জলধি / গল্প / ভাঙাচোরা স্বপ্ন
Share:
ভাঙাচোরা স্বপ্ন

দিল্লী লাগোয়া শহর গাজিয়াবাদ। সারাদিন গাড়ি ঘোড়া মানুষের ভীড় লেগেই আছে। ব্যবসা ছাড়াও নানা ধান্দায় ঘুরে বেড়ায় শয়ে শয়ে মানুষ। দিনের শেষে যে যার ঘরে ফিরে যায়। রাত বাড়লে হালকা হয় মোহন নগর বাসস্ট্যান্ড। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই ইন্দিরা কলোনীর সাত নম্বর গলির শেষ প্রান্তে আট বাই ছয় টিনের চালার নীচে রিয়াজের মাথা গোঁজার ঠাই। তুতোভাই রফিকুলের হাত ধরে সেই প্রথমবার ভিন রাজ্যের মাটিতে পা রাখে রিয়াজ। প্রথম প্রথম রাতে খাটিয়ায় শুয়ে দু চোখের পাতা বন্ধ করলেও কিছুতেই ঘুম আসতো না। নতুন জায়গা, তারপর একা থাকা। যাদের সাথে ওঠা বসা তারা সকলেই হিন্দীভাষী। হিন্দীটা আবার রিয়াজের খুব ভালো আসে না। সেকারণেই রিয়াজ কিছুটা সিঁটিয়ে থাকতো।   

ওদিকে মালদার রতুয়ায় বউ কুসুম তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে সংসার করছে। রিয়াজ যখন কাজের মাঝে থাকে বউ মেয়ের কথা ভুলে যায়। ভুলে না গিয়ে উপায়ও নেই। ছোট হাতুড়ি আর বাটালি দিয়ে কাঠের ওপর নকশা খোঁদাই শেষ হলে সরু বাটালি দিয়ে হাতের কব্জি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফিনিশ করা। খুব সুক্ষ কাজ! এদিক ওদিক হলেই মুশকিল।                

গাজোলের গ্রামের বাড়িতে রিয়াজের জীবনটা শুরু হয়েছিল অন্যভাবে। গ্রাম বাংলার চেহারা তখন সবে বদলাচ্ছে। কাঁচা রাস্তায় ফি বছর মোরাম বিছানো হচ্ছে। চাপাকল থেকে সবাই খাবার জল নিচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রামের ইস্কুল আট থেকে দশ ক্লাস হয়ে গেল। সরকার বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিলেও অভাবের সংসারে রিয়াজের পড়াশুনো ক্লাস এইট পর্যন্ত। ছোট থেকেই রিয়াজ ছবি আঁকতো খুব সুন্দর। পাশের গ্রামে মল্লিক বাড়ির ঠাকুর দালানে দুর্গা প্রতিমা তৈরী হোত। বন্ধুদের সাথে প্রায় দিনই সেখানে চলে যেত রিয়াজ। পটুয়ার প্রতিমা গড়ার কাজ খুব মন দিয়ে দেখতো। বাড়ি ফিরে কাগজের ওপর পেন্সিল দিয়ে চেষ্টা করতো প্রতিমার ছবি আঁকতে। ওর বয়স তখন পনের কি ষোল হবে, একটা কাঠের তক্তার ওপর পেরেক আর ধারালো ছুরি দিয়ে পদ্ম ফুল খোদাই করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। জহুরী জহর চেনে। রিয়াজের চাচা আজগর আলি।  পেশায় ছুতোর মিস্ত্রি। বড় কাঠ গোলায় কাজ করে। সেখানে রোজকার ব্যবহার্য আসবাব পত্র ছাড়াও রকমারি ডিজাইনের খাট আলমারি সৌখীন ফার্নিচার তৈরী হয়। কাঠের ওপর বাহারী নকশা ফুটিয়ে তুলতে বাইরে থেকে মিস্তিরি আসে। ওরা চুক্তিতে কাজ করে, কাজ শেষ হলে মজুরী নিয়ে চলে যায়। বাপ মা  মরা রিয়াজ নিজের লোক, ওকে কাঠ গোলায় লাগিয়ে দিলে কেমন হয়? তাছাড়া কাজ শিখতেও সময় লাগবে। শুরুতে জলপানি বাবদ কিছু পেলেই বা মন্দ কি! বাপের জমিতে চাষবাস করে খুব যে লাভ হবে না সেটা জানতো রিয়াজ। চাচার কথায় রাজী হয়ে যায়।  

খদ্দেরের পছন্দ করা ছবি দেখে কাঠের ওপর পেন্সিল দিয়ে মকশো করে তারপর বাটালি ঠুকে কাজ করে বড় মিস্তিরি। রিয়াজ মনযোগ সহকারে সেই কাজ দেখতে থাকে। মিস্তিরির ফরমায়েশ মতো এটা সেটা এগিয়ে দেয়। নকশা তৈরী শেষ হলে স্যান্ডপেপার দিয়ে ঘসা-মাজা করে রিয়াজ। মাস ছয়েকের মধ্যেই কাজের ধরণ বুঝে যায় রিয়াজ। বড় মিস্তিরিকে পেন্সিল দিয়ে মকশো করে দেয়া ছাড়াও কাঠের ওপর বাটালি দিয়ে ছোট খাট নকশা নিজেই ফুটিয়ে তুলতো। বছর দেড়েকের মধ্যেই গোলা মালিকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে রিয়াজ। প্রথম বছর পার হতেই জলপানি বেড়ে দ্বিগুণ, তার সাথে নকশার জন্য আলাদা মজুরী। প্রাপ্য সেই মজুরী বড় মিস্তিরির চাইতে কম হলেও খুশি হোত রিয়াজ। মজুরী কিছু কম হয় হোক, নিজের কাজের স্বীকৃতিটা তো পাচ্ছে!                                                       

এর পর রিয়াজকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি। গোলার মালিক থেকে খদ্দের, ওর হাতের কাজ দেখে সবাই খুব খুশি। জলপানির বদলে প্রতি মাসে মজুরী পাওয়া ছাড়াও রিয়াজের কাজে খুশি হয়ে বড়লোক খরিদ্দার দু একজন আলাদা করে বকশিসও দেন।

অন্যের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে! প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুপুরে রাম বিশ্বাসের খাবারের দোকানে টিফিন করতে বসেছে রিয়াজ। রাম বিশ্বাসের মেয়ে খাবারের থালা টেবিলে রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রিয়াজ চোখ তুলে তাকাতেই মুখ খোলে।                                                       

-বাবার কাছে শুনলাম আপনার হাতের কাজ খুব সুন্দর! কার থেকে শিখলেন?                

খেতে এসে মাঝে মাঝে মেয়েটিকে দেখলেও কোন দিন কথা হয়নি। স্বভাবতই লজ্জিত হয়ে ওঠে রিয়াজ। মুখে কিছু বলে না।                                                                

-আপনি তো বোবা নন! তাইলে কথার উত্তর দেন না কেন?                           

-না, মানে আপনি…..                                                                  

-আমি কুসুম। রামচন্দ্র বিশ্বাস আমার বাবা।                                                        

প্রথম আলাপেই কুসুমের সাথে ভালোবাসা তারপর বাড়ির অমতে বিয়ে। পাশাপাশি গ্রামে ভিন্ন জাতের দুই   পরিবারের বাস। ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে তুষের আগুন। অশান্তি আঁচ করতে পারে দুজনেই। গাজোলের ভিটে ছেড়ে রতুয়ায় এক কামরার বাসায় থিতু হয় কুসুম এবং রিয়াজ। কাজ জানা লোকের কাজ খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। রিয়াজের নতুন কাজের জায়গা অনেকটাই দূরে। সাইকেলে প্রায় এক ঘন্টার পথ। সব কিছু গুছিয়ে নিতে বেশি সময় লাগে নি। তবে এখানে মজুরী আগের থেকে কম। কাজের বহরও সেরকম নয়। বাসা ভাড়া দিয়ে নেয়ে খেয়ে দুজ়নের চলে যায়, হাতে প্রায় কিছুই থাকে না। বছর ঘুরতেই লক্ষীপুজোর দিন সংসারে আসে নতুন অতিথি। খুব আনন্দ হয়েছিল দুজনের। কুসুমের ইচ্ছেতে মেয়ের নাম রাখা হলো অংশী। অংশী নামের কি মানে জানতে চেয়েছিল রিয়াজ। কুসুম হেসে বলেছিলনামের মানে দিয়ে কি হবে! তোমার আর আমার দুজনের অংশ রয়েছে ওর মধ্যে, তাই নাম দিলাম অংশী। তুমি চাইলে ওকে অন্য নামে ডাকবে।  সেকেন্ডারী পাশ  কুসুম চিন্তা ভাবনায় রিয়াজের থেকে কিছুটা এগিয়ে। বউয়ের মুখে মেয়ের নামকরণের ব্যাখ্যা শুনে খুশিতে রিয়াজের মন ভরে যায়। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসার হার মানে ভালোবাসার কাছে। মেয়েটা তখন সবে হাঁটতে শিখেছে। মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সেলাই মেশিন কেনে কুসুম। ইস্কুলে পড়ার সময় সেলাই এবং মাপাজোকার কাজ শিখেছিল। বিয়ের আগেও বেশ কিছুদিন দরজির দোকানে মেয়েদের পোষাক তৈরী করেছে। মাস ছয়েকের মধ্যেই নিজের আয়ের জায়গা নিশ্চিত করে ফেলে  কুসুম। সংসারে নিজের রোজগারের কিছুটাতো দিতে পারছে, সেটাই বা কম কি!

একদিন সন্ধ্যেবেলায় রিয়াজের ছোট খালার ছেলে রফিকুল এসে হাজির রতুয়ার বাসায়। অনেকদিন পর দুজনের দেখা। রফিকুল কলেজ পাশ দিয়ে মুর্শিদাবাদে একটা নামী সিল্কশাড়ী তৈরীর অফিসে কাজ করে। অফিসের কাজে মাঝে মধ্যেই হিল্লি-দিল্লী করে বেড়ায়। বাড়তি টাকা রোজগার হয়। আলাদা কমিশনও পায়। রফিকুলের কাছেই গাজিয়াবাদের কাজের খোঁজ পায় রিয়াজ। ওখানে কাঠের ফার্নিচারের বড় এক  শোরুমে ডিজাইনের কাজ জানা লোক খুঁজছে। থাকা খাওয়ার খরচ মালিকের, মজুরীও অনেক দেবে। কুসুম আপত্তি করেছিল -এমনিতেই অনেক দূর, তার ওপর মেয়েটা ছোট।

-রতুয়ার বাসা থেকে মালদা হয়ে ট্রেন ধরে গাজিয়াবাদ যেতে আসতে দেড় থেকে দু দিন। এমন কি দূর? তোদের ভালো চাই তাই খোঁজ টা দিলাম। যাওয়া না যাওয়া তোদের ব্যাপার!

রফিকুলের কথায় ভরসা পায় রিয়াজ। গাজিয়াবাদের বিশাল ফার্নিচার শো-রুম। প্রথমবার দেখেই রিয়াজের মাথা ঘুরে যায়। শো-রুমের পাশেই লম্বা শেডের নীচে বিভিন্ন বয়সের মিস্তিরি কাজ করে। সবার যন্ত্রপাতি আলাদা আলাদা খোপে থাকে। রিয়াজের জন্য বরাদ্দ হলো ছোট একটা খোপ। শো-রুমের ভেতরে  একটা ঘরে একজন হিসাব পত্র লেখেন। মিস্তিরিরা সবাই ওকে নগদাবাবু বলে ডাকে। লোকটা যে খাঁটি বাঙালি রিয়াজ সেটা জানতে পারে প্রথম মাসের মজুরী হাতে পাওয়ার দিন। শরীরে যেন একটু বল পেল রিয়াজ, একজনকে তো অন্তত পাওয়া গেল। বিপদে আপদে এবং প্রয়োজনে দুটো কথা বলতে পারবে। মাস দুয়েকের মধ্যেই রিয়াজের কাজ সবার নজরে আসে। মালিক ভদ্রলোকও রিয়াজের কাজে খুশি। তবে প্রথম ছয় মাসের প্রাপ্য মজুরী থেকে প্রতি মাসে আড়াইশ টাকা বাদ যেত। রিয়াজকে নগদাবাবু জানায় ওটা এজেন্সী কমিশন, যাদের মাধ্যমে রিয়াজ কাজের খোঁজ পেয়েছে। কথাটা শুনে তাজ্জব বনে গিয়েছিল রিয়াজ। তুতোভাই রফিকুল এজেন্সীর লোক? কে জানে, সব ভেবে লাভ নেই! যুগ বদলাচ্ছে, কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। জাতভাই রফিকুল কিছু যদি পায় ক্ষতি কি! থাকা খাওয়ার খরচ নেই, মাস মজুরীও তো অনেক। বাড়তি খরচ হয় শুধু কুসুম আর অংশীর সাথে এস টি ডি বুথ থেকে ফোনের জন্য। সেও তো রোজ নয়। প্রথমবার মানি অর্ডারে টাকা হাতে পেয়ে কি খুশি যে কুসুম হয়েছিল! কথা যেন ফুরোতেই চায় না। রিয়াজকে সেদিন আঠাশ টাকা কলচার্জ দিতে হয়েছিল।        

শো-রুম এলাকার  দোকান পাট রবিবার বন্ধ থাকে তাই সেদিন মিস্তিরিদেরও ছুটি। পুজোর সময় দশেরা আর দেওয়ালিতে দুদিন করে ছুটি। পরের বছর দেওয়ালির ছুটির সাথে কয়েকদিন বাড়তি ছুটি নিয়ে  গ্রামের বাসায় এসেছিল রিয়াজ। জরুরী অনেক কাজের মধ্যে একটা ছিল ব্যাঙ্কে দুজনের নামে অ্যাকাউন্ট খোলা। মাসে মাসে রিয়াজের পাঠানো টাকা থেকে থোক কিছু টাকা আলাদা রেখে দিত কুসুম। ব্যাঙ্কে সেই টাকা জমা করে কুসুম খুব শান্তি পেয়েছিল।

মেয়েকে মানুষ করা ছাড়াও  ভবিষ্যতের চিন্তা, কুসুমকে যেন নতুন করে খুঁজে পায় রিয়াজ! আদর খুনসুটি আর সোহাগে হারিয়ে যায় দুজন -মেয়ে ইস্কুলে যাচ্ছে, দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাবে কুসুম। এবার তাহলে আসুক না আরেক জন ক্ষতি কি!

-খুব শখ হয়েছে দেখছি বাবুর! তাহলে এখানে চলে এলেই হয়। কথাগুলো বলে লজ্জায় বালিশে মুখ ঢাকে কুসুম। ইশারা বুঝতে পারে রিয়াজ। ওর পেশীবহুল দুই হাত এবং শরীরের সাথে মিশে যায় কুসুম।

মাঝের দিন গুলো যেন হুঁশ.. করে কেটে গেল। গাজিয়াবাদে ফিরে কিছুতেই কাজে মন লাগে না রিয়াজের। সব সময় বউ আর মেয়ের মুখ চোখে ভাসে। রিয়াজকে দেখে পাশ থেকে কাঠের ওপর ্যাঁদা ঘসতে ঘসতে মুচকি হেসে টিপ্পনি কাটে মিস্তিরি যোগিন্দার সিং। রিয়াজ আমল দেয় না, কালো পাথরের ওপর বাটালি শান দিতে দিতে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।

নতুন অতিথি সংসারে আসছে সেটা দু মাস পরেই বুঝেছিল কুসুম তবে রিয়াজকে জানায়ানি। সুখবরটা যেদিন শুনলো পারলে তক্ষুনি রতুয়ার বাসায় ফিরে আসে রিয়াজ। কিন্তু হুট করে যাব বললেই তো হয়না, হাত পা বাঁধা। খবরটা জানায় শুধু নগদাবাবুকে। রিয়াজের ইচ্ছে বাচ্চা হওয়ার আগে অথবা পরে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য যেন বাসায় আসতে পারে।

-কিছুতেই সেটা সম্ভব নয় রিয়াজ। তোমার জন্য আলাদা নিয়ম কি করে হবে? একান্তই যদি যেতে  চাও তাহলে যে কদিন কামাই করবে তার মজুরী কাটা যাবে। তবে খুব বেশি হলে দশ দিন। তার বেশি কিন্তু মালিক মানবে না।

নগদাবাবুর কথায় হতাশ হয় রিয়াজ। একটা করে মাস যায় রিয়াজের উদ্বেগ বাড়তে থাকে। চঞ্চল হয়ে ওঠে মন। তার আঁচ লাগে হাতের কাজে। মেয়েটা ছোট, কচি বাচ্চা নিয়ে কুসুম পারবে কি সব সামলাতে? রাতে চোখ বুজতে পারে না রিয়াজ, ক্রমশ অস্থির হয়ে ওঠে। হাতের কাজ জানা মিস্তিরির কাজের অভাব হবে না, দু পয়সা কম আর বেশি। কুসুমের তখন ভরা মাস, গাজিয়াবাদের কাজে জবাব দিয়ে রতুয়ার বাসায় ফিরে আসে রিয়াজ। না আসলে ভয়ানক বিপদ ছিল। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব হলেও অবিরাম রক্তক্ষরণে প্রাণ সংশয় হয়ে ওঠে কুসুমের। যমে মানুষে টানাটানি অবস্থা। হাল ছাড়ে না রিয়াজ। গাড়ি ভাড়া করে বাচ্চা সহ কুসুমকে নিয়ে সদর হাসপাতালে ছোটে। টানা তিন সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরে কুসুম। মেয়ের পরে ছেলে হওয়ায় বেজায় খুশি রিয়াজ। ছেলের  নাম দেয় আনীশ। কুসুম আদর করে ডাকে বাবলু সোনা। দুটো বাচ্চা মানুষ করা মুখের কথা নয়! তাছাড়া কুসুমকে বাঁচাতে ব্যাঙ্কে জমানো টাকায় হাত দিতে হয়েছে। নতুন একটা কাজ ধরে রিয়াজ, তবে সেটা চুক্তি ভিত্তিক। যেমন কাজ হবে তেমন পয়সা। মায়ের বুকের দুধ যে কদিন চলবে ঠিক আছে কিন্তু তারপর! রিয়াজের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে। একবার রফিকুলের কাছে গেলে কেমন হয়?

 দু দিনের চেষ্টায় রফিকুলের মুর্শিদাবাদের ঠিকানায় যোগাযোগ করে রিয়াজ। কিন্তু কোথায় রফিকুল! সে  এখন অনেক দূরে। জাহাজের প্যাকিং এজেন্সীর ব্যবসা খুলেছে বোম্বাই শহরে। বন্দর এলাকার পাশে কোথাও থাকে। বেশ কয়েকবার ওর নম্বরে ফোন করলেও ফোন ধরে নি রফিকুল। ব্যবসার কাজে ব্যস্ত, হয়তো সেকারণেই কথা বলার সময় নেই। রিয়াজের চেষ্টার খামতি নেই, সুযোগ পেলেই ফোন করে। সপ্তাহ দুই পরে ফোন ধরলেও রিয়াজকে খুব একটা আমল দেয় না রফিকুল। আপন খালার ছেলের এমন আচরণে কিছুটা অবাক হয় রিয়াজ। আবার ভাবে রফিকুল কি আর আগের মতো আছে! ব্যবসার কাজে হাজারো  ঝক্কি ঝামেলা থাকে। নিজেকে সান্ত্বনা দেয় রিয়াজ।

দিন তিনেক পরেই সন্ধ্যে নাগাদ রতুয়ার বাসার মালিকের ঘরে ফোন করে রফিকুল। নিশ্চয়ই কাজের খবর আছে! প্রবল উৎসাহ নিয়ে ফোন ধরে রিয়াজ। ফোনের টেবিলের পাশে বাড়ির মালিক বসে থাকায় দু জনের কথা হয় ভাব বাচ্যে। রিয়াজ ঘরে ফিরে এলে কি কথা হলো জানতে চায় কুসুম।    

-ভালো একটা কাজের খোঁজ আছে কুসুম। তবে সেটা দেশের বাইরে। আরব দেশ বুঝলে। কিন্তু ভালো খরচপাতি আছে। পাসপোর্ট, ভিসা করতে হবে। এজেন্সি কমিশন তারপর প্লেনের টিকিট, সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা।                 

-এত টাকা কোথায় পাবে তুমি? দরকার নেই ওসবের। কটা মাস যেতে দাও না, আমি সেলাই মেশিনে বসতে পারলে অনেক কাজ পাবো। এটা সেটা করে ঠিক চালিয়ে নেব।

-এখন আশি হাজার দিলেই হবে কুসুম! বাকীটা রফিকুল ওর এজেন্সী থেকে দেবে। আমার মাস মাইনের টাকা ওর কাছেই জমা হবে। প্রতি মাসে কিছু কিছু করে সেটা শোধ হয়ে যাবে। বাকী টাকা প্রতি মাসে আমাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে রফিকুল পাঠিয়ে দেবে। প্রচুর টাকা মাইনে দেবে। তিন চার বছর কাজ করতে পারলে জীবন বদলে যাবে কুসুম!

এদিক ওদিক করে টাকা জোগার হলেও ঘর সংসার ফেলে বিদেশে অতদূর যাবে! কসুম রাজী হয়না, কিন্তু রিয়াজ নাছোড়। দুই বাচ্চা নিয়ে কুসুম রইলো রতুয়ার বাসায়। রিয়াজ উড়ে গেল আকাশ পথে।

আরব দেশে রিয়াজের শুরুটা বেশ ভালই হয়েছিল। ওদেশে কাজ জানা লোক বিশেষ করে হাতের কাজ জানা লোক নেই বললেই চলে। সেই ফাঁক পুষিয়ে দিচ্ছে অন্যরা। রিয়াজ সেই অনেক অন্যদের মধ্যে একজন। ওদেশে টাকার ছড়াছড়ি। কাজ করো দম লাগাও টাকা কামাও। এই পোড়া দেশে  প্রদীপের ওপরে আলো, নীচে অন্ধকার। ভরা প্রদীপের তেল চুঁইয়ে পড়লে চেটেপুটে খাওয়া  রেওয়াজ। সেই অর্থে ওদেশে প্রদীপের আলো টিমটিম করে জ্বলে না, ঝলমলে থাকে সর্বক্ষণ। এক আশ্চর্য মায়াবী আলোয় ডুবে থাকে গোটা দেশ। সেই আলো ফিকে হয় না কখনও। প্রথম দশ মাসেই রফিকুলের এজেন্সীর টাকা শোধ হয়ে যায়। মাস গেলে রতুয়ায় রিয়াজের অ্যাকাউন্টে নিয়ম করে যে পরিমাণ টাকা ঢুকছে তা দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সংসার চালাতে পারলেও কুসুম খরচে লাগাম টানে। মানুষটা খুব খাটছে, তার কথাও তো ভাবতে হয়!

কিন্তু বছর দুই পরে যা ঘটলো তা ভাবনার অতীত। এক অজ্ঞাত কারণে রফিকুলের সাথে রিয়াজ যেখানে কাজ করে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হলো। কর্মহীন হয়ে গেল রিয়াজ। দিন গুজরান কিভাবে হবে ঠিক নেই। দেশে ফেরা দূর অস্ত। পরের পর দু মাস ব্যাঙ্কে টাকা না ঢোকায় প্রমাদ গোণে কুসুম। রফিকুলের নাম্বারে ফোন লাগছে না। মুর্শিদাবাদের ঠিকানায় খোঁজ করে জানা গেল রফিকুল বেপাত্তা। বেঁচে আছে না মরেছে কেউ জানে না। কিন্তু রিয়াজ কেমন আছে কি করছে সেই ভাবনায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে কুসুম!

জীবনে এমন দিন আসবে কে জানতো! একসঙ্গে অনেক টাকার হাতছানি। রিয়াজ বুঝতে পারেনি।   অনেক! অনেক টাকা, যা কোনদিন রিয়াজ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কুসুমের নিষেধ শুনলে হয়তো এমন হোত না। বেঁচে থাকার তাগিদে এক রেস্তোরায় পাসপোর্ট জমা রেখে এঁটো বাসন মাজা ধোয়ার কাজে লাগে রিয়াজ। সেখান থেকেই দেশে ফেরার এক চিলতে আলোর খোঁজ পায়। কিন্তু সেই আলোর পরশ পেতে চরম মূল্য দিতে হয় রিয়াজকে।

রতুয়ার বাসায় বউ আর দুই সন্তানের মাঝে যে ফিরে আসতে পারবে সেই আশা রিয়াজ ছেড়েই দিয়েছিল। ঘটনা যে শুধু রিয়াজের তা নয় আরও অনেকের। নাটের গুরু সেই রফিকুল। আরব দেশে কাজের নামে লোক পাঠানোর পিছনে ওর ছিল অন্য ধান্দা। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে ঘরে ফিরেছে বটে রিয়াজ। কিন্তু খুইয়ে এসেছে শরীরের অত্যন্ত মূল্যবান একটি অঙ্গ। রিয়াজের একটি কিডনি নেই। শরীরও ভেঙেছে অনেকটাই। আসলে শরীরের থেকে মন ভেঙেছে বেশি। দিনের আলোতেও যেন চোখেমুখে অন্ধকার দেখে রিয়াজ। মেয়ে অংশী কাছে আসলেও ছেলেটা আসে না।

কুসুম ছেলেকে এগিয়ে দেয় -যাও বাবলু সোনা কাছে যাও। তোমার বাবা উনি, কাছে যাও সোনা।

রিয়াজের আনীশ, কুসুমের বাবলু সোনা মাথা নিচু করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের মেঝেতে ওর দুচোখ থেকে জলের ফোটা পড়তে থাকে। দু হাতে বুক চাপড়ে ছেলেকে কাছে টানতে গিয়ে থমকে যায় রিয়াজ। পেটের বাঁদিক থেকে পিছনের দিকে পিঠ পর্যন্ত অসহ্য ব্যথা। ক্ষতের সেলাইয়ের জায়গাটা শুকিয়ে যেতে আরও সময় লাগবে? গলার স্বর ভেঙে আসে রিয়াজের। ভাঙা গলায় কাঁদতে চায় কিন্তু পারে না। ভাঙা চোরা স্বপ্ন নিয়ে কি বাঁচা যায়? রিয়াজের চারপাশে শুধুই শূন্যতা!       



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন