জলধি / গল্প / মো. রেজাউল করিমের গল্প
Share:
মো. রেজাউল করিমের গল্প
প্রহেলিকা

বাবর আলীর বাড়ির বাম পাশে প্রায় দুই বিঘা জমি অনাবাদী পড়ে রয়েছে। তার ওপারে কয়েক ঘর দরিদ্র মানুষের বসবাস। ঘরগুলো চারদিকে নানা জাতের গাছ-গাছালিতে এমনভাবে আবৃত যে ওখানে কয়টি পরিবার বাস করে তা বাইরে থেকে ঠাহর করা সম্ভব না। ওখানকার মানুষগুলোই জানে সেখানে দশটি পরিবারের বসবাস। পাড়ার নাম ফুলতলা হলেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তেঁতুল গাছটির জন্যই হয়ত-বা দশ ঘরের জনপদের নাম হয়েছে তেঁতুলতলা। ওদের সকলকে পাড়ার দোকানদার ছাড়া আর কেউ চেনে বলে মনে হয় না। তবে দোকানে যাঁরা চা খাওয়ার জন্য বসেন তাঁরাআবুনামে একজনের নাম শুনেছে। আবুকে চেনার বড়ো কারণ- গোটা দিন রিকশা চালিয়ে মধ্যরাতে সে চোলাই মদ খেয়ে হল্লা করতে করতে বাড়িতে ফেরে।

বাবর আলীর বড়ো ছেলে আকবর এইসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এক রকম অলস-অবসর কাটাচ্ছে। বাবার কড়া হুকুম- স্থানীয় গেঁয়ো ছেলেপুলের সাথে খেলাধুলা করা যাবে না। অখণ্ড অবসরে বাবার ছোট্ট কাঠের আলমিরা থেকে একটার পর একটা বই নিয়ে শেষ করতে থাকে সে।

রাতটা এখানে বেশ ভীতিকর। সন্ধার কিছু পরে অন্ধকার গাঢ় হলেই আখক্ষেত থেকে শেয়ালগুলো বের হয়ে সরব হয়ে ওঠে। পরিস্থিতিকে অহেতুক নাজুক করে তোলে নিশাচর কুলক্ষণা পেঁচার ডাক। কোনও গেরস্তের কুকুর যতক্ষণ সরব না হয় ততক্ষণ শেয়ালগুলো তারস্বরে চিৎকার অব্যাহত রাখে। বুদ্ধিমান প্রাণি কুকুর শোরগোল তুললেও সংখ্যাধিক্যের বিবেচনায় শেয়ালগুলোকে ধাওয়া দেয় না। ফলে কুকুর আর শেয়ালের হল্লা-পাল্টা হল্লা গভীর রাত অবধি চলতে থাকে। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকেরা যখন ঠেলা গাড়িতে মই নিয়ে বাড়ির সামনে দিয়ে যায় তখন ওদেরকে নিজের টাকা দিয়ে কেনা বৈদ্যুতিক বাল্ব বিদ্যুতের খুঁটিতে বেশ কয়েকবার লাগিয়েছেন বাবর আলী। কিন্তু কারা যেন রাতের অন্ধকারে বাল্ব ভেঙে দিয়ে যায়- এটা যে ছিঁচকে চোর কিংবা অধিক রাতে পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পাঁড় মাতালদের কাজ তা বুঝতে বাবর আলীর বেগ পেতে হয় না। বেশ কয়েকটা বাল্ব ভাঙার পরে বাবর আলী বাড়ির সামনেটা আলোকিত করে রাখার ইচ্ছে বাদ দিয়েছেন।

সাড়ে আটটার মধ্যে -বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার পালা শেষ। রাত দশটায় বাবর আলী রেডিও অফ করে বিছানায় যান, নির্দেশ মোতাবেক ছেলে-মেয়েও সে সময়ে গোটা শহরে হাতে গোনা দুচার জনের বাড়িতে টেলিভিশন ছিল, বাবর আলীর বাড়িও তেমনই বাড়ি যে বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম রেডিও। তখন বসন্তকাল। বেশ কিছুদিন হলো শীত বিদায় নিয়েছে, চমৎকার আবহাওয়া - না গরম, না শীত। এমনই এক রাতে বাবর আলীর বাড়ির সামনে বাঁশির সুর শোনা গেল। বাঁশি বাজায় রাস্তায় কালভার্টের ওপরে তৈরি ইট-সিমেন্টের স্থায়ী বেঞ্চে বসা বাবরি চুল, বুক অবধি নেমে পড়া দাড়ি ঠোঁট ঢাকা গুম্ফরাজির অচেনা এক মানুষ। নামাজ-কালাম নিয়ে সদা-ব্যস্ত বাবর আলীর স্ত্রী পরদিন রাতে খাবার সময়ে বাঁশির অপূর্ব সুরের কথা তুললেন। বাবর আলীর স্ত্রী বললেন গাঁয়ে হলে এদিক-ওদিক থেকে মানুষ বের হয়ে আসত। শহরে কে শোনে বাঁশির সুর, ভয়ে সব ঘরের মধ্যে সেঁটিয়ে থাকে। বাবর আলী বিরক্ত হলেন- বাবর আলীর বিরক্তিভরা রাশভারী মুখের দিকে চেয়ে আলোচনা আর এগোল না। পরদিনও রাত এগারটায় বাঁশি বেজে উঠল। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে শেয়ালগুলো আখক্ষেতে ঢুকে পড়েছে। বেশ কিছু কুকুর বাঁশিওয়ালার আশেপাশে এসে দাঁড়াল, কোনোটি-বা চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে তার চারপাশে ঘোরাঘুরি করছিল; তবে বাঁশিওয়ালার কোনও দিকেই খেয়াল নেই, সে যেন জগত-সংসার বিরাগী এমন এক মানুষ নিজের পাশে হিংস্র জীবজন্তুও যার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ। আপন মনে বাঁশিতে সুর-লহরী তোলায় নিমগ্ন সে। কত রাতে সে বাঁশি থামিয়ে কোন দিকে চলে যায় তা কেউ খেয়াল করে না, গভীর রাতে আশেপাশের শ্রমজীবী মানুষের কেই-বা জেগে থাকে বাঁশির সুর শোনার জন্য! বাঁশিওয়ালা কেন হঠাৎ করে তেঁতুলতলার সামনে এসে অন্ধকার বিভাবরীতে করুণ সুরে বাঁশি বাজানো শুরু করল তা কেউ জানে না, জানার চেষ্টাও করেনি- এটাই সত্য। তবে এটাও সত্য যে বাঁশিওয়ালা ছাড়াও আরও একজন তা জানে- তার বসবাস তেঁতুলতলায়।

রাত গভীরে বাঁশি বাজানো নিয়ে আলোচনা পাড়ার মোড়ে একমাত্র চায়ের দোকানে বসা স্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় স্থান পেল। বেশির ভাগ আলোচক আলোচনায় অনীহা প্রকাশ করলেন। বরং দেশের ভবিষ্যত অর্থনীতি, বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি- এসব বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতেই তাঁদের আগ্রহ লক্ষ্য করা গেল। দোকানী জানালেন আত্মীয়বাড়ি থেকে ফেরার সময় তিনি কালভার্টের ওপরে দাঁড়িয়েছিলেন কিছুক্ষণ। বাঁশিওয়ালা তার দিকে তাকিয়েছে বলে মনে হয়নি। তবে সাদা লুঙ্গি গায়ে সাদা চাদর পড়া চুল-দাড়িওয়ালা লোকটিকে দেখে মনে হয়েছে সে বাউল। একথা শুনে দোকানে বসা আলোচক-বুদ্ধিজীবীগণ বাঁশি বাজানো নিয়ে আলোচনা নিমিষেই ক্ষেদোক্তি প্রকাশ করে উড়িয়ে দিলেন।

দিনকে দিন বাঁশির করুন সুরে বাবর আলীর বড়ো ছেলে আকবর নিজের মধ্যে ভিন্ন ধরনের এক আমেজ অনুভব করল। আরও কাছে গিয়ে বাঁশিওয়ালার পাশে বসে বাঁশি বাজানো শোনার আগ্রহ হলেও বাবার কড়া শাসনের দেয়াল ডিঙিয়ে এত রাতে ঘর থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব তা সে জানে। কিন্তু দিনের পর দিন মনের মধ্যে আগ্রহটা ডালপালা বিস্তার লাভ করল। সেদিন ছিল পূর্ণিমা- জোছনা প্লাবিত রাত। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাত এগারটার দিকে ঘর থেকে সন্তর্পণে বের হয়ে পড়ল আকবর। দুমিনিটও লাগল না কালভার্টের বেঞ্চির কাছে পৌঁছতে। সাদা লুঙ্গি, সাদা চাদর গায়ে পেঁচিয়ে সে দুই হাতে বাঁশি ধরে পরম মমতায় তাতে সুর তুলেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে আকবরের উপস্থিতি টের পেয়ে তাকাল, চোখ জোড়ায় শীতল চাহনী- বিরক্তি ক্ষোভ উগড়ে পড়ছে। আকবর হঠাৎ- যেন সাহসী হয়ে উঠল, সে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘ভাইয়া আপনার নাম কী?’ ‘হেকমত, হেকমত আলী। চলে যাও এখান থেকে, চলে যাও।আকবর আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেল না। সামান্য হেঁটে আবারও খুব সাবধানে ঘরে ঢুকে মনে শত প্রশ্ন নিয়ে হালকা একটা চাদরে শরীর মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল সে।

আবুর চাঁদমুখী বউটার বাচ্চা হয়নি, আবু ভাবে তার বউ বাঁজা। বাড়িতে এসে বউকে দেখা মাত্র যেদিন পুত্রের কাছ থেকে বাবা ডাক শোনার জন্য আবুর মন কেঁদে ওঠে তখন সে হাতের কাছে যা পায়, তাই দিয়েই বউকে পেটায়- তা হতে পারে ঝাঁটা কিংবা চুলার চলাকাঠ। অথচ আবু এর আগে একটা বিয়ে করেছিল, দুবছর সংসার করার পরেও সন্তান হয়নি। সেই বউকে তালাক দিয়েছে সে। অথচ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দরিদ্র পিতার মেয়ে আবুর বউটা গর্ভধারণে কথিত অক্ষমতার জন্য ঝাঁটা কিংবা চলাকাঠের পিটুনী খেয়ে আসছে।

সেদিন আবু মদ খেয়েছিল স্বল্পমাত্রায়, তবে ঘরে ফিরল অনেক দেরিতে। স্বল্প মাত্রায় মদ খাওয়ার জন্য হৈ-হল্লা না করেই ঘরে ঢুকে দেখে ঘরে বউ নেই। মাটির পায়খানার সামনে চটের ছালা ওঠানো, তার মানে ওখানেও নেই। বাড়ির পেছন দিকে গিয়ে দেখে এক মনে বাঁশীর সুরে বিমোহিত বউটা একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও বউ এর কোনো নড়াচড়া নেই দেখে আবুর মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘হারামজাদী মাগী দুপুরে বাজার দিয়ে গিয়েছি না? স্বামীকে খাবার না দিয়ে পরপুরুষের সাথে প্রেম মারানো হচ্ছে? ছিনাল মাগী বাঁশী শোনা তোকে শেখাচ্ছিবলে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে দরজার খিল দিয়ে দিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝাঁটাটাই চোখে পড়ল। ঝাঁটার মাঝ বরাবর মুঠো করে ধরে গোড়া দিয়ে বেধড়ক পেটাতে শুরু করল। আবু বউকে পেটায় বিয়ের পর থেকেই; প্রথম দিকে চড়-থাপ্পড়ে সীমাবদ্ধ ছিল। এর পরে তা ঝাঁটা, চুলার চলাকাঠে উন্নীত হয়েছে, তবে তা ছিল সীমিত মাত্রায়। কেননা এর পরে বউ এর দেয়া খাবার খেতে হয়। আজ আবু হিতাহিত জ্ঞানশুন্য। রাতের অন্ধকারে গাছ-গাছালির আড়ালে দাঁড়িয়ে অন্য পুরুষের বাঁশীর সুর শোনা! এত বড়ো সাহস? বউটা শত আঘাতেও রা করে না, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে। তবে তেতুলতলার অন্য ঘরের মানুষ যারা বেশি রাতেও জেগে থাকে তারা আবুর হুঙ্কার শোনে, কারো-বা আবুর হুঙ্কারেই ঘুম ভেঙে যায়। সেদিন আবুর অত্যাচার সীমা ছড়িয়েছিল, যে-কারণে বউটা চিৎকার না করে থাকতে পারেনি, তবে তা ছিল স্বল্প সময়ের জন্য। আবু বউটার গলা টিপে ধরায় তার পক্ষে চিৎকার অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। আবু বউ এর গলা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পেসাব করার জন্য উঠে দাঁড়াল, কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না; চোলাই মদের প্রভাব, দীর্ঘক্ষণ বউ পেটানোর দরুন ক্লান্তি নাকি কেউ যেন ধাক্কা দিল- সে পড়ে গেল।

সেদিন বেশ ভোরে ঘুম ভেঙে গেল আকবরের। বাবার কড়া হুকুম- ফজরের নামাজ আদায় করে সকালে হাঁটতে হবে। আজান হওয়া মাত্রই নামাজ আদায় করে হাঁটতে বের হলো আকবর। তখনও মসজিদে জামাতে নামাজ শুরু হয়নি। আকবর বড়ো রাস্তা ধরেই এগিয়ে গেল। তেঁতুলতলা থেকে মাটির রাস্তা ধরে সাদা লুঙ্গি পড়া কে একজন সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে এগিয়ে আসছে; তার গায়ের চাদরে সামান্য রক্তের দাগ, প্রায়ান্ধকারেও দেখা যায়। কাছে আসতেই মনে হলো হেকমত আলী, কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস হলো না তাকে। লোকটি রাস্তা ধরে না হেঁটে রাস্তা পেরিয়ে প্রায়ান্ধকার আখক্ষেতের দিকে নিমে গেল।

অনেক বেলাতেও আবুর ঘর থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে পাশের ঘরের লোকজন একজন দুজন করে তার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে আবু আর তার বউ দুজনই মাটিতে পড়ে রয়েছে। আবুর বউ এর শ্বাস-প্রশ্বাস নেই, আবুরও একই অবস্থা। আবুর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে ঠোঁট অবধি এসে জমে গিয়েছে। এক কান-দুকান হয়ে খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই তেতুলতলা জনারণ্যে পরিণত হলো। পাড়ার দোকানের বুদ্ধিজীবীগণকেও সেই ভিড়ে দেখা গেল। সকাল আটটার দিকে পুলিশ এলো, তেঁতুলতলায় আবুর পড়শীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। আকবর তার ছোট্ট জীবনে বড়ো একটা ভুল করে ফেলল। স্বেচ্ছায় ভালোমানুষী করে নাকি হিরো হবার ইচ্ছায় একজনকে বলে ফেলল, ভোরে আমি -পাড়া থেকে একজনকে বের হয়ে যেতে দেখেছি। সম্ভবত সে- রাতের বাঁশিওয়ালা। পুলিশ আকবরকে আবুর পাশের ঘরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। আকবর তখন কৈশোর পেরিয়েছি মাত্র, এই জিজ্ঞসাবাদের পরিণতি সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। অকপটে সে দিল, ‘আমার যতদূর মনে হয় চাদরে রক্তমাখা লোকটিই হেকমত আলী। তার গোঁফ আমি রাতে দেখেছি, সকালেও যাকে দেখেছি তার গোঁফও সেরকমই।ময়নাতদন্তের জন্য আবু আর তার বউ-এর লাশ পুলিশ ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে গেল- তখন বেলা বারটা। জীবিত অবস্থায় আবু আর তার স্ত্রী কোনো দিন হয়ত পরম মমতায় জড়াজড়ি করে পাশাপাশি শোয়নি, আজ জড়াজাড়ি করে না হলেও পাশাপাশি শুয়ে রইল; তবে তারা মৃত।

বিকেলে বাসায় পুলিশ দেখে আকবরের মা-তো খুব ভয় পেয়ে গেলেন। পুলিশের কর্মকর্তা এসেছেন লক্কড়মার্কা একটা পিকআপ ভ্যানে। বাবর আলী তখনও অফিস থেকে বাসায় আসেননি। আকবরের মা-তো বোরকা ছাড়া বহিরাগতের সামনে আসেন না। তিনি বোরকা পরেই আসলেন বাইরের ঘরে, ঘরে না বলে বলা য়ায় ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। পুলিশ কর্মকর্তা জানালেন, ‘পাখিডাকা ভোরে জোড়া খুনের সাথে তেতুলতলা থেকে বেরিয়ে আসা লোকটার সম্পর্ক রয়েছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। আপনার ছেলে তা লোকটিকে দেখেছে। সে তাকে চেনেও সম্ভবত, সে নিজেই বলেছে।আকবর তৎক্ষণাৎ বললআমি চিনি না, একদিন রাতে বাড়ির কাউকে না বলে কালভার্ট পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তার বকুনীতে চলে এসেছি।

পুলিশ অফিসার বললেন, ‘হাঁ বাবু আমার স্যার থানায় আছেন। থানায় গিয়ে ওনাকে কথাটাই বলবা, কোনও ভয় নেই।আকবরের মা বললেন, ‘ওর বাবা আসুকনা’, সন্ধ্যা হয়ে যাবে, আমরা এত দেরি করতে পারব না। আমাদের গাড়ির হেডলাইট নষ্ট, এখনি যেতে হবে। স্যারকে থানায় আসতে বলবেন। ওনার সাথে বাসায় চলে আসবে। আকবর তখনও নিরুদ্বিগ্ন- পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে তার কোনও ধারণাই নেই যে। লুঙ্গি পাল্টে প্যান্ট পরে ওনাদের সাথে রওনা হলো সে, মা তার অন্য ভাই-রা তখন লা জওয়াব।

থানায় পৌঁছে আকবর জানল ওসি সাহেব নেই, আসতে দেরি হবে। তাকে ওসি সাহেবের ঘরেই একটা টুলে বসতে দেয়া হলো। সন্ধ্যার পরে বাবা আসলেন সাতটা-সাড়ে সাতটার দিকে। ওসি সাহেব আসলেন রাত দশটায়। এসেই অন্যান্য অফিসারকে ধমক দিলেন, আকবরকে রাতের খাবার দেয়া হয়নি কেন? বাবা বললেন, ‘দরকার নেই, আমার সাথে বাসায় গিয়ে খাবে। আপনারা কী জিজ্ঞাসা করবেন করেন, আমি না-হয় বাইরে অপেক্ষা করছি।ওসি সাহেব সাথে সাথেই জানালেন, ‘স্যার আপনি বরং চলে যান, আমরা ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ওর সাথে কথা বলে গাড়িতে করে আপনার বাড়িতে দিয়ে আসব। ওর গায়ে টোকাটি পর্যন্ত দিব না।অনেক পীড়াপিড়িতে বাবা চলে গেলেন। হাঁ, সে-রাতে আকবরের গায়ে টোকাটি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। তবে ওদের দেয়া খাবার খাওয়ার পরে প্রায় ভোর অবধি আকবরকে জিজ্ঞাসাবাদ চলল, তবুও পুলিশ কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। আকবরকে ওসি সাহেবের ঘরেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, তার গায়ে টোকাটি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। তবে পাশের ঘরে মারধোর কান্নাকাটি তাকে খুবই ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলল। বস্তুত তাদের নিরানব্বই শতাংশ প্রশ্নের উত্তরই আকবরের জানা ছিল না। ফজরের আজানের সময় টুলে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে। আটটার দিকে ঘুম ভাঙল, বাবর আলী সকালের নাস্তা নিয়ে এসেছেন রুটি, আলুভাজি ডিমভাজি। খাওয়ার পরে যা জানানো হলো তা শুনে বাবর আলী বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। আকবরের সাথে তাদেরকে আরও কথা বলতে হবে। থানায় চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময় রাখতে হলে আদালতে অনুমতি প্রয়োজন। অতএব আকবরকে আদালতে নেয়া হবে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতির জন্য। আদালত থেকে আকবর পুলিশের সাথে আবার ফিরল বিকেলের দিকে- বাবর আলী আছেন সাথে সাথেই, আরও যুক্ত হয়েছেন আকবরের কলেজের অধ্যক্ষ আত্মীয়স্বজন। এবারে বাড়ি থেকে খাবার এনেছে আকবরের মামা। খাওয়া হলে সকলকে জানানো হলো আদালত থানায় একদিন রেখে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন- আজ যেন তাঁরা আর না আসেন, কাল আসলেই হবে। সেদিন সারারাত একটা ঘরে আকবরকে একাকী রাখা হলো। উত্তর আকবরের জানা নাই, আকবর কল্পনাও করতে পারে না, এমন সব প্রশ্ন করা হলো। মাঝেসাঝে হালকা চড়-থাপ্পড়। আকবরের উত্তরে তাঁরা মোটেও সন্তুষ্ট হলেন না। পরদিন যথারীতি আদালতে। আকবর নতুন শব্দ শিখলজামিন’- না সেটি মিলল না। জোড়া খুনের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, জামিন হবেই-বা কেন? নিজের জন্য যতটা না তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগল আকবরের বাবার উদ্বেগাকুল মুখের দিকে চেয়ে। শ্যামলা মানুষটার মুখাবয়ব একদিনেই কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে।

আকবর তখন হাজতী হিসেবে জেলখানায়। তিন মাস পার হয়েছে, নিত্য পেটের পীড়ায় তার চোখ দুটো কোটরাগত, বুকের হাড়গুলো গোনা যায়, মুখের চোয়াল দুটো যেন ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসছে। বাবা-মা নিয়ম করে দেখতে আসেন। নির্ধারিত সময় শেষে চলে যাওয়ার সময় মায়ের কান্না অস্থির করে তোলে; তবে বাবর আলী অবিচল, অচঞ্চল; সান্তনা দেন- সত্যের জয় হবেই, ধর্য্য ধরো। জেলখানায় হাজতী দণ্ডিতদের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। হাজতীদেরকে কাজ করতে হয় না, কারারক্ষীরা তাদেরকে তেমন জোর-জুলুমও করে না। যদিও ভয়ংকর হাজতীদেরকে পৃথকভাবে রাখা হয়। আকবর জেলখানায় তার সেলে একজনকে পেয়ে গেল যে বাঁশি বাজাতে পারে। আকবরের আগ্রহে কারারক্ষীদের সহযোগিতায় লোকটা বাঁশি জোগাড়ও করে ফেলল। নিস্ফলা দিনগুলোতে লোকটা প্রায় দুপুরের খাবারের পরে বাঁশি বাজাত। কিন্তু আকবর তাতে সেই মনোময় সুর খুঁজে পেত না, যা সে পেয়েছিল হেকমত আলীর বাঁশিতে। রাতে আকবরের ঘুম ভেঙে যেত স্বপ্নে হেকমত আলীর বাঁশির সুরে। নিদারুন এক অশান্তিময় দিন- যার কারণে সে নিরপরাধী হয়েও জেলে, তার সুরলহরীই কিনা তাকে ভিন্ন এক ভুবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। জেলে থাকতেই পরীক্ষার ফল বের হলো। পরীক্ষার ফলাফল বরাবরের মতোই ভালো। তবুও সে উচ্চতর শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারল না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পেরিয়ে অবশেষে আকবরের জামিন মিলল এক বছর পর।

পাড়ার মানুষগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ল আকবরদের বাড়িতে- সকলেই তাকে দেখতে চায়, কথা বলতে চায়। এক পর্যায়ে আকবর ঘর থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য হলো। তার চেহারা দেখে সকলেই আহাউহু করল। মাসখানেক মায়ের পরম আদরে, সেবাযত্নে স্বাস্থ্য কিছুটা ভালো হলো। আত্মীয়-স্বজন, তার বাবার অফিসের লোকেরা দেখতে আসে। সকলেই এক পর্যায়ে জেরা শুরু করে। আকবর বাবাকে বলল রংপুরে যাব, চাচার বাড়িতে- গেলও। কিন্তু সেখানেও চাচা অফিসে গেলেই চাচির জেরা শুরু হয়। এক মাসের নাম করে গেলেও দুদিনের মাথায় চলে এলো। এবারে সে রাজশাহী গেল মামার বাড়িতে। সেখানেও একই সমস্যা। সেখান থেকেও চলে আসল। বন্ধু-বান্ধব বাড়িতে আসলেও কৌশলে একই ধরণের জেরা। রাতের ঘুম হয় না- ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়, তাকে জেরা করা হচ্ছে। মনে হলো এর চেয়ে জেলখানাতে থাকা ভালো ছিল। এক পর্যায়ে সার্বিক পরিবেশ আকবরের জন্য যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। রাতের ঘুম অন্তর্হিত হলো। অস্থিরতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল।

এদিকে মৃত আবু ছিল নিতান্তই গরীব। আকবর তার মায়ের কাছ থেকে জানল সে যখন জেলে তখন তেতুলতলায় প্রায়ই পুলিশ এসেছে। একে-ওকে এক বেলা, এক রাতের জন্য থানায় নিয়ে গিয়েছে। আবু তার হত্যাকারীর টিকিটিও পাওয়া যায়নি। নতুন আরও একটা শব্দ শিখল সে- সে শব্দটিচার্জশিট পুলিশ আবু তার স্ত্রী হত্যার ব্যাপারে চার্জশিট দিতে পারেনি, যে-কারণে তার জামিন হয়েছে; উকিল বলেছে তদবির করার মতো ওদের কেউ নেই, পুলিশ কখনোই চার্জশিট দিতে পারবে না। আকবরের দ্বিতীয় দফা জামিন মঞ্জর হলো। বাবা তাকে ঢাকায় একটা বেসরকারি কলেজে অসার্স কোর্সে ভর্তি করে দিলেন। মেসে থেকে পড়াশোনা শুরু করল সে। এখানে আবু তার স্ত্রী হত্যার ব্যাপার কেউ জানে না। আকবর বাড়িতেও যায় না। কলেজের প্রাকৃতিক পরিবেশ চমৎকার। সবুজ বনানি আচ্ছাদিত, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত কলেজের ক্যাম্পাস, নতুন সহপাঠী, পড়াশোনার চাপ- সব মিলিয়ে অতীত ক্রমেই ধুসর হতে লাগল। সাহস করে একবার ঈদে বাড়ি গেল। ফুলতলার মানুষ আবু বিষয়ক জটিলতা থেকে ততদিনে বোধ হয় মুক্ত হয়েছে। তবুও অতিরিক্ত সাবধানতার জন্য বাইরে যেত না সে। পাড়ার মসজিদে ঈদের জামাতে অংশ না নিয়ে শহরের কেন্দ্রিয় ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করল। ঈদের পরদিনই সে ঢাকায় চলে গেল। এতদিন পরেও হেকমত আলী তাকে পিছু ছাড়েনি। অনেক রাতেই আকবরের ঘুম ভেঙে যায় হেকমত আলীর সুরলহরীতে। লজ্জা ত্যাগ করে বাবাকে চিঠি লিখল। বাবার পরামর্শে শাহবাগের পিজি হাসপাতালে চিকিসৎকের স্মরণাপন্ন হলো। ডাক্তারের কাছ থেকে পাওয়া গেল ঔষধের নাম কিছু পরামর্শ। সমস্যার মাত্রা কিছুটা কমল, তবে একেবারে না। এভাবেই আরও তিন-চার বছর পার হয়ে গেল।

অনার্স ফাইনাল পরিক্ষা দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার আগে সহপাঠিদের সাথে কক্সবাজারে গেল আকবর। ভালো হোটেল নাকি একটাই- হোটেল সাইমন। সেখানে থাকার সামর্থ্য নেই ওদের। ফিসারীঘাটের কাছে একটা কম দামি হোটেলে জনা বিশেক ছাত্র উঠল। হোটেলটা কমদামি হলেও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সে রাতে ক্লান্তিতে নটার দিকেই সকলে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন টেকনাফ যাওয়ার পরিকল্পনা। গভীর রাতে বাঁশির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকল। স্মৃতির গোলাঘরে সাত বছর আগের ঘটনা চাগাড় দিয়ে উঠল। ঘুমানোর চেষ্টা করল- ঘুম আসে না। আকবর নিশ্চিত হলো এটা হেকমত আলীর বাঁশির সুর। মনের অজান্তেই সে ঘর থেকে বের হয়ে পড়েছে- অনেকটা ঘোরের মধ্যেই। হোটেলের সদর দরজায় গার্ডকে বলল সে বাইরে যাবে। গার্ড আঁইকুঁই করল বেশ খানিকক্ষণ, বলল রাতের বেলা একা বাইরে যাওয়া ঠিক না। আকবর বলল ঘুম আসছে না, সিগারেট কিনতে যাবে। পাঁচটা টাকা হাতে ধরিয়ে দিতেই মুখে রাজ্যের বিরক্তি ফুটিয়ে কাঠের চওড়া দরজাটা খুলে দিল। হোটেল থেকে বের হয়ে বাঁশির সুর যে দিক থেকে আসছে সে দিকেই চলল আকবর। কিছুক্ষণ হেঁটেই সৈকতের দেখা পেল। সমুদ্র, সমুদ্র সৈকত সম্পর্কে ধারণা তার কম। তবুও মনে হলো ভাটা চলছে- সৈকতকে অনেক প্রশস্ত মনে হলো। বাঁশির সুর আরও নিকটবর্তী হয়েছে। হাঁ এটাই হেকমত আলীর বাঁশির সুর। সাদা চাদর গায়ে দুরে সৈকতের বালিয়াড়িতে একজন মানুষ বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। এই বাঁশির সুর সে শুনেছে পাঁচ-ছয় বছর আগে- ফুলতলায় বাড়ির সামনের রাস্তায় কালভার্টের ওপরে বসা হেকমত আলীর বাঁশিতে। ক্ষণিকের জন্য ভাবল কেন আবারও হেকমত আলীর কাছে যাবে সে? একবার তার কাছে যাওয়ার জন্য জীবনটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছে, আবারও তার কাছে এই গভীর রাতে যাওয়া কি ঠিক হবে বাঁশির সুর শোনার জন্য? আবার ভাবল নাহ্, যার জন্য তার জীবনটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছে তার মুখোমুখি একবার হতে চায় সে। আর চিন্তা করতে পারে না, কোন এক অজানা শক্তি তাকে সম্মোহিত করে সামনের দিকে ঠেলে দেয়- সেও এগিয়ে চলে। সামনে এগোতেই বাঁশির সুর ক্ষীণ হয়ে আসে সাগরের ঢেউ এর উচ্চকিত শব্দে। তবুও সে এগিয়ে যায় সন্দেহভাজন সাদা চাদর পরিহিত হেকমত আলীর কাছাকাছি। এক সময় অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়, ভাটার ঢেউ প্রবলতর হয়; ঢেউ এর অগ্রভাগ যেন গোটা সৈকতকে ভিজিয়ে সৈকতের ওপরে ফেলে রাখা সারাদিনের ময়লা-অবর্জনা ঝেঁটিয়ে নিয়ে যেতে চায় গভীর সাগরের তলদেশে। বাঁশির সুর হারিয়ে যায়, সাদা চাদর গায়ে দেয়া হেকমত আলী নামক বিভ্রমে আকবর বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, সাগরের দিকে নিম্নগামী স্রোতের সাথে নিতান্তই নিস্ফলা লড়াই করতে থাকে সৈকতে উঠে আসার জন্য।                             



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন