জলধি / গল্প / স্বপন বিশ্বাসের গল্প
Share:
স্বপন বিশ্বাসের গল্প
উতল হাওয়া
অন্বেষা জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি। আকাশে শ্রাবনের ঘন মেঘ। মেঘের ফাঁকে সকালের সূর্য্যটা উঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে। তারই একটি আভা অন্বেষার মুখে। মুখটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। তবে আলোর আভাটা বোঝা যাচ্ছে। চুলগুলো চোখের পাশ দিয়ে গাল ছুঁয়ে বুকে এসে পড়েছে। পরনে একটা ধুপছায়া রঙের শাড়ী। একটা হালকা হাওয়ায় অন্বেষা যেন একটু কেঁপে উঠল। অন্জন তখন কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবল, একে কি শিহরণ বলে! এমন সময় টেলিফোনে রিং। কৌশিকের ফোন। অন্জনের ছোটবেলার বন্ধু। চট্টগ্রাম থেকে।
 
এই, কি খবর ? শিল্পীর জীবন কেমন কাটছে।
 
এই তো আছি। অন্বেষাকে নিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে।
 
অন্বেষা কে নিয়ে দিন কেটে যাচ্ছে, মানে কি? অন্বেষাটা আবার কে?
 
ওই যে তোকে বলেছিলাম না! অন্বেষা। বগুড়ায় একটা আর্ট এক্সিবিশনে গিয়ে পরিচয়।
 
ও হ্যাঁ, ওই যে বলেছিলি। সে তো বিদেশি কোন মেয়ে। তার নাম কি অন্বেষা?
 
আরে, বিদেশি হতে যাবে কেন? ওতো বাংলাদেশে বড় হওয়া একটা মেয়ে। আমাদের আর্ট কলেজ থেকে পাশ। পুরো দস্তুর শাড়ী পরা বাঙালী। এখন বাবা-মা’র সাথে নিউ ইয়র্কে থাকে। ওখানকার কোন এক স্টুডিওর পক্ষ থেকে এসেছে।
 
তা সে প্রবাসিনী তোর ঘাড়ে চাপল কি করে?
 
কে কখন কার ঘাড়ে চাপে, কি মাথায় চাপে, তা কি বলা যায়! তুই কিন্তু দেরি করবি না। আমি কিন্তু এক্সিবিশনের জন্য গ্যালারি বুকিং দিয়ে দিয়েছি।
 
তা গ্যালারি বুকিং দিয়েছিস। ছবি কি রেডি হয়েছে?
 
ওসব ছবি নিয়ে একদম ভাববি না। সময়মত সব কিছু রেডি হয়ে যাবে। ছবিতো আগে মনের ক্যানভাসে আঁকতে হবে। তারপরে তো ইজেলের ক্যানভাসে ফুটে উঠবে। এখন ঋতু পর্যায়ের গান শুনছি আর অন্বেষার নেশায় বুঁদ হয়ে আছি।
 
শালা! তুই এবার নির্ঘাত ডুবাবি। একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে, ভালো। ঘুরবি ফিরবি। ডেটিং ফেটিং করবি, ঠিক আছে। তাই বলে অপরিচিত একটা মেয়েকে বাসায় এনে তুলবি। দাঁড়া, আমি এখনি আঙ্কেল আন্টিকে টেলিফোন দিয়ে জানাচ্ছি। দেখি তোর অন্বেষার ভুতটা মাথা থেকে নামানো যায় কি না।
 
ভুত নয় বন্ধু। প্রেম। বুকে প্রেম না থাকলে ছবি জীবন্ত হয়ে উঠবে কিভাবে? ছবি মানে তো ক্যানভাসের ওপরে শুধু লাল নীল নানা রঙের আস্তরণ নয়। ছবিতে আদর সোহাগ ভালবাসা দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
 
তুই যে এতো কথা বলছিস, অন্বষা শুনছে না!
 
শুনলে শুনুক।আমিতো শুনাতেই চাই। চিৎকার করে শুনাতে চাই। এই যে অন্বষা, তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?
 
কোথায় তোর অন্বেষা? কত দূরে, যে এতো জোরে চিৎকার দিচ্ছিস?
 
অন্জন ইজেল থেকে ওপরের ক্যানভাসটা উল্টে দিয়ে বলল, এতক্ষণতো ঘরের ভেতরেই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। বর্ষার বৃষ্টি দেখছিল। এখন দূরে, নদীর ধারে, কাশের বনে। শরতের পড়ন্ত বিকেল। রোদ এসে পড়েছে সাদা কাশ ফুলের ওপরে। এলোমেলো বাতাসে কাশফুলে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। অন্বেষা তারই মাঝে এক গুচ্ছ কাশফুল বুকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। এই মাত্র আমার ডাক শুনে ফিরে তাকাল। বাতাসে উড়ছে ওর শাড়ীর আঁচল। তুই কি এবার দেখতে পাচ্ছিস?
 
হ্যাঁ, বন্ধু। খুব দেখতে পাচ্ছি। পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। তার খোঁপায় শিউলি ফুলের মালা। এমন কি ওর শরীর থেকে বকুলের গন্ধ পর্যন্ত পাচ্ছি। তবে চুলটা খুলে দিলে পারতি। শাড়ির আঁচলের সাথে উড়ত। তাতে আরও বেশি প্রাণবন্ত, আরও বেশি জীবন্ত হয়ে উঠত।
 
তা চুল খোলা আর এমন কঠিন কি? তুই যখন বলছিস দিলাম খুলে। শাড়ী খুলতে তো আর বলিসনি!
 
কথা গুলো বলতে বলতে দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল। তারপর কৌশিক বলল, বুঝেছি বন্ধু তুমি অনেক দূর এগিয়ে গেছ। এখন কাশবন থেকে বেরিয়ে কিছুদিন ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেল। তারপর আমলকি খাও।
 
ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলাটা তো বুঝলাম। কিন্তু আমলকি খাওয়ার ব্যাপারটা কি। এটা কিসের ইঙ্গিত?
 
না বন্ধু, আমি কোন ইঙ্গিত করিনি। যা করার তা উনি করে গেছেন। “শীতের হাওয়ার লাগল নাচন
আমলকির এই ডালে ডালে।” ঠিক ওই সময় আমলকি পাওয়া যায় কিনা তাও জানি না। এতো গাছ রেখে শীতের হাওয়া কেন আমলকির গাছে, তাও ঠিক জানি না। খেজুর গাছে লাগলে তবু একটা কথা ছিল। এরপরে আবার বসন্তে গিয়ে লিখেছে, “ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান। আমার আপনহারা প্রাণ, আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ।” কি যে সব শক্ত শক্ত কথা। তোরা শিল্পী সাহিত্যিকেরা পারিসও বটে।
 
অন্জন বলল, ওই গানে আমার প্রিয় লাইন হল, “তোমার অশোকে কিংশুকে, অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে।” এই অকারণের সুখটা ছবিতে ধরতে পারাটাই একজন শিল্পীর সার্থকতা।
 
দুই.
 
শেষ পর্যন্ত আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের গ্যালারিটা পাওয়া যায়নি। ফরাসি দূতাবাসের নিজেদের একটি জরুরী কর্মসূচি ছিল। শেষ মূহুর্তে ভেনু পরিবর্তন করে ধানমন্ডির দৃক গ্যালারি। সবাইকে নতুন করে জানানো হল। বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিতদের মধ্যে অন্বেষাকে পাওয়া গেল না। টেলিফোন সুইজড অফ। বগুড়ায় যখন দেখা হয় তখন বলেছিল রেডিসন হোটেল। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেল বেশ কয়েকদিন আগেই সে হোটেল ছেড়ে দিয়েছে। অন্জনের খুব মন খারাপ। এক্সিবিশন হবে অন্বেষাকে ছাড়া। অথচ সে হয়তো ঢাকাতেই আছে। একবার অনুষ্ঠান বাতিল করার কথাও বলেছিল। শুধু কৌশিক খুব শক্ত ভুমিকা রেখেছিল। বলেছিল, সব আয়োজন শেষ। এখন এসব পাগলামীর কোন মানে হয় না। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। আসতে চাইলে ঠিক খুঁজে চলে আসবে।
 
অনুষ্ঠান শুরুর পর দুপুরের দিকে অন্বষাকে পাওয়া গেল। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে নোটিশ টানানো ছিল। সেখান থেকে ঘুরে দৃক গ্যালারিতে এসেছে। গ্যালারিতে ঢুকেই চোখ চড়কগাছ। প্রতিটা ছবিতেই অন্বেষা। অন্জনকে দেখা মাত্র চেপে ধরল। এটা কি করেছেন? আপনি কি আমার পারমিশন নিয়েছিলেন? পারমিশন ছাড়া আপনি এটা করতে পারেন না।
 
সমস্যাটি জটিল হতে পারত। হয়নি। অন্বেষার প্রতিবাদে কোন উত্তাপ ছিল না। অনুযোগ ছিল। অন্জন বলল, বগুড়াতে তো আপনার সাথে কথা হল। আপনাকে বলেছিলাম, আমি আপনার ছবি আঁকব, আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে আঁকতে পারেন। এক্সিবিশনটা যৌথ ভাবে হতে পারে। তারপর তো আপনি লাপাত্তা হয়ে গেলেন।
 
অন্বেষা বলল, আমি ভেবেছিলাম আপনি ফান করছেন। আপনি এমনটা করবেন আমি ভাবতে পারিনি। সেদিন তো আরও অনেক কথাই হয়েছিল। সেগুলোকেও কি সত্যি ধরে নেব?
 
আলোচনাটা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছিল। এগোতে পারল না। মিডিয়ার লোকেরা মৌমাছির চাকের মত চারিদিক থেকে চেপে ধরল। সম্পর্কের পোষ্টমর্টেম শুরু হয়ে গেল। কি, কেন, কোথায়, কতদিন, কিভাবে। এমন হাজার প্রশ্ন। খবর পেয়ে নতুন নতুন সাংবাদিকরা আসছে। আর একই প্রশ্ন বারবার ঘুরে ঘুরে চলছে। শেষ পর্যন্ত দুজনকেই পালিয়ে বাঁচতে হল।
 
রাতে অন্বেষার ফোন এল। সোনারগাঁও হোটেল থেকে। সে অন্জনের সবগুলো ছবি কিনে নিতে চায়। যেকোন দামে। অন্জন কোন ছবিই বিক্রি করবে না। পরদিন সব পত্রিকায় দুজেনের ছবিসহ সংবাদ, সাথে নানান গসিপ ছাপা হল। এগজিবিশনে মানুষের ভিড় উপচে পড়ল। অনেকেই ছবি কেনার আগ্রহ প্রকাশ করল। অন্জন তার সিদ্ধান্তে অটল। সে কোন ছবি বিক্রি করবে না। সব ছবিতে “বিক্রয়ের জন্য নয়” লিখে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হল।
 
দুদিনের অনেক ধকল শেষ করে বাসায় ফিরতেই অন্বেষার ফোন।
 
কি করছেন? কোথায় আপনি?
 
এইতো প্রোগ্রাম শেষ করে এই মাত্র বাসায় ফিরলাম। আপনি কিন্তু আজ ফাঁকি দিলেন। খুব আশা করেছিলাম আপনি আসবেন।
 
সকালে পত্রিকার গসিপগুলো পড়ে এক্সিবিশনে যাওয়ার আগ্রহটাই হারিয়ে গেল। তাছাড়া ছবিগুলো যখন বিক্রি করবেন না তখন আর মায়া বাড়িয়ে লাভ কি!
 
ক্ষতিও তো কিছু ছিল না। মায়া থেকেই তো ভালবাসার জন্ম হয়।
 
আপনি উল্টো বললেন। ভালবাসা থেকেই মায়ার জন্ম হয়।
 
হতে পারে। হয়তো আপনিই ঠিক। আবার যৌথ ভাবেও হতে পারে। মানে, মায়া এবং ভালবাসা, দুটো একসাথেও হতে পারে।
 
পারে, মানে পারতো। তবে সময় শেষ। আগামীকাল সকাল দশটায় আমার ফ্লাইট। যাওয়ার আগে আপনার সাথে একবার দেখা করতে চাই। সকাল সাতটায় আমি হোটেলের লবিতে অপেক্ষা করব।
 
সকালে যখন অন্জনের ঘুম ভাঙল তখন দেয়াল ঘড়িতে সকাল আটটা। মোবাইলে অ্যালার্ম চেক করে দেখে পি, এম, হয়ে আছে। তাড়াহুড়া করে অন্বেষাকে ফোন দিল।
 
স্যরি, আমার ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেছে। আপনি কোথায়? আমি কি সরাসরি এয়ারপোর্টে আসব?
না, আমি হোটেলের লবিতেই আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনার সাথে দেখা না করে কোথাও যাব না।
 
ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে অন্জন যখন হোটেলে পৌঁছাল তখন ঘড়িতে প্রায় নয়টা। অন্বেষা নির্বিকার লবিতে বসা। অন্জন বলল, তাড়াতাড়ি গাড়ীতে উঠে বসুন। স্যরি, আমি হয়তো আপনার ফ্লাইটটা মিস করিয়ে দিলাম। তবু শেষ চেষ্টা করে একবার দেখা যাক। আর আপনার ছবিগুলো গাড়িতে প্যাকেট করা আছে। ওগুলো আপনি সাথে নিয়ে যান।
 
কেন? আপনি তো ছবি বিক্রি করবেন না। তাহলে আমি ছবি নেব কিভাবে?
 
ওই যে রাতে বললেন, মায়া। মায়ার বিনিময়ে।
 
মায়ার কি কোন বিনিময় হয়? মায়া আর ভালবাসা যে হাত ধরাধরি করে চলে।
 
এখন কথা বাড়াবেন না। তাড়াতাড়ি গাড়ীতে উঠে বসুন। আমি আপনার ফ্লাইট মিস করানোর দায় নিতে চাই না।
 
কেন? দায় নিতে কি আপনি ভয় পান?
 
অন্জন গাড়ীর দরজা খুলে ধরে বলল, ভালবাসার দায় নিতে ভয় পাই না কিন্তু দোষের দায় কে নিতে চায়? আর হয়তো আজ আমার কপালে সেটাই জুটবে।
 
আর, আমি যদি আপনাকে সে দোষের দায় থেকে মুক্তি দেই? তাহলে?
 
অন্জন অবাক হয়ে বলল, কিভাবে?
 
ফ্লাইটা যদি ক্যানসেল করে দেই। এয়ারপোর্টে যদি না যাই। যদি বলি, আমি আর নিউ ইয়র্ক ফিরে যাব না। আমরা দুজন মিলে ছবি আঁকব। যৌথভাবে। যৌথ জীবনের ছবি।
 
অন্বেষার কথা শুনে অন্জনের পৃথিবীটা যেন মূহুর্তের জন্য থমকে গলে। তারপর দুজন দুজনের চোখের দিকে ফিরে তাকাল। একটা হাওয়া দুজনের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেল। দখিনের উতল হাওয়া।


অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন