
ফেসবুকে একটা ছবি দেখে থমকে গেল বাদল।বহুদিন হলো দেশে যাওয়া হয় না।দেশটা স্বার্থান্বেষী মানুষদের বিচিত্র কর্মকাণ্ডে নাকি একটা জাহান্নামে পরিণত হয়েছে– তার স্ত্রী টুম্পা তাকে সেই কথা বার বার মনে করিয়ে দেয়। আরো বলে, অল্প বয়সে বুদ্ধি করে ভাগ্যিস আমেরিকায় আসছিলা… কপাল তোমার! বাদল স্মিত হেসে বলে,
গ্রামে আমার বাবার অনেক জমি-জমা থাকলেও তার পয়সায় আমি এদেশে আসিনি। স্কলারশিপটা না পেলে এদেশে এসে এত দ্রুত সবকিছু সেটেলড করা যেতো না। যাহোক, দেশ যদি জাহান্নাম হয় তাহলে আমার চেয়ে কপালটা তোমার ভালো। আমাকে বিয়ে করে তুমি এ দেশের নাগরিক হয়ে বাস করছ নয় বছর। তার আগে আরো পনেরো বছর আমাকেই যুদ্ধটা করতে হয়েছে।
বাদল ভাবছিল – এ কথার প্রত্যুত্তর করতে গিয়ে টুম্পা ঝগড়া বাঁধিয়ে দেবে। কিন্তু কি অপার মনোযোগে মহিলা ফেসবুকে কিছু একটা দেখছে যে তার কথাগুলো কানেই ঢোকেনি।
কী ব্যাপার, এত গভীর মনোযোগে কী দেখো যে, হুশজ্ঞান কিছুই নাই মনে হচ্ছে।
বাদল, তোমাদের গ্রামটার নাম বালিয়াডাঙ্গা ছিল না?
হ্যাঁ, কেন?
এসো, এদিকে এসো।
বাদল টুম্পার মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখল। ফেসবুকে কোনো এক নারীর পোস্টের নিচে একটা ছবি। আলুথালু বেশের পাগল মতো একজন নারী। পায়ে তার শিকল বাঁধা। চুলগুলোতে এত জটলা যে মনে হয়, কত মাস তাকে গোসল করতে দেওয়া হয়নি। রাগান্বিত ভঙ্গিতে ক্যামেরার দিকে তাকানোর সময় মনে হয় ছবিটা কেউ তুলেছে। চোখের গভীর চাউনিটুকু বাদলের বুকের প্রান্তরকে কেন যেন দুলিয়ে দিলো। মনে হলো, জীবনে কোনো এক সময় এই চঞ্চল তবু মায়াময়, গভীর তবু উচ্ছাসভরা দৃষ্টির সাথে তার গভীর ভাব বিনিময় হয়েছে। সে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করল,
কে উনি?
আমি কীভাবে বলব? তবে যাত্রাপালার নারী হওয়ার কারণে বিভিন্ন অপবাদে নাকি গ্রামের মানুষ তাকে দীর্ঘদিন একঘরে করে শাস্তি দিতে দিতে পাগল বানিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের পুরুষগুলো এক একটা ধাঁড়ি শয়তান। নারীদের দেহ ভোগ করার সময় বেশ্যা বলে লজ্জা পায় না কেউ। তাদের অসহায়ত্বকে এভাবে লাঞ্ছিত করে পুরো নারী জাতিকেই অপমান করে।
তুমি কী যেন বলছিলে, বালিয়াডাঙ্গা…?
ও হ্যাঁ, মহিলার গ্রামের নাম আর তোমার গ্রামের নাম এক তো। তোমার নামের সাথেও অদ্ভুত এক মিল আছে– মহিলার।
কী নাম উনার?
মেঘলা। আমার নামটা বাবা-মা মেঘলা রাখলেই ভালো হতো, না? মেঘলার বাদল হতে তুমি!
২.
‘যে মাঠে মেয়েরা ভাতার মেরে ফেলে তার নাম ভাতারমারির মাঠ, বুঝলা?’ কথাটা বলে বাদলের চোখে চোখ রাখল মেঘলা। তারপর শরীর কাঁপিয়ে খিলখিল করে হাসল। মেয়েটার লতানো শরীর। শ্যামলা ত্বক-মুখে যেটুকু লাবণ্য আর আভা তাও রোদে লাল হয়ে উঠেছে। কপালের ঘামে লেপ্টে আছে কয়েকটা চুলের অগ্রভাগ। বাদলের মনে হলো, মেঘলা আজ অকারণেই, সামান্য কথাতেও অনেক বেশি হাসছে। জোর করে হাসতে গিয়ে তার শরীরটাও কাঁপছে। বালিয়াডাঙ্গা গ্রাম থেকে সকালে বের হয়েছে তারা দুজন। হাঁটতে হাঁটতে এসেছে– দিকহীন, নিশানাহীন এই ভাতারমারি মাঠে। বেলা দশটা মাত্র। তাতেই নভেম্বরের রোদ তেঁতে উঠেছে। গ্রামের দিগন্তরেখায় কুয়াশার আস্তরণভরা সকালে পড়া সোয়েটার দুজনই গা থেকে খুলে ফেলেছে।
মেঘলার কটিদেশের উপরের অংশে সালোয়ারের ছেড়া অংশ দিয়ে ভিতরের গোলাপী আভাময় ত্বক দেখা যাচ্ছে। রোদ তার ত্বকের আভার সাথে খেলা করছে যেন। বাদল ঠিক জানে না, মেয়েরা বাইরে বাইরে শ্যামলা হলেও তার ভিতরটাতে এমন রোদ বাস করে কীভাবে? সকালের শীতটাকে সে মনে মনে খুঁজছিল। কিন্তু দিগন্তহীন এই মাঠকে সূর্য মনে হয় তার আপন খেলাঘর বানিয়ে হেমন্তেও তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে। মেঘলা আর বাদল একই বয়সি, ওর সহপাঠি ছিল মেঘলা। অষ্টম শ্রেণি পড়ার সময় মেঘলা বাবা হারাল। ফলে গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের গণ্ডিটা আর পেরুনো হলো না তার। গ্রামে তাদের জমি-জিরাত নেই। একটা কুঁড়েঘরে মেঘলা আর তার মায়ের অভাব অনটনে চলছে জীবন। বছর দুয়েক মেয়েটা একবার কোথাও নাই হয়ে গেল। কে বা কারা নাকি তাকে যাত্রাপালায় কাজ করার জন্য মেলায় ডেকেছিল। হ্যাঁ, সেবার সে কিছু টাকা পয়সা, নতুন একটা হারিকেন, মায়ের জন্য কিছু চুড়ি আর একটা শাড়ির সাথে রং মিলিয়ে পেটিকোট কিনে এনেছিল। তাতেই তার মা ভীষণ খুশি হয়েছিল। গ্রামে কারো বাসায় কাজ করার চেয়ে মেয়ে তার যোগ্যতায় অন্য কিছু করছে– এ নিয়ে তার মায়ের গর্ব সেই থেকে শুরু। এবার মেঘলার মা বাদলকে ডেকে বলল,
শুন, বাপ। হামার ছলক তুই অ্যানা গোপীনাথপুর মেলাত থুয়ে আয় তো। অনেক বড় যাত্রাপালা থেকে ওর নাম আসিচে… বাদল বলেছিল,
চাচী, অনেক মানুষই তো মেলায় প্রতিদিন যাচ্চে, ওদের সাথত গেলেই তো হয়।
এ কথায় মেঘলার মায়ের চোখ ছলছল করে ওঠে। বাপ মরা মেয়ে বলে না হয় মেয়েটাকে তার এমন জীবনযুদ্ধে নামতে হয়েছে– সেই কাজে সহপাঠি হয়েও বাদল সাহায্য করবে না? সবার সাথে বাড়-বাড়ন্ত হয়ে ওঠা মেয়েকে কি আর পাঠানো যায়? মেঘলার মায়ের অভিব্যক্তি বিপাকে ফেলে বাদলকে। গ্রামের সামর্থবান পরিবারের সন্তান সে। পড়াশুনায় মেধাবী। তাকে কি দরিদ্র পরিবারের একটা মেয়ের সাথে দূরের কোনো মেলার যাত্রাসঙ্গী হিসেবে সমাজ মানবে? নিজের বাবা-মাকে এখন কি বলে সে মেঘলার সাথে বের হবে? তার বাবা-মা কি এটা মেনে নেবে?
চাচী, তুমি বাবা-মা’কে ভুলেও জানিয়ো না, আমি মেঘলাকে রাখতে মেলায় যাচ্ছি।
না, না। তা বললে কি আর মেলায় য্যাতে দিবেনি? ওগলান কতা তোলাই যাবে না।
তারপর মায়ের কাছে এসে বাদল আবদারমাখা কণ্ঠে বলল,
মা, সবাই গোপীনাথপুর মেলায় যাচ্ছে। আমিও যাই?
সে কি? কিসের মেলা! ও তো গরুর বিশাল হাট।
না, অনেক কিছু আছে ওই মেলায়।
ওটা একটা অসভ্য মেলা। যাত্রা-নাচ-গান শুধু হলে ভালো হতো। ওটা নাকি জুয়া আর জাদুবিদ্যার মেলা । শুনেছি, অনেক ছেলেধরা আছে। মেয়েদের, ছেলেদের তরবারির নিচে জবাই করার জাদু দেখানো হয় ঐ মেলায়। তাছাড়া এখান থেকে মেলাটা নাকি পঁচিশ মাইল দূরে। মাঠের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর কোনো পথও নেই…
আরে, তুমি কি যে বলো, মা। আমি কি এখন আর অত ছোটবাচ্চা আছি? ইন্টারমিডিয়েট টেস্ট পরীক্ষা দিলাম! ছেলের চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে বাদলের মা কতক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন,
তোর বাপ শুনলে তো মাথা খারাপ করবে। হয়তো এক টাকাও দেবে না। আমার হাতেও তো তেমন টাকা-পয়সা সে দেয় না। মানুষটা কেমন কৃপন, জানিস তো?
টাকা লাগবে না। একটু চিড়া গুড় দাও। দুই-তিনদিন তো। কোনো ব্যাপার না।
বাদলকে তার মা লুকিয়ে লুকিয়ে তার হাতে দশ আর পাঁচ টাকার অনেকগুলো নোট দিলো। সেই স্মৃতি মনে করতে করতে ভাতারমারি মাঠকে অতিক্রম করে তারা মাঠের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা সরু খালের এক কিনারে বসল। পা আর চলছিল না। পঁচিশ মাইল যে এত দূরত্বের পথ তা বাদলের ধারণাতেও ছিল না। মেঘলার কি পা ব্যথা করছে না? নাকি, সারাদিন মাঠে মাঠে ধানকুড়ানো ছাড়াও পঁচিশ-ত্রিশ টাকার দিন-চুক্তিতে গৃহস্থের আলু তুলে দেওয়ার কঠিন কাজ করতে করতে এমন কঠিন জীবনই তার বড্ড আপন? বাদল ছোট্ট এক ঝোপ গাছের সামান্য এক টুকরা ছায়ার কাছে গাছেরই সাথে গা ঘেঁষাঘেষি করে বসে। জিজ্ঞাসা করে,
আর কতদূর? আমার অনেক পিপাসা পেয়েছে। খিদেও। সামান্য কষ্টেই গালফোঁলানো মেয়েদের মতো ভঙ্গি করে বলা বাদলের কথায় ফিক করে হেসে দিল মেঘলা। গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেটা আর তাদের এলাকার স্কুলের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটা তাকে গোপীনাথপুরের মেলায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য আজ তারই সাথে অজানা-অচেনা পথে নেমে এসেছে। তাও লুকিয়ে লুকিয়ে। বিনাস্বার্থে এমন কাজ কি ভালোবাসা না থাকলে করা যায়? জীবনে এত অহংকার করার মতো ঘটনা কি মেঘলার জীবনে ঘটেছে? স্কুলে শেখা শুদ্ধ ভাষা বলার চেষ্টা সে অব্যাহত রাখল,
এই, তুই না ফুটবল খেলিস? কেবল তো ভাতারমারির মাঠ পার হলাম। হি হি… আরো অনেক পথ, অ… নে… ক পথ… হি হি হি… যেতে যেতে কে জানে; সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে!
তাহলে তুই আমাকে নিয়ে আনলি ক্যান? এতদূর ক্যামনে যাব? এখনই তো আর দুই পা উঠতে চাইছে না।
তুই ছাড়া মা কি আমাক অন্য পুরুষ মাইনষের সাথে ছাড়তো? মানুষ নাই, জন নাই– এই মাঠে বাঘের সাথে হরিণকে পাঠানো আর কি! তুই এখনো এসব বুঝবি না। আর গোপীনাথপুরের মেলায় না গেলে, মেঘলা কি মেঘলা হতে পারবে রে! তুই দেখিস এবার আমি খালি টাকা কামাই-ই না, কত নাম কুড়াই। হি… হি…
তুই নাম কুড়াবি, টাকা কামাই করবি… আর আমার এখন মরার দশা। বাংলাদেশেও যে সাহারা মরুভূমি আছে, তা আমার এই প্রথম জানা হলো।
আমার জন্য জীবনে এই একবারই না হয় একটু কষ্ট কর!
এ কথায় জলের মতো নরম আর ঠাণ্ডা হয়ে গেল বাদল। এতিম মেয়েটার জন্য কেমন মায়া লাগল। এই বয়সে সে কি আনন্দে থাকবে, পড়াশুনা করবে– তা না, তার কাঁধের উপর পড়েছে সংসার টানার ভার! বাদল বলল,
চিড়া আর গুড় বের কর। একটু খেয়ে তারপর আবার রওয়ানা হই। ভাতারমারি পাথারের কী কাহিনী?
অনেক অনেক দিন আগে একজন কিষাণ ঐ মাঠত কাজ করতেছিল। আগুনের মতো রোদ পড়তেছিল মাঠে। রোদে লোকটার বুকের ছাতি ফাটি যায় যায় অবস্থা। কিষাণের বউ তার ভাতারের জন্য দুপুরের জল-খাবার নিয়া রওয়ানা হয়। দেখিস না, মাঠটার কিনার নাই! এই মাঠত পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার ভাতার বুকের ছাতি ফেটে মরে যায়। ভাতার মানে স্বামী। তারপর থেকে মাঠটার এমন নাম।
তা তুই তো অনেক কিছু জানিস দেখি।
এবার মেঘলার চিরচেনা হাসিমাখা কণ্ঠটা যেন বদলে যায়। সহপাঠির প্রতি কিছুটা অভিমানমাখা স্বরে তার দিকে চিড়া-গুড় এগিয়ে দিতে দিতে বলে,
মাঠতই যাদের জীবন কাটে, মাঠ নিয়া তারা তো অনেক কিছু জানবেই– তাই না? স্কুলে তোদের মাস্টারমশাইরা সারাবিশ্ব পড়ায়। আর আমাদের মাস্টারমশাই হলো, এইসব মাঠ, ধানখেত, মেঘলার বাদল দিন! আমরা ঘরের ধারের খাল-বিল, মাঠের আনাচে-কানাচে ঘাস-লতা গাছ সব চিনি। বুঝি বর্ষাকালে, বন্যাত কোন মাঠে কয় হাঁটু পানি। আর কোন পানিত কোন গাছ ভ্যাসা আসিচে। ভ্যাপসা গন্ধ, কচুরিপানা আর পানিমাখা জীবনের পচা গন্ধেই তো কাটে আমাদের জীবন।
মেঘলা, তোর একটা কবিমন আছে। মানুষ নাই, জন নাই! দুঃখের ব্যাপার হলো, নীলাকাশটা যেন এই মাঠটাকে পেঁচিয়ে ধরে তোকে আর আমাকে মেরে ফেলার জন্য তৈরি– এমন সময় তোর কবি পরিচয় পেয়ে আরো ভয় লাগছে। প্রাণটা ভয়ে ধুকপুক করছে।
কেন? শোন, আজকের দিন তোর মনে থাকবে– অনেক অনেক দিন, জানিস বাদল? তুই তো একদিন অনেক বড় মানুষ হবি– দোয়া করি; সেইদিন এই পাগলিটার কতা মনে কইরিস।
৩.
খাওয়ার পর শরীরে মনে হয় একটু প্রাণ এলো। আরো দুই ঘণ্টা টানা হাঁটার পর, মাঠের পর একটা গ্রামের ভিতর দিয়ে পার হয়ে আসার সময় টিউবওয়েল থেকে তারা তাদের জলের পাত্রগুলো পূরণ করে নিল। বড় একটা দিঘির ধারে অনেক কালের সাক্ষী বটগাছটার ছড়ানো শিকড়ের উপর বসল। মেঘলা বলল,
আর বেশিক্ষণ লাগবে না। এই বটগাছের কাছে আসা মানেই হলো আমরা মেলায় চলেই আইছি।
কিন্তু গ্রামটা পেরিয়ে আবার যখন মাঠ শুরু হলো, সেই দিগন্তজোড়া মাঠটার সম্মুখে থমকে দাঁড়িয়ে বাদল মনে মনে গোপীনাথপুর মেলার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করল। মেঘলা অপরাধীর মতো মুখ করে বাদলের দিকে তাকাল। বড় ঘরের ছেলে, যে কোনোদিন এত শারিরীক আর মানসিক ধকলের মধ্য দিয়ে যায়নি– তাকে ধরে এনে কি ভুলটাই না সে করেছে! তার মা তাকে বার বার বুঝিয়েছে বাদলকে তার সাথে না জড়াতে। কিন্তু মেঘলার জেদ,
মা, তুমি বলেই দেখো। হাজার হোক আমরা ছোটবেলায় একসাথে পড়ছি। সে না করবে না।
তোর লজর এত উঁচা ক্যান? ক্যাঙ্কা করে তুই ভাবলু যে, বাদল তোর জন্য অ্যাতো কষ্ট করবে? কতই বয়স ছলটার? জীবনে সে কি কোনোদিন পানিটুকুন তুলে খাইচে?
মা, বাদল ছাড়া কেউ তোমার মেয়েক নিরাপদে পৌঁছে দেবে না।
মেয়ের কথায় বাদলকে অনুরোধ করেছিল মেঘলার মা। মেঘলা কি কোনো ভুল করেছে? না, সে মনে মনে ভাবল– বাদলের সাথে তার না হয় একটা দিনের কষ্টের স্মৃতি থাকল। ছোটবেলায় প্রাইমারি স্কুল, মাধ্যমিক স্কুলের তিন বছর একসাথে যাবার পথে তো অনেক মধুর স্মৃতি তাদের আছেই। অল্প বয়স থেকে পোড় খেতে খেতে এই সতেরো-আঠারো বছর বয়সে মেঘলা বুঝে গেছে–কষ্টের স্মৃতিই মানুষের মনে থাকে। মেঘলা নিজেকে এবার নিজে প্রশ্ন করে,
তুই বাদলের সাথে কষ্টের স্মৃতি জমাতে চাস ক্যান? বাদল তোর কে? নিজেকেই সে আবার উত্তর দেয়,
বাদল আমার ছোটবেলার সাথী। ভাবনার, কল্পনারও। কিন্তু তা তো তাকে জানাতে নেই! বুঝতে দিতেও নেই… সেজন্যই এই গ্রাম থেকে , এই মাঠে মাঠে কাজ করার লজ্জা থেকে বাঁচতে শেষ দিনটা তাকেই সাথে নিলাম। জানি, ও কিছুই বুঝবে না। তবু, আমার শৈশব-কৈশোরের একজন বন্ধুকে সারাজীবনের জন্য স্মৃতিতে বান্ধে রাখতেই তো… বাদলের কণ্ঠস্বরে মেঘলার নিজের সাথে নিজের কথন থেমে যায়,
খাইছে, মেঘলা! এ তো দেখি আর এক ভাতারমারি দিগন্ত…
এই… এটা পার হলেই… গোপীনাথপুর।
হাঁটতে হাঁটতে বাদলের মাথা ঝিম ঝিম করে। রোদের রশ্মিগুলোর ঝিকিমিকি খেলা তার সামনে সর্ষেফুলের অসংখ্য কণা হয়ে ভাসতে থাকে। সে মনকে শক্ত করে– মেঘলার দিকে তাকায়। মেঘলার বক-বকানি অদ্ভুতভাবে কমে এসেছে। মেয়েটা তো কথা ছাড়া থাকতে পারে না। সে যত চুপ হয়ে যাচ্ছে তত দুনিয়াটা কঠিন হয়ে উঠছে। পথ আরো যেন লম্বা হয়ে যাচ্ছে। বাদল এবার অবাক হয়ে দেখল, মেঘলার পায়ের গোড়ালি রক্ত দিয়ে মেখে গেছে। ধানকাটা মাঠের নাড়ার আঘাত ক্ষয়ে অর্ধেক হয়ে যাওয়া স্যান্ডেল মেঘলার পা দুটোকে বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু সেদিকে মেয়েটার খেয়াল নেই। তার কবিমনে শিল্প ভর করেছে। সে যাত্রা পালাগানে অভিনয় করবে, বড় শিল্পী হবে– সেই গন্তব্যকে সামনে রেখে সমস্ত যন্ত্রণা হজম করে সামনে পা বাড়িয়ে চলছে। সামনে, সামনে। আরো সামনে। না, দুর্বল হলে চলবে না। ঢক ঢক করে জলপান করে বাদল নিজেকে চাঙা করে নেয়। হাত ধরে মেঘলাকে থামায়। নিজের কেডস খুলে মেঘলাকে তা পরে নিতে বললে মেয়েটার দুই চোখ ফেটে অশ্রু দেখা দেয়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে,
তোর মাথা খারাপ! খালি পায়ে তোকে আমি হাঁটতে দেবো না। তুই আমার পাশে আছিস, আমার পা ফেটে গেলেই কি, ছিড়ে গেলেই কি!
কিন্ত বাদল কোনো কথা শুনল না। সংবেদনশীলতা তার জন্মগত স্বভাব। পাশের মানুষ অথবা যে কোনো প্রাণীর কষ্ট তাকে ব্যথিত করে তোলে। জোর করেই কেডসটা তাকে পরাল, বলল,
আমার ফুটবল খেলা পা। আর মেলাটা তো বেশি দূরে নেই। সমস্যা হবে না। মেলায় পৌঁছে পা ধুয়ে স্যাভলন ক্রিম লাগাতে হবে। নাড়া বাদ দিয়ে হাঁটতে পারিস না?
মেঘলা কোনো কথা বলল না। ছোটবেলায় একসাথে স্কুলে যাওয়ার দিনগুলোর কথা তার মনে পড়ে। বাদলের এখনো শিশুমনটা হারিয়ে যায়নি। একবার স্কুলের বারান্দায় একটা পা ভাঙা একটা ছোট্ট দোয়েল পাখিকে সে পেয়েছিল। কে যেন ঢিল ছুড়ে পাখিটার একটা পা দুই ভাগ করে দিয়েছে। দোয়েলটাকে দুজন মিলে বাড়ি এনেছিল। সেই স্মৃতিতে ডুবে গেল মেঘলা। বাদল পাখিটার ভাঙা পায়ে হলুদ আর সরিষা তেলের মিশ্রন মেখে দিল। আমগাছের নিচু একটা ডালে খড় আর মরা ঘাস দিয়ে যত্ন করে পাখিটার জন্য বাসা বানাল। উড়তে না পারা পাখিটার বাসার ডালে প্রতিদিন কয়েকবার করে উঠে গম, কুড়ো আর পানি রেখে আসত। ডালে বসে বসেই মায়াভরে তার পালকে হাত বুলিয়ে দিত। বাদলকে দেখলেই কেমন ছটফট করে উঠত পাখিটা। মেঘলা গাছে উঠতে পারত না বলে নিচ থেকে সেইসব দৃশ্য দেখত। গাছ থেকে নামলে সে জিজ্ঞাসা করত,
ওর পা টা কি ভালো হচ্ছে? বাদলের চোখ অশ্রুতে টলমল করে উঠত,
না। পায়ের কাছে ঘা হয়ে গেছে। মনে হয় দোয়েলটার পায়ে পচন ধরেছে। বলে চোখ মুছেছিল শিশু বয়সের বাদল। পাখিটা কয়েকদিন পর মরেও গেল। একদিন সকালে বাদল গাছে উঠল। মেঘলা নিচ থেকেই অনুভব করল যে, পাখিটা আজ বাদলকে দেখে আর পাখা ঝাঁপটাল না। অনেকক্ষণ পর যেন মাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে যেভাবে দোয়েলটা দুই ঠোঁট ফুলিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তার অভিমান জানাত আজ তার কিছুই করল না। চুপ করে বাদল কতক্ষণ ডালটায় বসে থাকল। তারপর বুকের কাছে জড়িয়ে দোয়েল্টিকে নিয়ে নিচে নামল। বাদল যেন সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সে একটাও কথা বলল না। বাড়ি থেকে একটা কোদাল আনল। আমগাছের পশ্চিমে টিলাটার মতো উঁচু জায়গায় একটা বড় গর্ত করল। তার উপর কঞ্চি দিয়ে কবরের মতো করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিলো। তারপর পাখির কবরটার পাশে অবশ ভঙ্গিতে ধপ করে বসে পড়ল। দুই হাঁটুর ভিতর মাথা লুকিয়ে নিজেকে কতক্ষণ লুকিয়ে রাখল। মেঘলা একটু পর বাদলের হাঁটুর কাছে গা এলিয়ে নিজেও বসল। পাখিটার জন্য যত না খারাপ লাগছিল তার চেয়েও মেঘলার কষ্ট হচ্ছিল তার বন্ধুর মানবিক আর্তি দেখে। বাবা বেঁচে ছিল বলে সংসারে তাদের সচ্ছলতা ছিল। সেই বয়সে ঠিক তখনো তার জীবন নিয়ে তেমন কিছু বুঝে ওঠা হয়নি। তবে, মেঘলা সেদিন বড্ড গর্বিত হয়েছিল তার ওমন একটা বন্ধু আছে বলে। তবে সন্ধ্যার সময় থেকেই মেঘলার বড় আনমনা লাগল। রাতে ঘুমানোর সময় কেমন দমবন্ধ লাগল। তার দুই বছর পর সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর স্কুলে যাবার পথে মেঘলা বলল,
দোয়েলটা মারা গেল যেদিন সেই রাতে আমার মনে হয়েছিল, আমি সেই পা ভাঙা দোয়েল পাখিটা যার সাথে তোর একদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। আমার যেদিন কবর হবে, সেদিন কি তুই থাকবি, বাদল?
হ্যাঁ, এই দিগন্তের পর দিগন্তজোড়া এই নির্জন মাঠে, গোপীনাথপুর মেলার পথে আজ মেঘলার মনে হলো, বাদলের সাথে তার চিরবিদায় ক্ষণগুলোতে বাদল তার পাশেই আছে। তার মুখে এক চিলতে হাসির রেখা একটু স্পষ্ট হয়েই তা আবার হারিয়ে গেল।
৪.
অবশেষে মেলার দেখা মিলল। দূর থেকে গাছ-পালার ফাঁক ফোকর দিয়ে অসংখ্য তাঁবু আর টিন দিয়ে ঘেরা বিচিত্র ধরনের ঘর দেখা যাচ্ছে। মেঘলা এতক্ষণে আবার চঞ্চলতা ফিরে পেল। রোদের ঝিকিমিকি আলোয় মরিচার মতো দুলতে থাকা মেলার চিহ্ন বাদলের চোখে একবার স্পষ্ট হয় তো পরেরবার আবার হারিয়ে যায়। তবু, সে পা চালাতে থাকে। মাঠের খড়ের নাড়ায় তার পা-ও রক্তাক্ত হয়ে গেছে। পিপাসা কাঠ-কণ্ঠে একটা কথাও বেরুতে চাইছে না। কি এক ঘোরের মাঝেই তারা একটা বিরাট উঁচু তাঁবুর সামনে পৌঁছাল যার সামনে বড় করে বাঁকা বাঁকা অক্ষরে লেখা ‘রওশন সার্কাস’। একগাল হেসে মেঘলা বলল,
তুই পাঁচটা মিনিট দাঁড়া। আমি ভিতর থেকে কথা বলে আসছি। এরপর বাঁশ দিয়ে মানুষ ঢুকানোর লাইন দিয়ে দ্রুত হারিয়ে গেল মেঘলা। দুপুর গড়িয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বাদলের মনে হলো হয়তো বিকেল পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রায় বিশ মিনিট পর মেঘলা ফিরে এলো।
কী আজব! সার্কাস কেন যাত্রাপালা হবে?
আরে বোকা সার্কাস শেষ হলে যাত্রা শুরু হয়। চল, ভিতরে চল। তোর আর আমার আলাদা তাঁবু রাখা হয়েছে। বলে নিজের বাড়ির ভিতর যেন নিয়ে যাচ্ছে এমন করে মেঘলা বাদলের হাত ধরল এবং আঁতকে উঠল,
হায় খোদা, তোর গা তো পুড়ে যাচ্ছে। অনেক জ্বর। বলে মেঘলা বাদলের আপাদমস্তক ভালো করে খেয়াল করল। এবার মেয়েটা আর্তনাদ করে উঠল,
ও আল্লাহ, তোর পা এত কেটেকুটে গেছে। এত রক্তাক্ত হয়েছে– তাও বলিস নি…
বলে মেঘলা কিশোরীসুলভ অভিমানী কান্নায় নিজের উপরই রাগ ঝাড়তে ঝাড়তে বাদলকে টেনে নিয়ে গেল। একটা তাঁবুতে নিয়ে তাকে বসাল। জীবনে প্রথম তাঁবুর এক জীবনে প্রবেশ করে বাদল অবাক হয়ে সবকিছু দেখল। কিসের কটু গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করল। এই ঘ্রাণের সাথে বাদলের পরিচয় নেই। থেমে যাওয়া সময়ে পচা গুল্মের ভিতর যেন জ্বলন্ত সিগারেট কেউ ফেলে দিয়ে গেছে কত কত কাল! নিদারুণ শীতে কচুরিপানার পচে যাওয়া শেষ শিকড়টা যেভাবে কাদার সাথে লুটোপুটি খেয়ে মিশে যায়, একটা মরা পাখির শরীর যেভাবে সরিষাফুলের ভিতর ভোন ভোন করা মাছিদের সাথে মৌমাছির মধুসংগ্রহে উপদ্রুবের মতো– তেমন কোনো কিছুর অস্পষ্ট ঘ্রাণ যা বাদলের জীবনের কোনো অংশে, কোথাও জড়িয়ে নেই। কিছুদিন আগে লাইব্রেরি থেকে নেওয়া মিশরীয় সংস্কৃতি নিয়ে পাঠ করা অনুদিত একটা উপন্যাস পড়ার সময় তার অবশ্য মনে হয়েছিল কে বা কারা কাগজের পাতার ভিতর মিশরের হাজার বছরের পুরনো মমিগুলোর ঘ্রাণ মিশিয়ে দিয়েছে। যদিও তার জানা নেই মৃত্যুকালে মমি বানানোর জন্য কী কী উপাদান ব্যবহার করা হয়। আজ এই তাঁবুতে সেসব অচেনা গন্ধের সাথে ধুপ, মশার কয়েল আর মানুষের রক্ত অথবা ত্বকের ভিতর লুকানো অনাদিকালের কোনো একটা ঘ্রাণ, কোনো একটা ঘ্রাণ বাদলকে অদ্ভুত এক মোহাচ্ছন্নতায় স্থান-কাল-পাত্র সব ভুলিয়ে দিচ্ছে। যৌবনের প্রারম্ভে জীবন নিয়ে প্রথম এমন নিষ্ঠুর অথচ রহস্যময়, অসহনীয় অথচ নস্টালজিকতায় সে ভুলে আছে তার শরীরে প্রবল জ্বর অথবা তার দুই পা খড়ের নাড়ার আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত। জীবন থেকে আঁধারি আঁধারি ভোর হয়ে দুপুর; এমন করে ফেলে আসা পথের সময়ে অথবা এইসব অজানা ঘ্রাণসমূহের অস্পৃশ্য খেলার মাঝে সে হারিয়ে গেল যে তারা অনন্তকালের জন্য, বাদলের সারাজীবনের জন্য অনন্য এক স্মৃতি হয়ে গেল!
ঘোর ঘোরের মাঝেই সে বুঝল কেউ এখানে বাস করত। হয়তো তাদের জন্যই একটু আগে তাঁবুর ঘরটা ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছে। মেঘলা কোত্থেকে এক বাটিতে হালকা গরম পানি, স্যাভলন মলম এসব নিয়ে দ্রুত ঘরে ঢুকল। তার পেছনে পেছনে একজন যুবকও ঢুকল। যুবকটি বাদলকে দেখে বলল,
বাহ, তোমার চাচাত ভাই তো, যে কোনো নায়কের চেয়ে সুদর্শন। যাহোক, তুমি দেখো, আমি খাবার ওষুধ এসবের ব্যবস্থা করছি। তোমার নিজের পাগুলো স্যাভলন পানি ধুয়ে মলমটা মাখো। তাকে মেঘলা বলল,
তাড়াতাড়ি করেন একটু।
অনুগত এবং খুবই দক্ষ একজন নার্সের মতো মেঘলা বাদলের সেবা করে চলল। দেশি মুরগীর ঝোল দিয়ে রান্না করা খাবার খেয়ে বাদল ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল। ঘুম থেকে জাগল সন্ধ্যায়। মেঘলা এসে বলল, দেখি পায়ের কি অবস্থা? বাহ, অনেকটাই তো ভালো। খাবার নিয়ে আসি?
এই সন্ধ্যায়?
একটু হাঁটতে পারবি?
কেন?
অগ্রিম কিছু টাকা নিয়েছি। তোকে হোটেলে আচ্ছামতো খাওয়াব। এই মেলার মিষ্টি জগতের বিখ্যাত। আমরা মিষ্টি খাব। কুস্তি খেলা, তাসের খেলা–এসব দেখব। এই মেলার রাত কত বিচিত্র! রাতে রাতে আমরা ঘুরে ঘুরে সব দেখব। অবশ্য তোর পা নিয়ে পারবি কিনা! কিন্তু আজ রাত ছাড়া আমার হাতে আর সময় নাই। কাল রাত থেকেই আমার যুদ্ধ শুরু…
রাতের মেলার বর্ণনা শুনতে শুনতেই দারুণ রোমাঞ্চ অনুভব করল বাদল। তার গায়ের জ্বর তো পালালই, সে পায়ের ক্ষত-ব্যথা সব ভুলে গেল। বলল,
আরে ধ্যেত। পা নিয়ে এত চিন্তার কি আছে? যাব মানে অবশ্যই যাব।
মহানন্দে দুজন রাত দশটা পর্যন্ত মেলার মানুষের জীবনের কীর্তিকলাপ দেখল। খেলো। এবং সবশেষে এক দোকানে নিয়ে গিয়ে পিতল দিয়ে বানানো এক পালকি কিনল মেঘলা। ছয় বেহালার পালকিটা বেশ ভারী এবং অনেক দামী। টাকায় কুলাচ্ছে না যখন তখন মেঘলা দোকানীকে বলল,
চাচা, আমি মেঘলা। রওশন সার্কাসের। চেনেন আমাকে? পরে টাকা দিয়ে যাব… গালভর্তি হাসি দিয়ে দোকানী বলল,
আরে আম্মা। দুই বছর হলো আফনারে সার্কাসে, যাত্রায় দেকি না… কি আনন্দ আপনি আসচেন। লন, লন…
পালকিটা কাগজে মুড়িয়ে নিয়ে বাদলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মেঘলা বলল,
এটা রেখে দিস। মাঝে মাঝে একটু পলিশ করলেই ঝক ঝক করবে। আমাদের ফেলে আসা পথ আর রাতের স্মৃতি যেমন ঝকঝকে।
পালকি?
হুম, পালকি।
মেঘলা এবার হারিয়ে গেল এক বছর আগের সেই দিনে যেদিন যাত্রাপালায় যোগ দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল। যেদিন সে বুঝেছিল বাদলের কাছ থেকে চিরদিনের দূরত্ব তৈরি করা ছাড়া সে সীমা লঙ্গন করতেই থাকবে এবং মায়ের হাতে, সমাজের কাছে অপদস্ত হবে। মেঘলা তার মাকে বলেছিল,
মা, বাদলদের বাড়িতে ঐ যে অনেক কাল আগের একটা পিতলের পাত দেওয়া পরিত্যক্ত পালকি আছে না? আগের সব বড়লোকদের বাড়িতে ওমন পালকি কি থাকত? আমি কি ঐ পালকিতে উঠতে পারব?
এই কথা শুনে তার মা মেঘলার দুই গালে কষে চারটা থাপ্পড় লাগিয়ে ওমন সর্বনাশা স্বপ্ন না দেখতে নির্দেশ দিয়েছিল। সেদিন থেকেই কেন যে একটা পালকি কিনে বাদলকে উপহার দেওয়ার ভাবনা সে মাথা থেকে তাড়াতে পারেনি, তা সে জানে না।
অবাক হয়ে বাদল মেঘলার দিকে তাকাল। নারীমনের রহস্য না বুঝতে শেখা তরুণ বাদল বুঝল না, পালকির প্রসঙ্গ নিয়ে কেন মেঘলার চোখে অশ্রু জমেছে। আবার কেনই বা তাকে এত পরিতৃপ্তও দেখাচ্ছে!
পরদিন সারাবেলা ঘুমে ঘুমেই কেটে গেল। খাবারের সময়গুলো ছাড়া সারাদিন মেঘলার আর কোনো খবর নাই। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে জেগে বাদল অবাক হয়ে দেখল, অদ্ভুত জুড়ি দেওয়া পোশাকের মেঘলা তার পায়ের কাছে বসে মনোযোগ দিয়ে মলমগুলো মুছে মুছে নতুন করে কিছু একটা লাগিয়ে দিচ্ছে। সে উঠে বসে পা সরিয়ে বলল,
তোর আজ রাতেই কি অভিনয়?
হুম। তোকে রাতের খাবার খাইয়ে দিয়ে আমি মেক আপে চলে যাব।
কিন্তু তোর পায়ের অবস্থা তো খারাপ!
আরে, ঠিক হয়ে গেছে। তোর পা-ও দেখবি কাল সকালেই ঠিক হয়ে যাবে। মেঘলার প্রবল ইচ্ছা আর উচ্ছাসের কাছে ক্লান্তি, রক্তাক্ত পা সব হাওয়া হয়ে উবে গেছে। একজন ছেলে হয়ে মেয়েটার এই প্রাণচাঞ্চল্যের কাছে নতি স্বীকার করল বাদল। বুঝল, মেয়েটা শুধু টাকা কামাইয়ের জন্য এই কাজে আসেনি। তার গন্তব্য অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে।
৫.
কথা ছিল, সার্কাস নয়, যাত্রা দেখবে বাদল। কিন্তু সার্কাস দেখার জন্যও তার মন উতলা হয়ে উঠল। মেঘলাকে আর পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং একা একা সে সার্কাসের প্যান্ডেলে ঢুকল। পাহারাদার তাকে থামালে সে শুধু মেঘলার নাম বলল। তাতেই দুই পাটি দাঁত বের করে প্রহরি তাকে সমাদর করে একটা চেয়ার এনে বসতে দিল। প্রথম রাতের সার্কাস ততক্ষণে অনেকটাই পথ পাড়ি দিয়েছে। আগুন জ্বালানো একটা রিংয়ের ভিতর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হলো একজন পুরুষ আর দুইজন মহিলা। একজন মেকআপ করা, হাফপ্যান্ট এবং শরীরে সার্কাসের টাইট কাপড় পরা নারীকে পেছন করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা তক্তার সামনে। তক্তায় বুক ছুঁয়ে দাঁড়ানো সুন্দরী মেয়েটা দুদিকে দুই হাত প্রসারিত করে দিলো।
তারপরই ভয়ে আঁৎকে ওঠার দৃশ্যটা দেখল বাদল। মেয়েটার কয়েক মিটার দূরে অনেকগুলো ধারালো চাকু একটা ছোট টেবিলে রাখা। টেবিলটার পাশে এসে একজন দাঁড়াল। কয়েকটা চাকু হাতে তুলে নিল। সার্কাসের সাজে সাজা মানুষটা কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপর আরো একজন এসে চাকুওয়ালা মানুষটার চোখ পেছন থেকে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলো। মেয়েটা যে তক্তায় হেলান দিয়ে আছে সেদিকে চাকুওয়ালা মানুষটা একের পর এক চাকু ছুড়ল। মেয়েটার শরীর, হাত ঘেঁষে একটার পর একটা চাকু তক্তায় এসে প্রবিষ্ঠ হচ্ছে। টেবিলের সব চাকু শেষ হলে সেগুলো তক্তা থেকে বের করে আনা হলো। কালো কাপড়ে চোখ দুটো শক্ত করে বন্ধ করা মানুষটার হাতের পাশে টেবিলে রাখা হলো। মেয়েটাকে ঘুরিয়ে এবার তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। মেয়েটার দিকে চোখ পড়ামাত্র বাদলের বুকে বজ্রপাত হলো। মেঘলা! হ্যাঁ, মেঘলাই তো! এই মরণখেলা থামানোর জন্য সে চিৎকার করতে চাইল। কিন্তু তার কণ্ঠ কে যেন রোধ করে রেখেছে। মেঘলা যেন এসে তার কানে কানে বলল,
একজন নারী হয়ে মাঠে মাঠে আলু তুলে দেওয়ার বিনিময়ে একজন পুরুষের তিনভাগের এক ভাগ টাকা পাওয়া অথবা ফেলে যাওয়া একটা ধানের শিষ কুড়ানোর চেয়ে এভাবে মরে যাওয়াও আনন্দের, বাদল। তুই মনটাকে শক্ত কর।
কী আশ্চর্য! মেক করা মেঘলা এমন পরির মতো সুন্দর? আর আজ একদিনেই যেন সে অনেক বড় একজন মানুষ হয়ে গেছে। একজন নারীর পরিপূর্ণতা তার মলিন, ছেড়া সালোয়াড় পোশাকে এভাবে লুকিয়ে ছিল? উৎকণ্ঠায় বাদলের যেন দম বন্ধ হয়ে এলো। বিপদে পড়লে দোয়া ইউনূস পড়তে হয়। হ্যাঁ, মায়ের বলা গল্পটা তার মনে পড়ল। মাছের পেট থেকে যে দোয়া পড়ে ইউনূস নবী বেঁচে গিয়েছিল– সে চোখ বন্ধ করে বার বার দ্রুত সেই দোয়া পড়তে থাকল। মনে মনে নিজেকে দুষল। সীমা লঙ্গনকারী বলে মনে হলো। এতদূর মেঘলাকে নিয়ে এসে সে-ই তো তাকে জীবন-মৃত্যুর খেলায় নামিয়ে দিয়েছে!
খট খট , ধপ ধপ– শব্দে এক একটা চাকু তক্তাটায় গিয়ে মেঘলার শরীরের আশপাশে বিঁধে যাচ্ছে। বাদল আরো শক্ত করে চোখ বন্ধ করল। না তক্তাটায় নয়, ধ্বক ধ্বক শব্দে প্রতিটা চাকুর ধাক্কা লাগছে তার বুকে। চাকুর শব্দ থামল কিন্তু দ্রুততর হয়ে ওঠা তার হৃৎস্পন্দনের শব্দ থামল না। সে আলতো পায়ে তাঁবুর ভিতর এসে শুয়ে পড়ল। অবশ আর বিবশ শরীর নিয়ে যাত্রা দেখার ইচ্ছাটুকু তার আর থাকল না।
শেষ রাতের দিকে কিসের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। দুই চোখের পাতা খুলল সে। অন্ধকারে অস্পষ্ট একটা নারী ছায়ামুর্তি তার শরীর থেকে খুলে ফেলছে যাত্রার পোশাক। কিন্তু অন্ধকারও মনে হয় তার উন্মুক্ত শরীরের আলোকে লুকাতে পারল না। তার শরীরের ভাঁজগুলো পেন্সিলে আঁকা একটা স্কেচ হয়ে গেল। পেন্সিলের নারী স্কেচ এবার বাদলের সাথে যাত্রাপথে পরে আসা মলিন আর কোমরের কাছে ছিড়ে যাওয়া সালোয়ার কামিজে কিশোরী হয়ে গেল। ধীর পায়ে শিল্পীর পেন্সিলের স্কেচ করা শূণ্য শরীরের অবয়বটি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে থামল। বাদলের পাশে এসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর বোঝার চেষ্টা করল। পাতলা কাঁথাটা পায়ের কাছ থেকে টেনে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিল। তারপর শেষ রাতের মতো মিলিয়ে গেল।
মেঘলা মনে হয় সকাল দশটার দিকে হন্তদন্ত হয়ে ঘুম ঘুম চোখেই বাদলের তাঁবুটার কাছে এলো। বাদল তাঁবুর বাইরে একটা টুলের উপর বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। গুমোট এই পরিবেশ তার ভালো লাগছিল না। মেলাটা ঘুরে মায়ের জন্য খুটখাট কিছু জিনিসপত্র আর গুড়ের জিলাপি কিনে গ্রামে ফিরতে পারলে সে বাঁচে। ফিরতি পথে মেঘলা তার সাথে কাউকে জুটিয়ে দেবে– সেটা মেঘলার জন্য নাকি কোনো ব্যাপারই না। এই দিক-দিগন্তহীন মেলায় অত দূরের গ্রামের কাকে খুঁজে পাবে মেয়েটা? যদি কাউকে না পায়–তাহলে সে কীভাবে বাড়ি ফিরবে? বেশিদিন দেরি হলে বাবা তাকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেবে। তার রেশটা মায়ের উপরও পড়বে। সব এলোমেলো লাগছিল। হেমন্তের সকাল দশটাও যেন অনন্তবেলার মতো লাগছিল। গ্রামের নির্মল সকাল, পুকুর জলের টলটল জল তাকে টানছিল।
রাতের যাত্রাপালা আর সার্কাসের লোকদের কেন যেন বাদলের মুখোমুখি হতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে, তক্তাটায় এক একটা প্রবিষ্ঠ চাকু নিজেদের বুকে নিয়ে মানুষগুলো মুখে হাসি ফুটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে তাঁবু থেকে বের হয়ে মেলার দিকে যেতে চাচ্ছিল। ঠিক তখনই মেঘলা এলো। চোখে মুখে মেক আপের কিছু অংশ লেগেই আছে। গভীর ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে ওঠা মেঘলাকে খুবই অন্যরকম, অচেনা দেখাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে চেনা মেয়েটা যেন হঠাৎই একজন পরিপূর্ণ সুন্দরী নারী হয়ে উঠেছে। মেঘলা হন্তদন্ত হয়ে বলল,
আহা, তুই এতক্ষণ কিছুই খাসনি। আমি পরোটা আর মুরগী দিয়ে বুটের ডাল আনতে পাঠিয়েছি। কখন উঠলি? ঘুম হয়েছে? চল দেখি, তোর তাঁবুর ভিতরটা একটু গুছিয়ে দিই। বলে নিচু হয়ে বসে মেঘলা নির্দ্বিধায় দুইহাতে বাদলের পা দুটো নার্সের মতো দেখল।
বাহ, বাদল। এত তাড়াতাড়ি আমাদের দুজনেরই পা ঠিকঠাক হয়ে গেছে। তবু, তুই আজকে আর মেলার দিকে যাস না। নাস্তা করার পর আমি আবার মলমটা লাগিয়ে দেবো। বস, আমি একটু চোখ-মুখ ধুয়ে আসি। একসাথেই নাস্তা করব।
বাদল তার কোনো কথার উত্তর না দিয়ে অবাক হয়ে মেঘলার দিকে তাকিয়েই থাকল। গ্রামের ভাষাটা মেয়েটার মুখ থেকে একদম হারিয়ে গেছে। যাত্রায় অভিনয় করতে গেলে তো ঠিকঠাক ভাষাই ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু যে নারীকে প্রতিরাতে চাকুর সামনে বুক পেতে দিতে হয় তার জীবনের ভাষাটাও কি বদলে যায়?
খিদে পেটে সকালের নাস্তাটা দারুণ লাগল। নাস্তা শেষ করে মেঘলা বুকের কাছে সযত্নে লুকিয়ে রাখা একটা পঞ্চাশ টাকার নোটের সাথে কয়েকটা বিশ টাকার নোট বাদলের হাতে দিয়ে বলল,
আমার জীবনের প্রথম বড় ইনকাম! এ আমি তোর হাতেই তুলে দিয়ে ধন্য হতে চাই, রাখ বাদল। তোকে দেবার মতো আমার তেমন তো কিছু নাই তবে তোর এই গরীব বান্ধবি তোকে বড্ড ভালোবাসে– মনে রাখিস। এতক্ষণে বাদলের মুখে একটা বাক্য এলো। সে অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
তোর মাথা নষ্ট হয়েছে? তোর এত কষ্টের টাকা আমাকে দিতে হবে না। মেলায় ঘোরার জন্য মা আমাকে টাকা তো দিয়েছই।
তুই যদি, এটা না নিস– তাহলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে! এসবের মানে বোঝার মতো যথেষ্ট বড় তুই হসনি!
বাদল চমকে মেঘলার দিকে তাকাল। মনে হলো, তার চেয়ে দশ-পনেরো বছর সামনে গিয়ে একজন যুবতী তার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে মিনতি জানাচ্ছে। মেঘলা জোর করে বাদলের হাতে টাকাটা গুজিয়ে দিলো। বাদলের বিছানা গুছিয়ে বলল,
আজ আমার রিহার্সেল আছে। যাত্রাতে অভিনয় করতে হবে। তোর একা একা খারাপ লাগবে না তো?
আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
পথ ভুল করবি না তো?
আরে এই সার্কাস এলাকা কে না চিনবে?
তাড়াতাড়ি ফিরিস…
৬.
কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে, জীবনের বিচিত্র পসরা দেখতে দেখতে মেলার কোন প্রান্তে সে এসে পৌঁছাল– তা আর বাদল বুঝল না। গরুর হাটই দিক-দিগন্তে ছড়ানো। নিজেদের কয়েকটা করে গরু মেলায় এনেছে গৃহস্থের দল। টিনের বেড়া দিয়ে তারা এক একজন সংসার পেতেছে। হাজার হাজার সংসার! গোবরের গন্ধের সাথে রান্না করা খিচুরির গন্ধে বাদলের বেশ কয়েকবার বমি বমি লাগল। সে দ্রুত গরুর হাট এলাকা থেকে বের হলো। অনেকগুলো সার সার মিষ্টির দোকান পেরিয়ে পৌঁছাল কাসা-পিতলের হাড়ি-পাতিলের বাজার এলাকায়।
কী কেনা যায়? গ্রামে বিদ্যুত তো প্রায়ই থাকে না। মা প্রতিনিয়ত হারিকেনে কেরোসিন তেল ভরতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েন। কেরোসিন মাটিতে পড়ে যায়। অনেক ঘুরে ঘুরে সে দশ টাকা দিয়ে প্লাস্টিকের তিনটা ফানেল কিনল। ফানেলগুলোর নল হারিকেনের কেরোসিন প্রবেশের মুখে ঢোকে কিনা তা যাচাই করল। মেঘলার মায়ের জন্য চুরি, স্যান্ডেল আর কম দামেই একটা বটি কিনল। আহা, বেচারা! পুরোনো ধারহীন বটিতে কষ্ট করে তরকারি কাটাকুটি করে। এর মধ্যেই দেখল অনেক লোকজন ছোটাছুটি করে বানের মতো একদিকে যাচ্ছে। জাদুকর এসেছে, কাগইলের জাদুকর! একটা মেয়ের মাথা কেটে আবার জাদুবিদ্যায় তাকে বাঁচিয়ে তোলে যে জাদুকর।
কী আশ্চর্য! এ কেমন মেলা? মেয়েগুলোই যেখানে চাকুর সামনে সার্কাস আর জাদুর বলির পাঠা! একজন এসে তার পিঠ চাপড়ে দিল।
কে বা? মাস্টার স্যারের বেটা না?
বাদল অবাক হয়ে পেছন ফিরল। এই মেলাসমুদ্রে একজন চেনা মানুষ পাওয়া গেল! এই মেলায় এসে বাদল এই প্রথম বুঝতে শিখেছিল– অনেক বেশি মানুষের মধ্যেই মানুষ আসলে অনেক বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। হ্যাঁ মানুষটা চেনাই বটে। বাদলের দুই ঠোঁটে হাসি ফুটল,
আবুল চাচা।
আমি দূরত থ্যাকা দেকা পরায় দৌড়ায়া আসিচ্চি আর ভাবিচ্চি, মাস্টার স্যারের ছল ছাড়া এত সুন্দর মানুষ তো কেউ হবার পারে না! তুমি এই মেলাত ক্যা বা? মেঘলার প্রসঙ্গ বাদল এড়িয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করে,
আপনি কবে গ্রামে ফিরবেন?
কালকাই বারে! সকালে।
আমাকেও তো বাড়ি ফিরতে হবে।
তোমাক লিয়া যামু, বা। আসো হামাগেরে আড়া একটু দূরেই। গরু এনেছিল আবুল চাচা। সবগুলো বেঁচাবিক্রি শেষ বলে তাদের টিনের ঘর ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আজ রাতে তারা সবাই মিলে সার্কাস আর যাত্রাপালা দেখবে। বাদল বলল,
চাচা, আমি কাল সকাল আপনার এখানে আসব। আমি রওশন সার্কাসের এলাকাতেই আছি।
খ্যায়া যাও। গরুর গোবর আর খিচুরির মিশ্রিত গন্ধটার কথা মনে হওয়ায় বাদল বাধ্য হয় মিথ্যা বলতে,
না, দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছি। আবুল এবার সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
তুমি রওশন সার্কাচের ওটি কার কাছে আচো বা? মেগলা না তো? ওই ম্যায়ার খবর পুরা ম্যালা ছড়ায়ে গেচে ক’লে…
কপালে দুশ্চিন্তার রেখা নিয়েই তাঁবুর উদ্দেশে পা বাড়ায় বাদল। নিজেকে নিয়ে নয়, বাবা যদি এসব জানে তাহলে মায়ের সাথে হট্টগোল পাকাবে। না মেঘলার কাছে থাকার বিষয়টা ছড়িয়ে পড়ার আগেই তাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।
একে তাকে জিজ্ঞাসা করে করে সে আনমনা হয়েই তাঁবুতে ফেরে। তাঁবুগুলোর সামনের দিকটা বাদ দিয়ে সে পেছনের দিক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর নিজের গন্তব্যটা খুঁজতে থাকে। একটা তাঁবুর পেছন দিয়ে যাওয়ার সময় ফিসফিস নারীকণ্ঠের সাথে মৃদু অথচ গমগমে একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে। কণ্ঠটা মনে হয় মেঘলারই। বাদল চমকে, থমকে দাঁড়ায়। কাপড়ের তাঁবুর পেছনের ছোট্ট জানালাটার কাপড় উপরে উঠানো। অনিচ্ছাতে সত্বেও বাদলের চোখ যায় তাঁবুর ভিতর। শুধু ব্লাউজ পরা একজন নারীর বুকের উপর শুয়ে এত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একজন ত্রিশোর্ধ্ব পুরুষ যে জগতের কোনো কিছুর দিকে তার খেয়াল নেই। পুরুষটার বিরাট ঘন গোঁফ প্রাচীন কালের ভারতীয় সম্রাটদের মতো গালের দিকে প্যাচানো । হঠাৎই নারীটাকে দেখার ইচ্ছাকে দমন করতে পারল না বাদল। সে ভালো করে তাকাল এবার। মেঘলা! হ্যাঁ, মেঘলাই বটে। মনোযোগ দিয়ে মেঘলার সৌন্দর্য উপভোগ করা পুরুষটার কাছ থেকে নিজেকে নিজের কাছে আড়াল করতে যেন অন্য কোনো এক জগতে সে ডুবে আছে। যেখানে সে খুব একা!
এই দৃশ্য ভালো না খারাপ তা বুঝতে পারল না বাদল। শুধু বুকের প্রান্ত বেয়ে কেমন অদ্ভুত এক বাঁশির সুর বয়ে চলল। মেঘলার প্রতি ঘৃণা নয়, করুণাও নয় –কেন এত মায়া জন্মাল তা সে জানে না। নীলাকাশ নিজের শরীরে আরো নীল মেখেছে। কয়েকটা ছেড়া ছেড়া সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। বাদলের নিজেকে এই ছাড়া ছাড়া মেঘের মতো মনে হলো। চোখের চেয়েও বাদলের বুকটাই বেশি ভিজে উঠল। বাদল বুঝল, কেন মেঘলা তাকে শেষবারের জন্য এই পথের সঙ্গী করেছে।
যাত্রার মানুষটাকে চিরসঙ্গী করার সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে তাহলে? এই সার্কাসের জীবন যেমন চোখ বেঁধে দিয়ে ছুটে আসা ধারালো চাকুর সামনে মেঘলাকে দাঁড় করিয়ে দেয়, এই সমাজ তেমনি ধারালো চাকু হয়ে, পুরুষ নামের জাদুকরের তরবারি হয়ে মেঘলাদের মস্তক-হৃদয় দ্বিখণ্ডিত করে দেয়।
গতকাল রাতের কয়েক ঘণ্টা মেঘলাকে পরিপূর্ণ এক নারীতে রূপান্তর করিয়েছিল। আর আজ দিনের কয়েক ঘণ্টা তরুণ বাদলকে গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন এক পুরুষে রূপান্তরিত করল। তবে, সকালে দেওয়া টাকাগুলোর প্রতি তার ভীষণ আক্রোশ আর ঘৃণা জন্মাল। সে বুকপকেট থেকে টাকাগুলো বের করল। কয়েকজনের কাছে চেয়ে-পেতে এক টুকরা কাগজ আর কলম জোগাড় করল। মেঘলাকে এই প্রথম ‘তুমি’ সম্বোধন করে লিখল–
মেঘলা তুমি তোমার জীবন বেছে নিয়েছ। আমাকে এখন আমার পথে ফিরতে হবে। স্যরি, মেঘলা, তোমার এত কষ্টে উপার্জন করা টাকাগুলো নিতে পারছি না। ভালো থেকো।
কাগজটার নিচে সেই পঞ্চাশ আর বিশ টাকার কয়েকটা নোট রেখে সে তাঁবু থেকে দ্বিধাহীন বের হয়ে গেল। জীবনের যে চরম নিষ্ঠুরতা সে দেখে গেল– তার কাছে একা একা পথ চলতে চলতে ধানকাটা ক্ষেতের নাড়ার আঘাতে পা দুটোর আহত হওয়া বড় কিছু নয়। তবে যাবার পথটা ধরতেই তার মনে হলো– সামনের গ্রামে একটা বটগাছ আছে। সেখানে বসে সে আর মেঘলা আজলা ভরে জল খেয়ে কি অসীম পরিতৃপ্ত হয়েছিল।
৭.
এতক্ষণ ধরে কী ভাবছ, বাদল? কি আশ্চর্য, তুমি এতটা বিষণ্ণ হয়ে উঠেছ! আচ্ছা, মেঘলা নামের এই মহিলাটা কি তোমার চেনা? স্ত্রীর কথাগুলো যেন দূর কোনো অতীত থেকে ভেসে এলো। টুম্পার দিকে তাকিয়ে বাদল ঠিক যেন বুঝল না– এই নারীটা আসলে কে? এতদিন এতভাবে কাছে, পাশে থেকেও নারীটি যেন এখনো অচেনা। টুম্পা, মেঘলা? কে সে? এতগুলো বছর পাশে থেকেও এই নারী কি মেঘলার সেই একটা দিনের মতো এত পরিচিত হতে পেরেছে? অথবা শুধুমাত্র সামাজিক বৈষম্যের যাঁতাকলে ভাগ্যাহত এক নারীর জীবনের মতো এক স্ফটিক জলাধার হতে পেরেছে– যার সামনে দাঁড়ালে নিজেরই জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়? সাজানো গোছানো সংসারের এই নারীটি কি জানে একটা মেলায় জীবন কতভাবে কথা বলে? টুম্পা আবার প্রশ্ন করল,
তুমি মহিলাকে চেনো?
বুকের ভিতর হৃদপিণ্ডের দিকে কোন এক অদৃশ্যলোক থেকে একটার পর একটা ধারালো চাকু ভেসে আসছে। টুম্পার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বাদল ধীর পায়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করল। তার আলমিরার ড্রয়ারটা খুলল। সারাজীবন যত্ন করে লুকিয়ে রাখা সেই দামি পিতলের ছয় বেহারার পালকিটা বের করল। কতক্ষণ পালকিটার দিকে সে ভাষাহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। দিগন্তজোড়া হেমন্তের এক মাঠে একজোড়া অসহায় চোখের ভাষা কথা খুঁজে ফিরছে–
আমি সেই পা ভাঙা দোয়েল পাখিটা যার সাথে তোর একদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। আমার যেদিন কবর হবে, সেদিন কি তুই থাকবি, বাদল?
অলংকরণঃ তাইফ আদনান