জলধি / প্রবন্ধ / জসীম উদদীনের কবিতা : শতভাগ বাঙালিপনায় নির্মিত
Share:
জসীম উদদীনের কবিতা : শতভাগ বাঙালিপনায় নির্মিত

প্রথমে রবীন্দ্রবলয় ভাঙা, এরপর ত্রিশের কবিদের স্টাইলের দাপট ভেঙে সম্পূর্ণ নিজস্ব ও বঙ্গজ উপাদান নিয়ে কবিতা নির্মাণে সক্ষমতা দেখিয়েছেন কবি জসীম উদ্দীন। কবিতার সমস্ত উপাদান-চিত্রকল্প, অলংকার, ছন্দ, রস প্রভৃতি-বাঙালির, দেশজ। তার রচিত চারটি আখ্যানকাব্যেও একই রীতি অবলম্বন করেছেন। মিথও নিয়েছেন দেশজ  উৎস থেকে। বলা যায়, তার কবিতা শতভাগ বাঙালিময়, শতভাগ বাঙালিপনায় নির্মিত।

জসীম উদদীনের আখ্যানমূলক কাব্য চারটি হচ্ছে : নকশীকাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), সকিনা (১৯৫৯) ও মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩)। আখ্যানমূলক কাব্যগুলোর শব্দাবলি বা উপাদানগুলো আশেপাশের; সবুজবাংলার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু মাইকেল, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কবি আখ্যান বা কবিতায় রামায়ণ-মহাভারত, লোকগপুরাণ বা ধর্মীয় ঐতিহ্যের কাছে হাত পেতেছেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম জসীম উদদীন ব্যতিক্রম ও অনন্য। তার আখ্যানকাব্য জনপ্রিয়তা ও নির্মাণশৈলীতে অনন্য। জীবনানন্দ দাশও গ্রামবাংলার উপাদান নিয়ে কবিতা নির্মাণ করেছেন; তবে তার আখ্যানকাব্য নেই। জসীম উদদীনের অন্ত্যমিলের কবিতাগুলো কানে সমধুর ঝংকার তোলে। নকশীকাঁথার মাঠ সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। সোজন বাদিয়ার ঘাট-ও জনপ্রিয় কাব্য। এ দুটি আখ্যানকাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। কবি জসীম উদদীন বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের গীতিকার। এমন সব গান কে না শুনেছেন! গান নিয়ে সঙ্গীত গ্রন্থগুলো: রঙিলা নায়ের মাঝি(১৯৩৫), গাঙের পাড়(১৯৬৪), জারি গান(১৯৬৮), মুর্শিদী গান(১৯৭৭)। বোবা কাহিনী(১৯৬৪)নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। তার ভ্রমণকাহিনীগুলো চমৎকার। চলে মুসাফির(১৯৫২), হলদে  পরির দেশ(১৯৬৭), যে দেশে মানুষ বড়(১৯৬৮) ও জার্মানীর শহরে বন্দরে(১৯৭৫)। নাটক ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও আছে। রাখালী(১৯২৭) কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া বালুচর(১৯৩০), ধানখেত(১৯৩৩), হাসু(১৯৩৮), মাটির কান্না(১৯৫১), এক পয়সার বাঁশি(১৯৫৬), হলুদ বরণী(১৯৬৬), জলে লেখন(১৯৬৯), পদ্মা নদীর দেশে(১৯৬৯), দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি(১৯৮৭) উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।

ছোটবেলা থেকেই সৌন্দর্যের প্রতি খুব প্রবল আগ্রহ ছিল। নদী, প্রকৃতি ও নারীর সৌন্দর্য উপভোগ করতেন তিনি। ‘মুখখানা যেন সিন্দুরের মতো ডুগু ডুগু করে’ বলে উজ্জ্বল নারীর প্রতি টানের কথা বোঝা যায়। সে সময়ে হিদু ও মুসলমানের বাস ছিল বৃহত্তর ফরিদপুর, বলা যায় বাংলার অনেকস্থানে। মাঝেমধ্যে সম্প্রীতির ফাটল দেখা যেত। এসব নিয়ে কবিতায় তুলে ধরেছেন তিনি। তবে হিন্দুদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল তার, ছোটবেলা থেকেই। হিন্দুরমণীদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেন তিনি। কবির নিষ্পাপ চোখের বর্ণনা পাই আমরা বিভিন্ন কবিতায়, আখ্যানকাব্যে।  নক্সী কাঁথার মাঠ আখ্যানকাব্যে সাজুর সৌন্দর্য যেমন দেখি ‘লাল মোরগের পাখা’, তেমনই ‘তুলসীতলার প্রদীপ, তুলসীফুলের মঞ্জুরী কি দেব দেউলের ধূপ’, ‘সাঁঝ সকালের রঙিন মেঘেরা, ইত্যাদি সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যময়তা লক্ষ করা যায়। চিত্রকল্প নির্মাণ করতে যেয়ে বিভিন্ন অলংকার(উপমা,ইত্যাদি) দেশের কাছেই হাত পেতেছেন তিনি। কিছু কিছু অংশ (তার কবিতা থেকে) তুলে ধরলেই তা পরিষ্কার হবে। নারীর অনুভব খুব গভীরতর। নারী ও প্রকৃতি মিলে দারুণ প্রকাশে ব্যঞ্জনা পেয়েছে জসীম উদ্দীনের কবিতায়। বাঙালি সংস্কৃতি নিয়েই তার কবিতায় ওজস্বিতা প্রকাশ পেয়েছে।

‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি/ শিশির ভেজা ঘাসে/ সারারাতের স্বপন আমার/ মিঠেল রোদে হাসে।’ তিনি বাংলার গ্রামের উপাদান নিয়ে প্রকৃতিকে আধুনিকতা দিয়েছেন। তার কবিতা পাঠকের হৃদয়ে ঢুকে পড়েছে। গ্রামীণ জনপদের সমস্ত অস্তিত্বে কবি জসীম উদদীন মিশে গেছেন; বৃহত্তর বাংলার কৃষকসমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার নিবিড় বোঝাপড়াটা ভালোই জমেছিল; তার কবিতাতেই প্রমাণ। ‘‘রাখাল ছেলে’’  কবিতা থেকে : ‘ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশী পউষ-পাগল বুড়ী,/আমরা সেথা চষতে লাঙল মুর্শীদা-গান জুড়ি।’ কাশফুলের গুচ্ছ, বালুচর, সরিষা, শিশির, মিঠেল রোদ, রঙিন কাঁথা, বুনো ফুল, ফড়িং, টিয়া, ঘুঘু, ইত্যাদি-গ্রামের প্রতিবেশ, ছবি-অনায়াসেই এনেছেন কবিতার ছত্রে। ‘ফোঁটা সরিষার পাপড়ির ভরে, চরো মাঠখানি কাঁপে/ থরে থরে  সাঁঝের শিশির দুটি পাও ধরে কাঁদিয়া ঝরে-/ বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়াছে বালুর চরে(বালুচর)’। গ্রামের উপাদান নিয়ে জসীম উদ্দীন লিখেছেন। অন্ত্যমিলেও দারুণ হয়েছে। অন্ত্যমিল দিতে গিয়ে কবিতার বার্তা বা বক্তব্য  অস্পষ্ট হয়নি। এখানেই কবি হিসাবে তিনি স্বকীয় ও সার্থক। ‘মাথায় তাহার কুলোর উপর বদনা-ভরা জল,/ তেল-হলুদে কানায় কানায় করছে ছলাৎ ছল(পরিচ্ছেদ ৪, নক্সী কাঁথার মাঠ)’। ‘‘পল্লী বর্ষা’’ কবিতার অংশ বিশেষ : ‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে/ রেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।’  বর্ষা বিরহের ঋতু। বর্ষার সুর বেদনা ও একাকিত্বকে জাগিয়ে তোলে। পল্লীকবির এ চরণ যেন আমাদেরই মনের কথা। জসীমউদদীনের কবিতায় লোকবাংলার স্নিগ্ধ নিসর্গ যেমন উঠে এসেছে তেমনই উঠে এসেছে গ্রামবাংলার নানা অসঙ্গতি, শোষণের কথা, অনিয়মের কথা। জেলের বউয়ের মন-খারাপ উঠে আসে এমন, ‘ইচ্ছে করে কলসীটিরে বাঁধি মাথার কেশে,/ ভাসিয়ে দেয় জেলে তাহার রয় যে বে-গান দেশে(জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়)’। আসলে তিনি বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকার ভাষ্যকর। তাইতো তিনি সহজেই বলতে পারেন, ‘কাঁদে এই মাটি। আমি শুধু শুনি মাটিতে এ বুক পাতি,/ মাটির বুকের স্পন্দন শুনি, জাগিয়া দীঘল রাতি।’ গ্রাম বাংলার মানুষের আথিথেয়তা বিশ্ববিখ্যাত। ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় জসীম উদ্দীনের স্বর এবাবেই বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে, ‘তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের/ছোট গাঁয়,/ গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;/ মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি/মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,/মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের /স্নেহের ছায়,/ তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের/ ছোট গায়।’  গ্রামবাংলার বর্ষার দৃশ্য-মেঘ নিয়ে কবির বর্ণনা : ‘আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়েছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে,/ কেয়া বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল ধরে।/ কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝুম নিরালায়,/  ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়(পল্লী বর্ষা)’। রূপক, উপমা, প্রতীক, রূপকল্পের বিচিত্র, নৈপুণ্যপূর্ণ ব্যবহার আধুনিক কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আগের যুগেও এর ব্যবহার ছিল। চিরচেনা পরিবেশ নিয়ে জসীম উদদীনের কবিতার চিত্রায়ণ খুব স্বাভাবিক বিষয় বলেই মনে হয়। আশেপাশের লোকজ উপাদানের এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরছি:
(১) ‘মাঠের যতনা ফুল লয়ে দুলী পরিল সারাটি গায়,/ খোঁপায় জড়ালো কলমীর লতা, গাঁদা ফুল হাতে পায়(সোজন বাদিয়ার ঘাট)’।
(২) ‘পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সংকেত/ সবুজে হলুদে সোহাগ ভুলায়ে আমার ধানের খেত (ধানখেত)’।
(৩) ‘এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,/ কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!/ কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া, / তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।/ জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু,/ গা খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু।/ বাদল-ধোয়া মেঘে কেগো মাখিয়ে দেছে তেল,/ বিজলী মেয়ে পিছে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল(নকসীকাঁথার মাঠ)’।
(৪) ‘রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! সারাটা দিন খেলা,/ এ যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা।/ ‘কাজের কথা জানিনে ভাই, লাঙ্গল দিয়ে খেলি,/ নিড়িয়ে দেই ধানের খেতের সবুজ রঙের চেলি’।/...খেলা মোদের গান গাওয়া ভাই, খেলা লাঙল-চষা,/ সারাটা দিন খেলে— জানি জানিইনেক বসা(রাখাল ছেল, রাখালী)’। বলে রাখি এমন সাধারণ উপাদানে অসাধারণ বুননের কবিতা অনেক। উল্লেখিত কবিতাংশ তার কবিতার প্রতিনিধি হিসাবেই ধরে নেওয়া শ্রেয় হবে।

কবি জসীম উদদীন ‘কবির নিবেদন’ কবিতাটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রচনা করেছেন বলে জানা যায়। মুক্তিসংগ্রামে জয়ী হতে হলে অনেক মুক্তিযুদ্ধের শুভাকাঙ্গীদের মতো কবিও  উপলব্ধি করেছেন বিশ্ব-জনমত জাগ্রত করতে হবে। ফলে নিজের তাগাদা থেকেই এমন সব কবিতা লেখার প্রয়াস করেছেন তিনি। ১৬ মার্চ ১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধু কবিতার ঠিক শুরুতে লেখেন, ‘মুজিবুর রহমান!/ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।’ আরও কিছু কবিতাংশ তুলে ধরাই যায়-
(১) ‘যেথায় স্বর্গ ম্রিয়মান হয় আপনারে তুলনিয়া/ সে দেশের লাগি সাধনা মোদের রহিবে প্রজ্জলিয়া(জাগিয়া তুলিবা আশ)’।
(২) ‘এসব কাহিনি কহিবার মানা লিখিবার মানা হায়/ কবির কলম বড় অবাধ্য না লিখে বাঁচা যে দায়(কি কবিব আর)’। এখানে পাকিস্তানি কর্তৃক নির্মম অত্যাচার ও বাকস্বাধীনতা হরণের কথা বলা হয়েছে।
(৩) নির্যাতিত হিন্দুদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে কবি জসীম উদ্দীন লেখেন,‘ গীতারা কোথায় যাবে?/ কোথায় মমতা কোথা স্নেহ আর মায়া/ কাহারা আজিকে এদেশ হইতে মুছিয়া ফেলিছে/সকর শীতল ছায়া(গীতারা কোথায় যাবে?)’। গীতা হয়ে গেছেন হিন্দুদের প্রতীক। ‘সারা গাঁওখানি দগ্ধ শ্মাশান দমকা হাওয়ার ঘায়/দীর্ঘ নিশ্বাস আকাশ-পাতালে ভষ্ম উড়িয়া যায়(দগ্ধ গ্রাম)’। দেশীয় দোসরদের সঙ্গে নিয়ে পাকিবাহিনীর অগ্নিসংযোগ ও বাঙালিদের ওপর অমানসিক অত্যাচারের কথার ঈঙ্গিত পাওয়া যায় কবিতায়।
(৪) ‘হয়েছে দুরাশা! আকাশ-ফাটানো ছুড়িয়া বুলেট-গুলি/নরহন্তার বেশে নাচে সেই ধর্মের ভাইগুলি/ভ্রাতৃপ্রেম যে সংহারক রূপে হইয়াছে রূপায়ন/সংহতি আবহমান লভেছে কামানের গরজন(ইসলামী ভাই)’।

‘আমার হাড় কালা করলাম রে/আমার দেহ কালার লাইগা রে/আরে আমার অন্তর কালা করলাম রে/দুরন্ত পরবাসে...’- জনপ্রিয় এ গানটির রচয়িতা কবি জসীম উদ্দীন। কবি জসীম উদদীনের অমর কিছু গান রচনা করেছেন। তিনি এমন কিছু বাংলা গান এখনো মনের অজান্তে গুনগুন করে ছেলে- বুড়ো-আমরা। লোকজ এবং মাটির গানগুলোকে তুলে দিয়েছেন শহুরে মানুষের মুখে মুখে। আমরা মনের অজান্তে কবি জসীম উদদীনের অনেক গান গেয়ে থাকি। তবে অনেকেই গীতিকারের নাম জানেন না। শিল্পী রথীন্দ্রনাথের কন্ঠের অমর অনেক গানই শিল্পীর সুনাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু পর্দার আড়ালের গীতিকার পর্দার আড়ালেই থেকে গেছেন। কয়েকটি অমর গানের কথা বলতেই পারি- (১) ‘প্রাণ সখিরে/ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে।/বংশী বাজায় কে রে সখি, বংশী বাজায় কে।/আমার মাথার বেনী খুইলা দিমু/তারে আনিয়া দে...’, (২) ‘ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না...’, (৩) ‘বৈদেশী কন্যা গো...’, (৪) ‘আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাইরে...’/নদীর কূল নাই কিনার নাইরে...আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাবো...’,(৫) ‘কি বলিব সোনার চাঁদ...’, (৬) ‘আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি...’, (৭) ‘যোগী ভিক্ষা ধরো...’, (৮) ‘রসুল নামে...’, (৯) ‘ও সুজন বন্ধু রে...’, (১০) ‘পেটের জ্বালায় জইলা মইলা...’, (১১) ‘উজান গাঙ্গেরর নাইয়া...’, (১২) ‘আমার সোনার ময়না পাখি...’ ,(১৩) ‘জল ভরিতে যায় গো কন্যা...’, (১৪) ‘নদীর কুল নাই কিনার নাই...’,(১৫) ‘তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে...’, (১৬) ‘ছল ছল কল কল নদী করে টলমল...’, (১৭) ‘আমারন বন্ধু বিনোদিয়া রে প্রাণ বিনোদিয়া...’, (১৮) ‘নিশিথে যাইও ফুল বনে গো ভোমরা...’, (১৯) ‘উজান  গাঙ্গের নাইয়া...’, (২০) ‘আমার সোনার ময়না পাখি/কোন দেশেতে গেলা উইড়া রে/দিয়া মোরে ফাঁকি রে/আমার সোনার ময়না পাখি...’, (২১) ‘আমি বাইয়া যাইয়া কোন ঘাটে...’ ইত্যাদি গানের অংশ উল্লেখ করা যেতেই পারে। এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা কিন্তু কবি জসীম উদদীন। আধুনিক গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, জারি, সারি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান এবং উর্দুসহ অসংখ্য গান লিখে বাংলা গানের জগতকে করেছেন সমৃদ্ধ এবং উজ্জ্বল।  কবি জসীম উদদীন লোকসাহিত্যের অনেক কিছু উদ্ধার করেছেন বা সংগ্রহ করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স¤পাদনাও করেছেন। স¤পাদনায় অবশ্য তিনি সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। স¤পাদনার ক্ষেত্রে তিনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌলিকতা এড়িয়ে বা বলা যায় বিতর্ক এড়ানোর জন্য সতর্ক হয়ে স¤পাদনা করেছেন। কিছুক্ষেত্রে তাঁর মতো করে স¤পাদনা করেছেন। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত, দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে লোক সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে জসীম উদদীন কাজ করেন। তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও। তিনি ১০,০০০ এরও বেশি লোকসংগীত সংগ্রহ করেছেন, যার কিছু অংশ তার সংগীত সংকলন জারি গান এবং মুর্শিদা গান এ স্থান পেয়েছে। তিনি বাংলা লোক সাহিত্যের বিশদ ‘ব্যাখ্যা এবং দর্শন’ খন্ড আকারেও লিখে গেছেন।

আধুনিক কবিতায় অলংকারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীম উদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমসোক্তি ও অন্যান্য অলংকারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলংকারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ। জুতসই উপমা ও অনুপ্রাসের ব্যবহার কবিতার শিল্পগুণকে উন্নীত করেছে। প্রতিনিধি হিসাবে কিছু উল্লেখ করছি। প্রথমেই ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ থেকে কিছু অলংকারিক(উপমা ও অনুপ্রাস) প্রয়োগ দেখে নিই: ‘কাঁচা ধানের পাতার মত কচি মুখের মায়া’, ‘লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী’, ‘কচি কচি হাত-পা সাজুর সোনার সোনার খেলা,(যমক)/তুলসী তলার প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঝের বেলা’, ‘তুলসী ফুলের মঞ্জুরী কি দেব দেউলেত ধূপ’, ‘কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো’, ‘বাজে বাঁশী বাজে, রাতের আঁধারে, সুদূর নদীর চরে,/উদাসী বাতাস ডানা ভেঙে পড়ে বালুর কাফন পরে(সমাসোক্তিসহ)’। অন্যান্য কাব্য থেকে কিছু উদাহরণ টেনে দিতে পারি এভাবে:
(১) ‘চলে বুনো পথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন পরি।/দুর ছাই,কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি(উপমা ও অনুপ্রাস প্রয়োগ,পল্লী জননী, রাখালী)’।
(২) ‘হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুফু, সাত বছরের মেয়ে/ রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল বেহেস্তের দ্বার বেয়ে(অনুপ্রাস ও উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগ, কবর/রাখালী)’।
(৩) ‘হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোৎ¯œায় জাল পাতি,/টেনে টেনে তবে হয়রান হয়ে, ডুবে যায় সারারাতি(সমাসোক্তির প্রয়োগ, নকসী কাঁথার মাঠ)’।
(৪) ‘উদয় তারা আকাশ-প্রদীপ দুলিছে পূবের পথে,/ভোরের সারথী এখনো আসেনি রক্ত-ঘোড়ার রথে(সোজন বাদিয়ার ঘাট)’।


চরিত্র নির্মাণে(বিশেষত নায়ক-নায়িকা) কবি জসীম উদ্দীন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। উপমার প্রয়োগে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আর অন্ত্যানুপ্রাস তো কবির স্বভাবজাত।
(১) ‘সোজন যেনবা তটিনীর কূল, দুলালী নদীর পানি/ জোয়ারে ফুলিয়া ঢেউ আছড়িয়া কূল করে টানাটানি/ নামেও সোজন, কামেও তেমনি,শান্ত স্বভাব তার/ কূল ভেঙে নদী যতই বহুক, সে তারি গলার হার(সোজন বাদিয়ার ঘাট)’।
(২) সকিনা আখ্যানকাব্যে নায়িকা সকিনাকে নিয়ে নায়ক আদিলের স্বপ্ন; জসীম উদদীনের কবিতায়, ‘সকিনারে লয়ে আদিল এবার পাতিল সুখের ঘর,/ বাবুই পাখীরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর।/ স্রোঁতের শেহলা ভাসিতে ভাসিতে একবার পাইল কূল,/ আদিল বলিল,‘‘গাঙের পানিতে কুড়ায়ে পেয়েছি ফুল’’।/ এই ফুল আমি মালায় মালায় গাঁথিয়া গলায় পরিয়া নেব,/ এই ফুল আমি আতর করিয়া বাতাসে ছড়ায়ে দেব।/ এই ফুল আমি লিখন লিখিব, ভালোবাসা দুটি কথা,/ এই ফুলে আমি হাসিখুশি করে জড়াব জীবনলতা।’

জসীম উদ্দীনের হাসু চমৎকার একটি শিশুতোষ কাব্য। শিশুমনকে নাড়া দেওয়ার মতো অনেক ছড়া আছে এ গ্রন্থে। ‘আমার বাড়ী’ ছড়াংশ- ‘‘আমার বাড়ী যাইও ভ্রমর বসতে দেব পিঁড়ে/ জল্পান যে করতে দেব শালিধানের চিড়ে”। আবার ‘খোকার আকাক্সক্ষা’র মতো নীতিশিক্ষার ছড়া-কবিতাও রয়েছে। এ কবিতা থেকে দুছত্র- ‘সবার সুখে হাসব আমি/ কাঁদবো সবার দুঃখে’। ‘রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও’-‘‘আসমানী’’ কবিতায় এ চরণটি সবার পড়া ও জানা। এক পয়সার বাঁশী জসীম উদ্দীনের দ্বিতীয় শিশুতোষ কাব্যের বই। এখানে ‘এক পয়সার বাঁশী’, ‘হাসুমিয়ার চিঠি’, ‘মা ও খোকা’, ‘আসমানী’, ‘হাসুমিয়ার পাখীস্থান’, ‘গল্পবুড়ো’ শিরোনামীয় বেশ কিছু ছড়া/কবিতা রয়েছে। জসীম উদদীনের শিশুতোষ গল্প হচ্ছে ডালিম কুমার। এটিও আমাদের কাছে সম্যক পরিচিত। আর একটি মজার গল্পগ্রন্থ হচ্ছে বাঙালীর হাসির গল্প। উল্লেখিত দুটি গল্পগ্রন্থে শিশুমনের অনেক খোরাকের জোগাড় হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের আঞ্চলিক ও লোকমুখে প্রচলিত কথা নিয়ে মজার মজার গল্প সাজিয়েছেন তিনি।

শুধু লোকসাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয়, কবি জসীম উদদীনের সকল লেখা সমসাময়িক ও প্রাণবন্ত। তিনি দেশের মানুষের কথা, তাদের জীবনযাপনের কথা,সংস্কৃতি ও প্রকৃতি নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। গান ও কবিতায় তুলে এনেছেন লোকজ উপাদানের প্রাচুর্যে। কবি জসীম উদদীন পালাগান, গাজীর গান, লোকগীতি বা জারী-সারির আসরে যোগ দিতেন; এবং তা উপভোগ করতেন। আবার নিজের বাড়িতেও লোকসাহিত্যের বা উল্লেখিত গানের আসর বসাতেন। লোকসগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন তিনি। তাঁর এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানী, ইংল্যান্ড, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে আমন্ত্রিতও হতেন। এসব ক্ষেত্রে আলোচক হিসাবেও উপস্থিত থাকতেন। কবি জসীম উদদীনকে লোকসংগীতের প্রবাদপুরুষও বলা যায়। আধুনিকতা স¤পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য: ‘আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।’ আবার জীবনানন্দ দাশ মনে করেন, ‘বাংলা কাব্যে কিংবা কোনো দেশের বিশিষ্ট কাব্যে আধুনিকতা শুধু আজকের কবিতায় আছে; অন্যত্র নয়, একথা ঠিক নয়’।  কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত কাব্যকে আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করা যায়। জসীম উদদীন এ সংকীর্ণ অর্থে পল্লীকবি নন। নকসীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, সকিনা কিংবা বেদের মেয়ে ইত্যাদির উপাদান-উপকরণ পল্লীতে পাওয়া গেলেও কাহিনীবুনন, কবিতায় শব্দচয়ন, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, প্রতীক ও রূপক নির্মাণ শিল্পসম্মত ও আধুনিক। কবি হিসাবে তিনি শুধু পল্লীর নন, আবার শহরেরও নন। বরং এই দুয়ের মধ্যে সংযোগ সেতু। জসীম উদ্দীন প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর, ১৯৭৮) পান। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।  ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবি জসীম উদ্দীন-কে সম্মান সূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়া ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ বাংলার এ পল্লীকবি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। কবির কবর কবিতা অনুযায়ী ফরিদপুরের তাম্বুলখানায় নিজ বাড়িতে ডালিম গাছের তলায় কবিকে সমাহিত করা হয়।

বাংলাসাহিত্যের তিন গ্রান্ডকবি-কাজী নজরুল (১৮৯৯), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯) ও জসীম উদদীন (১৯০৩)-জন্ম প্রায় একই সময়ে। কিন্তু তাদের স্টাইলে ভিন্নতা ছিল। ফলে তিনজনই টিকে আছেন স্বমহিমায়। নজরুলর বিদ্রোহী সুর আর জীবনানন্দের প্রকৃতির অবগাহনের পাশাপাশি জসীম উদ্দীন গ্রামের ছবি এঁকেছেন কবিতায়। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কথা তার কবিতায়। জসীম উদ্দীন আখ্যানকাব্যেও বিদেশী মিথ ব্যবহার না করে গ্রামবাংলার উপাদান ব্যবহার করেছেন। ত্রিশের কবিদের স্টাইলের বাইরে জীবনানন্দ দাশ ও কবি জসীম উদ্দীন কবিতায় আঁকলেন গ্রাম ও প্রকৃতির ছবি। জীবনানন্দ দাশকে আমরা যেমন প্রকৃতির কবি বলি; তেমনই জসীম উদ্দীনকে গ্রামের কবি, ‘পল্লী কবি’ হিসাবেই পাঠকরা হৃদয়ে ঠাঁই দিয়েছেন



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন