জলধি / পাঠ-পর্যালোচনা / মন ও শরীর, শরীর ও মন নয় শুধু আরো অনেক কিছুর গন্ধ শোঁকায়
Share:
মন ও শরীর, শরীর ও মন নয় শুধু আরো অনেক কিছুর গন্ধ শোঁকায়
শুরু গল্পটার শুরুতে প্রায় পৃষ্ঠাখানেক গল্পের ভূমিকা। যেটাকে লেখক কোথাও কোথাও গল্প শুরুর গল্প বলেছেন। তবে প্রায় গল্পেই এইরূপ দেখা যাবে। এর ফলাফল সুন্দর। গল্পটা যত গভীর পাঠক মন ততোটা গল্পে বুঁদ হতে পারে নিঃসন্দেহে। এবং এর ফলেই গল্পটা তুলনামূলক উত্তম বলে বিচার্য হয়। 
‘ইলিশ মাছের ঝোলের মত জোছনা রাতে জন্ম নেওয়া গল্প।’ যেন একটা আধ ময়লা আধ খালি আধ কুসুমে ঢাকা বিচূর্ণ মাঠে পদব্রজে পা ডুবালাম। এত সম্মুখ ও জীবন্ত গল্প যে তার আকর গাইতেও আমাকে শব্দের মোহে পড়তে হচ্ছে। আমি হাঁ হয়ে শব্দের ভেতর পা চুবিয়ে তবেই নিস্তার পেলাম। যেন জংধরা এক গল্পের সূত্রপাত হলো। যেখানে আছে ইলিশ মাছের ঝোল ঝোল জোছনা। আছে মেলাবরন রুপোলি কাঠগোলাপ আর রক্তিম বিভাজন। 
এভাবে গল্পের চলন বলন বড় মোহাবিষ্ট ভাবে পাঠককে নিয়ে দৌড়ে চলেছে, একদম ক্লান্তিহীন দৌড়। দৌড় বললাম কারণ সীমাহীন গল্পের তোড়জোড়ে আমরা দৌড়টুকুই খুঁজে ফিরি অথচ কোনো রকম হেঁটে চলা ঢিমে তালে ছেঁচড়ানো গল্প পাওয়া গেলেও খুব জোড়ালো দৌড়ে অভ‍্যস্ত গল্পের বড়ই সঙ্কট। 
এরপর যে গল্পটা
‘মৃত মানুষের হাসি।’
যেন শহরের বুদবুদ আর বুদবুদ শহরের শব্দরাশি। এক লহমা তাকত নেই আমার। এ বড় জটিল ছিল জীবনে।
নিরিবিলি এক রাতে, হুল্লোড় বিহীন আবেশ, ঝিম ঝিম চারপাশ, হৈচৈ ডাকাডাকি নেই কোথাও, রাত দেড়টা তখন, পড়ে উঠলাম গল্পটা
কি অদ্ভুত আবেশ জড়ানো, লা জওয়াব, ভাষা ও শব্দে তা ব্যক্ত বড়ই অসম্ভব।
তারচেয়ে গল্পের কথা গল্পেই সুন্দর, এখানে বাড়ন্ত সে আলাপ বরং বেখাপ্পা, থাকুক, আমরা বরং অগ্রসর হই চলুন।
তারপর রোজার ক্লান্তি নিয়ে পড়লাম ‘পোশাক ও শরীর’
ফেসবুকে লিখলাম এভাবে, 
‘পোশাক ও শরীর’ আয়তনগত চার পৃষ্ঠা, তৃপ্তিতে যেন হাজার পৃষ্ঠার সমান। রোজার ক্লান্তি এমনিতেই ফুরিয়ে আসার মুহূর্তে লাগে বেশি। তারওপর এমন তৃপ্তি ক্লান্তিকে আরো ঘনীভূত করে বৈকি।
(বেলাটা শঙ্খ বিদায় লগ্ন ছিল বলে বাড়িয়ে যোগ করলাম)
শঙ্খ ঘোষের বিদায় লগ্নে এ সময়ের একজন গল্পকারকে পড়ছি আর আনন্দ জানাচ্ছি দেখে কেউ আবার ব্যথিত হবেন না। কারো কারো হারানোর ব্যথাটা এত বিঁধে কিন্তু আমরা সেসব দুঃখ কতটা শব্দে আর বাঁধতে পারি! তারচেয়ে এই খানিকটা দুঃখ ভোলার বাহানা মাত্র।
এরপরের গল্পটা কান্না জড়ানো। জুমার অক্ত ঘনিয়ে আসার মুহূর্তে গল্পটা পড়া হয়, ফেসবুকে লিখে উঠি এরকম―
‘মন ও শরীরের গন্ধ’ শরীর ও মন না শুধু, যেন আরো অনেক কিছুর গন্ধ শোঁকায়। 
জুমার অক্ত ঘনিয়ে আসা গল্পের নাম ‘আমি মরলে যেন ভাত দিয়ে কবর দেওয়া হয়― মঙ্গাবতি।’
পরে এই গল্পের ভাবনাবৃত্তি দিয়েই পুরো লেখার হেডলাইন টানলাম। এখন ভাল লাগছে, তবে গল্পটা শক্ত, বড়ই জলাভরণ।
এভাবে একে একে গল্পগুলো পড়তে থাকলাম আর ফেসবুকে লিখতে থাকলাম―
যে গল্প পড়তে গিয়ে মাথাটা কয়েক ভাগে ভাগ করতে হয়েছিল। এবং বার কয়েক অন্য মনস্ক হওয়ায় দোহরাতে হয়েছিল এর অনেক ক’টা লাইন। এখনো মনে হয় হলো না, নাহ্। খুব দূরে। একদম নীরব শূন্য কোথাও, জন আওয়াজ বিহীন কোথাও গল্পটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া গেলে হতো। এখনো যেন অনেক কিছুই আধো আলো আধো ছায়া, অনেকটা ঝাঁপসা হয়ে আছে।
গল্পের নাম― ‘দোমুখো গল্প।’
‘পাগলপ্রবাহ।’ 
একটি পোড়খাওয়া গল্পের নাম।
দুনিয়ার ভেতর ও বাহির। যেখানে আটকে থাকে অনেক অনেক ছায়া উপছায়া, বিন্দু এবং পরমাণু। কিন্তু আলো নেই বাতাস নেই কেবল আলো ছায়ার লাল নীল উপদ্রব। আরেকটা পৃথিবী আলোময়। আলোর ভেতর দীপশিখা জলে নেভে। আলোহীন কখনো মোছে মূর্ছা যায়। জলাভরণ। জলমগ্ন। আরো আরো অনেক শব্দ অনেক কথা কইতে কইতে গল্প তার শুরুতেই যেন আটকে যায় যেখান থেকে শুরু সেখানেই। একদম নেই কিছু কেবল দুটো বালিহাঁস পাখা ঝাপটানোর মত নরম বিকেলের গায় লেগে থাকে হাওয়ার মত দুর্বাঘাস। বইয়ের সপ্তম গল্পটা শেষ করতে পারলাম। গল্পের নাম ‘একরাতের প্রাণনাশা গান।’
ধীমান একটা অবয়ব। চলছে ফিরছে। হাসছে। মেঘ দেখছে। নিভে নিভে যাচ্ছে। সত্যিই একদম নিভেই গেল। গল্পটার ভেতর হাজার ক'টা গল্পের উপদ্রব এত হুল্লোড় এত হাহাকার মেখে চলে গেল যার অস্পৃশ্য যাতায়াত দেখলে নিজেকে চোরলোকটার ভাই বলে মনে হয়।
গল্প শেষ হয়ে গেলে দেখি সত্যিই কি যেন হা করে হাহাকার মেখে যাচ্ছে পুরোটা শরীর পুরোটা অবয়ব পুরোটা দস্তুর জীবনের মুখে। যেখানে আলো তার মতো মুছে যায়, জোছনা নিভে যেতে চাইলে তাকে আর ফেরানো যায় না কোনো ভাবেই। এ যেন অন্যলোকের এক দীর্ঘ যাত্রা।
মন ও শরীরের অষ্টম গল্পের নাম ‘চোর’
‘খুনি স্বপন’ হচ্ছে আত্মহত্যার মত করে অনেক ক'টা হত্যা বা আত্ম হত্যার নাম। অথবা পুরোটাই স্বপ্ন। অথবা স্বপ্নের মত অনেক কিছু। স্বপ্নটা যতক্ষণ ততক্ষণ এর প্রাচুর্য যেন স্তব্ধ করে করে হাতড়ে ফেরে। স্বপ্নের বাইরে গেলে কেবল একটা আত্মহত্যার মত কিছু গড়িয়ে যায়, রক্ত বা অন্য কিছুর ছাপ নিয়ে। যেখানে ছায়ারা খেলা করে আপন মনে। কেবল স্বপ্নটা একলা হয়ে পড়ে থাকে।
দুটো মানুষ কখনো একটার মত লাগে। কখনো নদী, জল, মেঘ, আসমান-জমিন, ভিন্ন না হয়ে এক মনে হতে থাকে। তাবৎ পৃথিবীটাই ঘোর। আর সমস্ত ঘোরগ্রস্ত অন্ধকারের নাম মায়া। মায়ার ভেতর অনেক ক'টা ছায়া দিনমান হেসে খেলে বিদ্রুপ করে, কেবল এক হয়ে যাওয়ার ভেতর জগৎটা কেমন ক্লান্ত দেখায়। এক অজ্ঞাত নম্রতার সাথে আমরা হুল্লোড় করতে করতে খেই হারিয়ে ফেলি যখন, তখন জানতে পারি পৃথিবী আরেকটা গল্পের দেখা পেয়েছে যার নাম ‘সময়মাছ’
এরপর পড়ে উঠলাম ‘পাপপোকা’
বইয়ের এগারোতম গল্প
অপরাধের ভাষা বড় জোড়ালো। কখনো তা পিছু ছাড়ে না। হয়তো কাল ক্রিয়াকাল অথবা আরও কিছুটা ক্লান্তি ছাপিয়ে যায় মুহুর্মুহু। অথবা বিবশ অন্ধকার মূর্ছা যায়। বা আমরা ভাবি এর ভেতর একটা যাপন আমরা আনন্দে পার করে দেবো। সত্যিই। ঘোরের ভেতর স্বপ্নের ভেতর আমরা তা কাটিয়ে দিই বা দিতে চাই। কিন্তু অনুতপ্ত দেহ মন আর কিছুটা স্বপ্ন স্বপ্ন ছায়া ঠিকই পেছন পেছন হেলে দুলে চলে আসছে!...
গল্পটা পড়ার সময় যেন নিজেই একটা গল্পের অবয়ব হয়ে উঠেছিলাম। মনে হলো হাঁ আছে নুজাতা নামের কেউ ঠিক পাশেই। একটা হলুদ ফড়িংও দেখলাম যেন আচমকা, আবার মিলিয়েও গেল ছাই ভস্মের মতো। কয়েকটা লেবু পাতা একসঙ্গে কচলানোর মত একটা আওয়াজ আর নিম্নস্তরের কিছু আঠালো ভাব ও রবরব একটা ঘ্রাণ পেতে থাকলে মনে হলো গল্পটা ফুরিয়ে গেছে। এবার বের হওয়া উচিত। নিজেকে তারপর জাগালাম এবং গল্পের শরীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বইয়ের পাতার মত নিজেকে খানিক ওল্টালাম। দেখছি হাঁ সব মিথ্যা নয়। তবে কিছু কিছু কেমন যেন ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার মত করে হাসছে একলা আমার দিকে তাকিয়েই।
‘বাতাসকবর’ নামের গল্পটা বই সমাপ্তির আগের গল্প। দুনিয়ার আরেক নাম পাগলখানা রাখলে কেমন হয়! এই কথার স্বরেও হয়তো পাগলের প্রলাপ ভাববেন কেউ কেউ। কিন্তু অনস্বীকার্য সত্য হলো যতসব ভাবলেশহীন সত্য তার ভেতর অস্ফুট এক পাগলামো যে গুমোট বেঁধে রয়ে গেছে তা বলাই বারণ। ধরা যাক চাকুরীর জন্য ওয়ে লাগবে। সর্বোত্তম ওয়ে হলো পয়সা। অথবা সজনরোল। এখন এই পয়সার অংকটা কত! ভাবুন। এই ভাবনার ভেতর হয়তো আপনি কিংবা আপনাকেই পাগল ঠাওড়ানো হবে। অগত্যা এই পাগলামিটুকু বা পাগল সাব্যস্ত হওয়া ব্যাপারটা মেনে নিয়েও আপনি স্বাচ্ছন্দবোধ করবেন। ভাববেন অবশেষে চাকুরী! সমস্ত ক্রিয়াকলাপেই দুনিয়াটা এখন পাগল হয়ে গেছে। হয়তো সেই পাগলামি আমরা বুঝি অথবা নিজেরাই পাগল হয়ে গিয়ে পাগলামিকে ভাবি সুস্থ। তবে সুস্থ বলতে দুনিয়ায় এখন আর বাকি নেই কিছু। ভাবা যাবে এই গল্পের থ্রোতে এমনই  অভ‍্যস্ত অনভ‍্যস্ত অনেক পাগলামি অনেক ক্রিয়াকলাপের কথা।
গল্পের ভেতর গল্প লেপ্টে আছে, এবং অনেক গল্পের সমন্বয়ে এই গল্পের নাম হয়েছে― ‘পাগলাগল্প’
এই করে গল্প সমাপ্তির পর বোধ হলো―
আনিফ রুবেদ পড়তে পড়তে পাঠক সবচেয়ে চমকাবে দুটি বিষয়ে। এক তার অদ্ভুত প্লট। এমনসব প্লট নিয়ে লেখক কাজ করেছেন যা হয়তো কারো ভাবনাতেও আসবে না। আবার ভাবনা এলেও আনিফের মত এত চাঞ্চল্য এত বিস্তর এত ব্যাপক রীতি ও প্রাচুর্যে যেই দোলাচল তা আসবে না আসা সম্ভব না। সম্ভব হলেও নিতান্ত কোনো লেখক বা গল্পকারের পক্ষেই তা সম্ভব। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তা হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে তার ভাষার টোন পরিমাপ পরিমার্জন পরিব্যপ্তি ইত্যাকার যাবতীয় বিষয়ে তিনি এত সরল এত আনকমন যা লা জওয়াব করার মত। আগে বুঁদ হোন নিজেই টের পাবেন।
তেরোটা গল্পের সমন্বয়ক এই পুস্তক বড়ই ‘দিলচাস্প।’
লাগাতার পড়লে হয়তো ফুরোতে সময় লাগবে না। কিন্তু একেকটা গল্প নিজস্ব শক্তিমত্তায় ঠিকই বলে যাবে নিজের দৃঢ় সেই অবয়বের কথা। যা হয়তো এই জন্মে আর কোথাও এরূপে দেখা দেবে না। 
বইটি ২০১২ জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়।


অলংকরণঃ তাইফ আদনান