জলধি / গল্প / স্বর্ণ পালকের ময়না
Share:
স্বর্ণ পালকের ময়না

বুঝলা মতিন মিঁয়া, এই চাইর দেওয়ালের মইধ্যি যাগো জিন্দেগী আটকাইয়া রইছে তাগো কুনো আপনজন নাইক্ক্যা; সব শালারাই ভুইল্ল্যা গেছে আমাগো। ন অইলে এই বেলফাইট্টা কাঠ হওনের গরমে এক গিলাস পানি পর্যন্ত কেউ আগাইয়া দিল না!- বৈশাখের তীব্র দাবদাহে হাঁসফাঁস করতে করতে জিহ্বার এক তৃতীয়াংশই বের হয়ে গেছে একশ আট নম্বর কয়েদী মাজু মিয়ার। তার মুখে এমন হাহাকার শুনতে শুনতে অভ্যস্ত তিনশ আটান্ন নম্বর সেলের কয়েদীরা। তবে যার উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো বলা সেই মতিন মিঁয়ার এসবে কোনো আগ্রহ নাই। জানালার ফাঁক গলে নীলাকাশের সীমানা ছাড়িয়ে যায় তার দৃষ্টি। আকাশের নীল ছেয়ে যায় তার চোখের মণি। যতদূর যায় শুধুই নীল; ও জানে নীলের কোনো অস্তিত্ব নেই আকাশের বুকে; সবই কালো, নিকষ কালো। দিনের আলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে বিভীষিকাময় অন্ধকার। সূর্য়ের ভূপাতিত রশ্মি বরাবর কারাগারের প্রাচীর ঘেঁষে উড়ে যায় কিছু ময়না। ওরা মুক্তির খোঁজে উড়ছে যেমনটি খোঁজে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী রুগ্ন যুবক, ধুঁকতে থাকা কোনো বৃদ্ধ সিংহ, খাঁচার ভিতর প্রহর গুনতে থাকা শালিক কিংবা মতিন মিঁয়া যে মুক্তির সমস্ত কপাট নিজ হাতে খিল দিয়ে পরম মুক্তির দিন গুনছে। পাখির অমন উদাস ওড়াউড়ি দেখে ফিসফিস করে জীবনানন্দ পড়ে,
-    মৃত্যুসাগর সরিয়ে শূণ্যে বেঁচে আছি, তোমায় ধন্যবাদ।
হে হেমন্ত, মাছি ফড়িং রোদেও ভিতর দেয়ালি পোকা উড়িয়ে দিয়ে তুমি
এ ওড়া যে আবছা ক্ষণিক, মানুষের সেই কথা ভাবিয়েছ।
মতিন মিয়ার ফিসফিসানি কেউ বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না কেন এত অদ্ভুত তার ব্যবহার। সুরুজ আলী হাতের তালুতে কিছুটা খৈনি ডলতে ডলতে কাছে এসে বসে। আঙলের চিপায় অধর টেনে মাঁড়ির ভাঁজে সযতনে খৈনি চালান দেয় যেন কোনো বনেদী বণিক পরম মমতায় সিঁন্দুকে রাখে দামী গহনা। সুরুজ আলীর কালচে হয়ে যাওয়া উটকো লালের দাঁতগুলো ঝিলিক দেয় যেমনটা মেঘনার বুকে সূর্যের আলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। থুতনীর নিচে শহরতলীর নাতিউচ্চ দালানের মতো ক্রমবর্ধমান শশ্ম্রুরাজিতে হাত বোলানো দেখে মতিন মিয়ার আরজুর কথা মনে পড়ে; এমন মমতায় একদিন আরজুর চুলে হাত বোলাতো সে। সুরুজ ফিক করে হেসে বলে, ‘মতি, তুই কী কস, কিচ্ছুই তো বুঝি না।’
মতিন হাসে। বাপের বয়েসী এই লোকটাই তারে মতি ডাকে আর ডাকতো আরজু। বাপের কথা মনে পড়তেই রাক্ষসের রুপ প্রকট হলো তার মনোজগতে; ঘৃণ্য ভয়ংকর বাপাক্ষস! শুধু মাংস খায় আর বিকট শব্দে উল্লাস করে। দাঁত বেয়ে রক্ত ঝরে, গাল বেয়ে রক্ত ঝরে, কাঁধ বেয়ে রক্ত ঝরে, বুক বেয়ে রক্ত ঝরে, পেট হয়ে লিঙ্গ বেয়ে রক্ত ঝরে; লিঙ্গ রক্তের স্বাদ পেয়ে উন্মত্ত হয়; পেখম তুলে নাচতে থাকে। নাচতে নাচতে হুংকার দেয়; হুংকারে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকা মেয়েটি ভয় পেয়ে বের হয়ে আসে। লিঙ্গ নাচতে থাকে, মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে যায়।
হুংকারের ঝংকারে ভয়ংকর হতে থাকে বাপাক্ষস; মেয়েটি পিছিয়ে যায় যেমন করে পিছিয়ে যায় অন্ধকারে কুসংষ্কারে জর্জিরিত হয়ে নষ্ট কোনো সমাজ, জাতি। যেমন করে পিছিয়ে যায় মুখোশ পরাদের নিরিহ ভালো মানুষটি। মেয়েটি পিছিয়ে যায়; পিছিয়ে যায়। একসময় পা জুড়ে নেমে আসে অবসাদ, শক্তিহীন হয়ে পড়ে মেয়েটি। প্রাণপনে চেষ্টা করে একটু পিছিয়ে যেতে; পিছিয়ে যেতে পারলেই যে মুক্তি। কিছু কিছু সময় পিছিয়ে পড়লে মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়। সবাই এগিয়ে যেতে চায় কিন্তু মেয়েটি পিছিয়ে পড়তে চায়, ভীষণ ভীষণ ভীষণভাবে পিছিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু সে পারে না। পিছনে তার পাহাড়সম দেওয়াল। শ্লথ হয়ে আসে পা। বুঝতে পারে নিয়তি সবাকে জিতিয়ে দেয় না। সেও হেরে যাবে; নিয়তির কাছে; সমাজের কাছে; সম্পর্কের কাছে; চোখের কাছে; দৃষ্টির কাছে; মুখের কাছে; বুলির কাছে। রাক্ষস এগিয়ে আসে; লিঙ্গ নাচতে থাকে। একসময় লিঙ্গ হারিয়ে যায় মেয়েটির যোণিপথ ঘুরে কৃষ্ণগহ্বরে। রাক্ষসের থাবায় উঠে আসে মেয়েটির সুঢৌল স্তনের মাংস, স্তনবৃন্তে আলতো কামড় দেয় বাপাক্ষস। রক্তের বদলে দুধের বন্যা বয়ে যায়। রক্তের বদলে দুধ ঝরে পড়ে; লাল লাল দুধ। দাঁত বেয়ে দুধ ঝরে, গাল বেয়ে দুধ ঝরে, কাঁধ বেয়ে দুধ ঝরে, বুক বেয়ে দুধ ঝরে, পেট হয়ে লিঙ্গ বেয়ে দুধ ঝরে; লিঙ্গ দুধের স্বাদ পেয়ে উন্মত্ত হয়; পেখম তুলে নাচতে থাকে। নাচতে নাচতে হুংকার দেয়; হুংকারে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকা মেয়েটি ভয় পেয়ে বের হয়ে আসে। লিঙ্গ নাচতে থাকে, মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে যায়। স্তনিত রাগ নিসৃত হয় বাপ নামক রাক্ষসের মুখে।
গলগল করে ঘামতে শুরু করে মতিন মিয়া। সুরুজ বুঝতে পারে; মতিনের অবস্থা ভালো নয়। ঘরের কোণায় থাকা মাটির কলসি থেকে পানি এনে মতিনের ঘাড়ে মুখে ছিটা দেয়। মতিন স্বাভাবিক হতে থাকে; চোখ দুটো জানলার ফাঁক গলে দূর নীলাকাশে হারিয়ে যায়। উড়তে থাকে ময়না। সূর্যের আলোয় ময়নার পালকগুলোয় সোনালী আভা ছেয়েছে। মতিন ফিসফিস করে বলে, ‘স্বর্ণ পালকের ময়না... স্বর্ণ পালকের ময়না... স্বর্ণ পালকের ময়না...’।
উঠে দাঁড়ায় মতিন। জানালার পাশে অন্যান্য কয়েদীদের ভিড়। এই কারাগারের একটা সুবিধা আছে; কারাগারের পাঁচতলা থেকে প্রাচীরের পাশের রাস্তা দৃশ্যমাণ। রাস্তার পাশের ভিড় করে কয়েদীদের আত্মীয় স্বজন। চিৎকার করে কথা বলে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে। দূরত্বটা এমন যে রাস্তা থেকে ছোঁড়া স্বরবাণ জেল ঘরের দেওয়াল ভেদ করতে পারে না। তবুও সবাই চিৎকার করে। সবাই যখন ক্ষ্যান্ত হয় মতিন মিয়া গিয়ে দাঁড়ায় জানলায়। আমানত শাহ্র দরগা স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। উঁচু মিনারের ওপর চাঁদের ফালি। সন্ধ্যার পর একধরনের সবুজাভ আলো ঘিরে ধরে চাঁদটাকে। মনে হয় হাজার হাজার জোনাক পোকা অক্লান্ত শ্রম দিয়ে চাঁদটাকে আলোকিত করে রাখে। মাঝে মাঝে আগরবাতির সুবাস এসে লাগে নাকে। মতিন মিয়া দুহাত ওপরে তোলে। মুখে কী যেন বিড়বিড় করে হাত দুটো মুখে মুছে নেয়। ঠোঁটের কোণে প্রশস্তির রেখা ফুটে ওঠে, মনে শান্তির ঢেউ জেগে ওঠে, চোখগুলো চকচক করে ওঠে; স্বর্ণ পালকের ময়নাগুলো ডানা ঝাপটে ওঠে; কারাগারের কার্ণিশে বসত গড়া কবুতরগুলো বাকবাকুম করে ওঠে; রাস্তার রিক্সাগুলো সমস্বরে ক্রিংক্রিং করে ওঠে বাকিসব নিরব হয়ে ওঠে।
মতিনের দুনিয়া সচল করে বাকি দুনিয়া অচল হয়ে পড়ে। মতিন দেখতে পায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরজু; পিছনে ইয়া বড় মোমবাতি ঝুলে আছে দোকানে। আরজুর হাত ধরে আছে রাহেলা। অস্বাভাবিক চঞ্চল তার চোখদুটো যেন খুব পরিচিত কোনো মুখ খুঁজে ফিরছে। বাপের দ্বিতীয়ঘরের মেয়ে রাহেলা। নিজের সন্তানও নয়। নতুন মা’র প্রথম ঘরের সন্তান। জন্ম থেকেই বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী। অথচ কী মায়া তার চোখে মুখে। বাপের বিশাল সম্পত্তি। প্রভাব-প্রতিপত্তি। মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয় মতিনের; মা’টা অকালে ছেড়ে গেল। আর ছেড়ে গেল বলেই আজ সে কারাবাসী। বিনাদোষে দোষী। আরজু অপলক তাকিয়ে আছে কি না বুঝতে পারে না সে। নাকি অন্যদের মতো সেও অচল দুনিয়ার মানুষ। চোখে মুখে করুণা ফুটে উঠছে মেয়েটার। কত স্বপ্নই না দেখেছিল দুজনে।
হাত নাড়ে মতিন। চোখ নেড়ে চেড়ে দেখে রাহেলা। অনড় থেকে যায় আরজু। রাহেলার জন্মদোষের ছুঁতোয় নতুন মা’কে ছেড়ে যায় তার পুরনো স্বামী। অবশ্য বিশ^াস হয়না মতিনের। মহিলার চরিত্র খুব একটা ভালো ঠেকেনি তার কাছে; এতটা বছর পার হয়ে গেলেও মা’র আসনে বসাতে পারেনি মহিলাকে। যতটুকুই কথা হতো অধিকাংশই ভাববাচ্যে। বাপের সাথে নতুন মা হয়ে ঘরে আসার পর থেকেই দেখেছে এবাড়ির জিনিস নতুন মায়ের বাপের বাড়িতে চালান দিতে। বাপকে বলেও খুব একটা লাভ হত না। শরীরে ভুলতো বুইড়া খাটাশের বাচ্চা। আজকাল নিজের বাপকে গালিগালাজ করলে মনে মনে সুখ অনুভব করে সে। দুঃখ শুধু ওই রাহেলার জন্য। সৎ বোন হলেও খুব মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিল মেয়েটার। নিজের যা আছে সবকিছুতেই অধিকার দিয়েছিল ছোট্ট বোনকে।
দূর থেকে চঞ্চল হয়ে ওঠা রাহেলা দিকে তাকায় মতিন। পাখিদের সাথে গান গাইছে রাহেলা; উড়ে যাওয়া প্রজাপতিরা একটু জিরিয়ে নেয় রাহেলার কাঁধে বসে। কুকুরগুলো লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে হেসে উঠছে রাহেলার সাথে সাথেই। রাহেলার মুখের ¯িœগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমিকার ঠোঁটে ঠোঁট লুকায় মদ্দা কবুতর। গলা ফুলিয়ে বাকবাকুম বাকবাকুম করে প্রদক্ষিণ করে প্রেয়ষীর চারপাশ। রাহেলার অন্তরে জাদু আছে। সবাই বুঝতে পারে অথচ বাপাক্ষসটা বুঝলো না।
সেদিন বর্ষার প্রথম বৃষ্টি ঝরেছিল। গাছে গাছে ছেয়ে আছে হলুদাভ সবুজ কদম। দূর থেকে মনে হবে হাজারটা সূর্য ঝুলে আছে গাছের আঁড়ালে। সেদিনের বৃষ্টিও ছিলো মায়াময়, মধুময়। যেন পৃথিবীর সব অশান্তি গিলে খাবে; সব অসুখ ধুয়ে মুছে নিয়ে আঁছড়ে ফেলবে কোনো এক নির্জন দ্বীপে। কথা ছিল এমনই কিছু হওয়ার। কদম রাহেলার ভীষণ পছন্দ। বাড়ির পিছে হিজল গাছেও ফুল ধরেছে, মিষ্টি সুগন্ধ আছে ফুলটায়। বৃষ্টি হলে টুপটুপ জল ঝরে পরে হিজলের লতা বেয়ে। জল গিয়ে পড়ে হিজলতলার নিচে পুষ্কনির শাপলা পাতায়। তার নিচে লুকিয়ে থাকা কানি সাপ তিড়তিড়িয়ে পালিয়ে যায়। পান কৌড়ি এগিয়ে চলে দ্রুত পায় যেন তার ওপর অভিকর্ষ শক্তির কোনো প্রভাব নেই। মতিন হাতে একগুচ্ছ কদম ফুল নিয়ে হিজল তলায় দাঁড়িয়ে দেখে একটা কৈ মাছ কানের ভরে ডাঙায় ওঠার চেষ্টা করছে। বৃষ্টি একটু ঝিমিয়ে আসলে হিজল ফুল ছিঁড়তে হবে। রাহেলা ভীষণ খুশি হবে।
হাতে কদম ফুল, পিঠে ঝোলানো হিজল লতা। ঢিপঢিপ পায়ে এগিয়ে যায়। দরজা ভিড়ানো। ভিতর থেকে খিল দেওয়া। কেমন যেন গোঙানোর শব্দ যেমনটা কোরবানির সময়ে গরুর মুখে হয়, বলির সময় পাঁঠার মুখে হয়; জীবনের শেষ আর্তি। কণ্ঠ বেশ পরিচিত তবে এইমুহূর্তে অচেনা। মা’র তো নয়; সকালে গেছে উপজেলা সদরে। সে জানে মা বাবাকে মিথ্যে বলেছে আসলে গেছে বাপের বাড়ি টাকা পাচার করতে; আজকাল সে অনেককিছুই বোঝে, মুখ খোলে না এই যা। সে জানে বোবার শত্রু নেই; মা তক্কে তক্কে থাকে, সুযোগ পেলেই তাকে ভিটেছাড়া করবে। আর একবার কামিয়াব হলেই মা হয়ে যাবে বাবার অঢেল সম্পত্তির এককছত্র মালিক। বাবা বুঝেও চুপ থাকে; যদিও বা কখনো কিছু বলে মা বাবার মুখে স্তন গুঁজে দেয়। বাপ শান্ত হয়। মুখে কুলুপ আঁটে। নতুন মা ছাড়াও অনেকেই বাপের শয্যাসঙ্গী আছে বলে বাজারে রটেছে। মতিন জানে যা রটে তার কিছু তো ঘটে। বাপ তার দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নয়।
মতিন ধীর পায় এগিয়ে যায়। চোখ রাখে দরজার ফুটোয়। উপরের উলঙ্গ দেহ দেখেই চেনা যায়। বাপ। কিন্তু নিচে কে? ঠাওর করে চায় মতিন। আঁতকে ওঠে। রক্ত নদী বয়ে যায় উরুতে, যৌনিতে, নাভিতে। বাপের লিঙ্গে। আড়াল সরে যায়। নিস্তেজ রাহেলা। ঝপঝপ খপখপ ঠপঠপ ঠাপঠাপ মেশিন চলে। বাপাক্ষসের মেশিন। মতিন শিউড়ে ওঠে। ভয়ে দূরুদূরু করে বুক। হার্ট বিট এই বুঝি হার্লে ডেভিডসনকেও হার মানাবে। মন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। হাতের কাছে ক্ষেতের কোদাল। অযান্তের মুঠোবন্দি হলো সেটা। বাপাক্ষসের মেশিন বন্ধ হয়েছে। লুঙ্গির নিচে লিঙ্গ ঢাকা পড়েছে। নেতিয়ে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরের দরোজার ছিটখানি খোলার শব্দ হলো। হাতের কোদালখানা আনমনে শূণ্যে উঠে গেল। বাবার ঘুমন্ত লিঙ্গ উঠোনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কোদালখানা শূণ্যে উঠছে আর নামছে যেমনটা সরলদোলক একবার ওঠে আরেকবার নামে। বাপের বুকে পুকুর খোদাই করছে মতিন।
নগ্ন দেহের রাহেলা মৃদুপায়ে এগিয়ে আসে। হাত রাখে কাঁধে। খনন বন্ধ হয়। জ্ঞান হারায় রাহেলা। ফিরে আসে নতুন মা। মতিন আর রাহেলা একঘরে পাশাপাশি। রাহেলা উন্মুক্তবক্ষা। রক্ত জমেছে নাভিতে, যৌনিতে, পায়ুতে, উরুতে।
আসছে। চেয়ারম্যান আসছে। মেম্বার আসছে। মাতব্বর আসছে। গরুর পাল আসছে। ছাগলের পাল আসছে। মানুষের পাল আসছে। পুরো গ্রাম ভেঙে আসছে। শুধু রোদটাই নেই।
শালিশ হলো। বিচার হলো। পুলিশ এল। তদন্ত হলো। মামলা হলো। রায় হলো। মুন্সিগঞ্জের মতিন চট্টগ্রাম এলো। কারাগার নম্বর তিনশ আটান্ন।
ঘোর কাটে মতিন মিঁয়ার। পীর বদর আউলিয়ার মাজার শরীফ থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসছে কানে। আযানের সুরে কী যেন আছে; হতে পারে পরপারে অপেক্ষারত মায়ের আহাজারি; হতে পারে আরজুর চোখ বেয়ে নেমে আসা কান্নার করুণাধারা, হতে পারা রাহেলার নিষ্পাপ চাহনিতে গলতে থাকা হিমবাহের গর্জন; হতে পারে মেঘ ভেঙে বৃষ্টি আসার আবাহন; হয়তো এর কোনোটাই না। রাস্তার ওপারে ঠাওর করে দেখে কেউ নেই; আরজু নেই ; রাহেলা নেই; কোনো কিছুই অচল নেই সবই সচল। গাড়ি চলছে, পাখি উড়ছে। স্বর্ণ পালকের ময়না উড়ছে।
আজ মতিনের ফাঁসির রায় হলো। অপরাধ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বোনকে বলাৎকার এবং বাধাদানের চেষ্টা করায় পিতাকে খুন!
কাল থেকে শুরু হবে নতুন জীবন। কনডেম সেলের জীবন। অন্ধকারে থাকার জীবন। একা থাকার জীবন। তিলে তিলে মৃত্যুর স্বাদ নেওয়ার জীবন। বেঁচেও মরে থাকার জীবন। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসে। আরজুর মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে; রাহেলার মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে; মরা মায়ের মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মুখ দিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘আহা, জীবন!’



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন