জলধি / পাঠ-পর্যালোচনা / স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘তীর ও তরঙ্গ’ ত্রিভুজ প্রণয়াখ্যান
Share:
স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘তীর ও তরঙ্গ’ ত্রিভুজ প্রণয়াখ্যান

স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য [১৯০৮-’৬৪] চল্লিশের দশকের কথাশিল্পী। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য। অর্থাৎ শিল্পের আধুনিকতম মাধ্যম নিয়েও স্বর্ণকমলের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। বিশেষত দেশভাগ নিয়ে তিনি নিমাই ঘোষের সহকারী পরিচালক হিসেবে নির্মাণ করেন ‘ছিন্নমূল’ [১৯৫০]; বাংলা বিভাজনের কতটা কুপ্রভাব পড়েছিল সাধারণ জনগণের উপর তা ‘ছিন্নমূল’-এর ফ্রেমে তুলে এনেছেন স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য। শিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠার কারণে পরিণামে স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্টও লিখেছেন। তথাপি সমকালে স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য কথাশিল্পী হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তবে কালস্রোতে ক্রমেই তিনি অনুজ্জ্বল হয়ে পড়েছেন, ঠাঁই নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। অথচ চল্লিশের দশকে স্বর্ণকমলের গল্প-উপন্যাস সাহিত্যমহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। প্রসঙ্গত একথাও সত্য যে, তিনি বহুপ্রজ কথাকার ছিলেন না। কিছু গল্প এবং দুটো উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। তাঁর ‘তীর ও তরঙ্গ’ [১৯৩৬] যখন প্রকাশিত হয়, একই বছর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এবং ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ [১৯৩৬] বের হয়েছিল। বিগত নয় দশকে স্বর্ণকমলের ‘তীর ও তরঙ্গ’ প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেলেও মানিকের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এবং ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ একালেও সদর্পে বিদ্যমান। অদ্যাবধি মানিকের এ দুটো টেক্সেটের উজ্জ্বলতা এতটুকু কমে নি; বরং বেড়েছে। প্রত্যাশ আরো শতাব্দীকালেও এ দুটো টেক্সেটের আবেদন ফুরাবে না, তা নিশ্চিত বলা যায়। অথচ একইসময় প্রকাশিত হলেও ‘তীর ও তরঙ্গ’ উপন্যাসটি সে গর্ব করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, টেক্সেটের গতানুগতিক বয়ানরীতি এবং বৈচিত্র্যহীন বিষয়।

কথাসাহিত্যের আলোচনার ক্ষেত্রে একথা আমি বরাবরই স্বীকার করি যে, বিজ্ঞাপন অথবা লেখক-রাজনীতির কারণে বিশেষ কোনো টেক্সট হয়তো লেখকের জীবদ্দশায় একধরনের মর্যাদা বা প্রচার-প্রসার লাভ করতে পারে; কিন্তু পরিণামে টেক্সটকে টিকে থাকতে হয় নিজগুণেই। কারণ, একদিন লেখক মৃত্যুবরণ করে, বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যায়- তখনই মূলত শুরু হয় মহাকালের গর্ভে টেক্সেটের টিকে থাকার প্রকৃত যাত্রা। আমাদের এ বিবেচনায় মানিকের উপরে উল্লিখিত টেক্সট যে মহাকালের গর্ভে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে, তা কথাবাহুল্য। একইসময় স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘তীর ও তরঙ্গ; নিয়ে একই ধরনের কথা বলার আদৌ কোনো সুযোগ নেই। আর এটা কেন নেই, সে প্রশ্নের জবাব খুঁজলে আমাদের নিকট এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ‘তীর ও তরঙ্গ’ উপন্যাসের বা টেক্সেটের বিষয় বা আখ্যান এবং করণকৌশল সেই অর্থে অভিনব কিছু ছিল না- যা পাঠককে দীর্ঘকাল মনে রাখতে বাধ্য করতে পারে। সোজাকথায় ‘তীর ও তরঙ্গ’ কোনো অভিনব রচনা যেমন নয়, তেমনি এর বয়নরীতি নিয়ে উল্লেখ করার মতো কিছুই নেই। খুবই সাদামাটা বা আটপৌঢ়ে এক ত্রিভুজ প্রণয় ‘তীর ও তরঙ্গ’ উপন্যাসের আখ্যান। এ ত্রিভুজ প্রণয়ের ভৌগোলিক অবস্থান পূর্ববঙ্গের [তৎকালীন] পদ্মা তীরবর্তী গোয়ালন্দ অঞ্চলের নিভৃত এক পল্লী বকুলতলার। এ গ্রামের যুবক সুনীল কলকাতা শহরে চাকুরি করে, টিউশানি করে। গ্রামে থাকেন- বিধবা মা মন্দাকিনী, ছোটবোন নীল আর ছোটভাই বাবলু। পিতামহ ব্রজনাথও জীবিত আছেন, তবে সুনীলের পিতার মৃত্যু হয়েছে; এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সন-তারিখের উল্লেখ নেই।

‘তীর ও তরঙ্গ’ উপন্যাসের নামকরণের ক্ষেত্রে লেখক বিষয়-ভাবনার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এখানে ‘তীর’ অর্থে পদ্মা তীরবর্তী বকুলতলা গ্রামকে বোঝানো হয়েছে। লেখক মাঝে-মধ্যে সুনীলের মুখ দিয়ে পদ্মা তীরবর্তী বকুলতলার ভাঙনের শংকা-সংশয় প্রকাশও করেছেন। গত বছর পদ্মা যে গ্রামের বেশকিছু ঘরবাড়ি সমেত নিজের তরঙ্গে ডুবিয়ে নিয়েছে- সেকথাও জানিয়েছেন। এ বছরেও ভাঙন অব্যাহত আছে, সামনের বছর হয়তো গ্রামের আরো কিছু ঘরবাড়ি পদ্মাগর্ভে বিলীন হবে এম সংশয়ও প্রকাশ করেছেন। তবে এখানে ‘তীর’ কথাটি গল্প-ঘটনায় বিশেষ গুরুত্বাবহ হয়ে ওঠে নি বলেই মনে হয়েছে। অন্যদিকে ‘তরঙ্গ’ শব্দটি আক্ষরিক অর্থে ‘ঢেউ’ হলেও উপন্যাসের ঘটনাবর্তে সে ঢেউ এর চরিত্রাদির মানসিক ক্রিয়াকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষত সুনীলের মানস-জগতে অণিমা সরকার আর নমিতা সেনকে নিয়ে যে দোলাচলবৃত্তি, তা গুরুত্বের সাথে বিবৃত হয়েছে। অন্যদিকে বিধবা অণিমা-সুনীলকে ঘিরে মন্দাকিনীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও একধরনের তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে। বিশেষত অণিমাকে পুত্রবধূ হিসেবে প্রত্যাখ্যানের দৃঢ় সংকল্প, আবার অণিমার মানসজুড়ে বাদলদা ওরফে সুনীলের প্রতি নির্ভরতার সন্ধান- এসব মিলিয়ে উপন্যাসের ঘটনাবর্তে একধরনের মানসিক ক্রিয়ার ‘তরঙ্গ’ প্রত্যক্ষভূত হয়। এ তরঙ্গের প্রমাণও দিয়েছেন ঔপন্যাসিক :

সেই মহানগরীর সঙ্গেও সে পুরোপুরি মিলিত পারিল কৈ! আবার বকুলতলার মনের সঙ্গেও জলের উপর তেলের মত ভাসিয়া থাকে- মিশ খায় না। তার প্রবহমান মনের এপারের তীরই শুধু ভাঙ্গিয়াছে- ভাঙ্গিতেছে। ওপারে আজো চর জাগে নাই। এই দুধারার দ্বন্দ্ব অসহ্য, এই দোটানার দোলন প্রাণান্ত। তাই সে কলিকাতায় বেখাপ, বকুলতলায়ও বেমানান। সে যেন ভাঙ্গা আর গড়ার মাঝখানের প্রাণান্ত ‘ইতিমধ্য’। দুদিনের টান মানিয়া নিজের মধ্যে নিজেকে শুধুই গুটাইয়া রাখিতে চায় নিশ্চল ভারসাম্যের নিষ্ফল দূরাশায়। [তীর ও তরঙ্গ, পৃ.১৯৭]

সুনীলের মানসচেতনার এ পরিচয় থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, তার মন এক দোদুল্যমান পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গন্তব্যহীন নিরুদ্দেশের দিকে যাত্রা করেছে। বাস্তবে নদী তরঙ্গে তীর ভাঙে নি; এ তরঙ্গ সুনীলের মনের। এই বিবেচনায় ‘তরঙ্গ’ শব্দটি উপন্যাসের নামকরণে ব্যবহার এক অর্থে সার্থকতা পেলেও ‘তীর’ শব্দটি বিষয়ের সাথে খুব একটা মানানসই বা যথেষ্ট যৌক্তিক হয় নি, সেকথা বললে, খুব একটা ভুল হবে না।

‘তীর ও তরঙ্গ’ উপন্যাসটির পাঠ-পর্যালোচনার শুরুতেই উল্লেখ করা দরকার যে, মন্দাকিনীর উপার্জনক্ষম বড় ছেলে সুনীল কলকাতায় কী কাজ করে, তা কিন্তু একবারও ঔপন্যাসিক জানান নি; বরং বিত্তবান এক ঘরের কন্যা নমিতা সেনের গৃহশিক্ষক সুনীল তা বেশ ঘটা করেই উল্লেখ করেছেন। কাহিনীর শুরুতেই প্রায় নমিতার গৃহশিক্ষক হিসেবে সুনীল নিয়োজিত হয়েছে এবং এর পরপরই শারদীয় পূজার ছুটি উপলক্ষে তাকে কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়ি বকুলতলায় ফিরতে হয়েছে। সেখানে অপেক্ষা করে আছে- বিধবা মা মন্দাকিনী, বোন নীলু, ভাই বাবলু আর পাশের বাড়ির অণিমা। যেদিন সুনীলের বকুলতলায় পৌঁছার কথা সেদিন পৌঁছাতে না পারলেও পরদিন ঠিকই সুনীল এসে পদ্মা তীরবর্তী বকুলতলায় উপস্থিত হয়- পূজার ছুটির অবসরে। আর এ উপন্যাসের সংকট কিংবা সমস্যা এখানেই তৈরি হয় এবং সেই সংকট থেকে উত্তরণের উপায়ও পূর্ববঙ্গের নিভৃত পল্লী বকুলতার আখ্যানেই নিহিত আছে।

সুনীল গ্রামের বাড়ি বকুলতলায় আসার পর ছোটবেলার খেলার সাথী অণিমাকে সক্রিয় চরিত্র হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছেন ঔপন্যাসিক। পাঠক তখন জানে, অণিমা এখন আর ছোট্ট বালিকাটি নেই; রীতিমতো তার বয়স সতেরো। সেকালের গ্রামের মেয়ে হিসেবে অণিমা তখন পূর্ণ যুবতীই। প্রথমে অণিমার সাথে বাল্যের স্মৃতি-বিস্মৃতির আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সুনীল-অণিমা উভয়েই উপলব্ধি করেছে- তারা আর সেই বালক-বালিকা বা বাল্যের খেলার সঙ্গী নয়। অণিমা এখন যুবতী। তার পরিবার সম্বন্ধে যে তথ্য ঔপন্যাসিক স্বর্ণকমল দিয়েছেন, তাতে করে তারা দরিদ্রই। পিতা নরেশ সরকার সংসারী না হওয়ার কারণে সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহ করতে হয় স্ত্রী সুলতাকেই। সে গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে; সে স্কুলও যে খুব ভালো চলে তা নয়। কোনোভাবে সুলতার সংসার টানাটানি করে চলে মাত্র।

এদিকে উপার্জনক্ষম পুত্রের মা মন্দাকিনীরও সাহায্য-সহযোগিতাও সুলতার সংসারে নিত্য লেগেই থাকে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, সুনীল কলকাতা থেকে আসার আগ পর্যন্ত সুলতা-মন্দাকিনীর পারিবারিক সম্পর্কটা লেখ বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল- সেকথা বেশ ঘটা করেই জানিয়েছেন। কেননা, নীলু-বাবলুর মতো সুলতার মেয়ে অণিমাও জাহাজ ঘাটে কখন বাদলদা [ওরফে সুনীল] এসে পৌঁছাবে সে খবর রেখেছে যথেষ্ট ঔৎসুক্য নিয়ে। তাছাড়া ঘরের এটা-ওটা তো নিত্যই অণিমাকে দিয়ে মন্দাকিনীর নিকট সুলতা ধার করে নেয়। এ ব্যাপারে মন্দাকিনী কখনো কোনো আপত্তি করে এমন কথা জানা যায় না। তবে সমস্যরর সৃষ্টি হয় সুনীল কলকাতা থেকে বকুলতলায় আসার পর; বিশেষত যখন-তখন অণিমার সাথে তার মেলামেশা নিয়ে মন্দাকিনীর মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার মাধ্যমে ঘটনার সূচনা হয়। মন্দাকিনী ভাবে, তাহলে কী দরিদ্র সুলতা নিজের মেয়ে অণিমাকে তার ছেলে সুনীলের পিছনে লাগিয়ে দিয়ে পার পেতে চায়! এরকম ভাবনা আদৌ সুলতার মনে ছিল কিনা, তা কিন্তু ঔপন্যাসিক স্বর্ণকমল স্পষ্টভাবে উপন্যাসের কোথাও উল্লেখ করেন নি। তবে অণিমার সাথে সুনীলের বিয়ে হলে যে সুলতা খুশিই হবে- এমন ইঙ্গিত আখ্যানে আছে। অথচ এখানে বড় বাধা সুনীলের মা মন্দাকিনী। সে ছেলের বিয়ে দিতে চায় বিত্তবানের ঘরে অঢেল উপঢৌকনের বিনিময়ে। ফলে অণিমার সাথে সুনীলের মেলামেশাকে সে সাধারণভাবে নিতে পারে না, বরং ক্রমেই তার সন্দেহ ঘনীভূত হয়। অবশ্য, তার সন্দেহকে খানিকটা বাড়িয়ে দিতে সহয়তা করে গ্রামের মুখরা বিধবা মানদা পিসি।

ছুটিতে সুনীল এবারে বাড়ি আসলে বিধবা মা মন্দাকিনীর একান্ত ইচ্ছা ছেলের বিয়ে দেবে কোনো বিত্তবানের ঘরে। সেকথা ভেবে আগে থেকেই দুএকটি মেয়েও দেখে রেখেছিল মন্দাকিনী। মা মন্দাকিনী ছেলের বিয়ের কথা ভেবে রাখলেও সে সুনীলের মনের খবর নেয়ার প্রয়োজন মনে করে না; এটা অবশ্য সেকালের বাবা-মা করতও না। কিন্তু আমরা ঔপন্যাসিকের বয়ানে জানা যায়, ছেলে সুনীলের মনের ঘরে আসা-যাওয়া করছে নমিতা সেন নামের কলকাতা শহরের এক তরুণী; আবার গ্রামের বাড়িতে আসার পর তার বাল্যকালের খেলার সাথী অণিমার দারিদ্র্য ছাপিয়ে বেরিয়ে আসা বেহায়া যৌবনও সুনীলকে বেশ আকর্ষণ করতে থাকে। বরং নমিকাকে ছাপিয়ে বর্তমানে অণিমার প্রতিই যেন বাদলদা ওরফে সুনীলের বাড়তি আগ্রহ দেখা দেয়; এর প্রমাণ ঔপন্যাসিক তাঁর বয়ানে তুলে এনেছেন। অথচ সুলতার মেয়ে অণিমা সরকারের সাথে সুনীলের কোনো ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠুক তা কোনোভাবেই সুনীলের মা মন্দাকিনী চায় না। তার মনের ভাব ঢেকে না রেখে স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছে ছেলেকেঃ

মন্দাকিনী কয়েক মুহূর্ত্ত স্তব্ধের মত দাঁড়াইয়া রহিলেন। তারপর ফাটিয়া পড়িলেন দারুণ আক্রোশে। কণ্ঠস্বর কয়েক পরদা চড়াইয়া দিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘ভালমন্দ ভাবার লোক আজ পেয়েছিস কিনা- তাই মা বেটি এখন আর কে তোর! সারাদিন তো সেই ভালোদের কাছেই পড়ে থাকিস। তোর তো আর ভাই নেই, বোন নেই, মা নেই। আছে কতকগুলো দাসীবাঁদী, দয়া করে দুটো খেতে দিস তাই খায়।’ [তীর ও তরঙ্গ, পৃ.১৫৬]

মায়ের এ জাতীয় বাড়াবাড়িতে সুনীলের মনে একধরনের বিদ্রোহ বা জেদ চেপে বসে অণিমার প্রতি বাড়তি আগ্রত দেখানো ব্যাপারে। আর সেটা দেখাতে গিয়ে সুনীল মনের অজান্তেই অণিমার প্রতি এক দুর্বার আকর্ষণের ঘূর্ণিপাকে তলিয়ে যেতে থাকে। তবে একইসাথে সুনীল একথাও ভাবে যে, অণিমাই তাকে পাওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে :

অথবা, হয়তোবা, মেয়েটা মনে করে- সুনীল তার আকর্ষণের নাগালের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে, ধরিয়া বাঁধিয়া রাখিতে হইলে এই সময়। যত শক্তি যত কৌশল জানা আছে অণিমা তার সবগুলিই প্রয়োগ করিতে উদ্যত হইয়াছে একসঙ্গে। সুনীল বুঝিয়াছে সবই আর হাসিয়াছে মনে মনে। তবু ভালো লাগে আগাগোড়া। নমিতার মত সূক্ষ্মবুদ্ধি নাই এই যা তফাৎ। অভিনয়টুকু নিখুঁত নয় এই যা অপরাধ। অভিনয়? দোষের কি? জীবনের অর্ধেকই তো অভিনয়! -অণিমার সঙ্গে সুনীলের, সুনীলের সঙ্গে অপরের, সকলের সঙ্গে সকলের। নহিলে যেন এই জীবনই চলে না। নহিলে এত কাছে আসিয়াও সুনীল মনের কথাটি অণিমাকে আজ খুলিয়া বলিতে পারিল কৈ? নির্জ্জন ঘরেও নিষেধটা শুধু বাইরের নয়, মনেরও? [তীর ও তরঙ্গ, পৃ.১৪৪]

অণিমা যে একেবারে সুনীলকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে নি, তা অস্বীকার করা যাবে না। অণিমার যৌবনের এই আকর্ষণকে নির্দোষ ভাবাই শ্রেয়। কারণ, সুনীল তো অণিমার নিকট আকাক্সক্ষার পুরুষ। সুনীল গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসার পর থেকেই সুনীলের পিছনে ছায়ার মতো লেগে থেকেছে। অথচ সুনীল তাকে শুনিয়েছে কলকাতার নমিতাকে ভালোবাসার গল্প। মুখে সুনীল অন্যকে ভালোবাসার গল্প শোনালেও কার্যত আবার সেই সুনীল কিন্তু চুম্বন করেছে- অণিমাকে। সেই অর্থে ভালোবাসার প্রাথমিক পদক্ষেপ সুনীলের দিক থেকেই ঘটেছে।

তার এই আকর্ষণের নিকট শহুরে মেয়ে নমিতা সেন যেন হারিয়েই যায়। সুনীল এবং মন্দাকিনীর মানসিক সংঘাত-রেষারেষি এমন পর্যায় উপনীত হয় যে, সুনীল মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে অণিমাকে বিয়ে করার; কিন্তু পরিণামে মায়ের মনে চূড়ান্ত আঘাত দিতে না পেরে সুনীল পাঁচদিনের ছুটি অবশিষ্ট থাকতেই কলতার উদ্দেশে রওনা হয়। এর ফলে মা মন্দাকিনীও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে- ছেলেকে অণিমার হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছে ভেবে। বলা যায়, সুনীল-অণিমার সম্পর্ককে সরল বিচ্ছেদের রেখায় টেনে দিয়ে মন্দাকিনী যেন খানিকটা মানসিক প্রশান্তিই লাভ করে। কিন্তু যাওয়ার দিন সুনীল ঠিকই মাকে চূড়ান্ত শংকায় নিমজ্জিত করে সুদূর কলকাতা শহরের উদ্দেশে চলে যায় জাহাজে উঠে। সুনীল জানিয়ে যায় যে, সে গ্রামের অণিমাকে নয়- ভালোবাসে কলকাতার নমিতা সেনকে; যে আজকের জাহাজে ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরছে। আর এজন্যই সেও ছুটি থাকতেই কলকাতায় রওনা হচ্ছে, তার সাথে একই জাহাজে যাবে বলে। অথচ সুনীল তো খুব বড় মুখ করে অণিমাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল, সেখানে রেখে তাকে পড়ালেখা শেখানোর দায়িত্বভার নেবে বলেও আগ বাড়িয়ে বলেছিল। আর সকাল বেলা যখন, সেই অণিমা লোকনিন্দা এবং পিতামাতার নিষেধ অগ্রাহ্য করে হলেও সুনীলের সাথে কলকাতা যেতে চায়, তখন সুনীল আর তাকে নিয়ে যাওয়া সাহস পায় না :

সত্যই সুনীলের শক্তি নাই, সাহস নাই- সাহস নাই গ্রামের  পাঁচজনকে অস্বীকার করিবার, সাহস নাই মন্দাকিনীর চোখের জল অগ্রাহ্য করিবার। অণিমার পায়ে শিকল, সুনীলের শিকল মনে!

সত্যই সে ভীরু! অস্পষ্ট বলিয়াই কপট, দুর্ব্বোধ বলিয়াই অক্ষম। তার এতদিনের অহঙ্কৃত আত্মপরিচয়ের তলে যে এতবড় ফাঁক ছিল তাহা টের পাইল সে আজ। [তীর ও তরঙ্গ, পৃ.২০৩]

মা মন্দাকিনীর আচরণে অভিমানাহত সুনীল রাগের মাথায় অণিমাকে কলকাতায় নিয়ে পড়ালেখা শেখানোর কথা বললেও পরিণামে সে গ্রামীণ সমাজবাস্তবতা এবং মায়ের ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করতে পারে নি। তার সাহস হয় নি, পরিবার এবং সমাজের চোখ রাঙানি অস্বীকার করার। অথচ, সেই গ্রামের সরলা প্রায় অশিক্ষিত মেয়ে অণিমা কিন্তু নিজের পায়ের দাঁড়ানোর সাহস নিয়ে সব ধরনের নিন্দা অগ্রাহ্য করে সুনীলে সাথে কলকাতায় যেতে চেয়েছে এবং সেটা সুনীলের আশ্বাসের প্রেক্ষিতেই। সুনীল যেদিন কলকাতা যাত্রা করবে, সেদিন সকালে সুনীলকে ডেকে পাঠায় অণিমা :

অণিমাদের ঘরে ঢুকিয়াই সুনীলের চক্ষু স্থির। এ কি কা-? অণিমা একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে তাহার জামা-কাপড় পুঁথিপত্র সব গুছাইয়া প্রস্তুত হইয়া আছে।

‘বাদলদা, আপনার সঙ্গে আমিও আজ কলকাতা যাচ্ছি।’

‘সে কি!’

‘আপনিই তো কাল নিয়ে যাবেন বলেছেন। আমি মেয়েদের বোডিং-এ থেকে পড়ব।’

কোথায় সেই রোরুদ্যমানা অসহায়া অণিমা। স্থির সহজ দৃষ্টি- দৃঢ় সঙ্কল্পের স্পষ্ট ছাপ মুখেচোখে। প্রশ্ন করে, ‘কী ভাবছেন?’

‘তা- হ্যাঁ- তবে, আগে থেকে-’

‘আমার পড়ার খরচ চালাতে না আপনি রাজি হয়েছেন। আমি চাকরি করে একদিন আপনার সব টাকা শোধ করে দেব বাদলদা। [...] আমার সর্ব্বনাশ করতে ওরা বাকি রাখে নি কিছু। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপিয়া গিয়া অণিমা গড়-গড় করিয়া বলিয়া যায়, ‘কাল রাত্তিরে মার সঙ্গে ভীষণ ঝগড়া হয়ে গেছে। আপনার সঙ্গে আমায় কিছুতেই যেতে দেবে না। তাতে নাকি জাত যাবে। নিন্দায় পৃথিবী রসাতলে যাবে। আমি কিন্তু যাবই।’ [তীর ও তরঙ্গ, পৃ.১৯৯]

অণিমা যখন সত্যিকার অর্থেই সুনীলের সাথে কলকাতায় যাবে বলে নিজের বাক্স গুছিয়ে তাকে সংবাদ দিয়েছে, তখন সুনীলের সম্বিৎ ফিরেছে যে, সে তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারবে না; তার অতটা সাহস নেই। অথচ ভালোবাসার অভিনয়টুকু সুনীল ভালোই করেছিল অণিমার সাথে। নিভৃত পল্লীবালা অণিমার সাহসের মূলে ছিল- সুনীলের সেই নড়বড়ে প্রণয়; যে প্রণয়কে সুনীল লোকনিন্দা ও পরিবারের আপত্তির মুখে অস্বীকার করতে চেয়েছে। পরিণামে, অণিমাকে গ্রামীণ সমাজের রূঢ়তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে, নিজে পালিয়েছে কলকাতার উদ্দেশে।

‘তীর ও তরঙ্গ’ উপন্যাসে সুনীলকে ঘিরে অণিমা এবং নমিতার একটা ঠাণ্ডা সংঘাতের প্রসঙ্গ থাকলেও নমিতা সর্বদাই ছিল ঘটনার আড়ালে অক্রিয় চরিত্র হিসেবে। বরং অণিমা সরকারই উপন্যাসে সক্রিয় চরিত্র হিসেবে সুনীলের মানসিক ঘাত-প্রতিঘাতকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে এবং সুনীল নিজেও প্রভাবিত হয়েছে; পরিণামে যদিও অণিমার পরিবর্তে নমিতারই জয় দেখিয়েছেন ঔপন্যাসিক। উপন্যাসের ঘটনায় অণিমাই কিন্তু রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে সুনীলকে বোঝার চেষ্টা করেছে, নিজের মনও দিতে চেয়েছে; কিন্তু পরিস্থিতি অণিমার অনুকূলে ছিল না। যৌবনের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে অণিমা যখন সুনীলের ভালোবাসার অতল তল খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেÑ সুনীলের বিধবা মা মন্দাকিনী সাক্ষাৎ রণমূর্তিতে। মন্দাকিনী চোখে আঙুল দিয়ে যেন অণিমাকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, তুমি এবং তোমার পরিবার দরিদ্র; তোমার কোনো অধিকার নেই আমার ছেলে সুনীলের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার। সুনীলের সাথে কোনোদিনই তোমার বিয়ে সম্ভব না। অথচ যেদিন সুনীল মায়ের জেদের নিকট হার মেনে কলকাতা শহরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সেদিনই সে মাকে জানিয়ে দেয় যে, সে কলকাতার নমিতা সেনকে ভালোবাসে, চাইলে হয়তো সে তাকেই বিয়ে করবে। শুধু মুখেই সুনীল তার ক্ষোভ প্রকাশ করে নি, বরং নমিতার চিঠিও মন্দাকিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। এর প্রমাণও পেয়েছে মন্দাকিনীÑ জাহাজ যখন বকুলতলার তীর ঘেঁষে কলকাতার উদ্দেশে ভেসে যাচ্ছিল, তখন ছেলের পাশে দীর্ঘদেহী শ্যামাঙ্গী এক তরুণীকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষও করেছে; তখন যেন মন্দাকিনীর সম্বিৎ ফিরেছে। লেখক মন্দাকিনীর এই মনোভাবের চমৎকার বিবরণও দিয়েছেন :

তবু এই রূঢ় কথাটা তিনি বুঝিয়াও বুঝিতে চান না যে! কেন ছেলে দূরের হইবে? কোথায় যাইবে সে? ...মন্দাকিনী তাহাকে এখানো ধরিয়া রাখিতে পারে। নিশ্চয়ই পারেন! বকুলতলার ছেলেকে বকুলতলায়ই বাঁধিতে পারেন। -অন্ততঃ পারিতেন। এ ক’দিন ভুল করিয়া আসিয়াছেন আগাগোড়া। ...আর মা নয়। অণিমা পারে- অণিমাই পারিত। ভুল- মস্ত বড় ভুল করিয়া বসিয়াছেন।... [তীর ও তরঙ্গ, পৃ.২০৭]

মায়ের উপর ক্ষোভ আর অভিমানে সুনীল কলকাতায় রওনা দেয়ার পর, মা মন্দাকিনী এ সত্য উপলব্ধি করেছে- স্টিমারে ছেলে পাশে দীর্ঘদেহী শ্যামাঙ্গী নমিতাকে দেখার পর। তখন মন্দাকিনীর মনে হয়েছে, সুদূর কলকাতা শহরের মেমের সাথে সুনীলের বিয়ে না হয়ে যদি অণিমার সাথে বিয়ে হতো, বরং সেই ভালো হতো- হোক না তারা গরিব। মন্দাকিনীর এ ভাবনা যে তখন কোনো পক্ষের জন্যই ফলদায়ক না, তা পাঠক জানে। কারণ, পাখি ততক্ষণে তো খাঁচা ছেড়ে সুদূর কলকাতায় রওনা হয়েছে। মা মন্দাকিনীর হাতে যখন ক্ষমতা ছিল, তখন সে অণিমাকে অবহেলা করেছে গরিব বলে অথবা তার গুরুত্ব সে উপলব্ধিই করতে চায় নি; যখন অণিমার অস্তিত্ব এবং গুরুত্ব মন্দাকিনী উপলব্ধি করেছে- তখন তার কিছু করার ক্ষমতা পরের কথা, ছেলের সাথে পুনরায় দেখা হবে কিনা, সেটাও সে নিশ্চিত নয়।

‘তীর ও তরঙ্গ’ উপন্যাসের পরিণামে সুনীলের কলকাতা যাত্রা, মা মন্দাকিনীর শংকা, তীরে দাঁড়িয়ে সুনীলের পাশে নমিতাকে দেখা, অণিমাকে ডেকে তখন মন্দাকিনীর আহাজারি প্রকাশের মধ্য দিয়ে কাহিনীর সমাপ্তি ঘটেছে। এ পরিণামে পাঠককে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সুযোগ দেয় না। বরং পাঠক ভিন্নতর সমস্যায় পতিত হয়। যেমন অণিমার কী হবে? সুনীলের সাথে কী নমিতার বিয়ে হবে? অথবা নমিতা সেন কী সত্যিই ভালোবাসবে সুনীলকে? সুনীলকে ভুলতে পারবে কী নিভৃত পল্লীর সরলা অণিমা কিংবা আবেগের মুহূর্তে সুনীল যে চুম্বন তাকে করেছিল- সেকথা সুনীল ভুলবে কী করে? এসব প্রশ্নের জটাজাল সামনে রেখেই উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে। এ ধরনের সমাপ্তি যে কোনো মহৎ উপন্যাসের ইঙ্গিতবাহী। কারণ, উপন্যাসে পরিণামে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে- সেখান থেকেই নতুন আরেক উপন্যাসের যাত্রা শুরু হতে পারে। ‘তীর ও তরঙ্গ’ উপন্যাসের সমাপ্তি মহৎ উপন্যাসের মতো হলেও এটিকে কোনোভাবেই মহৎ উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। এটি নিছক ত্রিভুজ প্রণয়কে কেন্দ্র করে এক কাহিনীনির্ভর সরল গল্পমাত্র। লেখকের নিকট এ রচনাটিকে মহৎ করে তুলবার মতো অনেক অনুষঙ্গ-প্রসঙ্গ থাকলেও সেগুলোকে তিনি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই বিবেচনায় বলা ভালো, ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য ‘তীর ও তরঙ্গ’ নামে একটি ব্যর্থ ত্রিভুজ প্রণয়োপন্যাস লিখেছেন, যা গতানুগতিক প্রচলিত ধারার বাইরের কিছু নয়, পরিণামে তা বিশেষ গুরুত্বেরও দাবিদার নয়।

গ্রন্থ পরিচয় : স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য্য, তীর ও তরঙ্গ, ১ম প্র, কলিকাতা : বরেন্দ্র লাইব্রেরী, ১৯৩৬।



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন