জলধি / প্রবন্ধ / এস. এম. লিটরেচার অ্যান্ড আর্টস স্কুলের ‘সখিচান’
Share:
এস. এম. লিটরেচার অ্যান্ড আর্টস স্কুলের ‘সখিচান’

অভ্যস্ততা মুগ্ধতার ঘোর সৃষ্টি করে কি না সে নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হলেই কেউ মুগ্ধতাকে জেনেবুঝে ফেলবে এমনটিও বলা যায় না। অযত্নে ফুটে ওঠা আটপৌরে দোলনচাঁপার সুবাস পথচলতি মানুষকে মুগ্ধতা দেয় কিন্তু ওই সুবাসটুকু কেন ভালো লাগলো সেটা ব্যাখ্যা করার চেয়ে দুরূহ কিছু আর হতে পারে না। কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের গল্প নিয়ে কিছু বলাটা, মুগ্ধ হবার কারণ বলার মতোই দুঃসাধ্য কিছু। বোঝা আর না-বোঝার আলো আঁধারে যে ব্যাখ্যাতীত সংশয়টুকু থেকে যায় সেখানে সেলিম মোরশেদের গল্পের বুদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যই পাঠককে পাঠমুগ্ধতা দেয়।         

সৌন্দর্যটুকু কেন মুগ্ধতা দিলো? আর সেই মুগ্ধতার মানেই বা কী? সেই তত্ত্ব তালাশ করতে গেলে পাঠঅভিজ্ঞতা আর অনুভব প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে যেতে হয়। গল্পের সৌন্দর্যের উপাদান চিহ্নিত করতে হয়। সেই সৌন্দর্য থেকে মুগ্ধতায় সমাচ্ছন্ন হতে হলে পাঠকের প্রয়োজন মেধা মননশীলতাচর্চিত একটি উপলব্ধিজাত মন। একুশ বছর বয়সেকাটা সাপের মুণ্ডুগল্পে হেমাঙ্গিনীর শরীর মন আর যৌনতার দুঃসহ জান্তব ক্ষুধার ভয়াবহ দৃশ্য এঁকে সেলিম মোরশেদের গল্পের যাত্রা শুরু। এরপর সাহিত্যে নতুন ধারা প্রবর্তনে উদ্যত হয়ে নিঃসঙ্গ অথচ দুঃসাহসিক অভিযাত্রীর মতো অনির্ণিত দুর্গম পথে তিনি হেঁটে গেছেন।লাবণ্য যেভাবে এগিয়েগল্পেশেষের কবিতা লাবণ্যকে যেমন বিনির্মাণ করেছেন, রক্ত-মাংসের মানবীরূপে অধিষ্ঠিত করেছেন, তেমনি বামপন্থী রাজনীতির ভাবাবেগ এবং মনোজাগতিক বৈকল্য ক্ষয়িষ্ণু সমাজের ভেতর আটকে পড়া এক যুবককে নিয়ে লিখেছেনসুব্রত সেনগুপ্ত গল্পের ভিন্ন নির্মাণশৈলীকোলাজপদ্ধতিতে আকৃষ্ট হয়ে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এর চিত্রনাট্য তৈরি করেন। ছোটোকাগজ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের আন্তঃযোগাযোগ এবং যুগপৎ এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত হয়ে আছে তাঁর গল্পসুব্রত সেনগুপ্ত        

কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন- ‘লেখা আর কিছুই না, শুধু দেখা ভেতর আর বাইরের যা কিছু তিনি দেখেন, সচেতন পাঠকের কাছেও সেটা দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় বাংলা সাহিত্যর যুগজয়ী গল্পগুলোর অন্যতমসখিচানএর কথা।সখিচানবহির্জগতের নিয়ন্ত্রণঅযোগ্য উপাদানের সাথে ব্যক্তির অন্তর্গত সত্তার পীড়নউদ্ভাস। গল্পটি  জীবনের। একই সাথে মৃত্যুর। সুর আর -সুরের। এই গল্পে শ্রেণি সমাজ সংস্কৃতি আর মূল্যবোধের কাঠামোগত চিন্তাভাবনা নিয়ে পাঠক জীবন আর অনুভব সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ায়। ঈর্ষা লোভ অভিমান অপমান আর  প্রতিশোধস্পৃহাকে ঘিরে সে প্রশ্নগুলো আবর্তিত হয়। উত্তরের অন্বেষায় ক্রমশ সংশয়ে, বলা ভালো, সম্ভাব্য উত্তরের সম্ভাবনাহীনতায় তলিয়ে যায়। এক সময় উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ভুলে যায় আসলে সে কী খুঁজছিল।                                                  

সখিচানগল্পটি বিশেষ মনযোগ আকর্ষণ করে মূলত এর গভীর বিস্তৃত বিষয়বস্তু এবং নির্মাণ প্রকৌশলের  জন্য। গল্প সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির একজন মানুষকে ঘিরে। গল্পের নির্মাণ প্রকৌশলের কথা বলতেই হয়। এর ভাষা কাব্যিক। ডিটেইলসে পরিপূর্ণ। গল্পের শুরুটা আশ্চর্য কুয়াশা আর শিশিরভেজা- “হাসপাতালের লাইটপোস্টের উপরে একটা রাতজাগা পাখি, শীতে। কুয়াশার চাপ নিচ থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে এসেছে অনেক উঁচুতে। বরফের অজস্র কুচি নীরবে ভেঙে ভেঙে ঢুকছে অবিরাম বাতাসে। ঘিরে ধরেছে বিস্তৃত চারপাশ; দৃষ্টি যতোটুকু যায় কুয়াশার ধোঁয়া ডুবিয়ে দিয়েছে খণ্ডকালীন আকাশ। বছরের ঠাণ্ডায় কেমন মানুষজন মরতে পারেএইসব আলোচনা চলছে। এই সময় সখিচান ঘরে। পরেই উষ্ণ হবে।প্রথম অনুচ্ছেদেই নামচরিত্র সখিচানকে পাওয়া যায়। উষ্ণতার কারণ হিসেবে বোঝা যায়মদ্যপানের একটি আসর বসতে যাচ্ছে। এই আয়োজন সৃষ্টি করা লেখকের জন্য কেন দরকারী হয়ে পড়েছিল পাঠক সে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে গল্পের শেষভাগে। মদের আসর শুরু হয় আর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে ডিন্যারেটিভাইজ প্রক্রিয়ায় গল্পের অবয়ব তৈরি হতে থাকে। আখ্যানবয়ানে একেকটি চিহ্ন ফেলে লেখক গল্পের চূড়ান্তে পৌঁছে যান। চিহ্ন ধরে ধরে গল্পের অবয়ব তৈরি করে নিতে হয় পাঠককে। তাই সেলিম মোরশেদের গল্পের পাঠককে হতে হয় তন্নিষ্ঠ। একাগ্রতার সাথে না পড়লে চিহ্নগুলোর কয়েকটা অসতর্কতায় বাদ পড়ে যেতে পারে। এতে মূল গল্প থেকে হয়তো সরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিন্তু পাঠকের নিরাশ হবার কিছু নেই। পাঠক নিজেই তখন আখ্যান নির্মাণ করে নিতে পারে।

গল্পের ভেতর আর কিছু দূর প্রবেশ করলে পাঠক জানতে পারেআজ থেকে সখিচানের কোনো পেশা নেই। পেশায় ডোম সখিচান সরকারী হাসপাতালের মর্গে কাজ করত। পরের বাক্যেই লেখক গল্পের বীজ রুয়ে দিয়েছেন তিনটি শব্দে।গোবিন্দ জায়গাটা নিয়েছে।গোবিন্দ চাকরিতে সখিচানের স্থলাভিষিক্ত না হলে গল্পটাই আর হয়ে উঠত না। সখিচান সেদিনই রিটায়ার করেছে। ঝাড়ুদার হিসেবে। ডোমের কাজ করলেও গোবিন্দর ষড়যন্ত্রে প্রশাসন নিয়মের বাইরে গিয়ে তাকে ঝাড়ুদারের পোস্ট দিয়েছিল। এই আসরে উপস্থিত সখিচান, তার স্ত্রী দুলারী, চৌদ্দ বছরের মেয়ে ফাল্গুনী, শ্যালক হারাধন- পেশায় সুইপার, হারাধনের মুসলমান বন্ধু মনোহর- বেকার স্নাতক। আর আছে গোবিন্দ। সে চাকরিতে সখিচানের স্থলাভিষিক্ত। আদপে গোবিন্দ মুচি। সখিচানের কাছে লাশ কাটার কাজ শিখে সখিচানের চাকরীটাই সে বাগিয়ে নিয়েছে।  

চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিকে ফেয়ারওয়েল দেয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্য তেমন কিছু গুরুত্ববহ নয়। তাই  সখিচানের এই বিকল্প ফেয়ারওয়েলের ব্যবস্থা করে শ্যালক হারাধন। ঘরোয়া আয়োজনে সে বন্ধু মনোহরকে নিয়ে আসে। মনোহর কবি কিন্তু কবিতা লেখে না। সুন্দর করে কথা বলতে পারে। সে এসেছে সখিচানকে নিয়ে কথা বলতে। মানপত্র পাঠের মতো কিছু একটা সে বলবে। দুলারী চুলায় মাংসের হাঁড়ি বসিয়ে লাল কৌটা থেকে টাকা বের করে গোবিন্দকে দেয়। মদ কিনে আনার জন্য। গোবিন্দ দুবোতলরেডসিলনিয়ে আসে।      

সখিচানের সাথে পাঠক একবার অতীতে আরেকবার বর্তমানে আসা যাওয়া করে। চোখের সামনে দৃয়াশ্যায়িত হয় প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনের কোলাজচিত্র। সেখানে আছে দলবাজ গোবিন্দর কথা, যার আপাত নিরীহ  চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই, ওরই রটিয়ে দেয়া মিথ্যাচারে নির্ধারিত সময়ের আগেই চাকরী থেকে অবসর দেয়া হয়েছে সখিচানকে। গোবিন্দ সখিচান আর দুলারীকে পিতা-মাতা জ্ঞান করে অথচ লোক দিয়ে রটিয়ে দেয় সখিচান নাকি লাশ কেটে পার্টির কাছ থেকে টাকা খায়। এই ভণ্ডামীটা সখিচান টের পেয়ে যায়। শিষ্য গোবিন্দর লোভ আর কপটতার জন্য সখিচানের নাম সরকারী খাতায় নথিভুক্ত হয় ঝাড়ুদার হিসেবে।        

হারাধন পেশায় সুইপার। সে একই সাথে সখিচানের শ্যালক বন্ধু। সখিচানের মন বুঝতে পারে সে। সখিচানের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ হারাধন করতে পারে না বটে কিন্তু ব্যথা প্রশমনের চেষ্টা করে। বিপদ আপদের ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেই হারাধনের জীবন কাটে। হারাধন নেশাখোর। ব্রাউন পেপার জ্বালিয়ে নাকে ধোঁয়া নিয়ে নেশা করে। সে জানে হেরোইন রাজনেশা, মদ এর কাছে কিছুই না। মদ শুধু মাতাল করে কিন্তু ওই নেশা তাকে কত কিছু দেখায়। সেই অনুভব লেখক সেলিম মোরশেদের ভাষায় বিচিত্র এক দৃশ্যকল্প হয়ে আমাদের চোখে ভাস্বর হয়- “রক্তের ভেতর অযুত-নিযুত কোটি-কোটি টিকটিকি ঝিম ধরিয়ে কাঁপায়- সাঁতরায় নিঃশব্দে, লাফ দেয়, টুপ করে গিলে খায় জেগে-থাকা যাবতীয় সুখের পোকা।এই অপ্রচলিত রূপকল্পে পাঠককে থেমে যেতে হয়। মানুষ যে রূপকতায় টিকটিকির মতো হতে পারে, সুখ হতে পারে পোকার মতোঅনুভবের এমন বহিঃপ্রকাশ লেখকের পর্যবেক্ষণ শক্তি আর কাব্যিক শক্তির সমন্বয় ছাড়া সম্ভব নয়।   

হারাধনের বন্ধু মনোহর। স্বচ্ছল পরিবারের বেকার স্নাতক। হারাধনের সাথে পরিচয়ের পর তাকে সহজ করে, শ্রেণিবৈষম্য ভোলাতে অনেক সময় লেগেছে মনোহরের। সে জেনেছে সুইপারদের প্রকট দুঃখকষ্টের জীবনের কথা। হারাধনের পৌরসভার চাকরি। ছয়শো টাকা বেতন। নিজস্ব কোনো আবাসস্থল নেই অথচ ওদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পরিচ্ছন্নতা, সভ্যতা। সখিচানের ঘরে এসে একটা ভুল ভাঙে মনোহরের, যখন দুলারী  শোকেস থেকে চিনামাটির প্লেট বের করে। রান্না করা মাংস বেড়ে দেয়ার জন্য। মনোহর বিস্মিত হয়ে দেখে সময় বদলের সাথে সাথে সুইপার, ডোম, ঝাড়ুদারদের ভেতর মধ্যবিত্তের রুচিবোধ চলে এসেছে। কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের এই পর্যবেক্ষণ বলে দেয় তাঁর লেখা বাস্তবানুগ।  কল্পনার আকাশে আখ্যানের ঘুড়ি উড়িয়ে দেন বটে কিন্তু বাস্তবতার নাটাই নিজের হাতে রেখে বর্ণনার সুতো ছাড়েন। দুলারী টাকা পয়সা নিয়ে তেমন চিন্তা করে না। কিছুটা চিন্তিত, ঘরটা ছেড়ে দিতে হয় কি না। অধিকাংশ ডোমনারীর মতো সে ধাত্রীবিদ্যায় পোক্ত। সুন্দরী, সুকণ্ঠী এবং দুর্মুখ। সখিচানকে ধরে রাখার জন্য যতটা চপলা আর কূটবুদ্ধির ভারসাম্য রেখে চলতে হয়েছে এতে বরং তার রূপ বেড়েছে। সখিচান যাত্রাপালা করে। আড়বাঁশি বাজায়। মদের গ্লাস রেখে আড়বাঁশিতে ফুঁ দেয়। বাঁশির ছিদ্রগুলোয় আঙ্গুল ওঠানামা করে।   

একটু একটু করে তীব্র-তীক্ষ্ম সুর ওঠে। সেই সুর ঘর চিরে সারা হাসপাতালের বিশাল-বিস্তৃত এলাকা নিস্তব্ধতায় স্তম্ভিত করে। সেই সুরে চমকে ওঠে দুলারী! এতো শিবরঞ্জন! এই রাগ অপেরার। রাতে যাত্রাপালার সুর। বাঁশির সুর শীতের কুয়াশা ফুঁড়ে লক্ষ্যমুখী অজস্র তীরের মতো তার শোণিতে আঘাত করে। রামপিয়ারীর কথা মনে পড়ে দুলারীর। যাত্রাদলে নাচত রামপিয়ারী। দুলারী ঈর্ষার বিহ্বলতায় রামপিয়ারীকে ভুলতে পারে না। তার গ্লাসধরা হাত মৃদু কেঁপে ওঠে- রামপিয়ারী- যে মৃত্যু নিয়ে ঘুরছে, মৃত্যুর হাতেরই ছায়া, সখিচানের নিঃশ্বাসে যে সুর তা মৃত্যুরই অর্চনাসে সুরমূর্ছনায় রামপিয়ারী থাকে, আপন করে নিজের মতো আসে আর যায়। সুরের মূর্ছনায় সে যখন অনুক্তভাবে সরিয়ে দিতে চাইছে বেঁচে থাকার সাধারণ সূত্রগুলোকে, গোবিন্দ তখন নেশার মধ্যস্তরে। সে ফিসফিসিয়ে বলে- “যাই পাখিটারে ধরে আনি।একই সাথে গল্পে দুটো ব্যাপার ঘটে এখানে। সখিচান গোবিন্দর বেঁচে থাকার সূত্রগুলোগুলো সরিয়ে দিতে চায় আর গোবিন্দ পাখিটাকে ধরে আনতে চায়। আপাতদৃষ্টে গল্পটিকে কৌশলহীন মনে হলেও পাঠক যেন ভুলে না যায়তিনি সেলিম মোরশেদ। গভীরভাবে পরিকল্পিত নির্মাণকলাকে কৌশলবিহীন অনুভবে পরিণত করা তাঁর রচনার শিল্পগুণ। এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় শিল্প-কৌশল।          

ডোম হলেও সখিচান শিল্পী, চিন্তাশীল এবং সংবেদী। বাচ্চাদের লাশ কাটতে কষ্ট পায়। একদিন এক মেয়ে- ধবধবে সাদা, রূপসী, সদ্যপ্রসূত বাচ্চা রেখে এন্ড্রিন খেয়েছে। প্রাণহীন দেহের স্তনযুগলে ফুলেফেঁপে উঠেছে তৃষিত মেঘনা। অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার আহ্বানে টপটপিয়ে পড়ছে অজস্র শ্বেতবিন্দু। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল সখিচান- “রূপ, কি রূপ! মরবো তো আমি, তুই ক্যান? লাশ আমি কাটতে পারব না।রাতে দুলারী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল- বাচ্চা তো আর না, তুমি কাঁদলে কেন? কান্নার কারণ জানতে চাইলে সখিচান জানায়- “কেঁদেছিলাম রূপ দেখে। রূপ তো আলো। মরে ক্যান?” তখন রামপিয়ারীর সৌন্দর্যের কথাও জিজ্ঞেস করেছিল দুলারী। সখিচানের মনে পড়ে রূপবতী রামপিয়ারীর কথা। রামপিয়ারী একবার বলেছিল- ‘রাত ভালোবাসিস সখিচান?’ সেই রামপিয়ারী হারিয়ে গেছে। যা কিছু হারিয়ে যায় সেটা আসলে মৃত্যুর ছায়া। মৃত্যুর বিপরীতে জীবন। জীবনের প্রতি মমতাই সখিচানকে দুলারীর দিকে ঠেলে দেয়। তবু ঘুমের ভেতর কেঁপে ওঠে সখিচান। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।বুকের দ্রুত নিশ্বাস আপনকার অন্তর্গত ঢালাই আর নির্মাণে হু-হু করে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। রামপিয়ারীকে সে ভোলেনি।কী সহজে, কী নীরবে লেখক এখানে একটি গোপন জানলা খুলে দেন আর সেই জানলা দিকে বহুদূর তাকিয়ে পাঠকের মর্মমূল অবধি শিউরে ওঠে।      

গল্পের বিভিন্ন চরিত্রের সাথে রক্তমাংসের আরেকটি অন্যতম চরিত্র আছে। সেটি হলো, পাখি। লাইটপোস্টের ওপর বসে থাকা রাতজাগা পাখি দিয়ে গল্পের শুরু আর পাখিতেই শেষ। পাখি জীবন আর মৃত্যুর প্রতীক। দুলারী পাখির দিকে তাকিয়ে ভাবে রামপিয়ারীর কত রঙ! ফাল্গুনী ভাবে পাখিটাকে সে পুষবে। গোবিন্দ পাখিটাকে একবারঅর্জনকরতে চায়। সখিচানের মনে হয় পাখির বিনিময়ে যদি ডোমের চাকরিটা পাওয়া যায়। পাখি জীবনের সম্ভাবনাময় প্রতীক হয়ে ওঠে। ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় আংশিক পাখি। হু হু হাওয়ার সাথে লাইটপোস্টের আলোয় বোঝা যায় পাখির হালকা লাল-কালো লেজ।সখিচান জানলা দিয়ে পাখিটার দিকে তাকিয়ে ভাবল: মৃত্যু নিয়ে আমার কারবার অথচ কেউ কি বিশ্বাস করবে যে মৃত্যুকে আমি দেখিনি। যাচাই করার চেষ্টা করি- তাও-বা কতটুকু?” শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশ্লেষণে সহায়ক হওয়া, আঘাতের চিহ্নগুলো নির্ণয় করা, ঘেঁটে-ঘেঁটে, কেটে-ছিঁড়েও কি মৃত্যুর স্বরূপ বোঝা যায়? “শীতার্ত বিষণ্ণ বিহঙ্গের দিকে তাকিয়ে ভাবলো সখিচান- মৃত্যু কী? মৃত্যু কেমন?” এটুকু পড়ে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। গল্পে যতবার সখিচান পাখির কথা ভেবেছে, আসলে গোবিন্দর মৃত্যুকেই ভেবেছে।    

নেশার ঘোরে গোবিন্দ যায় পাখিটাকে উড়িয়ে দিতে বা ধরে আনতে। নিয়তিই কি টেনে নিয়ে যায় গোবিন্দকে? ভেজা জুবুথুবু এক ঠায়ে বসে থাকা পাখির কাছে? মৃত্যু নাকি হত্যা? ক্লুলেস হত্যাকাণ্ড ঘটালো কি সখিচান? নাকি গল্পকার স্বয়ং সমস্ত আয়োজন করে দিলেন একটি নিরবচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড ঘটার জন্য। তাই অন্যায়ভাবে  অবসর দিয়ে দেয়া সখিচানের বিদায়ের দিনটিতেই মদের আসর বসানো হয়। বৃষ্টি আর কুয়াশাভেজা পাখি পিলারের তারের ওপর বসে থাকে যেন শুধু গোবিন্দকে হত্যা করে সখিচানের পূনর্বহালের জন্য। পাখির দিকে তাকিয়ে সখিচানের উপলব্ধি আসলে সেলিম মোরশেদের আখ্যান নির্মাণের আত্মগোপনকারী কৌশল। সখিচান পাখিটাকে দেখে কাতর হয়েছিল। শীতে বড় কষ্ট পাচ্ছে পাখিটা। হয়তো উড়তে চাচ্ছে, পারছে না। তারপর গোবিন্দ দিকে তাকিয়ে বলেছিল- ‘ভুলে যাবো ওকে, মরুক গে। যেন গোবিন্দকে উসকে দেয়া। মদিরা-মত্ত গোবিন্দ পাখিটাকে ধরে আনতে চাইলে তাকে নিরস্ত না করে বলে দেয়া- ‘না নিয়ে ফিরে আসিস না।সখিচান জানলা দিয়ে হালকা কুয়াশার ভেতর দেখতে পেয়েছিল শর্ট সার্কিট থেকে একটা তারের জয়েন্ট ঢিলা করে ওপরের তারগুলো থেকে অনেক নিচে নামানো হয়েছে। পাশের বিল্ডিং এর রেলিং বাঁচিয়ে তারটা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই ঢিলা জয়েন্ট বরাবরই পাখিটা বসে আছে।     

বাঁশি হাতে সখিচান প্রেমিক কৃষ্ণ।বাঁশিতে সুর তুললেও তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছিল লাইট পোস্টের দিকে সখিচানের চরিত্রের বৈপরীত্য পাঠক তখন আবিষ্কার করে। সখিচানের আকাঙ্ক্ষাটা আসন্ন হলেও এর গৌরচন্দ্রিকা আছে। গোবিন্দ পিলারে বেয়ে উঠে গেলে পাখিটার চোখে সখিচান এমন কিছু সত্য দেখল যা গোবিন্দ দেখতে পেল না। গোবিন্দর চোখ যখন পাখির দিকে এক ধ্রুবগন্তব্যে, সখিচানের উপলব্ধিতে সত্যের এক ক্রূর সৌন্দর্য। অন্যায় আর অপমানের প্রতিশোধ। সখিচানকে লাশ কাটা ঘর থেকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে পোস্টিং দেয়া হলো সখিচানের প্রধান শিষ্য গোবিন্দকে। কাকভোরে তখন সখিচান সারা হাসপাতাল ঝাড়ু দেয়। কী অসহনীয় সে সময়। জানলা দিয়ে সখিচান দেখছে গোবিন্দ ক্ষিপ্রতায় পাখিটাকে ধরতে যাচ্ছে তখনই সে বাঁশি রেখে জানলা লাগিয়ে দিল। আবার বাঁশি ঠোঁটে তুলে নিল। তীক্ষ্ম অথচ কোমল সুরে চাপা পড়ে গেল কারো স্পৃষ্ট হবার আর্তনাদ। শুরুতে প্রকৃতির শীত দিয়ে গল্প শুরু হয়েছিল, শেষ হলো আগুনের স্ফুলিঙ্গে শীতনিরপেক্ষতায়। গল্পের শেষটুকু এমন- “কাল সকালে তাকে মর্গে যেতে হবে- সখিচান ভাবল। মৃত্যুর নিশ্চিত পাঠে।আশ্চর্য নিরীহ দুটি বাক্যে লেখক প্রকাশ করে দেন সখিচানের ডাক আসবে গোবিন্দর শবব্যবচ্ছেদের জন্য।  

এবং নিরাসক্ত কলমে গল্প শেষ হয়। সেলিম মোরশেদেরসখিচানগল্পটি সূক্ষ্মতা আর জটিলতার উন্মোচন। ভাষার অনন্যতায় অনভ্যস্ত পাঠক হোঁচট খায় ঠিকই কিন্তু সখিচানের বোধের অনুকম্পনটুকু অনুভব করতে পারে। ব্যক্তি সখিচানের অস্তিত্ব, দর্শন, মনস্তত্ত্বকে বহন করার জন্য গল্পটির অতীতে আর বর্তমানে আসা যাওয়া ছিল অপরিহার্য। সাবলীলভাবে ক্রিয়াপদ এড়িয়ে গিয়ে লেখক অতীত বর্তমানের ভেদরেখাটি মুছে দেন। কালরূপের এই সচেতন বিপর্যয়টি তিনি ঘটান ন্যারেশানে ক্রিয়া বিশেষণ ব্যবহার করে। দীর্ঘ বাক্য ছোট বাক্যের সমন্বয়ে গল্প রচিত। সংলাপগুলো লেখকের বুদ্ধিমত্তা এবং পরিমিতিবোধের পরিচয় দেয়।সখিচান’  গল্পটি বহুবার পাঠ দাবী করে। অধিক পাঠে একঘেয়েমির সুযোগ নেই বরং পাঠ অভিজ্ঞতায় বলা যায় প্রতিটি পাঠে নতুন নতুন সূক্ষ্ম রসের খোঁজ পাবে পাঠক।         

সময়ের অনিবার্যতায় গোষ্ঠীবিশেষের মধ্যে যখন নির্দিষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনা দর্শন মতামত পরিব্যাপ্ত হয় তখনই ভাবনার একেকটি স্কুল গড়ে ওঠে। তাই আলোচনার শিরোনামেএস. এম. লিটরেচার অ্যান্ড আর্টস স্কুলবলাটা অতিশয়োক্তি হয় না। কারণ, কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদ বাংলা সাহিত্যেরবিরুদ্ধ স্রোতধারার অনিবার্য স্বাতন্ত্র্য নিরীক্ষাপ্রবণ লিখনশৈলী, ভাষাবৈশিষ্ট্য গদ্যভঙ্গীতে তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে একক পৃথক। সাহিত্যের ভাবসম্পদকে তিনি ধারণ করেন আখ্যান সৃষ্টির অসামান্য শক্তি দিয়ে। কথাশিল্পী সেলিম মোরশেদের রচনার ব্যতিক্রমী শিল্পগুণ আভাস দেয়বাংলা সাহিত্যের মন্দিরে তাঁর টেরাকোটার কাজ অক্ষয় হয়ে রবে।     

 

* ‘Selim Morshed’ নামটির সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবেএস. এম.’ অদ্যাক্ষর দুটো ব্যবহার করা হয়েছে।

(রচনাকাল: ২০২০।মেঘচিলওয়েবজিনে প্রথম প্রকাশিত)                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                           



অলংকরণঃ তাইফ আদনান