জলধি / পাঠ-পর্যালোচনা / জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা― হাইতোলা এক সন্ধ্যার অগণন যাত্রা।
Share:
জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা― হাইতোলা এক সন্ধ্যার অগণন যাত্রা।
(শিল্পের গন্ডি এত বিস্তৃত তথাপি সবাই তো আর সমান শিল্পী না। কেউ বড় শিল্পী কেউ তুলনামূলক ছোট। এইসব বিচার হয় তাদের শিল্প চর্চার ভিত্তিতে। কেউ কেবল গল্পকার কেউ আবার কবিমাত্র। তবে একজন আবার সবক্ষেত্রেই বিচরণ কল্পে সব্যসাচী হয়ে ওঠেন আবার সাহিত্যের সব মাকামে বিচরণ সত্ত্বেও অনেককে সব্যসাচী বলা হয় না। নাহিদা আশরাফি কবি হিশেবে বেশ সমাদৃত। কিন্তু গল্পেও তার যেই অবস্থান সেটা এই বই থেকে টের পাওয়া সম্ভব। এর ভেতর দিয়ে শিল্পের যেই বিস্তৃত গন্ডি তাতে তার বিচরণ স্বার্থক ও অর্থবহ মনে হয়।)
গল্পে ফেরা যাক
――――――
১. সাদা বাস কালো গাড়ি―
গল্পের নামটা আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক, সরল সাদামাটা। তবে গল্পের সমাপ্তি এই সাদামাটা নামটার একটা যথার্থ মিনিং খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে। তখন এই সরল নামটাকেই মনে হবে কত শক্ত, কত জীবন্ত।
যদি নামটার স্পয়লার না করে একটা যুৎসই ব‍্যাখ্যা করি তবে এভাবে বলা যায় যে― দুটো রঙ একটি সাদা একটি কালো, এই রঙের ব্যবধান আমরা জানি কারণ দুটো রঙের দুটো অর্থ, যেমন লাল একটা ভয়ংকর রঙ, যার অর্থ সতর্কতা বা বেদনা, তদ্রুপ সাদা মানে সরলিকরণ, স্বাভাবিক আর কালো মানে দুঃখ-শোক।
তবে রঙ দুটো নির্দিষ্ট দুটো গাড়ির নামের সঙ্গে মিশে একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে মোড় নিয়েছে, তা বোঝার জন্য গল্পের শেষতক যাওয়া জরুরি।
নামের এবং গল্পের সমাপ্তির এই যুৎসই ও অর্থবহ কম্বিনেশন এই গল্পকে স্বার্থক এক গল্পের রূপ দিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। জাস্ট অসামান্য।
ভেতরের গল্পের বিশদে না গিয়ে একটা ধারালো বিষয় যা গল্পের থিম কানেক্টেড তাই এখানে সংক্ষিপ্ত অক্ষরে বলা যাক।
মানুষের ভেতরকার জনরা ভেদে পুরুষ নারীতে যেই ভিন্নতা। এখানে যাপন ও যন্ত্রণার অনেক বাহ্যত ও পরোক্ষ মেটাফর স্পষ্ট। পুরুষ মানুষ যেমন হরহামেশা চড়ে বেড়ায় নারীতে সেটা অসাধ্য অর্থাৎ এই অসাধ্য মূলত আমাদেরই দায়। এখন বোঝার বিষয় যেই পরিবারে নারীই আশ্রয় পরিবারটা জীবনের উপলব্ধিতে ঝুলে থাকার জন্য! তখন সেই নারী কি হেয়ালি ও তিতিক্ষার ব্যবধানে একটা সমাজে দাঁড়িয়ে নিজেকে পদে পদে মেলে ধরে মিশে যেতে যেতে নিজেকে নিঃশেষ করতে হয় এই গল্প মূলত তাই। তবে সব মানুষেরই নিঃশেষ হওয়ার একটা স্তর থাকে, সে শেষ স্তর পর্যন্ত একটা নূন্যতম আশা ও বোধ নিয়ে বাঁচে, বাঁচতে চায়। কিন্তু এই শেষ হওয়ার পূর্বেই যদি কারো শুদ্ধ যাপনের ইচ্ছেটুকু, অবকাশটুকু এক্সপেক্টেশনটুকু মিইয়ে যায় তখন জীবন্ত মৃত মানুষ হয়ে সে বাঁচে, যেই বাঁচা আদতে বাঁচা নয় মৃত্যুর আরেক রূপ, যেখানে মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর সমস্ত উপভোগ্য অর্জিত হয় কিন্তু মরণ আর আক্ষরিক অর্থে ধরা দেয় না, ধুঁকে ধুঁকে মরা আরকি। এ এক অসামান্য গল্প।
২. বৃষ্টি ও শাড়ির গল্প―
গল্পের যে কত রঙ, কত রূপ এখানে ধরা দিয়েছে। থিম বিচার করলে খুবই সাদামাটা থিমের গল্প বাট যাপিত জীবনের অনাহুত অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত অনেক গল্পের সাক্ষী হই আমরা, এখানেও তেমনই চিয়ারত জীবনেরই কিছু গল্প বিচ্ছিন্ন ও খন্ড খন্ড হয়ে জমে উঠেছে একসঙ্গে।
শুরুতে গল্পের রঙটা প্রেমের লাগবে। প্রেমকে ছাড়িয়ে গল্পটা জীবনের একটা বাস্তব রূপে মোড় নেবে। যেখানে গল্পকারের ব্যবচ্ছেদ ও অক্ষর যাচনায় লাগবে যেন সাক্ষাৎ হুমায়ুন আহমেদের মিসির আলী হাজির হয়েছেন। যেমন মিসির আলী কাওকে দেখলে তাকে নিজের মত কল্পনা করতে চান, ভবিষ্যৎ ও অতীতে তার একটা প্রতিমূর্তি বিশ্লেষণ করেন অনায়াসে সভাবত। এখানেও প্রতিটা ছত্রে লেখক যেন মুহূর্ত ও চরিত্র গুলোকে নিজের সেই মিসির আলীয় ভাবনা ও বিস্তারে বাঁধতে চেয়েছেন। বিচার করেছেন, বিশ্লেষণও ব‍্যাখ্যা করেছেন কল্পনা থেকে নিজের মত। কখনো সত্য হয়েছে কখনো বা অস্পষ্ট আবছা হয়েই গল্প হারিয়ে গেছে অন্য কোথাও।
তবে গল্পটা আমাদের সমাজ, আমাদের যাপিত জীবন কেন্দ্রিক। এখানে আমরা প্রতিনিয়ত মানুষের কাছেই প্রতারণার শিকার হই, হচ্ছি, ফলত শ্রেষ্ঠ জীব সত্ত্বেও মানুষের ওপর আজকাল আর নূন্যতম বিশ্বাস ও ভরসা টুকু বাকি নেই। কিন্তু এর ভেতরেও আমরা বিচার করে উঠতে যদিও বেগ পাই, ভাল মন্দের ব্যবধানে। যেহেতু গায়ে মন্দ ভাল লেখা থাকে না কারো। তবু চিরায়ত ভুলের ভেতর শুদ্ধ যেই গুটি কয়েক মানুষের দেখা পাই আমরা, যাঁদের আর সবার মতোই ভুল ভেবে ভুল করি একটা সময় ঠিক ঠিক তার শ্রেয়তার যেই ভুলটা আমাদের মধ্যে তার ওপর থেকে ঝাঁপসা অন্ধকারটুকু সরে গিয়ে প্রকৃত শুদ্ধতা ধরা দেয় তখন নিজের প্রতিই কিছুটা অনমনীয় ভাবের উদয় হয়, হাহ, কেন, আসলেই সব তো মন্দ না, ভালোও রয়েছে সত্যি, পৃথিবী এত বড় যে আমরা ভালোর সন্ধান করিও কম খুঁজে পাইও কম।
আমরা কেবল চিরায়ত বোধ, যন্ত্রণা, আতঙ্ক, এর ভেতরেই আটকে আছি, কুঁকড়ে যাই প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া উপায়ও যে নাই। কিন্তু এর ভেতরেও কিছু থাকে যা আদতে অমন না যেমনটা ভেবে আমরা ভুল করি, কুঁকড়ে থাকি, শেষমেশ ভাবি আপাত সমস্তই যদি হতো এই পরিচ্ছন্ন বোধের আস্ফালন, আমরা আর কুঁকড়ে যেতাম না, ভুল করে শুদ্ধকে জাজ করতাম না অপাঙতেয় বলে।
৩. তালেব বুড়ার বিজয় দর্শন―
সামাজিক গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, জীবন বোধের গল্প, নীতি নৈতিকতার গল্প। এক গল্পের এত বিশেষণ ভাবলেই হা হয়ে যেতে হয়। মানে এই বিশেষণ লেখকের দেয়া না, পাঠক আপনাতেই এইসব জুড়ে দিতে চাইবেন পাঠান্তে। দারুণ এই গল্পের ছত্রে ছত্রে কখনো মুক্তিযুদ্ধ কখনো নীতি নৈতিকতা কখনো বা সমাজ ও জীবন বোধের ভাবনা সঞ্চার করবে।
দেশের জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন যখন দেখেন তাদের ই ঔরসজাত কারো হাতে এই অক্ষুন্ন বিজয় ও সজীবতা হার মেনে পদদলিত হচ্ছে নিতান্ত দুর্ভোগ দুর্নীতির যাঁতাকলে তখন দুঃখই হয় ঢের। ভাষাহীন দুঃখবোধ এটা।
আমরা যাপিত জীবনে আমাদের সমাজপতি বা রাষ্ট্রপতি বা এহেন ক্ষমতাসীন বলে যাঁদের জানি, বা যারা আমাদের এইসবের রক্ষক, মূলত ভেতরে তারা রক্ষক কতটা নাকি ভক্ষক তার চেয়ে বেশি সেই প্রশ্ন ব্যক্তি মাত্রই অবহিত। এবং এই খমতাধারী রক্ষকের একটা শ্রেণী যারা নিরাপত্তাকর্মী, যারা দেশ ও জাতির নিরাপত্তার দায়ভার নিয়েছেন, আদতে তারা সেই দায়িত্ব কতটা পূরণ করেন, নাকি ভেতরে ভেতরে এই দায়িত্বের নামে ক্ষমতার নামে নিজের উদরপূর্তিতে ব্যস্ত সে প্রশ্নও বাকি থেকে যায়। নতুন করে বলার নেই কিছুই।
এতক্ষনে বোধকরি আবছা করে গল্পের যাতায়াত সংক্রান্ত একটা প্যাটার্ন আপনার মনে জায়গা করতে পেরেছে। আমার উদ্দেশ্যও আবছা আইকন। পরিষ্কার আইকন একেবারে বইয়ে না ডুবলে অনুচিত বলা।
তবু আরেকটু ভেঙেই বলি নাহয়...
পথে পথে চিরায়ত যাপনে দেখি, ‘পুলিশকে বন্ধু ভাবুন’ স্লোগান। স্লোগানধারী গাছটার নীচেই যখন দেখি কোন একজন নিরাপত্তা কর্মী সজোরে চপেটাঘাত করছে কোনো দুস্থ অসহায় নিরণ্ময় রিকশা বা ভ‍্যান চালককে। হয়তো গায়ের জোরে ধাক্কাই দিয়ে বসছে কখনো, বা কোনো রিকশা ভ‍্যানকে উল্টেই দিল, যা হবার হোক। অথবা মোটা অংকের জন্য হাত বাড়াল নির্লজ্জের মত বা গাড়ি আটকে দিল, কি আর আছে করার, নেবেই তো, বড় ছোট যাই দিক, নেয়ার বিকল্প নেই। আমাদের সময়ে একটা কথা শুনেছিলাম শিক্ষকদের কাছে, ঘুসের এইযে তোড়জোড়, একবার এমন দশা হলো যে স্বভাবটা এত নিচে নামলো, এক পুলিশ বলে বসলো পয়সা দে যা আছে। লোকটা বললো স্যার টাকা নাই আসলেই, বাজার করে সব টাকা শেষ, পুলিশ― তাইলে এখন, আচ্ছা পিঠটা একটু চুলকে দিয়ে যা অন্তত!
তো শুরু হয় সামান্য অপরাধে। আপাত দৃষ্টিতে সেটা হয়তো তখন কোনো অপরাধ বলেই বোধ হয় না। কিন্তু এই যে যাত্রা। পর্যায়ক্রমে এর ধারাটা আদৌ কি থামে কোথাও? নিষ্ঠুরতার কোনো সীমা নেই যে।
এবং এইসব অমানসিক ও অমানবিক কার্যকলাপ দেখে কেবল মনে ভাবনা আসে, এরা আসলে মানুষ না ভিন্ন কিছু, এদের কি কোনো স্বজন নেই, ভাই বন্ধু, আত্মীয় কেউ নেই! তারা কি এইসব শেখায়, নাকি নূন্যতম মনুষ্যবোধের দীক্ষাটাও পায় নি এরা!
প্রশ্নটা মূলত এখানেই।
হয়তো পরিবার জানেই না তার এই অবস্থান। হয়তো জানেই না তার ক্রিয়াকলাপের কিঞ্চিৎ। হয়তো তারা ভেবে বসে আছে আহা ও তো আমার সন্তান, আমি দেশের জন্য দশের জন্য করেছি, ও কি এর উল্টোটা করতে পারে!...
৪.পার্সেল―
নিখাঁদ কোনো প্রেমের গল্প। যেখানে শরীর না রূপ না কেবলই মন থাকে মনের জন্য অধির। হয়তো প্রথম প্রেম অথবা না। বাট যে প্রেম সত্যিকার অর্থেই দুটো প্রাণ এক দেহের মতো। দীর্ঘ এক জীবনের শুরু লগ্নের যেই স্পর্শ ও নিজস্ব চেনা পরিচয়ের বোলচাল, তার সূত্রে জীবনের আরেক মাত্রায় যখন আগের সব ধুয়ে মুছে মিশে গেছে অন্য কোথাও, বাট সামান্য কোনো এক স্মৃতির বা নির্দিষ্ট কোনো বোলচালের সূত্রে প্রেমকে সেই আগের রূপে জীবন্ত করে তোলে এক মুহূর্তে। যেন আগের সব ঠিক এখনের সব আবছা আবছা। মিথ্যে। যাকিছু হয়তো বিড়ম্বনা বা ভিন্ন কোনো হেতুতে ভুলে থাকতে চায় কেউ, বাট আদতে তা ভুলে থাকা গেলেও আজন্ম ভুলে যাওয়া অসম্ভব। তার একটা জলজলে স্বাক্ষর এই গল্প।
৫.মেয়েটি ও একটি অসম্পাদিত গল্প―
ছোট গল্পের যেই আকার প্রকারের নমুনা হওয়া দরকার এই গল্প বোধয় তার আক্ষরিক জায়গাটাই ধরতে পেরেছে। একটা সক্ষম ও সমুন্নত গল্প বলা যায় অনায়াসে একে। গল্পের ভেতরের বিস্তার যদি আলাপে বিস্তৃতি পায় তবে গল্প পড়ার আরাম ও আনন্দ কিছুই বাকি থাকবে না। এটুকু মাথায় রেখেই কেবল ভেতরের একটা সমূহ আচড় এখানে রেখে যেতে চাই।
গল্পের যেই চিত্রায়ন বিশেষত তুলনামূলক অভিব্যক্তি ও বিশেষণ, শব্দের বা ইমাজিনেশনের আবির্ভাব যা এখানে তা দেখার মতো। যেমন গল্প থেকে যদি আংশিক তুলে দিই― ‘তরুণী সন্ধ্যার আমেজ মেখে দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র সরোবর। এখান থেকে যে রাস্তাটা পাঁচ নাম্বার অবধি বুক পেতে দিয়েছে এবং সেই রাস্তার গায়ে মাস্তানি করা যুবকের মতন ধাক্কা দিয়ে যে লেকটা চলে গেছে’... এমনসব অভিনব আয়োজনে গল্পের সূচনা। প্রধানত ছোট গল্পের শুরুটা এমন আচ্ছন্নকর আমেজে হওয়া সুন্দর। শুরুটা আচ্ছন্নে না কাটলে ভেতরে প্রবেশ দুরূহ। তারওপর ছোট গল্পের অবয়ব যেহেতু অনেকটা দীর্ঘ নয় ফলত খুব স্লোমোশন যেটা উপন্যাসের মেটাফর সেটা গল্পের আখ্যানে যুৎসই নয়। এসব বিচারে আনুসাঙ্গিক গল্পটা স্বার্থক। ভেতরের প্লট হিসেবেও এই গল্পের যেই প্রভাব ও আবেদন জাস্ট হিম করে রেখে দেয়ার মত। সহজ শব্দে বললে― সমাজের কিছু চিত্র চরিত্র যা একপেশে একচেটিয়া ভালোর আবরণে আবদ্ধ বাট ভেতরে জঞ্জাল বেশি। কিন্তু এমনসব ভালোর খোলস আমরাই মূলত তৈরিতে সাহায্য করি। তবে কখনো কোনো ভিন্ন মাত্রায় সেসব খোলস অবদমিত ভাবে খসে পড়ে। তাও আমাদের মত রক্ত মাংসের চরিত্রের হাতেই। বাট এখানে বলা ভাল এটা খুবই তাত্বিক ও সন্দেহজনক। কারণ আমরা মানুষ মাত্রই স্বার্থ ও অনৈতিকতার আশ্রয়ে ভুগি। ফলত ভালোটা নিজের সক্ষমতাতেও জাহির হয় কম, ছিটকে যায় কেবল মন্দের দিকেই। এখানে সেইসব ভালো কেমন করে এক অবদমিত আশ্রয়ে ভালো হয়েই ফুটে ওঠে। আর সমাজের চোখে ধুলো দেয়া এক শ্রেণী যারা এক খোলসে জড়িয়ে রাস্তা পার হতে হতে ভাবে দুনিয়া পার হয়ে গেলাম। বাট মানুষ না হোক হয়তো বন্ধুর মত মানুষ মানুষ খেলায় মানুষের উপায়েই কোনো বাড়তি শক্তির কাছে এই অন্যায় হেরে যায় তখন দেখতে ভাল লাগে। প্রকৃত অর্থে সত্যের জয় হয়, হয়তো একটু স্লোলি। তবে এখানে গল্পের যেই অন্যরকম মাত্রা তা কেবল গল্পের থিম কেন্দ্রিক না বরং গল্পের আয়োজন ও চরিত্র কেন্দ্রিক বেশি। এখানে এমন এক চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় যার আদতে অস্তিত্ব নেই এবং সে তার গল্পটাই মূলত সত্যাসত্য বলে যেতে চায়। মরা মানুষ তবু তারে নিয়ে অন্তত মিথ্যাচার না হোক। বলা হয় মরে গেলে মন্দ বকো না আর। যত মন্দই হোক। কিন্তু আমরা মরাকে নিয়েও বিজেদের সুবিধা কেন্দ্রিক আরো কত ফাঁদ পাতি হিসেব নেই। বোঝার ও শিক্ষার অনেক দ্বার এই এক গল্প থেকে বেরিয়ে আসে। দারুণ।
৬.ধারা বহমান―
এক দীর্ঘশ্বাসের গল্প আবার অনেকটা প্রেমের গল্প। তবে এখানে এত অল্প পরিসরে যাকিছুই লেপ্টে আছে সবটাই খুব খুব গভীর। জোড়ালো। প্রেমটা এক কথায় অপূর্ব। যেন এর রেশ পাঠ শেষে পাঠকের ভেতর এক অপরূপ সুরভী হয়ে লেগে থাকবে অনেক কাল। আর দীর্ঘশ্বাস বলতে আমার উদ্দেশ্য এই গল্পের মূল থিমটুকু। অর্থাৎ মধ্যবিত্তের যেই টানাপড়েন যেই হাল চালের সম্মুখীনতা সেইসব বড় তীক্ষ্ণ লফজে মিশে গেছে গল্পের আপাদমস্তক রূপায়নে। এক কথায় যে ফকির তার ইজ্জতের বালাই নেই। সে যখন তখন যার তার কাছে চাইতে পারে হাত পাততে পারে, সমস্যা হয় না, আত্মসম্মানবোধ জনিত কোনো বাঁধার কাছে হেরে যেতে হয় না। আর যারা ধনী তাদের হিসেব তো নেই-ই। কেবল দোটানা আর টালমাটাল জীবন সামলাতে গিয়ে হরেক কিস্সা আর হরেক রূপকল্পের মুখে পড়তে হয় মধ্যবিত্তের। না পারে কারো কাছে হাত পাততে― পাছে ইজ্জত যায়! আর না পারে আয়েশ করে সমস্ত আহ্লাদ পূরণ করতে। যেন চারপাশে জাজ্জল‍্যমান একটা রূপায়িত আবহাওয়া কেবল ধেয়ে আসছে তার ধাওয়া থেকে পরিত্রাণ এই জন্মে অসম্ভব। বড় শক্ত গল্প।
৭.জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদ―
যেসব কাজে মানুষের হাত নাই। স্রষ্টার একক স্বাধীনতা সেসবে মানুষের যেই আক্ষেপ হাহাকার তার একটা আলোকস্পর্শ এই গল্পে পাওয়া যাবে। এবং সাথে সাথে মানুষ কিংবা যেকেউ সবার কর্মেরই একটা নির্দিষ্ট অর্থ থাকে। অর্থহীন কাজেরও দূরদর্শী এক অর্থ থাকে। পাগলের পাগলামো আপাত দৃষ্টিতে যা অর্থহীন পাগলামো মাত্র বাট তাতেও তার মত অর্থ থাকে। তেমনই এই অনর্থ নাই হওয়ার একটা টার্ম এই গল্পের মুখ্য। আমরা দেখতে পাই জগৎ সংসারের হরেক রঙ রূপ আলাপ কলাপ ও যাবজ্জীবন। কেবল এই সবের রূঢ়তা ও দৃঢ়তার যেই বাহাস তার পেছনে আমরা পড়ি কম। বাহাস গুলো যে সত্যি অর্থের দিকেই ধাবমান যদি আমরা সে অর্থের আসল অংকটা ঠিক ঠিক ধরতে পারি তবেই তা বোঝা সম্ভব। একটা জীবনের এই হরহামেশা দৌড় আর হাহাকারের গল্প এই ছত্রাংশ।
৮.
অমল ধবল শিউলি খালা’র ভেতর একটা জলজ্যান্ত সমাজ দাঁড়িয়ে আছে কি শক্ত আর কি করুণ আচ্ছাদনে। ভয়ঙ্কর।
পৃথিবীতে কেবল মাত্র বাবা মাই সন্তানদের নিজের চেয়ে সমস্ত কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসেন, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা যাকে বলে। এবং সমস্ত জীবন নিজেদের ক্ষয় করেন কেবল সন্তানদের জন্য। অথচ সমাজ ও পরিস্থিতি আর নির্মম বাস্তবতা এত শক্ত যে এক সময় এই সন্তানরাই বাবা মাকে আর আশ্রয় প্রশ্রয় দিতে চায় না। সমাজে ও পরিবারে তারা যেন অনেকটা ‘বেশি’ হয়ে যান তখন। আরও সহজ এই দুনিয়া এখন। বিরক্তির শেষমেশ একটা অবস্থান থাকে। এখানে তাও নেই। কেউ সহজের জন্য বৃদ্ধাশ্রমের পথ দেখেন। কেউ আবার ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট নিয়ে মরে যান। এবং তবু তাদের শেষ যাত্রায় সন্তানদের প্রতি সেই নিঃস্বার্থ নির্দোষ অভিযোগহীন অবয়বটাই ধরা থাকে। যে সকল সন্তানরা মরণ কালেও বাবা মার এক পলক সাক্ষাতের সময় করে উঠতে পারে না। অনেকটা মরে গেলে এই বলে বলে আসে ‘শালার বুড়ো মরারও সময় পেল না।’ কি করুণ। তবু নির্বাক বাবা মায়ের সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। যেখানে আরোপ নেই অভিযোগ অনুযোগ অনুশোচনা কিচ্ছুটি নেই। কেবল ভালোবাসা আর ভালোবাসা। তবু যদি আমরা বুঝতাম।
৯.দ্বিতীয় ও শেষ চিঠি―
একটা অন্যরকম প্রেমের গল্প। গতানুগতিক না। একটা যুৎসই সুন্দর টুইস্ট আছে গল্পে। একদম হিম হয়ে যাওয়ার মতো। জাগতিক এ দুনিয়ায় সবই সম্ভব। এখানেও ঠিক তাই দেখা গেছে। তবে বাস্তব প্রেমের যে আসল নকল দুটো দিক রয়েছে এই গল্পে আসল দিকটাই ভারি হয়ে দেখা যাবে। কিছু গল্প থাকে থিম কিছুটা নরমাল ও গতানুগতিক লাগে কিন্তু গল্পের পরিণতিতে মনে হবে এত জোশ। যেন আর ভাষায় এর অনুভূতি ব্যক্ত করা যায় না। তবে শুরুটা কেমন ঝিমিয়ে চলেছে। এবং বলা ভাল গল্পের আকার কিছুটা দীর্ঘ হওয়ায় গল্পটা উপন্যাসের মতোই খানিকটা স্লোমোশন বাট গল্পের পরিণতি বেশ স্বার্থক মনে হয়েছে আমার। এবং মনে হয়েছে গড়পড়তা প্রেমের গল্প না হয়ে কিছুটা অদ্ভুত সুন্দর এমন প্রেম যদি নিতান্ত গল্পেও দেখা মেলে তবে মন্দ কি!
১০.আলো-কথা―
মানুষে মানুষে যেই ভেদাভেদ সেসব তো মানুষেরই তৈরি। কেউ হয়তো ধনী কেউ বা গরিব। বাট ধনী অপেক্ষা গরিব মানুষ হিসেবে উত্তম মানুষ। কিন্তু আমরা বরাবরই আমাদের আশপাশের গরিব মানুষদেরও নূন্যতম মানুষ ভাবতে চাই না। তাদের খানিকটা সজ্জন আশ্রয় প্রশ্রয় দিই না। দিতে চাই না। অথচ কোরআন কেতাব আল্লা রাসূলের শিক্ষা তো তাই। মানুষে মানুষে নেই ভেদাভেদ। তাই তো নামাজে গরিব ধনী এক কাতারে দাঁড়াতে হয়। কাঁধে কাঁধ মেলাতে হয়। এই শিক্ষা রাসূলের সময় থেকে বাস্তবায়িত। কিন্তু এক শিক্ষার বাস্তবতা যে কতটা অবেহলিত বর্তমানেও তা আমরা আমাদের আশপাশে নজর দিলেই টের পাবো। তবে হাঁ ব‍্যতিক্রমও যে নাই তা না। আছে এখনো সমাজে কিছু সত্যিকারের ভাল মানুষ। গল্পটা তাদের নিয়েই। এবং সবচেয়ে বড় কথা যখন একজন মানুষকে তার পোশাকে তার অবয়বে তার শ্রেণী ইত্যাদি উপেক্ষা মানুষ হিশেবে গণ্য করা হয় মূলে তখন তারা কতটা আদরে কতটা আনন্দে কতটা মানবিকতায় নিজেদের ভাবতে বোধ করতে পারেন ভাষাহীন সুন্দর, দেখার মত।
১১.হাওলাদার সাহেবের বিশ টাকা―
একটা সুন্দর গল্প। গল্পের এন্ডিং গল্পের যাবজ্জীবন ম্যাড়মেড়ে ভাব কাটিয়ে একটা নির্মোহ আনন্দ দেবে নিশ্চিত।
পৃথীবিতে খোদার হরেক সৃষ্টি রয়েছে। রয়েছে প্রতি সৃষ্টির হরেক প্রজাতি। সেটা রঙ বর্ণ কার্যকলাপ রূপ কল্প মেজাজ সাকুল্যের বিচারে।
এখানে মানুষের ভিতর এমন কিছু বিশেষ কার্য স্বভাব পরিলক্ষিত হয় যাতে করে মানুষে মানুষে আলাদা হয়ে যায় বিশিষ্টতার গুণে। বলা হয় অমুক এমন তমুক অমন। ইত্যাদি। কারণ দুজন দু রকম। হয় মেজাজে নয় কার্যকলাপে নয় রূপ কল্পে। এখানে স্বভাবত ও কার্যকলাপ গত এক মানুষের গল্প আসছে যাতে সমাজের একটা নির্দিষ্ট প্লাটফর্ম দাঁড়িয়ে যায় অনায়াসে। আমরা আমাদের আশপাশে এমনতর অদ্ভুত চিন্তা স্বভাব ও আয়োজনের হরেক মানুষ হরেক প্রাণীর দেখা পাই এবং সত্যি বলতে এইসব বিশেষ কোনো দোষ গুণ বা স্বভাবের দরুণ সে হয়তো কখনো ভাল কিছুর মুখোমুখি কখনো আবার দায়ে পড়ে আবার বিপত্তিরও স্বীকার হয় নির্ঘাত। গল্পের সমাপ্তি ও টুইস্ট এবং এজাতীয় বিশেষ স্বভাব কার্যকলাপ ও পরিণতির গল্প হিসেবে এটা একটা দারুণ সময়ের স্বাক্ষর হয়ে থাকবে মনে মনে।
১২.বাবার চাদর―
মুলত হরর ফ্লেভারের গল্প। তবে এর শিক্ষাটা বড় সুন্দর। আবেদনটা বড় জোড়ালো। যারা প্রকৃত অর্থে ভাল মানুষ তাদের সাহায্য খোদা-ই করেন। সেটা যেকোনো উপায়ে। আর ভালোর পাল্লাটা সবসময় ভালোই থাকে। হয়তো আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায় না বোঝা যায় না তবে ভেতরে ভেতরে ভালোটাই সমুজ্জ্বল সুন্দর, চির ভাস্মর। কেউ হয়তো বিপদের মুখোমুখি, দেখা গেল খোদার বিশেষ কৃপায় এমন সাহায্য তার নসীব হলো যেটা মনুষ্য শক্তির উর্ধের। গল্পটা তা-ই।
১৩.ডায়রি―
মানুষ কখনোই চায় না এমন পরিণতি কিন্তু প্রকৃতি সমাজ ও পরিবারের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু কার্যকলাপ বা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি কেন্দ্রিক এমনই অযাচিত কিছুর উদ্ভব ঘটে জীবনটা যার জন্য এক নিমিষেই থেমে যায়।
একটা প্রেমের গল্প। তবে শুভ পরিণয় এখানে দেখা যাবে না। দেখা যাবে একটা স্বকরুণ ও মর্মাহত দৃশ্যের অবতারণা।
এর ব্যবচ্ছেদ এর বিশ্লেষণ অনেক দিকপাল নিয়ে অনেক ডালপালা নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় যদিও কিন্তু অক্ষর শূন্যতা বা বলা ভাল ভাবের যেই মহিমা এখানে গল্পের বিরূপ ও শক্ত আমেজ সেসব কেমন থমকে দিল একেবারেই। আর এগুনো গেল না। আহা কি দুর্ভাগ্য, কি অযাচিত অসংলগ্ন ও অসহনীয় নিয়তি।
১৪.নিরংশু দুপুরে ফোটা আলোমুখী ফুল―
মুক্তিযুদ্ধের কিছুটা অবয়ব মূর্ত হয়েছে গল্পের ছত্রে। তাতে পরিষ্কার সেই হায়েনাদের কথা তাদের অযাচিত ক্রিয়াকলাপের কিছু নমুনা দেখা যাবে।
তবে মূল যেই থিমটা গল্পের আসল জায়গা তা হচ্ছে।
সমাজে নারী পুরুষের এই হেয়ালি অবাধ বিচরণ আর হেন তেন চলন বলনে এইযে কত কত সন্তানের আবির্ভাব। যারা দুনিয়াটা দেখছে ঠিক কিন্তু তাদের বাস্তবতা পৃথিবীতে বড় ভঙ্গুর। যাদের বাবা মায়ের নাই ঠিকঠিকানা তাদের তো সমাজে কোনো দাম নাই। মানুষ বলেই মনে করা হয় না। অথচ দোষটা কার এখানে। একটা ফুটফুটে সন্তান। এই জন্মে ওর কি হাত আছে! কিন্তু এইযে ধকল, এইযে যাপন, এইযে হেয়ালি একটা সমাজে বেড়ে ওঠা, পদে পদে দলিত মথিত হওয়া, যেন জন্মটাই ওদের এমন এক অভাবিত দাগ নিয়ে। এর বাইরে গিয়ে কি কেউ ভাবে কখনো। কেউ কি আদৌ মানুষ ঠাহর করে ওদের! মানুষের যেই চাওয়া পাওয়া যেই মর্যাদা এর কি আদৌ খানিকটা ওদের বেলায় ভাবা যায়! এমনই এক সাক্ষাৎ প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায় গল্পের জোড়ালো ভাবাবেগে।
নিরীক্ষণ
বিচারবোধ
পর্যবেক্ষন
দৃশ্যায়ন
বইয়ের প্রতিটি গল্পের মূল বৈশিষ্ট্য।
ত্রুটি বলতে বড় করে বললে এটুকুই বলা যায় যে, ছোট গল্প হিসেবে একেকটা প্লট খুবই দারুণ বাট ছোট গল্পের পরিসর গত যেই ক্লাইমেক্স, সাক্ষাৎ যেই মূর্ত স্থিরচিত্র, যেই আচমকা থামিয়ে দেয়া বা প্রভাবিত করা সেসব অপ্রস্তুত, ধীর ও স্লোলি লেগেছে খানিক।
আর গল্পের জন্য যেসব মাল মশলার দরকার হয়
এখানে তা যথেষ্টই মিলবে, কেবল মশলার ব্যবহারে যথাযথ জায়গা, পরিমাণ ও যুৎসই মানদন্ড কামনা করে।
এখানে সেসব শতভাগ উত্তীর্ণ বলা যায় না তবে উন্নতির তো শেষ নেই বড় মানুষদেরও নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সীমানা বাকি থাকে, এখানে লেখককে সেই দূরদৃষ্টি আর নিজেকে বর্তমান থেকে ছাড়িয়ে যাবার উৎকর্ষের প্রতি দৃষ্টিপাত করার আহবান করবো আমি।
জলধি থেকে প্রকাশিত গল্পকার নাহিদা আশরাফীর ' জাদুর ট্রাংক ও বিবর্ণ বিষাদেরা' গল্পগ্রন্থটির নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন।
মূল্য: ৩০০ টাকা


অলংকরণঃ তাইফ আদনান