জলধি / গল্প / পার্সেল
Share:
পার্সেল

আমার বাড়ির এই দিকটায় সন্ধ্যাবেলায় না থাকে দিনের আলো, না জমে ঠিকঠাক রাতের আঁধার। যার দরুন ষ্ট্রীট লাইটগুলো পরিপূর্ণতা পায় না! এমন আলো-আঁধারির আবছায়াতে কোনমতে গাড়ি, বাড়ির পার্কিং লটে এনে দাঁড় করাই। গাড়ির পেছনের ট্র্যাঙ্কে সারাসপ্তাহের বাজারঘাট জড়ো করে রেখেছি। সাপ্তাহিক ছুটিরদিনের আগেরদিন কাজ শেষে ফেরার পথে বাজারসদাই করা আমার বহুদিনের অভ্যাস! দু’হাত ভর্তি গ্রোসারি তোলে চটজলদি দোরের কাছে ফিরতে, কিছু একটা তাও বেশ জবরদস্ত দরজা ঘেঁষে অনড়ে পড়ে থাকতে দেখলে, দাঁড়িয়ে পড়ি! পরক্ষণে মনেহলো চাইনিজ প্রতিবেশীর একটি নাদুস নুদুস জার্মান শেপারড আছে, সেটা হয়তো ছাড়াবাড়ি পেয়ে নির্ভারে ঝিমোচ্ছে ! কুকুরে বড়ো ভয় আমার তাই ওকে সরে যেতে অযথা খটরমটর শব্দ করি কিন্তু মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েও এর কোন নড়চড় নেই!

 

ইদানীং জন্তু জানোয়ারও কেমন যেন মানুষের মতো অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছে! সবাই স্বাধীনতা চায় তবে সমস্যা ওই একটাই, অন্যের অধিকার হরণ করে! এবার জিনিসপাতির ভারে হাতগুলো অবস হবার যোগার, সইতে না পেরে ভয় ভেঙ্গে গেটের দিকে পা বাড়াতে দেখি,- কুকুর নয়, ঢাউস সাইজের এক পার্সেল! পুরোদস্তুর ডাকবাক্স  যেন দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে! পা দিয়ে নাড়াতে ওজন টের পেলাম-সাচ্চা জিনিসে ঠাঁসা। কী আছে তাতে, কে জানে! এমন ওজনদার বোচকা টেনে ঘরে তোলা আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই কোনমতে সেটাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ি।

নভেম্বর মাস চলছে। এদেশে থাঙ্কস গিভিং’ নামের লোকউৎসব আসি আসি করছে। এসময়ে পুঁজিবাদ মার্কিনমূলকে জিনিসপাতি কমদামে কেনাবেচার হিরিক পড়ে যায়। কতো রকমের ছাড়-ছাঁটের হাতছানি চলে তার কোন ইয়ত্তা নাই। এই কাটছাঁটের হুজুগে মানুষ নিজের জন্যে সারাবছরের কেনাকাটা যেমন করে বন্ধু-স্বজনদেরও উপহারসামগ্রী যে যার সাধ্যমতো পাঠায়। এবং ডাক-ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহন বেশ সহজ এবং সুলভ হওয়ায় বেশিরভাগ লোক আটপৌরে জিনিসপাতি কেনাকাটায়ও ডাকের সুবিধা নেয়। আর উৎসব হলে তো কথাই নেই। সকাল হতে ডাকেরলোক মানুষের দোরে দোরে সেসব বিলাতে শুরু করে দেয়। তবে ওসব অনলাইন কেনাকাটার ঝক্কিঝামেলায় আমি ভুল করেও যাই না, যদ্দুর পারি নিজহাতে ঘেঁটেছেঁটে বাজারঘাট করি। তবে পার্সেল দরজার ওপাশে পড়ে থাকলেও সেটা নিয়ে নিজমনে বহু প্রশ্নের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে! আমি তো কিছু অর্ডার করিনি তবে এই পার্সেল আমার দোরগোঁড়ায় এলো কী করে! কেউ হয়তো আমাকে গিফট-পার্সেল পাঠিয়েছে! সেরকম সুযোগ দেখছি না! এই ধরাদামে আমাকে পার্সেল পাঠাবার লোক কেউ আছে বলে মনে পড়ছে না!

 

তবে গিফট-পার্সেল’ কথাটা মনে আসা মাত্র বুকটা ধক করে উঠল! অনেকটা পথঘাটে শ্মশানের পোড়াকয়লা- ভাঙ্গা মাটিরকলসি সহসা চোখে পড়লে যেমন করে বুকে বেদনার ঢেউ উথলে ওঠে, সেরকম! পার্সেল’ আমার নামে কখনো আসেনি” এমন কথা বললে নির্ঘাত নিজের সাথে বেইমানি করা হবে। একটা পার্সেল আমার উঠতি- বয়সে নেহাত এসেছিল বটে- অনেকটা সাপ-লুডু খেলার মতো করে! পরিষ্কার করে বললে, আমার জীবনটাকে ওলটপালট করে দিতে! যেন একঝটকায় উঠে গেলাম পথের মাথায় পরক্ষণে কিছু বুঝতে না বুঝতে ধপাস করে পড়ে গেলাম মাটিতে! এই শীতের সন্ধ্যায় সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাসায় ফিরে কই একটু দম নিবো, তা না- এই পার্সেল আমাকে সেই কবেকার স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে শীতকুয়াশার মতো বেদনার চাদরে ডুবিয়ে ছাড়ল!  কলেজ থেকে ফিরতে জানা গেল আমার নামে একটি পার্সেল এসেছে। পার্সেলে কী জিনিস, কে পাঠালো তার কিছুই আমি জানি না! তবে বাড়ির লোকদের ফিসফিসানি কানাকানি দেখে মনে হলো কিছু একটা অবৈধ জিনিস তো বটেই! পুরোদস্তুর জানতে নিজের রুম থেকে অন্দরবাড়ি ঢুকি। বাড়ির সকলে এমন কি আমার মা-ও মুখ আষাঢ়েমেঘে ঢেকে আমাকে এড়িয়ে চলছেন! অবশ্য বাড়িতে সামান্য অঘটন কিছু ঘটলে তাঁর এমন অবস্থা নতুন নয়- এ বাড়িতে তাঁর আলাদা কোন কদর নেই,অনেকটা বাড়ির আসবাবের মতোই এসংসারে তাঁর সংযুক্তি! দেখলাম,তিনি শাড়ির আঁচলে অশ্রু সামাল দিতে ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন! বাড়ির পরিবেশ অনেকটা কালবৈশাখী ঝড়ের আগের প্রকৃতির মতো  নীরব,থমথমে! বুঝতে পারলাম নিজের অজান্তে মহাপাপ করে বসে আছি!

 

বড় চাচার ডাক পেলাম! তিনি বাংলাঘরের খোদাই নকশা করা চেয়ারে অগ্নিদগ্ধকাঠের মেজাজে বসে আছেন! একে তো তিনি চণ্ডাল রোগী তারমধ্যে চোখজোড়া কড়কড়ে লাল হয়ে আছে! অর্থাৎ তিনি আজ কিছু একটা ঘটাতে যাচ্ছেন এমন আশঙ্কায় বাড়ির সকলে যে তঠস্থ তা তার চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে!! ওদিকে আমাদের বাবা বাড়ি নেই! তিনি নিষ্কর্মা,সকাল-সন্ধ্যা তাস পেটান,মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ান, জগতসংসার নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। আমরা বড়চাচার দয়াদাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকি। আমাদের সাথে চাচার সম্পর্ক মালিক-ভৃত্যের ন্যায়! তবে বাড়ির সকলে ভয় আতঙ্কে ডুবে থাকলেও আমার কেন যেন কোন ব্যাপারে বাড়তি উৎকণ্ঠা কাজ করে না। এবং আজকের দিনেও তার ব্যত্যয় ঘটে না! আমার লাজ-লেহাজ স্বভাব-আচার ভালো না- বড় চাচার এহেন অভিযোগের সত্যতা জানি না তবে আমার আলগা ডরভয় আসলেই কম। আমি নির্ভয়ে তার সামনে যেয়ে দাঁড়াই। বড় চাচার পায়ের কাছে চতুর্ভুজাকৃতি একটা বাক্স। বাক্সটি বাঁশকাগজের মোড়কে প্যাঁচানো এবং মোটা কালো কালির হরফে ইংরেজিতে আমার নাম-ঠিকানা লেখা। আমি অবাক হয়ে বাক্সের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেসময় চাচা চরম ক্রোধে কাঁপছেন, কাঁপাহাতে ধরা বয়স্ক-লাঠিটি নাক বরাবর তুলে দু’চোখেরমণি তাতে নিবদ্ধ করে চণ্ডালরোগটাকে বোধহয় জেতেজুতে সামলে নেবার চেষ্টা করছেন! সেসবে আমার চিটেফোঁটা খেয়াল নেই! আমার সমস্ত আগ্রহ সেই চারকোনা বাক্সের ভেতর। আমি হাত বাড়িয়ে পার্সেলটি ধরতে গেলে তিনি নেকড়ের মতো হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন! তার ভাবভঙ্গিতে মনে হল, পার্সেলের ভেতর বোধহয় মার্কিনী অ্যাটম-বোমা আছে আমার হাতের ছোঁয়ায় তা ফেটে যাবে! তবে বড়চাচার এমন আতঙ্কিত হবার একটি কারণ আছে বটে, সেঘটনা বলি। যদিও সেটা একমাত্র কারণ কিনা, আমি ঠিক জানি না। 

 

আমার দাদা তখনকার সময়ে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে মোটামুটি অবস্থাপন্ন ছিলেন। অর্থের সাথে যশের যোগসাজশ সবার ভাগ্যে জুটে না। যেমন আমার দাদা। দাদা মুখ্যত বিষয়সম্পদ পৈতিকসূত্রে পেলেও যশ বিষয়টা তাঁর জীবনে অধরা থেকে যায়। এসব বিষয় অবশ্য শুরুতে তিনি মোটেও গুরুত্ব দিতেন না কিন্তু সমস্যার শুরু হয় তার অতি কাছের বন্ধুর পরিবর্তনের মাধ্যমে! দাদার বাল্যবন্ধু, যোগেন্দ্র নাথ বসুর তল্লাটজুড়ে বেশ নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। তারা একই মাটি- আলো-জলে বেড়ে ওঠেছেন একই ক্লাসে পড়াশুনার কারনে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরও ঘাটতি ছিল না। কিন্তু একটা সময় পর দেখা গেল বন্ধু কেমন বদলে গেল, তাকে অযথা অবহেলা করতে শুরু করল! দিন যায় বন্ধুর তাচ্ছিল্যের মাত্রা বাড়ে! হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা বলে হয়তো বন্ধু একটু বেশি মাত্রায় সুযোগ পেল! বন্ধুর এরূপ আচরণে তিনি যারপরনাই মর্মাহত হলেন এবং সামান্য একটা ইস্যুতে দু’জন মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়লেন!  

মামলায় দু’পক্ষ সমানে সমান লড়ছিল। কথায় আছে- পুলিশে ধরলে এক ঘা, উকিলে ধরলে দশ ঘা। মামলায় যা হয়-উভয়ে মামলার পেছনে সম্পদ ঢেলে প্রায় নিঃস্ব হওয়ার অবস্থায় পৌঁছে এবং অযথা মামলায় জড়িয়ে নিজেদের ভুল হাড়গোস্তে সমানে টের পায় কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হবার দু’পক্ষের হয়ে গেছে! এবং অবধারিতভাবে মামলার শেষ পর্যন্ত তাদের লড়তে হল। তখনকার বিচারব্যবস্থা বড়ো ন্যায্য ছিল, এখনকার মতো পেশিবহুল ছিল না! প্রায় চার বছর পর মামলার ফাইনাল রায়ের আগে পরিষ্কার বোঝা গেল, রায় দাদার পক্ষে যাবে।  

 

সেসময়ে রাতের আঁধারে কে বা কারা একটি চৌকোনা বাক্স আকৃতির পার্সেল,দাদার ঘরের দরজার সন্মূখে রেখে যায়! আমার দু’বছর বয়সী একমাত্র ফুফুর স্বভাবমতো ভোরসকালে ঘুম ভেঙ্গে যায়! কাকভোরে বাড়ির সাহায্যকারী মেয়ের কোলে চড়ে সে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ায়। ফুফুকে কোলে নিয়ে মেয়েটি দাদার ঘরের বাইরবাড়ির উঠোনে গেলে পার্সেলটি তার চোখে পড়ে। সে কিছু না বুঝে পার্সেলটি খুলতে গেলে তরতরিয়ে বেরিয়ে আসে একটি জ্যান্ত দাঁড়াস সাপ! সাপ দেখে মেয়েটি ভয়ে চিৎকার করে দূরে সরে পড়লে তার কোল থেকে ছিটকে ফুফু যেয়ে পড়ে পার্সেলের সামনে! আর এই ফুসরতে ফুফুকে সাপ কামড়ে দিয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে যায়! বিষাক্ত সাপের ছোবলে ফুফুর মৃত্যু হয়। ফুফু ছিলেন দাদার পর পর চার ছেলে সন্তানের পরে হওয়া একমাত্র মেয়ে কাজেই তার মৃত্যুর পর দাদার মাথাখারাপ হয়ে যায় এবং এরপর তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন পাগল হয়ে বেঁচে ছিলেন! ধারণা করা হয় বিরুদ্ধপার্টি মামলায় হেরে যাবে নিশ্চিত জেনে এমন জঘন্য কাজটি করে! 

 

বড় চাচার চোখদুটো ধনুকের তীরের মতো আমার দিকে স্থির হয়ে আছে, ও-দৃষ্টি এমুহূর্তে আমাকে পুরোপুরি কাহিল করে ফেলে। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। যদিও প্রকৃত ঘটনা এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয় যে  চাচার এই ক্রোধাম্বিত মূর্তি কি দাদার সেই প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা স্মরণে নাকি নির্দোষ চারকোণা আমার নাম খচিত এই ডাকবাক্সের কারণে! পার্সেলে আমার নাম-ঠিকানা থাকলেও প্রেরক সম্পূর্ণ অচেনা। প্রেরকের স্থানে একজন আমেরিকান যুবকের নাম ঠিকানা। চাচা পার্সেলের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, লোকটির পরিচয়! সাহেবের নামটি বেশ কঠিন, উচ্চারণ করতে যেন দাঁত খুইয়ে পড়ছিল আমার আর চেনার তো প্রশ্নই আসে না! যদিও শহরের নামটি চোখে পড়তে আমি প্রকৃত ঘটনা আঁচ করতে পারি! কিন্তু আমি বিস্মিত হবার ভান করি! এবং লক্ষ করি এতক্ষণধরে তার চোখের মণি দু’টো রাগে-ক্ষোভে মার্বেলের মতো এদিক-সেদিক ঘুরলেও তা আমার এই অভিনয়ে কেমন ধীর স্থির হয়ে এলো অর্থাৎ আমার অভিনয় যথার্থ হয়েছে। তিনি আমাকে শতভাগ বিশ্বাস করেছেন! 

 

আমাদের বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে পশ্চিমদিকে একটি মজা-ডেঙ্গা ছিল। তারও পশ্চিমে ছিল তাঁতীপাড়া। সেই পাড়ার সকল কাচা-পায়খানার মলমূত্র মজাডেঙ্গায় এসে আশ্রয় পেত! বড় চাচার ক্রোধের-হাতে অসুরের শক্তি নিয়ে একঝটকায় সেই পার্সেল ডেঙ্গার মধ্যিখানে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন! আমার চোখের সামনে তখন সাহেবি নামের অগোচরে লুকিয়ে থাকা জাভেদের বেদনা-বিদূর মুখটা ভেসে ওঠল!

জাভেদের সাথে আমার সম্পর্ক বাল্যকালের অর্থাৎ যে-বয়সে পাপ-পুণ্য বাটখারায় হিসেব করা হত না, তখনকার সময়ের। আমার বয়স পাঁচ, জাভেদের আট-নয় হবে হয়তো। একই গ্রামে বসবাস। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ি হাঁটাপথ হওয়ায় কাকভোরে আমরা একত্রে মক্তবে আরবি শিখতে যাই এবং বেলা উঠতে স্কুলে যাওয়ার নাম করে বনে-বাদাড়ে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াই। এভাবে বেশ কবছর পর তারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে মাঝে বহুদিন যোগাযোগ ছিল না। তারপর যখন আবার যোগাযোগ হলো সেসময়ে আমি সমাজ থেকে পাপপুণ্যের হিসেব নিকেশ পইপই করে শিখে ফেলেছি। এখন চাইলেই দু’জনে বাড়ি ছেড়ে আমাদের সেই স্মৃতি-মেদুর পথেঘাটে হেঁটে বেড়াতে পারি না। জাভেদ আমার বাড়ি ছুতাছাতায় আসলেও আমার তাঁর কাছে ছুটে যাওয়া হয় না। একসময় জানতে পারি পড়াশুনা শেষে সে বিদেশ চলে গিয়েছে এবং সেখান থেকে আমাকে চিঠি লেখে। আমিও দুচারটা চিঠির উত্তর করি এবং এভাবে সবার অলক্ষ্যে আমাদের যোগাযোগটা ঢিলেঢালা করে হলেও রয়ে গিয়েছিল। 

 

বছর দুই পরে আমিও কলেজে ভর্তি হলাম এবং যোগাযোগ চিঠিপত্রের মাধ্যম হলেও সম্পর্ক আগের চেয়ে বেশ মজবুত হল। একটা সময় পর দু’জন দু’জনের মনে বোধহয় পোক্তভাবে বসতি করে নিলাম, তা না হলে এতদিন গোপনে আমার বন্ধুর বাড়ির ঠিকানায় তাঁর চিঠি এলেও এখন আমার ঠিকানায় সরাসরি তাঁর পাঠানো পার্সেল ভিড়ল কি করে! এবং বলতে গেলে পার্সেলের এমনতরো অঘটনের দৌলতে আমাদের সম্পর্ক আরোও দৃঢ় হল এবং দ্রুত ঘর বাঁধার সিদ্ধান্তও নিয়ে নিলাম! জাভেদ দেশে ফিরে সামাজিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে বড় চাচা অবধারিতভাবে তা প্রত্যাখান করেন। বড় চাচা এমন করবেন অবধারিত এবং পরবর্তীতে আমাদের করনীয় ঠিক করা ছিল! এবং সেমতো একদিন কলেজ থেকে জাভেদের সাথে ওর মামাবাড়ি চলে গেলাম! সেখানে আমাদের বিয়ের সমস্ত আয়োজন করা ছিল। বিয়ের পর বছর খানেকের মধ্যে কাগজপত্র গুছিয়ে গাট্টিবোচকা বেঁধে চলে গেলাম জাভেদের কাছে। আমেরিকায় শুরুতে গুছিয়ে নিতে একটু কষ্ট হলেও বছরখানেকের ভেতর আমরা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। জাভেদের পড়াশুনা প্রায় শেষ সেসময়ে ভালো একটি চাকুরি পেয়ে গেল। আমি কলেজে ভর্তি হলাম। দু’কামরার এক বাসা নিলাম, যার ব্যলকনিতে বসে আমরা সকাল-সন্ধ্যা পাহাড়ের গায়ে ঠেসে থাকা আকাশ দেখি। সেখানে আকাশ ক্ষণেক্ষণে রূপ বদলায়,আকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে পাহাড় নানান সৌন্দর্যে সাঁজে। আমরা নিজেদের আকাশ ভাবি, কখনো পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে কতো কী নামে বেনামে ফুল ফোটে। আমরা হাতে হাত রেখে ফুলে ঢাকা পথ ধরে হেঁটে যাই সুখসমুদ্রে। কিন্তু একটা সময় পরে আমাদের তরতাজা সুখগুলো কেমন মিইয়ে যেতে লাগল! শরতের ছেঁড়া মেঘেরা আমাদের মনের আকাশে এলোমেলো দিকশূন্য হয়ে উড়তে লাগল! আমি গোপনে দীর্ঘশ্বাসে অবিন্যস্ত মনের নিশানা খুঁজি আর জাভেদ, ভরা পূর্ণিমায় পাহাড়ে সেইপ্রান্তে চোখ রেখে আড়ালে অশ্রু মুছে! আমাদের দু’কামরার বাসাটা বদলে যায় না; বসার-ঘরের কাছঘেঁষা ব্যালকনি,আকাশ, পাহাড় সবকিছু একই থাকে, এবং আকাশটা তখনও পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমায়, শুধু আমাদের মনের-দূরত্ব অবিরত বাড়তে থাকে! 

 

সবুজ পাহাড়টা একসময় বিবর্ণ হয়- বজ্রপাতে মাথা ভেঙ্গে পড়া প্রকাণ্ড কোন বৃক্ষের মতো ন্যাড়া,ন্যুব্জ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! আমরা ভরাপূর্ণিমার আঁধারে পাশাপাশি বসে গোপনে হাতের কড়ে গুণে গুণে হিসেব মিলাই- বিয়ের আট বছর পেরিয়ে গেছে ! আমাদের মাঝে আজও সন্তান নামের কোন সেতু গড়ে উঠেনি। আমি এবং জাভেদ একটার পর একটা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তাও কয়েকবছর ধরে এবং আমার ফ্যালোপিয়ান টিউব সমস্যা জানা যায়। ডা. আমাদের ষোলআনা নিরাশ করেন না, সার্জারির ভেতর দিয়ে গেলে সহজেই নাকি এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু জাভেদ চিকিৎসা বিষয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়ে যদিও আমার ফ্যালোপিয়ান টিউব সমস্যা ধরা পড়ার পূর্বপর্যন্ত চিকিৎসা নিতে অতিউৎসাহী ছিল! আমার বর্তমান সমস্যা ধরা পড়ার আগের কাহিনী বলি। ছোটবেলায় জাভেদ ফুটবল খেলতে যেয়ে নাকি জায়গা মতো শক্ত আঘাত পায় এবং ডা তখন তার ভবিষ্যৎ পিতা হওয়া বিষয়ে সংশয় জানায়। বিয়ের আট বছর পেরিয়ে যখন আমাদের কোন সন্তান আসে না তখন সে সেই শঙ্কায় ভীত ছিল। বিয়ের দু’চার বছর পেরিয়ে যেতে সন্তানের বিষয় উঠলে তার মধ্যে অধীর অস্থিরতা টের পেতাম! আমাকে তাবৎ দুনিয়ার নিঃসন্তান দম্পতিদের প্রেমকাহিনী শুনাত, আমি তার ঘটনাটা তখন জানতাম না!

 

সেদিনটির কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। দু’দিন ধরে অবিরাম তুষার ঝরছিল, আকাশে বোধহয় চতুর্দশী চাঁদও ছিল। দিনের মতো ফকফকা পরিষ্কার লাগছিল সেদিনের রাত। আমরা অভ্যাসবশত কফির মগ নিয়ে ব্যালকনিতে পাশাপাশি বসে আছি। ডা. কাছে সবে দু’জনে টেস্ট দিয়ে এসেছি, দু’চার দিন বাদে নিশ্চিত রেজাল্ট জানা যাবে। তাকে অতিরিক্ত বিষণ্ণ এবং উৎকণ্ঠিত মনে হলো, যদিও মনটা আমারও ভীষণ খারাপ ছিল। আমি ওর মনটা শান্ত করতে একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওর পাশে বসি। সে খুব অপরাধবোধ নিয়ে ফুটবল খেলার কাহিনীটি বলে। সেই আমি জানলাম! তার গাল বেঁয়ে বয়ে চলা অশ্রু চাঁদের আলোতে ঝিকমিক করছিল! আমার হাতদুটো ওর দু’হাতে শক্ত করে ধরা, চোখে অবুঝ শিশুর মতো আশ্রয়ের প্রার্থনা! ওর অসহায়ত্ব আমাকে খুব পোড়াচ্ছিল! আমি ওর অমন বেদনার্ত চাহনিতে এমনভাবে সংহত হলাম যে আমার সারাজীবনের মা হওয়ার বাসনা মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেল! আমি সন্তানহীন হয়ে আজীবন ওর পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করলে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো খুশিতে কাঁদছিল। আমি নিজেও খুশিতে কেঁদে জারজার হয়েছি একত্রে জীবন কাটাবো স্বপ্নে বিভোর হয়ে।

 

তিনদিন পর রেজাল্ট পেলাম- আমার ফ্যালোপিয়ান টিউব সমস্যা! জাভেদের কোন সমস্যা নেই। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। কিন্তু জাভেদ এমনতর একটি অশুভ সংবাদে উজানের ঢলে গর্ভবতী-নদীর মতো খুশিতে ছলছলিয়ে ওঠে! চুপচাপ স্বভাবের গোবেচারা জাভেদ অনবরত কথা বলেই যায়,বাঁধভাঙ্গা খুশির জোয়ারে সে কী করবে যেন ভেবে পাচ্ছিল না! আমি দমবন্ধ হয়ে যেন মরে যাচ্ছিলাম,আমার কষ্টটা আমার রোগে নয়, উল্লাসিত জাভেদকে দেখে। সেই শুরু! আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বভাব-মেজাজের এক জাভেদকে আবিষ্কার করলাম! এবং আমাদের এতদিনের যাপিত অভ্যস্ততা কিংবা স্বভাবগুলোও তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল! অকারনে গোখডা সাপের মতো ফুঁসফুঁসিয়ে ওঠে! সামান্য ছুতোয় ছাতায় আমাকে দুনিয়ার অভিযোগে বিপর্যস্ত করে; তাতে আমি যত না কষ্ট পাই, বিস্মিত হই ঢের বেশি!

  

স্বাভাবিকভাবে আমাদের বন্ধুত্বটা নিঃশেষ হতে শুরু করে; আমরা সেই দুকামরার বাসায় থাকি, সারাদিনে দু’একটা কথা হয় কিনা! মুহূর্তগুলো এমন হয়ে উঠল; যেমন, সেই আগের মতো তুষার ঝরছে,অভ্যাস মতো আমি দু’মগ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে গেছি, জাভেদ দূর পাহাড়ের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে কফির মগ তুলে নিল কিন্তু চুমুক দিতে ভুলে গেল! আমিও হয়তো ধুঁয়া-উঠা কফিকাপ শীতল হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার পাশে চুপচাপ বসে থাকলাম- বাক্যহীন, জড়’র মতো স্বপ্নহীন, জীবন মৃত। সেই অসাড় জীবন বয়ে নিয়ে গেলাম আরও মাস সাতেক! ডা.র অফিস থেকে চিকিৎসা শুরুর তাগিদ আসতে থাকে। আমি ওদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারি এ চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল! জাভেদকে বিষয়টা জানাতে সে বারুদের মতো ফুঁস করে জ্বলে উঠে এবং বলে, ওসব ফালতু কাজে একপয়সাও খরচ সে করবে না! ওর এমন আচরণে আমার পৃথিবী টলে ওঠে যদিও আমার সমস্যার পর থেকে আমরা দু’জন ভিন্ন জগতে বাস করছি, তারপরও! নিজেকে এতটা ছোট এর আগে কখনো মনে হওয়ার সুযোগ আসেনি! পায়ে-দলা দূর্বাঘাসের মতো অপাংক্তেয় মনে হল নিজেকে! ইদানীং তাকে নিজেকে নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত হওয়াটা আমার চোখ এড়ায় না। দেশে স্বজনদের সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ে বিষয়ে আলাপচারিতা আমার সামনে বেশ সাবলীলভাবে করতে শুনি! জাভেদকে আমি এখনো প্রচণ্ড ভালোবাসি যদিও আমি বাস্তবতা বুঝতে পারছি। জাভেদকে ছাড়া নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা সময়টা চিন্তা করতে কূলকিনারা পাই না যদিও ভবিষ্যৎ সেদিকে দ্রুত হাঁটছে। অর্থনৈতিকভাবে আমি ওর চেয়ে এগিয়ে এবং পশ্চিমা-সমাজ ব্যবস্থায় একা বাস করা বিষয়ে কোন প্রতিবন্ধকতা তো নেই-ই বরং সমাজ এক্ষেত্রে আরও বেশি সুবিধা দিতে প্রস্তুত থাকে। তারপরও জাভেদ যতোটা আমাকে ছেড়ে যেতে তাড়াহুরা করে আমি তার উল্টোটা করি। নিজের সাথে অবিরত যুদ্ধ করে একটা ফয়সালায় আসতে ব্যর্থ হই। নিদ্রাহীন রাত কাটে দিনেরবেলা উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াই। বেহায়ার মতো ভবিষ্যৎ ভাবি- সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু বাস্তবতা কী সবপ্নের পথ ধরে হাঁটে! জাভেদের দ্বিতীয় বিয়ে পাকাপোক্ত হয় ওর মায়েরদিকের কোন পরিচিতের সাথে। অসামান্য প্রতিভাধর মেয়ে ! আমাকে জাভেদের মন থেকে ঝরাপাতার মতো খসিয়ে ফেলতে ওর ভূমিকা অনেকটা ভূত তাড়ানোর সরষের মতো। আমাদের সংসারের টানাপোড়েন টের পেতে দুনিয়ার অপরপ্রান্ত থেকে অপার কৌশলে জাভেদের মনপ্রাণ জয় করে আমার সাঁজানো সংসারটার মালিক বনে গেল মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে! যদিও অফিসিয়ালি তালাক ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে ঘটে না, ততদিনে। সে তালাকের জন্যে মুখিয়ে থাকলেও এদেশে দ্বিতীয় বিয়ের জটিলতায় নিজে থেকে তা করতে পারছিল না। আমি স্বেচ্ছায় তাকে মুক্তি দিলাম! স্বাভাবিক অর্থে সে যদিও ধরে নেয়, জিতে গেছে। আদতে সে হেরে যায়, যা বোঝার ক্ষমতা সে তখন হারিয়েছে!  

 

জাভেদ বিয়ে করতে দেশে চলে গেলে আমি আমাদের সংসার ছেড়ে ভিন্ন ষ্টেট, ক্যালিফোর্নিয়া এসে একা সংসার পাতলাম! চাকুরি ট্রান্সফার নিয়ে আসায় অর্থনৈতিক সমস্যা যদিও হল না কিন্তু নিঃসঙ্গতা বিশেষ করে জাভদেকে হারানোর কষ্ট আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলল! প্রথম অবস্থায় মরে যেতে ইচ্ছে করতো এবং ধীরে ধীরে যা হয়, অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। জীবনের দুঃসহ স্মৃতিগুলোকে কৌশলে এবং আলগোছে মনের গভীরে তোলাকাপড়ের মতো গুছিয়ে রেখেছি! সময়ে-সময়ে তা মুচরে ওঠে, শীতকালের ভোরের মতো মনকে বিষণ্ণতায় ঢেকে দেয়, তারপরও জীবন তো বয়েই চলে! এই শীতের রাতে কে যেন ডোর বেল বাজিয়ে আমাকে বর্তমানে ফেরাল! এতক্ষণ ডুবে থাকা অতীত স্মৃতিস্তূপ থেকে সরে এসে ডোর ক্যামেরায় চোখ ফেরালাম। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক আমার পাশের লেনের বাসিন্দা, তার নাম জর্জ আব্রাহাম। আমাদের বাসার নাম্বার এক হলেও ঠিকানায় একটু প্যাঁচ রয়েছে! আমার ষ্ট্রীট, তার লেন- এখানেই মূল সমস্যা। মাঝেমধ্যে পোষ্টম্যান লেন এবং ষ্ট্রীটের তফাৎ ভুলে যায় হয়তো! আর আমার লেটারবক্সে তার লেটার জমা পড়ে, যেমন আমারটা তার বাক্সে! আজও পোষ্টম্যান ভুল করে তার পার্সেল আমার বাসায় রেখে গেছে! 



অলংকরণঃ তাইফ আদনান