জলধি / পাঠ-পর্যালোচনা / 'লাশপাতাল' এক জীবন্ত ইতিহাসের কড়চা
Share:
'লাশপাতাল' এক জীবন্ত ইতিহাসের কড়চা
সাহিত্যে গল্পের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মৌখিক বা লিখিতভাবে মানুষ স্বভাবত গল্প বলতে ও শুনতে ভালোবাসে। গল্পের কাব্যিক ঢংই পাঠককে আকৃষ্ট করে। গল্পের ভেতরে কাব্যিকতা থাকলে মানুষের মনোজগত সহজেই আকৃষ্ট করা যায়। গল্প নানা রকম হতে পারে– প্রকৃতিকেন্দ্রিক, প্রেমবিষয়ক, সামাজিক, ভৌতিক, হাস্যরসাত্মক, উদ্ভট, সাংকেতিক, ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক, মনস্তাত্ত্বিক বা জীবনসংগ্রামে ভরপুর। প্রাণ-প্রকৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যকে গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারা বিশেষ যোগ্যতার ব্যাপার।
 
এতে সমাজ-সভ্যতার বাস্তবতা তুলে ধরা যায় গল্পকারের চিন্তাশক্তি দিয়ে। গল্পকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হতে হয় অল্প কথায় লক্ষ্য স্থির বা বক্তব্য ঠিক রেখে পাঠকের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা। তাহলে গল্পের সূচনা এবং সমাপ্তির ইতিহাস গুলিয়ে ফেলতে পারবে না পাঠকসমাজ। আমাদের সাহিত্যে পাঠককে আকৃষ্ট করতে না পারার বড়ই অভাব! সাহিত্যে রস একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গল্পকারদের এ বিষয়টিতে আরও কঠিনভাবে নজর দিতে হয়। সাধারণত গল্প হলো গতিময় বর্ণনা। যে বর্ণনায় সমাজের গতিময়তা উঠে আসে। ভাষাবিন্যাস হয় নির্মেদ; কিন্তু ইঙ্গিতধর্মী। সুন্দর উপস্থাপনার বিশেষ যোগ্যতার জন্য পাণ্ডিত্যে ভরপুর হলেই শুধু চলে না, এর জন্য সমাজের ভেতরের চিত্রগুলো বিশেষভাবে অবলোকন করতে হয়।
 
গল্পকার আব্দুল আজিজ। তিনি কবিতাও লিখেন। তার লিখিত ‘লাশপাতাল’ বইটি দীর্ঘ সময় নিয়েই পড়তে হলো। ভেবেছিলাম এটি প্রথমে পড়ে শেষ করব। কিন্তু গল্পের ভেতর যেভাবে একের পর এক ইতিহাসের স্থান দিয়েছেন, তাতে একটানা পড়ে শেষ করা মুশকিল। 
 
একটা গল্প পড়ে দীর্ঘক্ষণ গ্যাপ দিতে হয়। তা না হলে মস্তিষ্ক হ্যাং হয়ে যায়; এটা হয়তো আমারই দুর্বলতা! সম্পূর্ণ ভিন্ন ঢঙে আদি ইতিহাসে ফিরে যাওয়াটা তিনি গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। যা পাঠকের জন্য বুঝতে পারা, কিছুটা কষ্টদায়ক। তবে গল্পের গভীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারলে সহজ হয়ে যাবে। 
 
বইটির সূচিক্রম সাজানো হয়েছে ১৪টি গল্প দিয়ে। প্রত্যেকটা গল্পের ধাঁচ আলাদা। গতির রয়েছে ভিন্নতা। যে কারণে পাঠককে একটি পড়ার পর, অন্যটি পড়ার প্রতি আকর্ষণ কমবে না। 
 
নিজস্ব শব্দভাণ্ডার তৈরি করতে পেরেছেন। এটি হলো এ বইয়ের মূল আকর্ষণ। ধার করা শব্দের প্রতি ঝোঁক নেই, রয়েছে নিজস্ব ঢঙ। তবে আরো সাবলীল হতে পারে সে নিজস্বতার। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ, আলাপ। 
 
গ্রামে বেড়েওঠা একজন মানুষের দৃশ্যপট সত্যিই চমৎকার হয়। যদি নিজে হতে পারেন দৃশ্যশিল্পী। শিল্প-শিল্পীর সঙ্গে সম্মিলন ঘটিয়ে, দেখার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো যখন লেখনি আকারে ছাপা অক্ষরে প্রকাশ করে; তখন তা মানুষের কথা হয়ে উঠে। পাঠক মনে করতে পারে, আরেহ আমিই তো এই ছিলাম, এই গ্রামের যে বর্ণনা! চেরাগ বাতির সঙ্গে কত ইতিহাস রয়েছে। সংসারের টানাটানি তো আমারও ছিল। সামান্য ধোপাগিরি জীবনের কথা তিনি যে বর্ণনার ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন, তা তো আমারই জীবন ভেবে পাঠক—সান্ত্বনা পেতে পারে, এটুকু সামান্য জীবন নিয়ে কেউ দিব্যি গল্প লিখে ফেলল! 
 
গল্প মানেই জীবনের জয়গান। জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা। মানুষের অন্তর্জগতকে আঘাত করা, ভেতরের দুঃখ-কষ্ট-অনুভূতি এবং খরাকে কলমের খোঁচায় তুলে ধরা। যা পড়লে গা ছমছম করবে। চোখের পাতা ভিজে আসবে। চোখের কোণ বেয়ে বইয়ের পাতায় যে জল পরবে; তাই গল্প! লেখক এই জায়গাটাই ধরতে পেরেছেন। 
 
চাপাইনবাবগঞ্জের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা কিংবা বেড়েওঠা, তাদের জন্য এটি আরো সহজবোধ্য হবে। কারণ ওখানকার প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ-পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য যে আষ্টেপৃষ্টে থাকাটা জরুরি। সেটি আমার নেই। কিন্তু ওই বোধশক্তি। বোধের লড়াই— যে লড়াই থেকে লেখকের গল্পগুলোর সঙ্গে রিলেট করতে পারছি। 
 
সীমান্ত হত্যা। জলপাই রঙ। কতটা ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করতে পারে। মানুষগুলো নির্বাক। নিস্তব্ধ। অসহায়ত্ব দেখানোর মতো কোনো জায়গা নেই। কেমন একট অদ্ভুত, ভুতুড়ে সমাজে তাদের বাস। লেখক তো তাই তুলে ধরেছেন। ‘গাধাচরিত’ গল্পে তিনি দেখিয়েছেন— ‘বিবি হাওয়া কি আগুনে সেঁকছিল পুত্র কন্যাদের ক্ষুধার রুটি! সে বুঝতে পারে না হত্যা কী? রক্তপাত শেষে তার আরেক পুত্র হাবিল নড়ে না উদ্যত হয় না মাটির যোনিতে আঘাত হানার জন্য কঠিন অস্ত্র হাতে, ক্ষুধার কথা বলে না যেন পাথরের মতো পথে রয়েছে মাটিতে...।’ 
 
এই যে চরিত্র নির্মাণ করেছেন, তার জন্য ইতিহাসের অনেক দূর যেতে হয়। হয়তো এক গল্প পড়তে গিয়ে, আরেক গল্পের জন্ম দেওয়া। কিংবা ইতিহাসের কাছে পাঠককে ফিরিয়ে নেওয়ার তাড়না! 
 
গ্রামের ভেতর চাউর গল্পগুলো কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে। বংশপরম্পরায় সে গল্পগুলো নিয়ে তৈরি হয় নানান মিথ। তেমনই এক গল্প ‘ধানবিদ্যার চাঁদ’। এক পিরের গল্প। পিরের আগমন, তাকে মেরে ফেলার ইতিহাস। যে গল্প মানুষজনকে ধীরে ধীরে কাজকর্ম
থেকে বিযুক্ত রাখা শুরু করে। শুধুমাত্র পিরের গল্প করে বেড়ানোই হয় কাজ। এই অপয়া অশুভ গল্প থেকে একদিন মুক্তি মিলে গ্রামের মানুষগুলোর। 
 
গ্রাম থেকে শহরে ছুটে চলার ইতিহাস এক গল্পে তিনি তুলে ধরেছেন। শহুরে মানুষের ভেতর হঠাৎ জন্ম নেওয়া গ্রামের প্রতি অবহেলা।
 
কবিরাজের উত্থান। কৃষি নিয়ে গবেষণা করে কবিরাজ। ফসলের ফলন নিয়ে মতামত দেয় কবিরাজ। তিনি গল্পে লিখেছেন— ‘কবিরাজের বয়স হয়েছে। বাঁঝা, বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। তার কোনো উত্তরাধিকার নাই। বউটি মৃগী রুগী ছিল, পোখরে ডুবে মরেছে। কেউ কেউ বলে চুলহিতে টেনে পানিতে বসিয়ে রক্ত চুষে ছেড়ে দিয়েছে...।’
 
লেখক আব্দুল আজিজের গল্পে যে ভুলটি নেই, সেটি হলো কথ্যরীতি-চলিতরীতির সংমিশ্রণ। তিনি যখন কথ্য বলা শুরু করেছেন, তখন সচেতনভাবেই সেটি বলে গেছেন। যে কাজটি আমাদের এখানে বরাবরই ভুল হয়।  এটি হয় লেখকের শেকড়ের সঙ্গে যোগসূত্র না থাকার কারণে। 
 
‘লাল ফ্রক’ গল্পটি গা ছমছম করা। সাত-আট বছরের শিশুর ইতিহাস। যে শিশুটির পরনে ছিল লাল ফ্রক। স্কুলে যাওয়ার বয়স হওয়া সত্ত্বেও, হয়নি স্কুলের পথ মাড়ানো। 
 
মায়ের পালিয়ে বিয়ে করা। অনিশ্চিত পথচলা। লোকজনের কথা চালাচালি ‘ওর মা মাগি পালিয়েছে পরপুরুষের সাথে, বড় হলে এও একই ধারার হবে...।’ 
 
জীবন্ত ইতিহাস। এত সহজবোধ্যভাবে তিনি তুলে ধরেছেন, যা সত্যিই বিস্ময়কর। গল্প তো সবাই লিখতে পারেন না, চেষ্টা করেন। কিন্তু বার বার পথভ্রষ্ট হয়, খেই হারিয়ে ছন্নছাড়া ভাব তৈরি করে। যা ‘লাশপাতালে’ ঘটেনি। 
 
১৪টি গল্প নিয়ে আলাদা আলাদা বর্ণনা দিতে গেলে, একটি বিশালাকার প্রবন্ধ দাঁড়িয়ে যাবে। যা পাঠকের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠবে। কিন্তু সেটিই আসলে সাহিত্যসমালোচনা কিংবা আলোচনা। আমার এটি ধরে নেওয়া যেতে পারে, পরিচিতিমূলক ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
 
তার গল্পে আরেকটি বিশেষ দিক হলো চরিত্র নির্মাণ। তিনি নামকে চরিত্র হিসেবে নির্ধারণ করেননি। বিশেষ কোনো চরিত্রের ভেতর আবদ্ধ থাকেননি। কখনও একটি হাসপাতাল, কখনও একটি গ্রাম; কখনওবা গ্রামের আদি ইতিহাসকে ঘিরে গল্প নির্মাণ করেছেন। 
 
‘লাশপাতাল’ গল্পটি একটি লাশকে ঘিরে। হঠাৎ মরে যাওয়া। ডাক্তারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়ার পূর্বে পৃথিবীকে বিদায় জানানো। যেটি অহরহই ঘটে থাকে। লেখক যে দুটো লাইন দিয়ে শুরু করেছেন— “ভাই লাশ নিয়ে যাচ্ছেন, খুশি হয়ে কিছু বখশিশ দেন”...
 
জীবন প্রদীপ হঠাৎ থমকে যায়। কোনোকিছু বুঝে উঠার মতো সময় পায় না পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজন। এই যে গল্পের বুননশক্তি তিনি দেখিয়েছেন সেটি তরুণদের জন্য আশার বাণী। যখন হতাশায় ঘিরে ধরেছে, থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে; সে মুহূর্তে এ রকম বই নিয়ে আলোচনাটাও জরুরি। 
 
আব্দুল আজিজের শক্তির জায়গা হলো—অহেতুক টেনেহিঁচড়ে প্লটকে বাড়ানোর চেষ্টা করেননি। একের পর এক অহেতুক চরিত্রের মেলবন্ধন ঘটাতে চাননি। হযবরল পরিস্থিতি তৈরি করতে গিয়ে পাঠককে বিভ্রান্ত করতে চাননি। থেমে গিয়েছেন। নির্দিষ্ট গন্তব্যে। বাকি পথ পাঠককেই হাঁটতে হবে। 
 
গল্পের গন্তব্য লেখক যেভাবে দেখছেন, পাঠক ঠিক সেভাবে নাও দেখতে পারেন। পাঠক আরও বহুদূর ছুটে চলে যেতে পারেন; সেটির দায় পাঠকের। গল্পকার তার দূরঅব্দি এগিয়েছেন। তবুও আরও কত সাবলীল-স্পষ্টতা এবং বহুর্মুখী হতে পারত সেটি আলোচনা করা যেতে পারে। কখনও খেই হারাইনি কিংবা পথভ্রষ্ট হয়নি; ত বলাটা মুশকিল। কিন্তু এটাই শক্তির জায়গায় যে, এমন এক সময়ে বসে তিনি লিখছেন আদি-ইতিহাস। সীমান্তে বেড়েওঠা মানুষের অভাব-অনটন। নারীর ক্লেষ-যাতনা। 
 
শুধুমাত্র প্রেমভক্তি থেকে লেখা আসেনি। মধ্যবিত্তের মতো বিশেষ চরিত্র নির্মাণ করেননি। তুমি-আমি এবং একটি ভালো চাকরিতে আবদ্ধ রেখে যে গল্প রচিত হয়; তা তো অনেক সময় শুধুমাত্র পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই জাগায়। অপরের দুঃখকে পরখ করতে শেখায় না, নিজের আরও কত বড় হওয়া উচিত ভেবে অস্থির করে তুলে। 
 
রজঃস্বলা নারীর সমাজের চোখে ধীরে ধীরে অচ্ছুৎ হয়ে উঠার গল্প লিখেছেন তিনি। পরিবার-সমাজ রজঃস্বলা নারীকে করে রেখেছে ঘরবন্দি। ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটা ধরা যাবে না, ওটা ছোঁয়া যাবে না—সে গল্পই তো আপনার-আমার সব নারীদের। যে গল্পগুলো তিনি ‘লাশপাতাল’ বইটিতে তুলে এনেছেন।
 
পরিশেষে
 
‘লাশপাতাল’ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা না হোক; কিন্তু এটি যে একটি গল্পের বই, যেটি জীবনের কথা বলে গেছে। যে জীবনকে বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা প্রত্যেকেই সেটি অন্তত কোনো এক পাঠক জানুক। 
 
প্রেমহীন জীবন। অভাবের সঙ্গে বন্ধন গড়ে তোলার জীবন। যে জীবনের পাল্লা কখনও অতি ভারী, কখনও এটাই হওয়ার কথা বলে দীর্ঘশ্বাস। তা তো অসত্য নয়। ‘লাশপাতাল’ গল্পপ্রেমীরা পড়ে দেখুক। 


অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন