জলধি / গল্প / প্রেসিডেন্ট
Share:
প্রেসিডেন্ট
আজ বাংলাদেশ এর পঞ্চাশতম  বিজয় দিবস। বাংলাদেশ সাজ সাজ রবে সেজেছে। মার্কিন  প্রেসিডেন্ট আসছেন বাংলাদেশে । আপ্যায়নের ব্যাপারে বাংলাদেশ এর প্রধানমন্ত্রী খুবই কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। সব ধরনের নদীর মাছ, বাংলাদেশের সব সবজি, সব ফল যেন থাকে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নিজে আদেশ দিয়েছেন। আনানো হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের পিঠা যেমন; মুগপাকন, বিবিখানা, রসে ভিজানো চিতই,
চালের রুটি, হাঁসের মাংস, ছিটারুটি ইত্যাদি।  যশোর থেকে প্রধানমন্ত্রী আনিয়েছেন কাঁথাষ্টিচ এর নকশীকাঁথা।  মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন তিনি বাংলাদেশে এসে ঐ দিনই টুঙ্গিপাড়া  যাবেন জাতির জনকের সমাধিস্থলে। গিয়েছেন ও।
গিয়েছেন রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। 
 
এসেই একবার চুমু খেয়েছেন জাতীয় পতাকায়। প্রেসিডেন্ট শুরুতেই বলেছিলেন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নৈশভোজ করতে চান। গনভবনে সেরকমই ব্যবস্থা হয়েছে। বিশেষ করে তিনি জীবিত সব নারী মুক্তিযোদ্ধা যেন উপস্থিত থাকে সে ব্যপারে বলে দিয়েছেন।  নৈশভোজে বসে প্রেসিডেন্ট খোঁজ করেছেন সজনা ডাটা দিয়ে ডাল। ছিল সেটাও। নৈশভোজ শেষে প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা করবেন। আজ মুক্তিযোদ্ধারা ভীষণ খুশি তাঁরা সম্মানিত।  গণভবনে আজ হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা বসে আছেন। আছেন বেশ কয়েকজন নারী মুক্তিযোদ্ধা।  গনভবনে আসার জন্য সব মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হয়েছে নতুন  কাপড় কেনার টাকা। সবার নতুন কাপড় নিশ্চিত করেই প্রবেশ করানো হয়েছে গনভবনে। 
 
শুরু হয়ে গেছে প্রেসিডেন্টের বক্তৃতা। প্রথমেই তিনি ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মার প্রতি সম্মান দেখান, সাড়ে চার লাখ নারী মুক্তিযোদ্ধার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা  জানান। এবার তিনি বাংলা বলতে শুরু করেছেন। সবার চোখে বিষ্ময়।
প্রেসিডেন্ট বলছেন; আজ আমি আপনাদেরকে দুজন মানুষের কথা বলবো। তাঁদের একজন ফরাসি আর একজন বাঙালি।
 
আমার বাবার নাম জ্যাঁ কুয়ে।  ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর ফরাসির ওর্লি বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তানের পি আই এর ৭২০ বি বিমানটি ছিনতাই হয়।  ছিনতাইকারী  যাত্রী বেশে  কিছুক্ষণের মধ্যেই ককপিটে ঢুকে কোপাইল্ট আর পাইলটের মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ধরে জানান বিমানটি ছিনতাই হয়েছে। ছিনতাইকারীর দাবী কোনো  টাকা পয়সা ছিলো না। ছিলো ভারতের শরনার্থী শিবিরে আটকে পড়া ঔষধ ও পথ্য। ঐদিন বিমানবন্দরে আসার কথা ছিলো  জার্মান চ্যান্সেলর আর ফরাসি রাষ্ট্রপতির।  ঐ ফাঁকেই কুয়ে ঢুকে যান।
 
সেদিন জ্যাঁ কুয়ে কোন টাকা  পয়সা দাবী করেন নি।  দাবী করেছিলেন ভারতীয় শরনার্থী শিবিরে আটকে পড়া বাংলাদেশীদের জন্য ঔষধ আর পথ্য। কুয়ে বুকে হাত দিয়ে দেখাচ্ছিলেন তার বুকে বোম বাঁধা আছে দাবী না মানলে তিনি বিমান উড়িয়ে দেবেন। অতপর দুজন রেডক্রস কর্মী আসে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। প্রকৃত পক্ষে তারা ছিলো পুলিশ। ধরা পড়ার পর দেখা যায় যেটাকে তিনি বোমা বলেছিলেন সেটা আসলে একটা বাইবেল আর একটা অভিধান।  যদিও উপস্থিত সবাই বলেছিলেন যে কুয়ে কারো ক্ষতি করেন নি। তিনি যা করেছেন মানবতার জন্য করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি পাঁচ বছর জেল হয় জ্যাঁ কুয়ের । এখানেই সব শেষ নয়। বাংলাদেশ এর জন্য তিনি ছুটে গেছেন অষ্ট্রেলিয়া, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, ভারত সব জায়গায়। কুয়ে এর এই অভিযান এর প্রতি সম্মান দেখিয়ে ফরাসি রেডক্রস আর মাল্টার কিংস হসপিটাল ভারতীয় শরনার্থী শিবিরে ২০ টন ঔষধ পথ্য পাঠিয়েছিলো। কিন্তু আফসোস বাংলাদেশ  স্বাধীন হয়ে কুয়েকে কোথাও এতটুকু স্মরণ করেনি।
 
আমি আরেকজন বাঙালি নারীর কথা বলতে চাই যিনি একজন নারী মুক্তিযোদ্ধা। যাকে পাকিস্তানী ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছিলো পনেরো দিন। প্রতিদিন অন্তত পাঁচজন পাকিস্তানি সৈনিক তাকে ধর্ষণ করত পালাক্রমে। খাবার বলতে পাউরুটি, কলা আর পানি এসবই দেয়া হত। অবশেষে তিনি পালিয়ে বেঁচে ছিলেন পাহারায় থাকা ঘুমন্ত দুইজন পাকিস্তানি সৈন্যকে আঘাত করে । নয়মাস তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন বিভিন্নভাবে। কখনো ক্যাম্পে গিয়ে নিজে ধরা দিয়েছেন আবার কখনো গেরিলাদের খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে পরিবার তাকে আশ্রয়  দিতে চাইলো না।  পরিবারের আত্মসম্মানে বাঁধলো। 
 
নসীমন ছিলেন শ্যামা মেয়ে তার চোখদুটো ছিলো পদ্মদিঘির মতো টলটলে।   মাথায় ঘন কালো চুল। আর হাসি ছিল ভুবন ভোলানো। কুয়ে তখন কাজ করছিলেন যশোর সীমান্তে যুদ্ধের অবস্থা নিয়ে। কুয়ে প্রেমে পড়ে যান নসীমনের। বিয়ে করে নিয়ে যান আমেরিকাতে।  আর আমি কুয়ে  ও নসীমনের একমাত্র পুত্র সন্তান।
বাবা মারা যান আমার বারো বছর বয়সে। মা ছোট বেলা থেকেই আমাকে বাংলা শিখিয়েছেন। বাংলা কবিতা পড়ে শোনাতেন। মা আমাকে লালন গীতি, নজরুল গীতি শোনাতেন। মায়ের খুব প্রিয় কবি ছিলেন 
জীবনানন্দ দাস আর নজরুল। প্রায় প্রতিদিনই  মা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতেন। মা আমেরিকার গিয়ে আইন পড়েছিলেন। আমেরিকায় মা মানবাধিকার কর্মী ছিলেন।
 
শেষ বয়সে মা  ডিমেনশিয়া আক্রান্ত হয়ে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন।  স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন কিন্তু  জয় বাংলা আর বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত শুনলে চুপ হয়ে থাকতেন। অপার বিষ্ময়ে সবাই শুনছে প্রেসিডেন্টের ভাষণ। এবার কুয়ে ঘোষণা দেন তিনি বাংলাদেশে একটা প্রকল্প করবেন যেখানে গরুর খামার হবে,  আম বাগান হবে, সবজি বাগান হবে আর হবে নারী ও অসহায় মুক্তযোদ্ধাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। এরপর বাংলাদেশ এর প্রধানমন্ত্রী সশ্রদ্ধ চিত্তে কুয়েকে কে স্মরণ করেন। আর সবাইকে অনুরোধ করেন জ্যাঁ কুয়ের  এর উদ্দেশ্যে স্যালুট দিতে। এবং তিনি বিনম্র চিত্তে মার্কিন  প্রেসিডেন্ট কে জানান তিনি কুয়েকে কে সর্বোচ্চ সম্মানিত করার ব্যবস্থা করবেন। 
 
পরিশেষে, প্রেসিডেন্ট জানান তিনি সবার সাথে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে চান। তিনি জানতে চান; যশোর অঞ্চলের কোনো নারী মুক্তিযোদ্ধা আছেন কিনা। সত্তুর বছর বয়স্ক নমিতা দাসকে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট নিজে এসে হাত ধরে মাইকের সামনে নিয়ে যান নমিতা দাসকে। নমিতা দাস আর প্রেসিডেন্টের যৌথ কণ্ঠে  শুরু হয়" আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।" অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল। টিভি স্ক্রিনের সামনে থাকা সমস্ত বাঙালির কণ্ঠে তখন,"আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি"
 
দ্রষ্টব্যঃ ফরাসি নাগরিক জ্যাঁ কুয়ের ত্যাগের শ্রদ্ধায় নিবেদিত।


অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন