জলধি / গল্প / বেঙ্গল মিট
Share:
বেঙ্গল মিট

দুপুরটা যেন কেমন হয়ে গেলো। লিফটের দরজাটা খুলে যেতেই সিকিউরিটি গার্ড বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা  প্যাকেটের মতো দেখতে ভারি বস্তার মুখবাঁধা অংশটুকু দু’হাতে ধ’রে এমন এক হ্যাঁচকা টান মারলো, পারলে যেন বস্তার উঁচু ঝুঁটি ধরে একটানে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় লিফটে ঢোকানোর আগেই শাজিয়া দৃষ্টি নিচু করে উৎকন্ঠিত হয়ে এদিক-সেদিক কী যেন খোঁজে সাদা রঙের প্যাকেটটা গায়েব কাপড়ের শপিং ব্যাগটা কোথায়! ‘আর কোনো প্যাকেট ছিলো না তো’— বলে লিফটের ভেতরে এক পা আর বাইরে আরেক পা রেখে সিকিউরিটি গার্ড মোমেন চোখের দৃষ্টিটা আরো প্রসারিত ক’রে চারপাশটা দ্যাখে। কোনো ধরনের সাদা প্যাকেট নেই ওর দু’হাতের মুঠিতে তখনও পঁচিশ কেজি ওজনের বস্তার ঝুঁটি ধরা। বস্তার গায়ে বড়ো করে লেখা মুনজুর স্পেশাল চিনিগুঁড়া চাউল’; ওপরের দিকে ছোটো করে লেখা বাবুর্চিদের একমাত্র পছন্দবস্তাটা পাটের না, প্লাস্টিকের। এতে অবশ্য চাল নেইঅন্যকিছু।

  

শাজিয়ার মুখ পরিশ্রমে তেলতেলে, রোদে সামান্য তাপাহতসময়টা ভরদুপুর হলেও রোদটা নরম ফলে মোহাম্মদপুরের বাতাসে হালকা গরম ক’দিন ধরেই বৃষ্টি হবে-হবে এমন অনুভব মার্চের শেষ দিনগুলোকে আরামদায়ক করে রেখেছে। তবুও মুখের ওপর ঘামের আভাস। ওড়নার প্রান্তটা একবার কপালে আরেকবার বাঁ-গালে চেপে ধরলে, সুতি কাপড় আলগা ঘামটুকু শুষে নেয়। তবু স্বস্তি পায় না শাজিয়া— দুই কেজি গরুর মাংস আর আধ কেজি চিকেন প্রিমিয়াম কিমা এই বাজারে যথেষ্ট মূল্যবান। কিমা পরে কিনলেও চলতো। রোজার ঈদের আরো কিছু দিন বাকি আছে কাজের চাপ কমানোর জন্য শাজিয়া ভেবেছিলো, কিমা’র পুর দিয়ে আলুর চপ বানিয়ে ডীপ ফ্রিজে তুলে রাখবে। কিমাসহ সেই মাংসের ব্যাগ আচমকা লাপাত্তা!  

‘বস্তার পাশেই তো ব্যাগ থাকার কথা’ কথাটা কানে যেতেই, টাকা গুনতে গুনতে, কিছু একটা গণ্ডগোল অনুমান করে লিফটের সামনে এগিয়ে আসে কেয়ারটেকার আজাদ। কিছুক্ষণ আগে রিকশা থেকে বস্তাটা সে-ই নামিয়েছিলো। ঝাড়ুদার, ক্লিনার, রঙমিস্ত্রিও উঁকি দিয়ে ভিড় বাড়ায়। জুম্মার নামাজ শেষে পাঞ্জাবী-পায়জামা পরা কিশোর-যুবক আর বয়সী পুরুষরা লিফটের অপেক্ষায় আশেপাশে দাঁড়িয়েভিড়ের মধ্যে তারাও শামিল। রিকশা থেকে শুধু বস্তাটাই আজাদ নামিয়েছে; আর কোনো শপিং ব্যাগ সেখানে ছিলো না। শাজিয়া বিরক্ত হয় এবং স্পষ্ট মনে করতে পারে, সে ব্যাগ হাতে নিয়ে রিকশায় উঠে পায়ের কাছেই রেখেছিলো। পাশে বস্তাটা তুলে দিয়েছিলো বিসমিল্লাহ ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ছেলেটা। ব্যাগটা রাস্তায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আড়াই কেজির প্যাকেট পড়ে গেলে দুনিয়াসুদ্ধ মানুষের টের পাওয়ার কথা। হতে পারে ভুল করে সে ব্যাগটা বিসমিল্লাহ-তে রেখে এসেছে। আরেকটা সম্ভাবনার কথা মনে হতেই পীড়াদায়ক অস্বস্তি শুরু হয় শাজিয়ার— রিকশাওয়ালা হয়তো প্যাকেটটা নিয়ে গেছে। এতোগুলো চোখের সামনে দিনে-দুপুরে এ রকম অন্যায়! শাজিয়ার মনের ভেতর স্থির-নিরিবিলি জায়গাটার মাটি ফুঁড়ে দুঃখ আর রাগের মিশ্র অনুভব বেরিয়ে আসে। এটা মানতে অসুবিধা হয় যে রিকশাওয়ালা তাকে ঠকিয়েছে। 

          

আজ নামার সময় শাজিয়া জন-মানুষহীন খালি লিফটে মৃদু সুবাস পেয়েছিলোহাওয়ায় অজান্তে সুঘ্রাণ রেখে কেউ হয়তো নেমে গেছে কিংবা উঠে গেছে ব্যবহৃত আতরটি যে দামী ছিলো, বেশ বোঝা যায়শাজিয়ার অবশ্য ‘বেঙ্গল  মিট’ এ যাওয়ার কথা ছিলো না। টাটকা সবজি আর মাছ-মাংস কেনার দায়িত্বটা উপভোগ করে নাফিউল। টাউন-হলে বাজার করার সময় ওর মাথার ভেতর নানান বিষয়ের পারমুটেশান কম্বিনেশান চলতে থাকেপরিবারের কার কী পছন্দ সে বিষয়টা মনে রেখে, কোন তরকারির সঙ্গে কোন মাছের অবিরোধ, বড়ো-ছোটো-মাঝারি মাছ কেনা আর না-কেনার বোঝাপড়া, এইসব মাছ-মাংস আর সবজির পক্ষে ফ্রিজের ভেতর জায়গা করে উঠতে পারা— সবকিছু মিলিয়ে এ এক রীতিমতো জটিল সমন্বয়ের ব্যাপার বাজার করতে করতে পণ্যের দাম, সরবরাহ, চাহিদা, ক্রেতা-বিক্রেতার মনস্তত্ত্বের হাল-হকিকত নাফিউলের জানা হয়ে যায় ভেবে পায় না বাজার প্রতিযোগিতার এন্ডলেস ম্যারাথন কোথায় গিয়ে থামবে, আদৌ যদি থামে! শুধু বাজেটের সঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিসপাতির দামের ভারসাম্য রাখাটাই দিন- দিন কঠিন হয়ে যায় এইসব মিলমিশের হ্যাপা এড়ানোর জন্যই পারত পক্ষে শাজিয়া বাজারমুখো হয় না। কাঁচা-বাজার যদি-বা চলে কিন্তু কানকোয় লালিমার তারতম্য দেখে তাজা মাছ চেনা কিংবা মাংসের কাটা টুকরা দেখে সিনা আর রানের মাংসের মধ্যে তফাৎ করা— কোনোটিতেই সে তেমন সুবিধা করে উঠতে পারে না। নাফিউলের জন্মদিন আজ স্ত্রীর হাতে বিশেষ রেসিপি’র বিফ-ভুনা তার প্রিয় এবং এমন একটা সারপ্রাইজ সে আজ পেতেই পারে এই বাড়িতে জন্মদিনের আয়োজন বিশেষ রান্না আর ছোটোখাটো উপহারে সীমিত। মেয়েরা জন্মদিনের কেক আর ক্যান্ডেল নিয়ে আসে। শাজিয়া-নাফিউলের সদ্য কৈশোরে পা-দেয়া আইডেন্টিক্যাল যমজ মেয়েরা টপ্পা আর টোড়ি— নিজেদের জন্মদিন কাটায় বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে হুলস্থুল আড্ডায়। অবস্থা বুঝে কখনো ঘরে, কখনো বাইরে পকেটের ওজন মেপে সেই মতো শেফ’স টেবলে জাপানী সুশি-ডাম্পলিং কিংবা তিনশ ফিটের নীলা মার্কেটে হাঁসের মাংস দিয়ে চিতই আর গরম গরম মিষ্টিতে রসনা-বিলাসে চলে সপ্রাণ উদযাপন।

 

নাফিউলের জন্মদিনে বাজারের ঝামেলায় না গিয়ে ‘বেঙ্গল মিট’-এর দিকেই গেলো শাজিয়াকেজি প্রতি শ’খানেক টাকা বেশি নিলেও বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র আন্তর্জাতিকমানের মাংসের দোকানে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই ব্যস্ত রাস্তাটা তখন নিরিবিলি। দু-একটা রিকশা গাড়ি আসে যায়। হেঁটেই যাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সোজা মেইন রোড পার হয়ে যায় শাজিয়া।

মাংসের দোকানে তেমন ভিড় নেই মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো বোরকায় আবৃত ছোটোখাটো গড়নের একজন তরুণী পুরো দোকান সামলাচ্ছে। আগে এখানে সেলসগার্ল দেখেনি শাজিয়া। একজন ক্রেতার জন্য দক্ষ হাতে পলিথিনে মাংস র‍্যাপ করতে করতে সে আরেকজন ক্রেতার প্রশ্নের উত্তর দেয় শাজিয়া কোনো কথা না বলে ডিসপ্লেতে রাখা টি-বোন স্টেকের মাংস কলিজা পায়া মাটন শ্যাঙ্ক চিকেন উইংস আর ফিলে দ্যাখেমাংসের ট্রেতে রাখা ট্যাগ ধরে ধরে নাম পড়ে আর দাম মিলিয়ে নেয়কুলার আর ফ্রিজারে কোল্ড কাট সসেজ চিকেন নাগেট ড্রামস্টিক বিফ কলিজার সিঙ্গারার আইটেমগুলোয় চোখ বুলিয়ে যায়মেয়েটা বিলিং মেশিনে কার্ড ঢুকিয়ে কী-প্যাড চেপে চেপে টাকার অঙ্ক বসায় তারপর পাসওয়ার্ডের জন্য ক্রেতার হাতে মেশিন ধরিয়ে দিয়ে শাজিয়ার দিকে তাকায়। অপরাধীর ভঙ্গিতে লাজুক হেসে বলে— সবাই নামাজ পড়তে গেছে তো তাই আমি একা। আর কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে। এই প্রথম মেয়েটার দিকে  ভালো করে তাকায় শাজিয়া। মুখের ভেতর বাঁ-দিকে একটা গ্যাজ-দাঁত চেহারায় লাবণ্য এনে দিয়েছে। মেয়েটার কথা শুনে শাজিয়ার মনে পড়ে আজ ‘জামাতুল বিদা’— রমজান মাসের শেষ শুক্রবার। সেজন্যই ভেতরে বাইরে এই সময়ে এতোটা ফাঁকামেয়েটা দু’কেজি গরুর মাংস আর মুরগির কিমা আলাদাভাবে র‍্যাপিং ক’রে ‘বেঙ্গল মিট’ লেখা সাদা ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়। দোকান থেকে বেরিয়ে আলু আর পেঁয়াজের জন্য বিসমিল্লাহ স্টোরের দিকে রিকশা ঠিক করে শাজিয়া।

 

নাফিউলের স্বাদগ্রন্থিগুলো শাজিয়ার ক্যারিজম্যাটিক রান্নায় উজ্জীবিত হয়বিশেষ করে সেটা যদি হয় কষানো মাংস, দেশি মুরগির রোস্ট আর মটরশুঁটি-পোলাও শুধু কষানোর সময় ধোঁয়ার ঝাঁজটুকু  কিচেনহুড ফাঁকি দিয়ে এদিক ওদিক হয়ে নাফিউলের নাসারন্ধ্রকে দারুণ জব্দ করে হেঁচে-কেশে তখন চারপাশটা নাজেহাল হয়ে যায় টপ্পা আর টোড়ি সবজি খেতে চায় না দুজনের অবস্থান ভাত থেকে একটু দূরেই ওদের আঙুলে চপস্টিক নড়ে ওঠে রামেনে কিংবা সসেজে-নাগেটে বিফ-ভুনা দিয়ে ওরা পরোটার পর পরোটা খেয়ে, মায়ের রান্নার তুল্য আর কিছু খুঁজে পায় না ‘স্বাদ--ম্যাজিক!’ ব’লে মেয়েরা তৃপ্তির  হাসি হেসে তাদের ঘরে চলে যায় ম্যাজিক না ছাই! মনে মনে  হাসে শাজিয়া। টপ্পা ইদানিং শ্রেণিসচেতন ও রুচিসচেতন সে জেনেছে নিধুবাবুরটপ্পাআদিতে পাঞ্জাবের উটচালকদের গান হলেও ধ্রুপদী সংগীতে খেয়ালের পরেই তার স্থান এ গান প্রণয়মূলক তাই রান্নার আগে প্রাণিজ আমিষের আঁশ-রক্ত-চর্বি ধুয়ে দেয়ার জন্য মায়ের অনুরোধ রাখতে টপ্পা অপারগএমন অপছন্দের কাজ সে করতেই পারে না টোড়ি একই সঙ্গে চিন্তাশীল আর ঘোরগ্রস্ত যেন বীণা হাতে গহিন অরণ্যে গান গাইছে কোনো কোমলতমা তাকে ঘিরে মুগ্ধতায় হরিণশাবকরা শুনছে ধ্রুপদী ঠাট তাই মাংস কাটাকাটির সময় ডাক পড়লে টোড়ি বেঁকে বসে, সুরমাধুর্যহীন কাজে তার ঘোর অনীহা দুবোনেরই অন্যরকম কিছু হওয়ার ইচ্ছা খুব টোড়ির আঁকার হাত ভালো। রিসাইক্লিং আর্টিস্ট হতে চায় সে ঘরে-বাইরে প্লাস্টিকের বোতল, পুরনো কাপড়, কাঠের টুকরা, সিগারেটের শূন্যগর্ভ প্যাকেট থেকে শুরু করে ফেলা দেয়া যে কোনও জিনিসই ওর আর্ট মেটেরিয়েলস্‌ একটা দারুণ পেইন্টেড ল্যাম্প বানিয়ে শাজিয়াকে চমকে দিয়েছে টোড়ি টপ্পা চায় মেটাল ওয়েল্ডিং শিখে জুয়েলারি অন্ট্রাপ্রেনার হতে গয়নার নিজস্ব ব্র্যান্ড শুরু করবে সে অনলাইন আর অফলাইনে ইউনিক কিন্তু ট্রেন্ডি কালেকশান বিক্রি করবে টার্গেট ক্রেতাদের কাছে মেয়েদের মুখে এমন অনিশ্চিয়তায় ভরা, স্থায়িত্বহীন ক্যারিয়ারের কথা শুনে শাজিয়ার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়— প্যাশান থাকতেই পারে, তাই বলে পেশা? তবু মনে মনে স্বীকার না করে পারে নাভাবনাগুলো সৃষ্টিছাড়া হলেও ওদের চামড়ার নিচে রক্তের ভেতর সৃষ্টিধারা বইছে  

        

টপ্পা আর টোড়ির নাম রেখেছিলো তাদের ফুপুজীদিলনাশিহ বেগমমধ্য ষাটেও যার গানের গলার কারুকাজ মুক্তার একেকটি দানার মতো স্নিগ্ধ দ্যুতি ছড়াতো শাস্ত্রীয় সংগীতে কেবলই হাতে নাড়া  বেঁধেছিলেন কিন্তু পরহেজগার বাবার ইচ্ছা ছিলো না মেয়ে গান শিখুক শিল্পী মেয়ের মনের গতিবিধি বুঝতে পেরে বিয়ের জন্য চাপাচাপি না ক’রে তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন দিলনাশিহ বেগম দীর্ঘকায়-মাখনরঙা-মোলায়েম গুণগ্রাহী ছিলো বিস্তর কিন্তু সংসারে থেকেও তিনি ছিলেন বৈরাগ্যে, সাধিকার সত্তায় গৃহী হয়ে বস্তুগত কোনো আকাঙ্ক্ষা তার ছিলো না। রান্নার হাতটি পেয়েছিলেন দাদী-আম্মার কাছ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দিলনাশিহ বেগম হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল বুলিয়ে গুনগুন করে গেছেন নিঃশব্দে গলা-সাধা গেলে হয়তো বিখ্যাত গাইয়ে হতেন ভাই-বোনের কারো ঘরে ছেলে-মেয়ে হলেই সদ্যজাতকে কোলে নিয়ে তিনি যে নামে ডাকতেন, পরে সেটাই ডাক-নাম হয়ে যেতো নামগুলো সবই ছিলো সংগীতজাত তিন ভাইয়ের স্ত্রীদের মধ্যে শুধু শাজিয়া সুরময়ী সুরেলা গলার জন্য যে কেউ তাকে ভালোবাসতে পারে, দিলনাশিহ বেগমকে না দেখলে শাজিয়া বিশ্বাস করতো না মৃত্যুর আগে  দিলনাশিহ বেগম তাকে দুটো গোলাপ-বালা আর সাত-মশলার আফগানি কাবাব প্ল্যাটারের গোপন রেসিপি দিয়ে গেছেন, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী বনেদিয়ানা। কাবাবের রহস্য আসলে লুকিয়ে আছে মশলামিশ্রিত পেঁয়াজ-লেবুর রসে মাখিয়ে অন্তত ২৪ ঘণ্টা মাংস রেখে দেয়ায়এতে মশলার সবটুকু স্বাদ মাংস শুষে নেয় প্রতিবছর দিলনাশিহ বেগমের মৃত্যুবার্ষিকীর একদিন আগে থেকে এই কাবাব বানানোর  প্রক্রিয়া শুরু করে শাজিয়া। শিকবিদ্ধ মাংস কাঠ-কয়লায় গ্রিল করতে গিয়ে টের পায়, শিখিয়ে দেয়া রান্নার নানানতুকতাক প্রয়োগ দেখে জীবনের ওপারে তিনি নিশ্চিত খুশি হয়ে যান! দিলনাশিহ বেগমের গোলাপ-বালা জোড়া ব্যাংকের লকারে রেখে দিয়েছে শাজিয়া। একটা টোড়ি আর আরেকটা টপ্পার জন্য কতোদিন ভেবেছে, মেয়েদের বলে রাখবে সাবেকী নকশার বালা দুটো যেন না ভাঙে, বলা হয়নি

          

আজিজ মহল্লার বিসমিল্লাহ স্টোরের সামনে মামুন ব্যাপারী আর নতুন ছেলেটা যখন দোকানের ঠিক বাইরে ঝুলন্ত সান চিপস আর শ্যাম্পুর স্যাশের নিচে সাজিয়ে রাখা চিড়ার প্যাকেট আর মসুর ডালের বস্তার পাশে  খেজুরভরা কাগজের কার্টনগুলো সাগরের মতো বিস্তৃত নীল রঙের পলিথিন মেলে ঢেকে দিচ্ছে, শাজিয়ার রিকশাটা দোকানের সিঁড়ির গা-ঘেঁষে থামলো মামুন শাজিয়াকে দেখেই পলিথিন তুলে ফেলে একগাল হেসে বলেআপনে দশ মিনিট বসেন, আপা নামাজটা পইড়া আসি শাজিয়া বসবে নাকি চলে যাবে ঠিক করতে পারে না রান্নার সহযোগী শেফালি তার ফেরার অপেক্ষায় বসে আছে এক মিনিটও এখন অনেকটা সময় ইফতারের বেগুনি-পেঁয়াজুসহ যাবতীয় ভাজাভাজি বিকালেই শুরু করতে হবে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে শাজিয়া মামুন এগিয়ে এসে শাজিয়ার বসার জন্য ছেলেটাকে টুল দিতে বলে তারপর অপূর্ব বিনয়ী চোখে তাকিয়ে থাকেআপনেও নামাজের সো’য়াব পাইবেন খোলা দোকানে টুলের ওপর বসে দুজনের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শাজিয়ার মনে হয়— না বসলেও চলতো মাংসের ব্যাগটা সিমেন্টের মেঝেতে রেখে আলগাভাবে হাতল ধরে বসে থাকে শাজিয়া এমন বাসন্তী দুপুরে হালকা রোদের বাতাসে খুতবা ভাসছে এতো দূর থেকে বয়ান বোঝা যায় না, সুরটুকু শুধু শোনা যায় কর্মব্যস্ত ঠাসাঠাসির বাজার এখন শান্ত; যেন ঘুম-ঘুম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে নিশ্চল, শুনশান।  

বিপরীত দিকে রাস্তার ওপাশে সারি সারি কেমন ভঙ্গুর ধূলি-ধূসর সব দোকান নিউ ধানসিঁড়ি টেইলার্স অ্যান্ড ফেব্রিক্স দোকানটা খোলা থাকলেও অন্ধকার ছাওয়া আবছা ভেতরটায় কিছু দেখা যায় না শহীদ মিনি হোটেলের সামনে রাস্তার ওপর চুলা-চাক্কির টেবিল পেতে ইফতার বানানোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে পাশে আহরণ লাইব্রেরির ভেতর বই-খাতা-কলম আর যাবতীয় স্টেশনারি সাজিয়ে রাখা না দেখেও বলা যায় সবকিছুর ওপর একপ্রস্থ ধূলা-বালি পড়ে আছে দেয়াল থেকে বইয়ের আলমারির ফাঁকটুকুতে মাকড়শার জাল লটকে আছে নরম সুতার মতোদেখতে দেখতে শাজিয়ার চোখ নরম নিদ্রালু হয়ে যায়। শরীরের ভেতর দিয়ে গড়াতে গড়াতে ক্লান্তি নেমে আসে

  

তেহারি ঘরের দিক থেকে হেলতে দুলতে নতুন ছেলেটা দোকানে এসে হাজির পেছন পেছন সদা হাস্যময় মামুন ব্যাপারী এতোটা সময় কোন ফোঁকর গলে বেরিয়ে গেলো শাজিয়া বুঝতে পারে না এবার ভিড়  বাড়ার আগেই তাড়া দেয় মামুনকে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মুদি-মালামাল নিয়ে ঘরমুখো হতে চায় শাজিয়া জলদি ফিরতে পারলে বাঁচে, সব মিলিয়ে এখানেই প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় চলে গেলো অটো- রিকশা ডেকে বস্তাটা তুলে দেয় দোকানের ছেলেটা ওয়ালেট খুলতে গিয়েও শাজিয়ার হাত থেমে যায় দু’দিন পর ঈদের বাজার করার সময় ছেলেটাকে বাড়তি কিছু টাকা বকশিস দিলে বরং ওর ঈদটা সুন্দর হবে  

আজিজ মহল্লা থেকে বেরিয়ে মূল রাস্তায় ওঠার আগেই রিকশার চাকা থেমে গেলো শাজিয়ার সামনে দিয়ে গর্জনশীল বিশাল লম্বা এক মিছিল বয়ে চলছে প্রায় সবার পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি মিছিলের সামনে মাইক থেকে দেয়া শ্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে মিছিলের হাজারো মানুষ মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলছেভেঙ্গে দাও, গুঁড়িয়ে দাওশাজিয়া কান খাড়া করেও কিছু বুঝতে পারে নাকী ভেঙ্গে-গুঁড়িয়ে দিতে হবে? চলিষ্ণু মিছিলের পিছু পিছু শাজিয়ার রিকশা এগিয়ে যায় মিছিলে একজন দু’হাত উঁচু করে প্ল্যাকার্ড মতো একটা কাগজ ধরে হাঁটছে দূর থেকে কাগজের অপর পিঠে উল্টো করে ফুটে ওঠা ছাপ পড়ার চেষ্টা করে শাজিয়া  ইংরেজিতে লেখাসেইভ প্যালেস্টাইন জুম্মার নামাজের পর মুসল্লীরা মিছিল নিয়ে বেরিয়েছে মুহূর্তেই শ্লোগানটা বুঝে ফেলে শাজিয়াইসরায়েলের আস্তানা, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও নাফিউল পত্রিকা পড়ে বলছিলো যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল দুইশশিশুসহ কয়েকশ’ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করার প্রতিবাদে বিভিন্ন দেশে মার্কিন দূতাবাসের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে শাজিয়া আশ্চর্য হয়েছিলো— জেরুজালেমে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে ইসরায়েলিরা গাজায় যুদ্ধ-বিরতি চালু রাখা আর হামাসের হাত থেকে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা বাকি জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ওপর ক্ষিপ্ত ইসরায়েলের হাজার হাজার নাগরিক শাজিয়া চুপ করে আছে দেখে নাফিউল আর কিছু না ব’লে খবরের কাগজ পড়ায় মন দেয়

  

রিকশা চলছে থেমে থেমে দূর থেকে নিজেদের হাউজিং দেখতে পায় শাজিয়া। পাঁচ তলার বারান্দায় শেফালি দাঁড়িয়ে আছে। বাগানবিলাসের গাঢ় ম্যাজেন্টা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের পাশে ওর মুখখানি অস্পষ্টভাবে বোঝা যায় মিছিলের আওয়াজ শুনে দেখতে এসেছেদু’মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে সে ফিরে যায়  

এইটুকু পথ অথচ মিনিট দশেক লেগে যাবে হয়তো— অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে বরাবরই যেমন শাজিয়ার দেরি হয়ে যায়। ভারী ব্যাগ-বস্তা হাতে নিয়ে হেঁটে চলে আসা সম্ভব না। মিছিল সোজা না গিয়ে হাউজিংয়ের সামনে দিয়ে মোড় ঘুরে যাওয়ায় সময় কিছুটা বেঁচে গেলো। রিকশায় বাঁ-হাতে হুড ধরে ব’সে থাকে শাজিয়া— সেই দূরদেশের মতো এদেশেও তো শিশুরা নিরাপদে নেই; সুযোগ পেলেই নারী আর শিশুদের খুবলে খায় পুরুষপিশাচদেশ কেমন যেন অগোছালো, মানুষ স্বস্তিতে নেইদেয়ালে আঁকা রঙিন গ্রাফিতির দিকে তাকায় শাজিয়া। ‘নয়া বন্দোবস্ত’ আর কবে হবে কে জানে! দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে যায় দুশ্চিন্তায় ম্রিয়মাণ ফুসফুস থেকে পৃথিবী গভীর জটিল অসুখে ভুগছে। ক্রমশ উন্মত্ত, উপশম অজানা। সব ধর্মেই আছে প্রলয়ের কথাশেষ দিনটিতে ‘ধ্বংস’ শব্দটি কার্যকর হবেবিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিনাশ হয়ে গেলেও আত্মা অবিনশ্বরপুনরুত্থান আর পুনর্জন্মসৃষ্টির ধ্বংস হয়ে যাওয়া শুধু অন্তই নয়, পুনরাবৃত্তির সূচনাও।  বিড়বিড় করে শাজিয়া— ‘দিস ইজ দ্যা ওয়ে দ্যা ওয়ার্ল্ড এন্ডস/ নট উইথ দ্যা ব্যাং বাট আ হুইম্পার...’  

   

রিকশা দেখে কেয়ারটেকার আজাদ এগিয়ে এসে বস্তা নামায়। প্রতিবছর রমজান মাসে শাজিয়া এই হাউজিংয়ের স্টাফদের একদিন ইফতার করার টাকা দেয়। এবারই টাকা দিতে দেরি হয়ে গেলো। ভাড়া মিটিয়ে ছোটো ওয়ালেটটা হাতেই রাখে শাজিয়া। লিফটের বাঁ-দিকে কাউন্টারে বসা আজাদকে ইফতার  আর ঈদী বাবদ কিছু টাকা বুঝিয়ে দিয়ে রেজিস্ট্রি খাতায় সিগনেচার দেয়আজাদ বলে— ম্যাডাম, সব সময় ইফতার করান এইবার সেহরি করানচারপাশের সবাই আবদারে-জবরদস্তিতে নিজেরটা এতো বুঝে নেয় যে ক্লান্ত লাগে শাজিয়ার। মানুষ মনে হয় আজকাল আর তৃপ্ত হতেই চায় না। লিফটের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে শাজিয়া এক সপ্তাহ ধরে দুধওয়ালা, পেপারওয়ালা, লন্ড্রিওয়ালা, ময়লাওয়ালা সবাই হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। ঈদের খরচ বাবদ শাজিয়াকে যে পরিমাণ টাকা দেয় নাফিউল, ওর পক্ষে আর কতো জনকে কতোটুকুই-বা দেয়া সম্ভব! লিফট চলে এলে সিকিউরিটি গার্ড মোমেন ভারি বস্তাটা দুহাতে ধরে হ্যাঁচকা টান মারে বস্তা লিফটে ঢোকানোর আগেই শাজিয়ার চোখ এদিক-সেদিক কী যেন খোঁজে ‘বেঙ্গল মিট’-এর মাংসের ব্যাগটা কোথাও নেই

   

মোমেনকে মুদীর বস্তাটা বাসায় পৌঁছে দিতে বলে লিফটের সামনে থেকে সরে যায় শাজিয়া। জায়গাটা খালি করে দেয়। ঘর থেকে বেরোনোর সময় দেখেছিলো মৃদু নাসিকা-গর্জনের সঙ্গে নাফিউল ঘুমাচ্ছে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ইফতারির পর থেকেই নাফিউলের বুক আর গলা জ্বলছিলো। সেহরির সময় গ্যাস্ট্রিকের  ওষুধ খেয়ে শুয়েছিলো কিন্তু ঘুমিয়েছে সকালের দিকে। আজ শুক্রবার, শাজিয়া ভেবেছিলো, একটু বেলা করে ঘুমাকটপ্পা-টোড়ি ছুটির দিনেও কেমেস্ট্রির বই খুলে পড়তে বসেছে। আগামীকাল ‘মেকিং সল্ট অ্যান্ড  সেপারেশান টেকনিক’ এর ওপর ক্লাস-টেস্ট। স্কুলে রোজার ছুটি শুরু হয়ে গেলেও কোচিং ক্লাসে বিরাম নেইএদের কাউকেই এক্ষুণি মাংস হারিয়ে যাওয়ার দুঃসংবাদটা দিতে শাজিয়ার মন চাইলো না বলবেই-বা কী! আজাদ উত্তেজিত গলায় বলে রিকশাওয়ালাই নিয়া গেছে; বাটপার একটা। প্যাসেঞ্জারের প্যাকেট ফিরাইয়া দিয়া যাইবো না!  

এমন তো না যে শাজিয়াকে কেউ কোনোদিন ঠকায়নি শাজিয়া বরং কিছু ক্ষেত্রে জেনে-বুঝেই ঠকেসেই কবে একদিন কার্জন হলের সামনের রাস্তায় হিমেল আর রুমকি রিকশায় পাশাপাশি পাঁচ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে শাজিয়া দেখেছিলো পৃথিবীর সমস্ত আলো দুজনের মুখে— যে আলোর কোনো অনুবাদ করতে হয় না দুজনকে ঘিরে বিচ্ছুরিত গোধূলি-আভায় সম্পর্কের মানে প্রকাশিত হয়ে যায়— লুকিয়ে রাখা যায় না। সেদিন অপূর্ব সৌন্দর্য ঘোরে দুজনকে দেখছিলো শাজিয়া। ইচ্ছে করেই তো সে ঠকেছে। দীর্ঘদিনের রূপরস-স্পর্শ-গন্ধময় অধিকারে একবারের জন্যও হিমেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি। উল্টোদিকে হেঁটে চলে গিয়েছিলো। প্রতিক্রিয়া দেখায়নি; ময়ূর-নীল তসরের ওপর কাঁথাস্টিচের শাড়িটা পরতে নিয়ে বান্ধবী জলি যখন আর ফেরত দিলো না লন্ড্রি থেকে হারিয়ে গেছে জানিয়ে দিয়ে দিব্যি হেজেলনাট-ক্যাপাচিনোর স্বাদ আর হেলথ বেনিফিট নিয়ে অনর্গল কথা বলে গেলো প্রিয় সেই শাড়ির কথা দ্বিতীয়বার জলির সামনে শাজিয়া তোলেনি মনের ভেতর জমে ওঠা বিন্দু বিন্দু দুঃখফেনা সে মুছে নিয়েছে প্রবঞ্চিত হওয়ার একেকটি বেদনাকে অতিক্রম করে গেছে নিজের বিশিষ্টতায়

 

এতো যে ঠকেছে জীবনে— ভেঙে যাওয়া সম্পর্কে, কখনো বেদখল হয়ে যাওয়া সম্পদে— একটা রিকশাওয়ালার হঠকারিতার কাছে সে এভাবে ঠকতে নারাজ। খেটে খাওয়া মানুষের কাছে কেনো তাকে প্রতারিত হতে হবে? সে কি এই রিকশাওয়ালাকে চাওয়া মাত্রই বাড়তি টাকা দেয়নি? বিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠলেও ভারাক্রান্তবোধ করে শাজিয়া। রিকশাওয়ালা যেন বিপন্ন করে দিয়ে চলে গেলোইন্টারকমে ফোন ক’রে শেফালিকে বলে দেয় বস্তা খুলে সদাইপাতি গুছিয়ে রাখতে মাংসের প্যাকেট হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনে শেফালি বিস্মিত। এতোক্ষণ ধরে সে মাংস-রান্নার যাবতীয় বাটা-মশলা আর গুঁড়া-মশলা তৈরি করেছে। আদা-রসুন-জিরা ব্লেন্ড ক’রে, এক বাটি পেঁয়াজ কুচিয়ে রেখেছে আপা মাংস রাঁধবে ব’লে, অথচ... সিকিউরিটি গার্ড মোমেনের দিয়ে যাওয়া বাজার গোছাতে গোছাতে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় শেফালিওর মনে হয় এই দেশে আবার ক্যাচাল লাগবে— কী জানি কিসের এতো লম্বা মিছিল হলো, দুই কেজি মাংসের প্যাকেট খোয়া গেলো— এ সবই ঘোর বিপদের আলামত      

শাজিয়া উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। বিসমিল্লাহ স্টোরে গিয়ে সাদা রঙের ব্যাগ খোঁজ করতেই মামুন ব্যাপারী জানায় সে বেঙ্গল মিটের প্যাকেটটা দেখেছিলো। সিসি ক্যামেরায় চোখ রেখে জানালো ব্যাগ হাতে ক’রেই রিকশায় উঠেছিলো শাজিয়াপাশে বস্তাটা তুলে দেয়া হয়েছিলো। শাজিয়া ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই মামুন বলে— আপনি তো প্যাকেটটা ধরেই ব’সে ছিলেন। থমকে যায় শাজিয়াসারাক্ষণই আসলে সে প্যাকেটটা হাতে ধরে রেখেছিলো। শাজিয়ার মনমরা, থমথমে চেহারা দেখে মামুন কথা বাড়ায় নাহাঁটতে থাকে শাজিয়া। খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাওয়ার মানে হয় নাআজাদকে ফোন করে বিল্ডিংয়ের সিসি ক্যামেরায় ঘটনাটা দেখতে বলেযা-ই হোক, রোজার মাসে রিকশাওয়ালা যদি মাংসটা রেঁধে  সপরিবারে ইফতার করে, এতে শাজিয়ার পূণ্যই হবে। পরক্ষণে মনে হয় এভাবে পাওয়া কোনো খাবারে ইফতার করলে কি রোজা কবুল হয়? ফুটপাথে ভিড় বেড়েছে। দ্রুত হাঁটার সময় একবার হোঁচট খায় শাজিয়াকপাল বেয়ে ঘামের মিহিধারা নামে— সামলে নিয়ে ফের হাঁটা ধরে।

   

এসব ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে বেঙ্গল মিট চলে আসে। দোকানের মেয়েটাকে আরো দুই কেজি গরুর মাংস দিতে বলেঅম্লান হাসিতে মেয়েটা আরেকজন সেলসম্যানকে জানায়— ‘এই কাস্টোমারের কথাই বলছিলাম।’ কী বলছিলো কে জানে? এতোটুকু কৌতূহল অনুভব করে না শাজিয়া। রাজ্যের ক্লান্তি ওর শরীরে এসে জড়ো হয়েছে। এই দুপুরেই গলা শুকিয়ে কাঠ। বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা এলে রুহ আফজার ঠাণ্ডা শরবতে চুমুক দিয়ে তবেই তৃষ্ণার নিবারণ মনে মনে টাকার হিসাব করে শাজিয়া। চিকেন কিমা না কিনেই বেরিয়ে আসে।         

হাউজিংয়ের সামনে আসতেই উত্তেজিত আজাদ, মোমেন, ক্লিনার, রঙমিস্ত্রি শাজিয়ার দিকে তাকিয়ে সম্মিলিতভাবে যা বলার চেষ্টা করে এর মানে এমন দাঁড়ায় যে— মাংসের প্যাকেট ওই রিকশাতেই ছিলো।  বস্তা নামানোর সময় শাজিয়ার পায়ের পেছনে মাংসের ব্যাগটা আজাদ দেখতে পায়নি। এদিকে বস্তাটা নামিয়েছে দেখে শাজিয়া ভেবেছে, সে রিকশা-ভাড়া দেয়ার কোনো এক সময় আজাদ মাংসের ব্যাগটাও নামিয়ে ফেলেছে। সিটের ওপর চোখের সামনে ব্যাগটা রাখলে হয়তো এমন ভুল বোঝাবোঝি হতো না।

আপা, আসেন... দ্যাখেন... দ্যাখেন... দেখার জন্য শাজিয়া ন্যূনতম আগ্রহ বোধ করে না। রিকশাওয়ালা মাংস নিয়ে গেছে বেশ করেছে। যা গেছে যাক! সে মচ্ছব বামে রেখে ডানে লিফটের দিকে চলে যায়। মোমেন লিফটের ডাউন বাটন চাপ দিয়ে অনুরোধ করে— দ্যাখেন আপা, দেখলে জানডা ঠাণ্ডা হবে। লিফট পনেরো তলা থেকে নামছে দেখেই কিনা শাজিয়া মনিটরের দিকে এগিয়ে যায়রিয়াইন্ড ক’রে ক’রে  আজাদ মুহূর্তটাকে ফিরিয়ে আনেএই তো রিকশা এসে দাঁড়ালো... আজাদ বস্তা নামিয়ে চলে যাচ্ছে লিফটের দিকে... শাজিয়া ভাড়া মিটিয়ে এসে আজাদকে ঈদের টাকা দিচ্ছে... রিকশাওয়ালা ভাড়ার টাকা পকেটে নিয়ে রিকশা ঘোরালো... সেখানে মাংসের সাদা ব্যাগ... রিকশাওয়ালা একবারও পেছন ফিরে তাকালো না... মাংসের ব্যাগটা দেখতে পেলো না... তারপর সোজা হাউজিং সোসাইটির মেইন গেট দিয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে গেলো... মনিটরে ভেসে ওঠা এই দৃশ্যস্রোত দেখতে দেখতে শাজিয়ার মনটা মুহূর্তে হালকা হয়ে যায়। রিকশাওয়ালা বেরিয়ে যাওয়ার সময়ও জানে না, প্যাসেঞ্জারের একটা ব্যাগ রিকশায় রয়ে গেছে!     

ভেতরে কোথাও নিজের সমপরিমান চাপ কমে গিয়ে নির্ভার অনুভব। যেন এক্ষুণি উড়ে যাবে, চেহারা এমন ফুরফুরে হয়ে যায় শাজিয়ারদেখে অবাক শেফালি— স্বল্পভাষী হয়েও মাংস হারানোর চাঞ্চল্যকর  খবর এরই মধ্যে সবাইকে সে জানিয়েছেদোকানে গিয়ে আবার দুই কেজি মাংস কিনে, দ্বিগুন খরচা করেও আপার কোনো দুঃখ নেই! কিয়ামের নন-স্টিক কড়াইতে সমস্ত মশলা-তেল-পেঁয়াজ-মাংস হাতে মাখিয়ে শাজিয়া কাচের ঢাকনি দিয়ে ঢেকে দেয়। চুলার মধ্যম আগুনে মার্বেল কোটেড কড়াই তেতে ওঠে— চারপাশে মশলার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে। ফুটতে থাকে ঝোলে-মাংসেমায়ের হাসিমুখ টপ্পা-টোড়িকে আশ্বস্ত করে, অসময়ে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখাই যায়— বকা খাওয়ার সম্ভাবনা এখন শূন্য। কোন মুভি দেখা হবে সেটা নিয়ে দু’বোনের মতভেদ হলেও মিটে যায় সহজেই। নাফিউল ঘুম থেকে উঠে গালে আফটার শেভের সতেজতা নিয়ে ভাবছিলো গণঅভ্যুত্থানের পর এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় এনসিপি’র তরুণদের ওপর কতোটা আস্থা রাখা যায়। ওর বুকে অম্লতার জ্বলুনি আপাতত নিভে গেছে ওমিপ্রাজলে। শাজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে মাংস খোয়া গেলেও চোখ দুটো কী উজ্জ্বল। কী সুন্দর দেখতে! ঈদ যেন কবে? শাজিয়া বাচ্চা মেয়ের মতো হেসে বলে— আজ ঈদ!

এবং আশ্চর্য, কেউ জানে না, আজই তো উদযাপন। রিকশাওয়ালা যে জিতিয়ে দিয়ে গেছে!         



অলংকরণঃ তাইফ আদনান