জলধি / গল্প / ফাল্গুনী দে'র দুটি অণুগল্প
Share:
ফাল্গুনী দে'র দুটি অণুগল্প
বিসর্জন

- তোমার মোবাইলে পুজোর ঢাকের কলার টিউন শুনলেই মনটা কেমন হুহু করে ওঠে। উদাসী সুর আমাকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। 

- আমার নতুন ফোন পয়মন্ত বলতে হবে ! টেক্সট মেসেজের চ্যাটার প্যাটার ছেড়ে বেরিয়ে এসে প্রথম ফোনটা করলে অবশেষে। 
- এই প্রথম এই শেষ মশাই। নেহাৎ পূজোর শুভেচ্ছা আমি সবাইকে ফোন করে জানাই। তুমি তো এখনও প্রোফাইল পিকচারে নিজের মুখ অব্দি দেখালে না। এই ছয় মাসে যার সাথে রাত জেগে এতো এতো কথা, তার মুখটুকু দেখার অধিকার নেই ? 
- মুখ দেখে কি হবে ? এইতো বেশ কথা বলছি, হাসছি প্রাণ খুলে। এইকি যথেষ্ট নয় ! 
- তবুতো মানুষের একটা আগ্রহ থাকে নাকি ? কল্পনার সাথে মেলাতে ইচ্ছে করে না ?
- যদি তোমার কল্পনার সাথে না মেলে ! ধরো আমি একটা কুৎসিত, মোটা, অর্বাচীন লোক। তাহলে আর ভালোবাসবে না ? 
- ধূর, ভয় দেখাবে না বলে দিলাম। আমি ফোন রাখছি। 
- তোমাকে কিন্তু অষ্টমীর দিন অঞ্জলীর সাজে দারুন লাগছিল। 
- ও মা সেকি ! কোনদিন যদি ভিড়ে পাশে এসে দাঁড়াও আমি তো জানতেও পারবো না। ভারি অন্যায়। এমনটি কিন্তু কথা ছিলনা। আমি ফোন রাখলাম। ভীষণ রাগ করেছি।
- দশমীর দিন দেখা হবে। কথা দিলাম। 
- ও মা চিনবো কি করে ! এতোই যদি লজ্জা, ঘোমটা পরে এসো, ওটা দেখলেই চিনে নেবো। 
- সে আর দরকার হবে না মাতন। তোমার ভাইয়ের সাথে পূজোর মধ্যেই ভাব জমিয়ে নিয়েছি।
- তুমি তো আলেকজান্ডার হে !
 
একের পর এক প্রতিমা নিরঞ্জন চলছে। মানুষের ভিড়ে, ঢাকের আওয়াজে, শাঁখ আর উলুধ্বনিতে এলাকা সরগরম। ভিড়ের মধ্যে বইয়ের পাতার মতো এক একটি মুখ পাল্টে পাল্টে মাতন অপেক্ষা করে কখন সে পৌঁছাবে গল্পের সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্লাইম্যাক্স এর পাতায়। 
বিকেলে ভাই কনফার্ম করেছে তার নতুন বন্ধুকে সে প্রতিমা বিসর্জনের টিমে দেখেছে। 
 
সন্ধ্যে প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। দূরে চেয়ারে বসে লাল্টু'দা হাঁক পাড়ে - "জলের তলায় আর কেউ থেকে গেলো নাতো ? দেখিস বাবা।" 
শুনেই মাতনের বুকে বজ্র-বিদ্যুৎ খেলে যায়। পাগলের মতো এক নাগাড়ে ফোন করেই চলেছে। বেজে যাচ্ছে ঢাকের অসহ্যকর বিসর্জন বাজনা। বাড়ি ফেরার আগে চোখের জলে মাতন হোয়াটসঅ্যাপ করে - "মানুষ লাজুক হয় জানতাম, নির্লজ্জ কাপুরুষ হয় জানতাম না। শুধু একটিবার বলো, তুমি এখন কোথায় ?"

ডাঙ্গা পাড়ের বট
ডাঙ্গা পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশজোড়া প্রাচীন বট। মাটির গভীরে চিরঘুমে শায়িত অপঘাতে মৃত সুন্দরী উমাইজা। জনশ্রুতি বলে কবরের উপর পোঁতা গাছে জিনের বাস। খোলা আকাশের নিচে তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে। তার উপর মেয়েমানুষের কবর বলে কথা ! বহু শাখা প্রশাখা বিস্তারে যেন দশ হাতে ব্যাটাছেলেদের ডাকছে।  
 
ভিন গাঁ থেকে এসে ঝাঁকড়া চুলো একটা পাগল লোক বটের নিচে ডালপাতার কুঁড়েতে বাস করে। সারাদিন নেশা করে। মাঝে মাঝে হাউ হাউ করে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাথর কেটে কেটে মূর্তি বানায়। নারী মূর্তির এমন আদল এই তল্লাটে কেউ কোনোদিন দেখেনি।
 
কস্মিনকালে এই বটে ফল ধরেনি। কাঠবেড়ালি আসেনি। একটা পাখির বাসা অব্দি না। রাত্রিবেলা অলৌকিক বটের চারপাশে মূর্তিগুলো গলে গলে কালো হয়ে ওঠে। দিনেরবেলা আয়তনে ফুলে ফেঁপে হয়ে ওঠে বরফ সাদা। লোকটি প্রচন্ড রাগে মূর্তির গায়ে সজোরে আঘাত করে। চুল ছিঁড়ে এদিন ওদিক ছুটে বেড়ায়। গভীর রাতে গাছের কোঠরে উন্মাদের মতো অস্থির সঙ্গম করে।


অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন