংস্থাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। এ-ছাড়া মিশর ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল। মিশর, আলজেরিয়াসহ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানকারী কিছু দেশ পর্দার অন্তরালে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করতে থাকে। আরব লীগও বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা করে।
বঙ্গবন্ধু ওআইসি’র শীর্ষসম্মেলনে অংশগ্রহনের দুটি যৌক্তিকতা উপলব্ধি করেন: ১. বাংলাদেশ সে-সময়ে আর্থিক সংকট ছাড়াও প্রচণ্ড বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছিল। পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র সৌদ আরব, ইরান, ও তুরস্কসহ বেশ কিছু বিত্তশালী আরব দেশ স্বাধীন বাংলাদেশকে তখনও স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি বাংলাদেশীরা ঐ বছরগুলোতে বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে হজ্বেও যেতে পারত না। সম্মেলনে অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে সম্পদশালী মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ আসতে পারে। ২. পাকিস্তানে আটক আটক প্রায় ৪ লক্ষ সামরিক ও বেসামরিক বাঙালির বিনিময়ে ৯৩ হাজার য্দ্ধুবন্দী বিনিময়ের যে সম্ভাবনা ছিল সিমলা চুক্তির কারণে তা অন্তর্হিত হয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানের সাথে সরাসরি আলোচনার সুযোগ প্রয়োজন; যা এই সম্মেলনে হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে আটকে-পড়া বাঙালিদের প্রত্যবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হতে পারে।

আরব লীগ নেতবৃন্দের কূটনৈতিক চাপ, মিশর ও আলজেরিয়ার নেপথ্য কূটনীতির প্রভাবে পাকিস্তান ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। একই দিন ইরান ও তুরস্কও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে।  সে-বছর ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে ‘ইসলামী সম্মেলন সংস্থা’র দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলন বঙ্গবন্ধু যোগদানের সিদ্ধান্ত-গ্রহণ করেন; যা ঐ মুহূর্তে অনেককে বিচলিত করলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সেই সিদ্ধান্তের সুফল ভোগ করছে নানাভাবে; এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর ‘স্টেটম্যানশীপ’। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ কূটনৈতিক বিজয় ছিনিয়ে আনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে! আর এর পুরো কৃতিত্বই বঙ্গবন্ধুর। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আসে এই জয়।

সহায়ক তথ্যসূত্র
১. দ্যা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২, ২৪ জানুয়ারি।
২. লে.জে. এ. এ. কে নিয়াজী, (অনু: ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল), দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান, আফসার ব্রাদার্স, ২০১১, ঢাকা, বাংলাদেশ।
৩. একেএম আতিকুর রহমান, “মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক”, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
৪. তানভীর সালেহীন ইমন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বর্হিবিশ্ব’ তাম্রলিপি , ২০২০, ঢাকা।
৫. মওদুদ আহমেদ (অনু: জগলুল আহমেদ), ‘শেখ মুজিবর রহমানের শাসনকাল’, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৮৭, ঢাকা।

6. https://mea.gov.in/in-focus-article.htm?19005/Simla+Agreement+July+2+1972.

7. https://casebook.icrc.org/case-study/bangladeshindiapakistan-1974-agreement.

 8. Shahnawaz Mantoo, “Sheikh Mujibur Rehman: Founder of Bangladesh”, Department of Political Science, University of Kashmir, 2015, India.



অলংকরণঃ জলধি