জলধি / প্রবন্ধ / বিমূর্ত থেকে মূর্ত - প্রয়োগ।রূপান্তর।ভাবনা
Share:
বিমূর্ত থেকে মূর্ত - প্রয়োগ।রূপান্তর।ভাবনা
(চিহ্ন সম্পর্কিত ১টি আপেক্ষিক ধারনা'য়)
কবিতা পরবর্তীতে চিহ্ন-সম্ভাব্যতা @
আলোচিত বই : চিহ্নতত্ত্ব বা সেমিওলজি (সস্যুর থেকে দেরিদা); রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়; তবুও প্রয়াস
---------------------------------------------------------------------
এ জগৎ ও তার সাথে আন্তঃসম্পর্কিত প্রকৃতিটির যদি শুরু থেকে ইতিহাসটি দেখা যায় ~ খুব সাধারনভাবে আমরা দেখবো : কিভাবে সমস্ত বিক্রিয়াগুলি বিভিন্ন শক্তির সন্নিবিষ্ট রূপ ও রূপান্তরগুলি নিয়ে আজকের বিবর্তনটিকে আমাদের চোখের সামনে দাঁড় করিয়েছে; বিমূর্ত থেকে মূর্ততায়।আসলে ~ বিমূর্ত হলো আকারহীন বা যেকোনোরকম রূপহীন; বিষয়টিকে আরো সুন্দর করে বলা যায় ~ বিমূর্ততা হলো সেই প্রকৃতি, যাঁর কোনো সচেতন সংজ্ঞা হতে পারেনা বা হওয়াটা একটি আপেক্ষিকভাবে ও প্রাথমিকভাবে অসম্ভব।সুতরাং, একথা বলতেই পারি ~ যাঁর, সচেতনভাবে একটি নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা থাকে : তাই'ই হলো বিমূর্ততা'র রূপান্তরিত মূর্ত রূপ বা আকার।সভ্যতার শুরু থেকেই বিমূর্ত ও মূর্ত'র ভিতর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ক্রমবিকাশমান; যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা ~ যেটি একদিকে যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যম এবং অপরদিকে আগুন // চাকা আবিষ্কারের চেয়ে সমান্তরাল গুরুত্বপূর্ণ একারণেই যে, সভ্যতা যেহেতু প্রকৃতি ও ব্রহ্মাণ্ডের সাথে জীবিত'র পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্কটি বেঁচে থাকার উপাদানগুলির আদানপ্রদানের সর্বোচ্চ আনুপাতিক হার নির্ভর।
 
প্রসঙ্গত, 'মুজনাই' শিরোনামে একটি আন্তর্জাল পত্রিকায় ভাষার প্রাথমিক বিকাশ সম্পর্কিত ধারনায় যা বলেছিলাম ~ "প্রযুক্তি বিষয়টিকে যদি একলাইনে বলতে হয়, তা এভাবে বলা যেতেই পারে : "এমন একটি ব্যবস্থা, যা দুটি বস্তুর ভিতরে নূন্যতমো উপলব্ধ সহজ উপায়ে ও দ্রুততমো যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম"।একটু কি কঠিন লাগলো? তবে আসুন, কথাটিকে একটু সহজ করে বোঝা যাক।উদাঃ-১ : ধরা যাক গুহামানুষের কথা।সে জানতো না ছবি আঁকার কথা / অক্ষর কল্পনা থেকে ভাষার লিখিতো রূপ।সে কেবল অপরের সাথে যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের উদ্দেশ্যে, দৃশ্যকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা থেকে শিখে নিয়েছিলো স্বরধ্বনির ব্যবহার।ব্যবহৃত হয়েছিলো ধ্বনিভিত্তিক সংকেত।কারন, সংকেত হলো স্বল্পকায় এবং দ্রুতগতির যোগাযোগ বা অবস্থান নিশ্চিত করার প্রামাণ্য ডকুমেন্টেশন।আবার বিভিন্ন ছন্দভিত্তিক ভাবে, সেই স্বরধ্বনির পুনরাবৃত্তি থেকে জন্ম নিলো সুর এবং শ্রুতি।কিন্তু শুধুমাত্র ধ্বনিভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো সীমাবদ্ধতা সম্ভবতো, যোগাযোগ করতে চাওয়া চরিত্রগুলির একই সময়কালে অবস্থান এবং নিগর্ত ধ্বনির শ্রুতিসীমানায় চরিত্রগুলির শর্তসাপেক্ষ থাকা।এখোন, এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে গিয়েই হোক / নিজ অস্তিত্বকে বহু ভীড়ে খুঁজে নেবার তাগিদ থেকেই হোক : প্রয়োজন হলো, দৃশ্যকে কিছু চিহ্ন আঁকার মাধ্যমে প্রকাশিত করার প্রয়োজনীয়তা।গভীর পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে খোঁজা হলো, কঠিন মাধ্যমের আধার বা চিত্রধারক (আধূনিকতায় যা ক্যানভাস্)।খুঁজে নেওয়া হলো, উপযোগী ও উপযুক্ত লেখনী ধারকশৈলী অনুযায়ী।তারপর বর্ণ / রঙ।পরবর্তী পর্যায়ে : অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলার ইচ্ছে নিয়ে কাল্পনিকতার মিশেল সহযোগে ব্রহ্মাণ্ডের বিমূর্ত প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ করার প্রথম সার্থক প্রচেষ্টা।"
 
'চিহ্ন কি?' ~ যদি প্রশ্নটির উত্তর আমাদের জানা গতানুগতিকতার বাইরে দিতে হয়, তাহলে কি বলতে পারি : যেকোনো বিষয় সম্পর্কিত এক বা একাধিক সমান্তরাল নির্দিষ্ট রূপটিকে সচেতনভাবে সংজ্ঞাভিত্তিক প্রকাশ ও সেটিকে অন্যের প্রতি একটি যোগাযোগব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে প্রয়োগ করতে পারা; তাই'ই হলো চিহ্ন।এখানে, 'অন্য' অর্থে ব্রহ্মান্ডের যাবতীয় জীবিত বা আপেক্ষিকভাবে মৃত ~ যেকোনো কিছুই হতে পারে।এখন এই অংশটিকে আরও প্রাঞ্জলার্থে বলতে গেলে; প্রসঙ্গক্রমে সেই 'মুজনাই' নামের পত্রিকাটির একটি আন্তর্জাল সংখ্যায় প্রকাশ : "ধরা যাক কোনো একজনকে সামুদ্রিক গভীরতার চরিত্র ব্যাখ্যা করতে বলা হলো, যে কখনো সমুদ্র দেখে নি।নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এখানে তাঁর একমাত্র সহযোগী আশ্রয় উপাদান হলো কল্পনা, যেটি সে তার নান্দনিক বিষয়টি সম্পর্কিত আত্তীকৃত চেতনা থেকে প্রকাশ করবে।এবার তাকে, কিছু তথ্য দেওয়া হলো সমুদ্র সম্পর্কে।দেখা যাবে, তার তথ্য নির্ভর কল্পনা কিছুটা রূপান্তরিত হয়েছে।এবার তাঁকে দেখানো হলো অডিও এবং তারপর অডিও-ভিস্যুয়াল পর্ব।দেখা রূপান্তরকরণের প্রবণতা আরো ক্রমবর্ধমান।এবার, সবশেষে তাঁকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া গভীর সমুদ্রতলে।দেখা যাবে, তাঁর চেতনালব্ধ নন্দনতত্ত্বের চূড়ান্ত রূপান্তর।অর্থাৎ, অভ্যস্ত মাধ্যম ও তা থেকে প্রাপ্ত তথ্যশৈলীর প্যাটার্ন থেকে লব্ধ অনুভূতিসমূহের প্রকাশ (যাকে কিছুটা হলেও কল্পনা বলা যেতে পারে) ~ এসবই পরিবর্তনশীল, অস্থায়ী। 'কাল্পনিকতা' বিষয়টিকে বলতেই পারি : জানা এবং অজানার মধ্যে থাকা পারস্পরিক সম্পর্কের বাহ্যিক প্রকাশ (একটা অচেনা relation)।ভাষা / সংখ্যা / শূন্য / ইত্যাদি : যেকোনো কিছুতেই নান্দনিকতা বিষয়টি, অনেকটাই এরকম নয় কি?"
এতোটা পড়ার পর, কেউ এবার প্রশ্ন করতেই পারেন ~ বর্তমান সময়ে চিহ্ন নিয়ে এতোকিছু চর্চার প্রয়োজনীয়তা কোথায়? বা, কবিতা/গদ্য নিয়ে চর্চার ক্ষেত্রে, চিহ্ন নিয়ে এতো বক্তব্য কী কেবলই কয়েকটি বইমাত্র পঠিত কয়েকটি উটকো জ্ঞান বিতরণ নয় কি? অতএব, আলোচনার আরো গভীরতা বাড়াবার আগে, এই বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন।সম্প্রতি, প্রিয় একটি সাহিত্যপত্রিকার অগ্রজ সম্পাদক বলছিলেন, "উন্নততর সমাজব্যবস্থা ছাড়া কবিতা কেউ পড়বে না"।কোনো তার্কিক মহাসভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অনেকেই হয়তো করতে পারেন; অবিশ্যি এটা তাঁরাই করবেন ~ যাঁরা দৈনন্দিন চিন্তনের অনুশীলন সম্পর্কিত চর্চা থেকে বিরত হয়েই নিজস্ব যাপনপর্বটিকে অতিবাহিত করে যান।যদিও, অহেতুক বিতর্ক বাদ দিয়েও একথা বলাই যায় ~ "উন্নততর" শব্দটি নিজেই একটি অভিজাত ও জটিল এবং কখনোসখনো 'ইউটোপিক্' বা কষ্টকল্পিত বিষয়।কারণ, আজ অবধি পৃথিবীতে কোনো স্থানে ~ না এমন কোনো সময় এসেছে বা পর্ব এসেছে।যদি আসতো কবি হিসেবে আমরা সকল মানুষকেই পেতাম; অর্থাৎ কবি ও পাঠক :: উভয় অংশটিই আলাদা হয়ে থেকে যেতো না।বিদেশেও দেখেছি, পাঠকসংখ্যা সুনির্দিষ্ট।
আর ভিন্ন ধারার চেতনা সমন্বিত কবিতাতে; এই সংখ্যা আরোই কম।নতুবা সকল কবিই হতেন সর্বজনবিদিত সেলিব্রিটি।কিন্তু জীবদ্দশায় এমোন বিষয়ের পুনরাবৃত্তি খুব একটা আমরা দেখি না।অতএব এই স্থানটিকে আরো একটু বিশ্লেষণ করলেই; আমরা যা পেতে পারি : "কবিতা হলো চেতনার গতিপ্রাপ্ত এমনই এক প্রকাশ, যা সময় সাপেক্ষ এবং মুহূর্ত থেকে প্রতিনিয়ত মূর্ততা ও বিমূর্ততা'র আন্তঃসম্পর্কিত ধারকটিকে জানান দেওয়ার সাক্ষী।এটি মূলতঃ দুই প্রকার, প্রথমটি হলো সময়ের একরৈখিকতা'কে আশ্রয় করে স্থানীয় অঞ্চলে বসবাসকারী পাঠককে, সেই নির্দিষ্ট সময়টির গতির প্রতি আকর্ষিত করা।দ্বিতীয়টি হলো বর্তমান সময়বলয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভিন্ন একটি সময়বলয়ে প্রবেশ এবং তার সাপেক্ষে নতুন অজানা যাত্রপথে থেকে আশেপাশের যাবতীয় বৈশিষ্ট্যগুলির অনুসন্ধান ও প্রয়োগকরণ; যা একপ্রকার ভিন্ন মাত্রার নিরীক্ষা-প্রবণতা বিশেষ।" অতএব কবিতা বিষয়ক যে প্রকরণটি সংক্ষিপ্ত স্তরে পেতে পারি ~ (১) সময়োচিত কবিতা :: বিমূর্ততা'র গায়ে মূর্ততা'র আবরণটিকে নিয়ে চর্চা ও অনুশীলন এবং (২) ভবিষ্যৎমুখী গতিপ্রাপ্ত বহুরৈখিক সময়ের কবিতা :: বিমূর্ততা'র গা থেকে মূর্ততা'র আবরণটিকে সরিয়ে ফেলে নগ্ন ও প্রকৃত'র অনুশীলন।অর্থাৎ সহজ কথায় নিজস্ব ভাষার বিন্যাসে কবিতা প্রকাশের প্রক্রিয়াটি একটি বিপরীতমুখী দ্বান্দিক্ পর্যায়; যদিও উভয়ের যাত্রাপথই ~ মূর্ততা এবং বিমূর্ততা গুণাবলী'র অভ্যন্তরে থাকা কোনো কিছুর সাথে আন্তঃসম্পর্কিত।আসলে, যাকিছুই ঘটছে ~ সেসবেরই 'টাইম অ্যান্ড স্পেস' আলাদা আলাদা। আমাদের লজিক্যাল্ সিস্টেম অনুযায়ী 'টাইম' বিষয়টি হলো সময় (মহাবিশ্বের মৌলিক কাঠামোর ভিতরে থাকা, এমন একটি বিশেষ অংশ ~ যেখানে সমস্ত ভৌত বা বাহ্যিক পরিবর্তনের ঘটনাসমূহ, একটি নির্দিষ্ট ক্রমধারায় ঘটে) এবং 'স্পেস' হলো স্থান (মহাবিশ্বে অসীম অভিমুখীন দৈর্ঘ্য / প্রস্থ / উচ্চতা বিশিষ্ট ত্রিমাত্রিক বিস্তৃতি, যেখানে বস্তু ও ঘটনা একসাথে অবস্থান করে।অতএব, যার আপেক্ষিক অবস্থান এবং দিক আছে)।কিন্তু তার সাথে চেতনা / আলো / স্পন্দন ~ এসব কি পৃথক পৃথক মাত্রা হিসেবে গণ্য হতে পারে না? সমস্ত কিছু নিয়েই তো কবিতার ব্রহ্মাণ্ড।ভুল বললে, পাঠকের দায়িত্ব শুধরানোর।
 
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি ~ আবহমানের জগদ্দল স্থিরতা কাটিয়ে ভবিষ্যৎের কবিতা-ইতিহাসের পথে, শুরু থেকে যাত্রাপথটিকে চর্চা করা জরুরী এবং নতুন পথের আবহে আগামীর বিমূর্ত অভিমুখীনতায় 'চিহ্ন' বিষয়টি একদম'ই উপেক্ষা করার মতো নয়।আর, এখানেই গুরুত্বপূর্ণ একটি বই "চিহ্নতত্ত্ব বা সেমিওলজি (সস্যুর থেকে দেরিদা)"; লেখক রমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় // প্রকাশক 'তবুও প্রয়াস (পশ্চিমবঙ্গ)' // ডিসেম্বর ২০১৯।বইটিতে চিহ্নের একেবারে আদিপর্ব থেকে বর্তমান পর্যন্ত মোট নয়টি ভাগ রয়েছে।যা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দার্শনিক // চিন্তাবিদ // ভাষাবিদ বর্ণিত ভাবনাগুলির একপ্রকার যথাযথ ধারনা-প্রয়োগগুলির সারসংক্ষেপ।এর ভিতর যাঁদের ধারনা এবং প্রয়োগগুলিকে নিবন্ধিত করা হয়েছে ~ সস্যুর / পিয়ার্স / লুই হেলমস্লেভ / রোঁলা বার্থ / লেডি স্ত্রোস / জাক লাকাঁ / দেরিদা ~ দেখানো হয়েছে কিভাবে ভাষাতাত্ত্বিক দর্শন থেকে শুরু করে চিহ্নগত বিবর্তনগুলি সময় সাপেক্ষে স্পষ্টতরভাবে রূপান্তরিত হয়েছে এবং সেটি আগামীদিনে আরও কতোটা সমাজজীবনে প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
 
মূলত ভাষা সৃষ্টির ইতিহাসভিত্তিক দর্শনগত ধারনার ওপর নির্ভর করে ~ কালের প্রবাহে একটি শব্দ কীভাবে ভাষাতত্ত্বের ডায়ক্রনিক অ্যাক্সিস বা কালিক অক্ষরেখার সাপেক্ষে বিবর্তিত হয়; সেই বিষয়টির ওপর নির্ভর করে।বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন ফার্দিনান্দ দ্য সস্যুর।তিনি প্রথম প্রচলন করেন ~ ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক দেশিক বা সিনক্রনিক (synchronic) Axis; যার ওপর নির্ভর করে আলোচিত হয় : একটি ভাষার প্রকৃতি এবং অবস্থা কী, একটি ভাষার অস্তিত্বের প্রধান শর্তগুলি কী, ইত্যাদি।সস্যুরের ধারনানুযায়ী যেকোনো ভাষার চিহ্ন হলো ~ 'চিহ্নক & চিহ্নিত', এই দুটি বিষয়ের অনুপাত; যেখানে ~ 'ভাষা' একটি সিস্টেম, 'চিহ্নিত' একটি ধারনা (concept) এবং এই চিহ্নক এবং চিহ্নিতের সম্পর্ক অনিবার্য নয়, আকস্মিক।সস্যুরের ধারনা অনুযায়ী প্রতিটি চিহ্ন একেকটি স্বতন্ত্র পর্যায়, অর্থাৎ একটি চিহ্নের সাথে অন্য আরেকটি চিহ্নের পার্থক্য আছে বলেই দু-টি চিহ্ন অর্থবহ।আর এই পার্থক্য আছে বলেই একেকটি স্বতন্ত্র ভাষাগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সম্ভব।সস্যুর যেকোনো ভাষাকে দুভাগে ভাগ করেন ~ লাং (langue) এবং পারোল (parol)।লাং এখানে বলা যেতে পারে ভাষার এমন একটি গ্রন্থিত আলমারি, যেখানে তার সমস্ত চিহ্নগুলি রয়েছে এবং বক্তা যখোন সেখান থেকে একটি সুনির্দিষ্ট চিহ্ন ব্যবহার করেন ~ তা হলো পারোল।অর্থাৎ কবিতায় ব্যবহৃত ভাষাচিহ্ন বা শব্দার্থ-চিহ্নগুলির প্রয়োগ জনিত বিবর্তন বা আঞ্চলিক হবার ধরন, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের সূত্রপাত এখানেই ~ একথা বলাই যায়।সস্যুরের মতানুসারে লাং একটি সীমাবদ্ধ নিয়মানুবর্তিতা, কারণ চিহ্নরা নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সম্পর্কিত; যাকে তিনি বলেছেন ভাষার সিনট্যাগম্ (syntagm) বা একটি চিহ্ন অপর চিহ্নটির সাথে তথাকথিত বিশেষ নিয়মের syntagamatic বন্ধনে বাঁধা।কিন্তু বাক্যের তাৎপর্য নির্ধারনে এই সম্পর্কটি যথেষ্ট নয়, কারণ বক্তার চিহ্ন চয়নের স্বাধীনতা।কিন্তু কবিতা ভাষাচিহ্নের এক আজব রসায়নাগার; যেখানে সিনট্যাগম্ বিষয়টির প্রয়োগভিত্তিক বদল সম্ভব।
 
এরপর বইটিতে যে পর্বটি রয়েছে ~ সস্যুরের সমসাময়িক আমেরিকান দার্শনিক পিয়ার্স, চিহ্নের দর্শন নিয়ে যেসব ভাবনাগুলির অবতারণা করেন।সস্যুর যেখানে প্রতিটি চিহ্নকে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দু-টি তলবিশিষ্ট বা দ্বিআক্ষিক বা dyad ভেবেছিলেন, পিয়ার্সের মতানুসারে চিহ্ন ত্রিআক্ষিক বা তিনটি অঙ্গ বিশিষ্ট ~ প্রথমতা (firstness) // দ্বিতীয়তা (secondness) // এবং তৃতীয়তা (thirdness); যার সম্পর্কিত মূল তিনটি আলোচিত বিষয় হলো 'যথাযথ প্রতিবিম্ব' বা Representation // 'বিষয়' বা Object // 'ব্যাখ্যা' বা Interpretant।এছাড়াও পিয়ার্সের মতানুসারে যে কোনো কিছুই চিহ্ন নয়; যতক্ষন না তাকে চিহ্ন হিসেবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে।আবার, চিহ্নের ব্যাখ্যা নিজেই কিছু চিহ্নের সমষ্টি; অর্থাৎ একটি চিহ্ন আরো অনেক অসংখ্য চিহ্নের সমষ্টি ~ এভাবে একটি চিহ্ন থেকে অসংখ্য চিহ্নের জন্ম অনন্তকাল ধরে চলতে থাকা প্রবাহ, যার শেষ নেই / অসীম।পিয়ার্সের দৃষ্টিকোণ থেকে চিহ্ন স্বয়ংক্রিয়, স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।ঘটনার বিকাশের পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে চিহ্নগুলি অস্তিত্ব নির্ভর।এখন ঘটনার বিকাশপর্যায়টি কিভাবে চিহ্নের অস্তিত্ব ক্রমশঃ স্পষ্টতর করে তোলে একটু দেখা যাক।ধরা যাক, একটি ফটোগ্রাফি চোখের সামনে রাখা হলো ~ তার নৈস্বর্গতা চেতনায় একটি অনুনাদ সৃষ্টি করবে (সাধারনভাবে ভালো বা খারাপ লাগা), এটি হলো 'প্রথমতা // 'যথাযথ প্রতিবিম্ব'; এরপর তার মর্মার্থ অনুসন্ধান করতে চাইলে, যেসব আপাত উপাদানাংশগুলি পাওয়া যেতে পারে ~ 'দ্বিতীয়তা' // 'বিষয়'; এরপর থাকবে প্রচলের সাথে তার তুলনা, অর্থাৎ সম্পূর্ণ ব্যাখার গতিপথটি আদৌ সম্ভাব্য যুক্তিনির্ভর কি না ~ তখোন তা হলো 'তৃতীয়তা' // 'ব্যাখ্যা'।প্রসঙ্গত : বেশকিছুকাল আগে মুজনাই পত্রিকার একটি আন্তর্জাল সংখ্যায় একটি ফটোগ্রাফিকে ডিকোডিং করেছিলাম কবিতায় ~ সেখানে ফটোগ্রাফির চিহ্নগুলি কিভাবে ওপরের তিনটি পর্বের সমষ্টিগত অবস্থানে থেকে একটি কবিতার চিহ্নাংশে পরিনত হয়েছে তা নীচের অংশটি পড়লেই বোঝা যাবে।ঘটনাটির নাম রাখা হয়েছিলো 'ক্লিকপো' বা 'ক্লিক্-পোয়েট্রি'।
 
## ক্লিক্-পো (CLICKPO) ##
 
১৪৫তম কোভিড প্যান্ডেমিক্-দিবস ও তারপর
 
        
++++++++
 
চুউউউউউউপ্।। কোনো কথা হবে না
 
                                                    কোনোওরকম
 
আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা
 
আহত                        }
 
                                    প্রতিটা খাঁজ ###
 
                                    প্রতিটা কোষ ###
 
শব্দহীন  ><  চৌচিরতা
 
 
               ||
 
 
কয়েকতাল         নিরাকার শব্দ"ওরা
 
                          দৈনিক ~ ছুঁচসুতো বুনোট্
 
 
                          স্বশব্দ   {    আকরিক-নিরীক্ষণ 
 
                                                  ]] মেশামিশি 
 
                                                            ¢
 
                                                      শব্দবোধ
 
                                                      শব্দভেদ
 
 
(বি.দ্র. : ক্লিক্-পো অর্থাৎ ক্লিক্+পোয়েট্রি; এই সময়ের কবিতার একটি বিশেষ ফর্ম।যেখানে, ফটোগ্রাফি বা ক্যামেরাজনিতো ক্লিক্ নিজেই আস্ত একটি কবিতা হয়ে ওঠে।এখানে রাখা প্রস্তাবিতো শব্দরূপটি, কেবলমাত্র সেই ক্লিকপোটির শব্দভাষাগতো প্রতিফলন; যার ভিত্তি হলো "এনকোডিং & ডিকোডিং" প্রক্রিয়া।শব্দার্থ দ্বারা প্রস্তাবিতো ভাষারূপটি কোনো স্বতন্ত্র কবিতা নয়; বরং ক্লিকপোটির বা ক্যামেরা'র ছবিটির একটি অন্তর্বর্তী উপাদানগুলির সাপেক্ষে সাধারন ভাবানুবাদ)
 
ক্লিক্-পো : ডনমে ডোনামেয়ুরা (কেরালা, ভারত)
 
শব্দভাবানুবাদ : রাহুল গাঙ্গুলী (প.বঙ্গ; ভারত)
 
:
 
যদিও, পিয়ার্স বর্ণিত চিহ্নরূপের বুনোট এখানেই শেষ নয়; বরং তিনটি পর্বের মাত্রা'য় তাদের ভিতর পুনরায় বিভিন্ন চিহ্নের উপস্থিতির সম্ভাবনা তিনি দেখিয়েছেন ~ যারা নানাপ্রকার // নানাভাবে মিলিত হয়ে, অগুনিত চিহ্নাদি সম্পৃক্ত একটি ঘটনার সুনির্দিষ্টতা নির্দেশ করার চেষ্টা করে।যদিও চিহ্নবিজ্ঞান বা সেমিওলজি বা সেমিওটিকস্ অপরাধবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সাধারনভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে; কিন্তু কবিতা বা কবিতা পরবর্তী কোনো শব্দরূপের রহস্যময়তায় তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করার নয়।সস্যুর এবং পিয়ার্স পরবর্তী রুশ দার্শনিক ভ্যালেন্তিন ভলোশনিকভ ~ যিনি বললেন লাং একটি বিমূর্ত ধারনার প্রতিফলন; অতএব 'পারোল'-কেন্দ্রিক আলোচনাই ভাষা বিবর্তনের মূল উপাদান এবং একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা সিচ্যুয়েশনের কথাই পারোল; সুতরাং পরিস্থিতি পাল্টালে পারোল পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।এর পরবর্তী পর্যায়ে বইটিতে আলোচিত হয়েছে ড্যানিশ ভাষাতত্ত্বজ্ঞ লুই হেলমস্লেভ বর্ণিত ধারনা ~ সস্যুর বর্ণিত চিহ্নক বা Signifierকে তিনি বললেন প্রকাশ / আধার বা Expression এবং চিহ্নিত বা Signifiedকে আধেয় / বিষয়বস্তু বা Content; আবার Expression'কে ভাগ করলেন তিনটি পর্বে ~ বিষয় (expression substance) // রূপ (expression form) // উদ্দেশ্য (purport)।ধ্বনির পরপর অবিচ্ছিন্ন পরস্পর প্রবাহ বিশেষ উচ্চারণে ব্যবহৃত হলে তা expression substance; উচ্চারণের সমষ্টিগত অংশ হলো expression form; আর তা যখোন ভাবনার উদ্দেশ্যে বাহিত হয় expression purport।একইভাবে Contentকেও তিনটি পর্বে তিনি ভাগ করেন ~ content purport // content substance // content expression।হেলমস্লেভের মতানুসারে চিহ্ন কেবলমাত্র ধ্বনি-ভাবনার পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বলে না; সে বিভিন্ন একাধিক স্তরবিশিষ্ট।এমনকি তার সমষ্টিগত ভাষাটিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে, একটি 'পরাভাষা'র প্রয়োজন ~ ঠিক য্যামোন কোনো টেক্সট'কে বিশ্লেষণ করতে গেলে ব্যাকরণের ভাষা প্রয়োজনীয়; এখানে কিন্তু ব্যাকরণ meta-language বা পরাভাষা।আবার এই পরাভাষাটিও গঠনগতভাবে দ্বিতল বিশিষ্ট ~ content plane & expression plane; এমনকি এই content planeটিরও দুটি তল আছে ~ যথা, content plane এবং expression plane।অর্থাৎ চিহ্নের একাধিক স্তর ও বৈচিত্র্যকে হেলমস্লেভের দৃষ্টিকোণ থেকে নিবন্ধিত করতে চাইলে, চিহ্নতত্ত্ব হয়ে ওঠে আরো গভীরতর এবং সুদূরপ্রসারী।
 
গতো শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ফরাসী চিন্তাবিদ রোঁলা বার্থ ~ বিজ্ঞাপনে ছবি বা চিত্র প্রয়োগে চিহ্নের ব্যবহার নিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। বিজ্ঞাপনে উপলব্ধ বক্তব্যকে বার্থ তিনভাগে ভাগ করেন ~ মুখের কথা (verbal) // ভাষাগতো বক্তব্য (linguistic image) // সমগ্র ছবিটিকে একটি বিশেষ প্রতিবিম্বরূপে, যার আপাতদৃষ্টিতে ছবিতার্থ ছাড়া অন্য বক্তব্য নেই : অভিধা (denotation)।বার্থ এই ছবির অভিধা'কে বলেছেন non-coded message এবং যাপিত জীবনের চিহ্নাদির নিরিখে এই messageটি থেকে যেসকল শব্দার্থ পাওয়া যেতে পারে তা হলো coded message।বার্থ চর্চিত চিহ্নতত্ত্বে denotation থেকে প্রাপ্ত লক্ষণসমূহ বা connotationগুলি ~ চিহ্নাংশ সমষ্টি দ্বারা একাধিক চিহ্ন থেকে চিহ্নাদি'র স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ।আসুন, এবার একটি স্মরচিত কবিতা পরবর্তী শব্দরূপ দিয়ে বিষয়টিকে দ্যাখা যাক।
 
Mathematics in The Space 
--------------------------------------------------------
0ⁿ. 0ⁿ. 0ⁿ. 0ⁿ. 0ⁿ
                    0ⁿ
             0ⁿ
      0ⁿ
0ⁿ. 0ⁿ. 0ⁿ. 0ⁿ. 0ⁿ
                             "
          ➻ n = {(0 ÷ 0) ∝ k.∞
 
    ↹
 
             [k →  V/I/S/I/O/N]
 
                      |∞|
 
            [k →  I/L/L/U/S/I/O/N]
 
                     |∞|
 
           [k →  E/V/O/L/U/T/I/O/N]
 
'মহাশূন্যের গণিত' শিরোনামের এই কবিতাটিতে দ্যাখা যাচ্ছে ~ '০'এককটি 'n'মাত্রার নিরিখে সৃষ্টি করছে মহাশূন্যের একক-চিহ্ন 'Z'; যাকে আমরা তল থেকে elevation বলে থাকি।এরপর এই অবস্থানটির নিরিখে 'n'মাত্রাটিকে বিশ্লেষণ করে বর্ণিত হয়েছে একটি সমীকরণ; যেখানে '০'মানগতভাবে 'অসীমের সাথে k গুণিতকে' সমানুপাতিক।এবার এই সমীকরণটির মিথোস্ক্রিয় প্রশমন 'k' অবস্থানটিকে স্পষ্টতর করছে; যা দৃষ্টিগতভাবে তিনটি পর্যায়ভূক্ত ~ vision বা দৃশ্য // illusion বা বিভ্রম // evolution বা বিবর্তন।আসলে, ঘটমান যা কিছু তার সবটাই তো এই তিনটি পর্যায় থেকে আলাদা আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় ~ যার দর্শনগত ফল ভিন্ন।অবশ্য এখোন এটি ক্যানো বা কিভাবে কবিতা হলো ~ তার সার্থকরূপটি যদি কেউ সরাসরি জানতে চান; উত্তরে বলবো ভাবুন // না পারলে আলোচনার দরজা সবসময় খোলা।
 
হেলমস্লেভের অনুসরণে চিহ্নের ক্রিয়াটিকে অনুধাবন করার জন্য বার্থ রচিত মানচিত্র ~ একটি উল্লেখযোগ্য কাজ।Denotative sign বা অভিধাসূচক চিহ্নের চিহ্নক // চিহ্নিত, উভয়ই থাকে।কিন্তু সেই Denotative sign নিজেই যখোন connotative signifier অর্থাৎ নতুন কোনো চিহ্ন-প্রকরণবিশিষ্ট; বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে চিহ্নতত্ত্ব আলোচনা বেশ জটিল।এর পরবর্তী পর্যায়ে ~ সস্যুর বর্ণিত ভাষাতত্ত্ব নিয়ে বেশ কিছু নতুন ধারার কাজ করলেন রূশ ভাষাতত্ত্বজ্ঞ লেডি স্ত্রোস।যিনি পরিচয় ঘটালেন চিহ্নাদির সাথে সাংষ্কৃতিক // অর্থনৈতিক // সামাজিক প্রচলিত ট্যাগ // ইত্যাদি।ত্র্রোস বর্ণিত ভাষাবিকাশে ~ সাংষ্কৃতিক কার্যকলাপ একটি বিরাট সাইন সিস্টেমের অন্তর্গত; সাংষ্কৃতিক চিহ্ন হিসেবে তাদের কোনো স্বকীয় তাৎপর্য নেই।ঐ সংষ্কৃতিতে বহাল অন্যান্য চিহ্নাদির সাথে কোনো চিহ্নের সম্পর্কজনিতো পার্থক্য বা relational difference-ই চিহ্নটির অস্তিত্বের কারণ।তবে, উল্লেখযোগ্যভাবে লেডি স্ত্রোসের 'মিথ' সম্পর্কিত চিহ্ন বিষয়ক কাজ নৃতত্ত্ব স্ট্রাকচারালিজম্'কে প্রতিষ্ঠা দেয়।সস্যুর য্যামোন বলেছিলেন ~ চিহ্নক এবং চিহ্নিত'র সম্পর্ক আকস্মিক; ফরাসি ভাষাতত্ত্বজ্ঞ এমিল বেনভেনিস্তে কিন্তু এই সম্পর্কটিকে অনিবার্য বলেছেন ~ তাঁর মতে, যেহেতু চিহ্ন এবং চিহ্ন-সংক্রান্ত মনের ধারনা, এই উভয়ের সাথে আন্তঃসম্পর্ক মানুষ ছোটোবেলা থেকে এতোটাই স্পষ্টভাবে শিখতে থাকে; যে সে কখনোই এই অতিসূক্ষ্ম পার্থক্যটিকে উপলব্ধি করতে কখনোই সম্ভবপর নয়।য্যামোন শুরুতে উদাহরণ দিয়েছিলাম সমুদ্রের উদাহরণ ~ যার চিহ্নক এবং চিহ্নিত, এই দুইয়ের সম্পর্ক আকস্মিক নয় অনিবার্য।অতএব, এখানে ভাবার বিষয় হলো কবিতা পরবর্তী নিরীক্ষামূলক শব্দরূপ কি এই বক্তব্য-প্রবাহের শর্তাধীন?আর এখানেই গুরুত্বপূর্ণ রূপক্ বা মেটাফর্ নামক রূপকল্পটির চিহ্নরূপ অস্তিত্ব।অর্থাৎ "এক ফোঁটা সমুদ্র" থেকে "কয়েক ফোঁটা সমুদ্র" বা আরো অনেককিছুই।
 
চিহ্নবিজ্ঞান একের পর এক নানান্ বিষয়কে অন্তর্ভূত করে, চিহ্নের স্বতন্ত্র গতিপথটি বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন দিক অভিমুখী য্যামোন করেছে, ত্যামোনই গতিবেগটিকেও বাড়িয়েছে পর্যায়ক্রমে ~ সস্যুর থেকে যেভাবে শুরু।ভাষাবিজ্ঞানে চেতনার জগৎটিকে যুক্ত করতে চেয়ে, উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন জাক লাকাঁ।তিনি বললেন ~ ভাষার জগৎ সেই মাধ্যম যার সাহায্যে ব্যক্তি তার বক্তব্যকে প্রতিফলিত করে; ভাষা এবং ব্যক্তির মধ্যে অন্তর্বর্তী দূরত্ব থাকলেও, একই সাথে ভাষার জগৎ বক্তব্য দ্বারা ব্যক্তির প্রতিফলন ঘটায়, অর্থাৎ ব্যক্তির subjectivity তৈরি করে।অতএব সস্যুর নির্দেশিত চিহ্নক ও চিহ্নিত'কে একটু আলাদাভাবে প্রয়োগ করে লাকাঁ দেখালেন বক্তার সাথে চিহ্নের সম্পর্ক।এখানে তিনি প্রাধান্য দিলেন 'চিহ্নিত'কে।অর্থাৎ, সস্যুর য্যামোন ধ্বনি সমাহারটির সমষ্টিগত প্রয়োগ হিসেবে ~ 'চিহ্নক'টিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন; লাকাঁ প্রাধান্য দিলেন সমষ্টিগত দৃশ্যাকারের প্রয়োগে 'চিহ্নিত'কে।লাকাঁ'র মতানুসারে ~ মানুষ একটি ভাষার মধ্যে জন্ম নেয়, যা একটি সুনির্দিষ্ট লাং এবং আরেকার্থে সেই সুনির্দিষ্ট লাং'টি শিশুর জন্মের আগে থেকেই বিদ্যমান।এখোন, শিশুটি যেভাবে সেই লাং থেকে বিভিন্ন চিহ্নের ধারনাগুলি নিজের মতোন করে অর্জন করে নেয় ~ সৃষ্টি হয় তার অন্তর্জগৎ বা subjectivity; এমনকি বক্তা হিসেবে তার মনোজাগতিক অবস্থানটিও বাছতে হয় সেইসব ধারনাগুলি থেকেই।উদাহরণস্বরূপ, চিহ্ন'র স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ প্রবাহটি দ্যাখানো সংক্রান্ত কিছু আগের কবিতাটির শিরোনাম নিতে পারি : "Mathematics in The Space" ~ এখানে কেউ বলতে পারেন "মহাশূন্যের ভিতর গণিত" // আবার কেউ বলতে পারেন "মহাশূন্যের গণিত"।অর্থাৎ গোটা অংশটিই ব্যক্তি ও তাঁর প্রয়োগ সাপেক্ষে স্বতন্ত্র এবং পরিবর্তনশীল; অর্থাৎ এককথায় চিহ্ন'র আপেক্ষিকতা।সুতরাং আমরা বলতেই পারি ~ চিহ্ন থেকে চিহ্নাদি প্রবাহ দ্বারা প্রকাশিত মূর্ততা একপ্রকারের আপাত ও আপেক্ষিক।লাকাঁ'র মতানুসারে, বহির্জগতের চিহ্নক সম্ভার এবং অন্তর্জগতের চিহ্নিত'র মধ্যে দুর্ভেদ্য দেওয়াল থাকার কারণে ~ এদের মধ্যে কোনো লম্বভাবে যাতায়াত নেই, বরং ভূমির সমান্তরালভাবে কোনো চিহ্নিত একটি চিহ্নকের আড়ালে, তারপর আরেকটি চিহ্নকের আড়ালে, তারপর আরেকটি ~ এভাবে অবস্থান করে; আর এই কারণে চিহ্নক থেকে চিহ্নিতকে চেনা যায় না, চিহ্নকের আড়াল থেকে চিহ্নিত হাতছানি দেয়।অর্থাৎ অনেক signifierর সাথে signified বা চিহ্নকের সাথে চিহ্নিত আঠা দিয়ে আটকে থাকার মতো।
 
সেমিওলজি বিষয়টিতে difference-এর ধারনাটি প্রথম উপস্থাপিত করেন জাক দেরিদা।সস্যুর যেখানে ধ্বনি নির্ভর মুখের ভাষাকে লিখিত ভাষার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন বা তাঁর ভাবনানুযায়ী signified যেখানে thought sound বা উচ্চারিত ভাবনা নির্ভর এবং লেখার ভাষাটি যেখানে মুখের ভাষার অনুবাদ বা গৌণ; দেরিদা সেখানে দেখালেন ~ লিখিত ভাষা (দৃশ্য নির্ভর) ও মুখের ভাষা (ধ্বনি নির্ভর), উভয়েই স্বতন্ত্র সিস্টেম।উভয়ের পার্থক্যই উভয়ের অস্তিত্বের মূল কারণ।যেখানে সস্যুর বর্ণিত ~ মুখের ভাষা কেবলমাত্র মনের শুদ্ধ ভাব; সেখানে দেরিদা বললেন ~ মুখের ভাব // লিখিত ভাব, উভয়েই বক্তব্যকে প্রভাবিত করে।যেহেতু, আমাদের জীবনযাপনে অপরোক্ষ অনুভূতি বা জ্ঞান সম্ভব নয়; মাধ্যমই অনিবার্য অংশ।দেরিদা'র মতানুসারে ~ প্লেটো থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত সব দার্শনিকই জ্ঞান/ভালোবাসা/অমরত্ব/ইত্যাদি কিছু শব্দার্থের ধারনাকে দর্শনের কেন্দ্র হিসেবে ভেবেছেন; অতএব তাঁরা সকলেই লোগোসেন্ট্রিক, এমনকি সস্যুর চর্চিত ধারনাটিও (যেহেতু সস্যুর বর্ণিত কেবলমাত্র মুখের ভাষাই শুদ্ধ)।যেহেতু কেন্দ্রের আর কোনো কেন্দ্র থাকতে পারেনা; সেহেতু কেন্দ্র আপেক্ষিক, অতএব কোনো কিছুকেই কেন্দ্র বলে চিহ্নিত করা যায় না।আলোর কেন্দ্রে য্যামোন অন্ধকার, ত্যামোনই অন্ধকারের কেন্দ্রে আছে আলো।সুতরাং, দেরিদা'র এই difference-এর প্রাথমিক ধারনা অনুযায়ী ~ কোনো চিহ্নেরই চূড়ান্ত অর্থ বা তাৎপর্য নির্ণয় করা যায় না।চিহ্নের তাৎপর্য থাকে তখনিই ~ যখোন সে তার প্রতিবেশী চিহ্ন বা অন্যান্য চিহ্নগুলি থেকে আলাদা।আবার একইসাথে, কোনো চিহ্নের তাৎপর্য ততোক্ষন বোঝা সম্ভব নয়, সেই চিহ্নটি যতোক্ষন না পরবর্তী চিহ্নটিতে উপনীত হচ্ছে।দেরিদার দর্শনানুযায়ী যেকোনো চিহ্নের তাৎপর্য অনন্তকাল ধরে deferred হয় বা বিলম্বিত হয়; সুতরাং কিছুতেই আর চূড়ান্ত তাৎপর্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।অধুনান্তিক বা অধুনান্তিক পরবর্তী কবিতায় য্যামোন আমরা বহুরৈখিক / বহুচিত্রিত / বহুমাত্রিক / ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলি খুঁজে পাই।সুতরাং একথা অনস্বীকার্য যে ~ 'চূড়ান্ত অর্থে পৌঁছানো ও থেমে যাওয়া' বিষয়টি পারতপক্ষে লোগোসেন্ট্রিক্ বৈশিষ্ট্যজনিত একটি আপেক্ষিক প্রয়াস।সুতরাং, আমাদের অস্তিত্ব // জগৎ // জীবন ~ সবই অজ্ঞাত এবং অজ্ঞেয়; এর কোথায় কোনো কেন্দ্র নেই; বরং অসীম ব্রহ্মান্ডের প্রতিটি বিন্দুই কেন্দ্র।আর স্বতন্ত্রভাবে 'কেন্দ্র' খুঁজতে যাওয়া মানেই 'প্রান্ত'-এর সাথে দ্বান্দ্বিকতা অবশ্যম্ভাবী।
 
পরিশেষে একথাই বলবো যে ~ কবিতা পরবর্তী স্তরে (হয়তো যাকে শব্দরূপ বলতে চেয়েছি); চিহ্নের প্রয়োগ এবং চিহ্নাদি প্রবাহের বহুস্তরীয়তা নিশ্চিতভাবেই নতুনত্বের পথ দেখাবে।একারণেই চিহ্ন বিষয়টির চর্চা ও বিস্তার আমাদের অবিলম্বেই বাড়ানো উচিৎ।যদিও বাংলা ভাষায় আন্তর্জাতিক কবিতায় বেশিরভাগ পরীক্ষা/নিরীক্ষা হয়েছে ধ্বনি প্রাধান্যর লোগোসেন্ট্রিকতাকে কেন্দ্র করে; উপেক্ষিত হয়েছে চিহ্নের visual-রূপটি ~ অতএব এই বিষয়েও ভবিষ্যৎ চর্চা বাড়বে বলে আমি আশাবাদী।চিহ্ন বিষয়ক প্রয়োজনীয় আলোচনা এবং সমান্তরালভাবে বইটির আলোচনা ~ একসাথেই রাখা হলো, এ কারণেই।তবে, বইটিতে বেশ কিছু মুদ্রণ ত্রুটি রয়েছে ~ বানান থেকে কয়েকটি তাত্ত্বিক জায়গায়; আশা করি আগামী সংষ্করনে তা শুধরানো হবে।শেষ করার আগে 'মুজনাই' পত্রিকার একটি আন্তর্জাল সংখ্যায় এনকোডিং // ডিকোডিং বিষয় নিয়ে একটি কাজ করেছিলাম; মাধ্যম ছিলো রবিঠাকুর রচিত গীতাঞ্জলী গ্রন্থের একটি ছোট্ট অংশ ~ শিরোনাম ছিলো "রবীন্দ্রকাব্য & ডি-কনস্ট্রাকশনবাদ"।চিহ্ন প্রবাহের অসীম অভিমুখী বিমূর্ততা প্রয়োগ প্রসঙ্গে, তা এখানে রাখলাম।
 
পর্ব-১ : (অনুপ্রেরণা : গীতাঞ্জলী - ৮৫ নং কবিতা)
--------------------------------------------------------------------
ঝরছে অঝোর :: ?-?-?
           এসময় দৃশ্য ≠ ↑ ∝ ↓
           অসময় ~ অদৃশ্য।স্পর্শ < মৃদু > রোঁয়াশা
           চৌহদ্দি ধড়াসধড়াস্
 
এইমাত্র ______
                       বিস্তৃত নিরেট           রেখা|লীকময়
 
স্তর|ভিযোজন    } 
                            বিন্যাসমাণ ~ টুকরোটাকরা   আ
                                                                         পা
                                  ||                                      দ
                                                                         মা
                           ০ মায়া                                   থা
                                     || ০ আলো                    হী
                                                    || ০ গভীর      ন
 
 
++++++++++++++
 
পর্ব-২ : (অনুপ্রেরণা : গীতাঞ্জলী - ১৩ নং কবিতা)
--------------------------------------------------------------------
মেঘলা আড়াল        আড়ালীয়া-মেঘ
                             }}} ♣ {{{   অন্তর্হিত শরীর
                                           নতমুখী ছাইভস্ম 
 
                                              ||
 
                                   ভাসমান আলোকণা-গতি
 
            বোজা চোখ      ||      অপ্রকাশিত 
 
                        মহা০ [যাবতীয়]     নিরেট 
                                                    পথিক আকার
উদ্বায়ী ইথার ঘর
                          ??? - এলেমেলো - ??? 
সম্পর্কিতো
                 স্পর্শ & 
                             আঙুল 
 
                   
(ওপরোক্ত ২টি লেখা, কোনোরকম অন্যধারার কবিতা প্রয়াস নয়।বরং, ভাষার অভ্যন্তরীণ আন্তঃসম্পর্কিত বিভিন্ন শর্তগুলির ওপর নির্ভর করে, ভাষান্তরের মাধ্যমে সময়কে অতিক্রম করার প্রয়াস।এই পরীক্ষামূলক্ কাজটিতে, কবিগুরুর 'গীতাঞ্জলী' স্রেফ ১টি স্যাম্পেল্ বা নমুনার প্রতিনিধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।সমভাষায় এই কাজ আগেও হয়েছে, তবে তা ব্যাপকহারে নয়।)


অলংকরণঃ তাইফ আদনান