জলধি / গল্প / পান্তাভাতে বার্থডে
Share:
পান্তাভাতে বার্থডে

খাতা কলমে মোঃ সিদ্দিকুর রহমান। ছাত্রদের শব্দে সিদ্দিক স্যার আর গ্রামবাসীর নিকট সিদ্দিক মাষ্টার। গত বছর মাষ্টারের রিটায়ারমেন্ট উপলক্ষ্যে স্কুল কর্তৃক আয়োজিত বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি একটা দামী কথা বলেন। বলেন যে, মানুষ আসলে মরার আগে আরো দুইবার মারা যায়, একবার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শেষ করার দিন আর দ্বিতীয়বার চাকুরী জীবনের শেষ দিন।

রিটায়ারমেন্টের পর বাড়িতে শুয়ে-বসে কিংবা বাজারে গল্প-গুজব করে তার সময় কাটতো, সংসারে সদস্য বলতে আড়াই জন। মাষ্টার ও তার স্ত্রী আর রফিজার মা, যে কিনা দিনের বেলায় মাষ্টারের পুরো সংসারের কাজে সহায়তা করে। ছেলে মেয়েরা সবাই যার যার সংসারে। কেউ দেশে, কেউ বিদেশে। মাস খানেক আগে হঠাৎ করে শ^াসকষ্ট বেড়ে কি দিয়ে হল, মাষ্টারের স্ত্রী মারা গেলেন। খবর পেয়ে ছেলে মেয়েরা ছুটে এলো। ছেলে মেয়ে বলতে দুই ছেলে দুই মেয়ে আর তাদের বাচ্চারা। মেজ ছেলে কানাডায়, ছোট মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বাকি দুটি ঢাকায় থাকে। মাষ্টারের স্ত্রী মারা গেলে ঢাকার দুজন সময়মত আসতে পারলেও দেশের বাইরের দুজন এলো দাফন-কাফন শেষে, মারা যাওয়ার দুদিন পর। করোনাকাল। তাই নানা আনুষ্ঠানিকতার ফেরে পড়ে এই বিলম্ব । সবাই সপ্তাহ খানেক ধরে কান্নাকাটি করে শোক সারিয়ে এবার বিদায়ের পালা। কিন্তু মাস্টারকে বাড়িতে একা রেখে তারা কিভাবে যাবে। আবার যার যার কর্ম ফেলে কারো পক্ষেই যেহেতু বাড়িতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করে মাষ্টারকে দেখভাল করা সম্ভব না। তাই অগত্যা ঢাকার বড় ছেলের বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত হল।

(২)
জায়নামাজে বসে মাগরিবের নামাজের সালাম ফেরাতে যেয়ে মাষ্টার বড় ছেলের বউ রুপা চায়ের ট্রে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। সংক্ষিপ্ত মোনাজাত শেষে উঠে দাঁড়িঁয়ে জায়নামাজটা ভাঁজ করতে করতে রুপাকে জিজ্ঞাসা করলেন- দোদুল উঠেনি?
রুপা চায়ের ট্রেটা বিছানায় রেখে ট্রের পাশে বসে জবাব দিল- না এখোনো ঘুমাচ্ছে।
দোদুল মাষ্টারের নাতি। ক্লাস এইটে পড়ে। ডে-শিফটের স্কুল। আসতে আসতে বিকাল হয়ে যায়। কোন রকমে পাঁচ কেজি ওজনের বইয়ের ব্যাগটা ফেলে বিছানায় ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয়। ঘন্টা খানেক ঘুম দিয়ে উঠে তারপর খাওয়া দাওয়া। অর্থাৎ দাদা যখন সন্ধ্যায় নাস্তা খায়, নাতী তখন লাঞ্চ নিয়ে বসে। আজ দাদা নাতীর লাঞ্চ ও নাস্তা একসাথে হল না, তাই রুপাকে শ্বশুরের এই জিজ্ঞাসা। রুপা পিরিচ দিয়ে চায়ের কাপটা ঢেকে আপেল আর বিস্কুট সামনে ধরলো। মাষ্টার হাত দিয়ে না সুচক ইশারা করে বললেন- এসব খাবো না। শুধু চা দেও।
রুপা পিরিচের উপর কাপটা রেখে শ্বশুরের দিকে এগিয়ে দিল। মাষ্টার শব্দ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলেন। চা খেতে খেতে যখন ঠান্ডা হয়ে আসে তখন শব্দের মাত্রা কমে আসে। রুপা মাথার কাপড় একটু টেনে টুনে নড়ে চড়ে বসে বললো- বাবা, একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
- কও।
রুপা আমতা আমতা করে বললো- কালতো আপনার জন্ম দিন। সবাই আসবে। তাদের জন্যেতো রান্না-বান্না করবো। আপনার কোন কিছুর চয়েজ আছে কিনা।
- আমার আবার কি চয়েজ। তোমরা যা খাবা আমিও তাই খাবো।
- আম্মা থাকলে হয়তো জিজ্ঞেস করা লাগত না। তারপরও আপনি বলেন, আমি ব্যবস্থা করবো।
মাষ্টার লম্বা টানে চায়ের শেষ চুমুকটা শেষ করে কাপটা রুপার হাতে দিয়ে মাথা নিচু করে বললেন- তোমার শ্বাশুড়ি নেই এক বছর হতে চললো। সে থাকতি যখন স্কুলি যাতাম, সকালে খাতাম পান্তা ভাত, সাথে পিয়াঁজ মরিচ। সিডা অবশ্য আমি একা খাতাম না। বাড়ির সবাই খাত্যো। জোনেরা পান্তা খায়েই বেশ সকালে মাঠে চল্যে যাত্যো। তোমার দাদা শ্বশুর কলের গানডা নিয়ে কাচারিতে বসতেন। বেলা যখন এগারোটা বাজত তখন কলের গানের মাইকটা মাঠের দিকে মুখ করে জোরে আব্বাস উদ্দিনের গান ছাড়তো। ওকি গাড়িয়াল ভাই...........। এই গান শুনে জোনেরা বুইজতো নাস্তা রেডি। বাড়িতে যাওয়ার ডাক পড়িছে। সকাল সাতটা থেকে এগারোডা পর্যন্ত টানা চার ঘন্টা মাঠে। এ সময় রোদির তাপও কম থাকে। কাজে কষ্ট কম হয়। এরপর যখন বেলা মাথার উপর উঠতি থাকে কখন আর কাজ করা দায়। তাছাড়া সকালের পান্তাই পেটে কতক্ষন থাকে। পেটেও টান পড়ে।
গান শুনার সাথে সাথে গরু জোড়া কোন গাছের ছায়ায় বাইন্দ্যে একটানে বাড়ি। এই সময়ডারে জোনেরা কয় “নাস্তার বেল”। রুপা মুচকি হাসছে। আর মাঝে মাঝে মাথা নেড়ে শ্বশুরের কথায় তাল দিচ্ছে। মাষ্টার একটানা বলে চলছেন। কিছু সময় থেমে আবার বলা শুরু করলেন- আমার অবশ্য নাস্তার বেলের আগেই বেরোই পড়তি হতো। পান্তা খায়ে পুকুরঘাটে একটা সিগারেট শেষ করে ঝাপ দিতাম পানিতি। গোসল সাইরে‌্য নয়টার মদ্যি রেডি হয়ে সাইকেল নিয়ে বেরোই পড়তি হত্যো। তা নাহলি দশ মাইল সাইকেল চালায়ে দশটায় স্কুল ধরা কঠিন হয়ে যাত্যো। বেরোনোর সুমায় তোমার শ্বাশুড়ী গরম ভাতের টিফিন ক্যারিয়ারটা ধরায় দিয়ে আমার পাছ পাছ বাড়ির বেকি ব্যাড়া পর্যন্ত আইসতো। কিছুক্ষন বিরতি নিয়ে নিচুস্বরে মাষ্টার বললেন- অনেকদিন পান্তা খাওয়া হয় না।
নাস্তার বেল বলতে বুঝাতো নাস্তা খাওয়ার সময় বা বেলা। গ্রামীন কৃষিভিত্তিক সমাজে সারা দিনের প্রধান খাবারের সময় ছিল এটা। মাছের ঝোল, একটা ভাজি না হয় সবজি আর সাথে ডাল। কৃষি শ্রমিকদের সাথে গৃহস্ত কাজের সকলেই এই খাবারের টাইম টেবিলের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। জন অর্থাৎ কৃষি শ্রমিকেরা নাস্তার বেলে বাড়ি ফিরে গোসল সেরে নিত। তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে বেলা তিনটা পর্যন্ত বিশ্রাম, অর্থাৎ কাচারিতে গ্রামোফোনে গান শোনা, বিড়ি খাওয়া আর শুয়ে বসে গড়াগড়ি যাওয়া। কেউবা কাচারির খুঁটির সাথে পিঠ লাগিয়ে সামনে দু’পা ছড়িয়ে দিয়ে গড়গড় করে হুক্কা টানতো। বেলা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লে আবার মাঠে যেত। ঘন্টা দুয়েক কাজ করে গোধূলী লগ্নে লাঙ্গল জোয়ালটা কাধে নিয়ে গরুর সাথে ধূলা উড়াতে উড়াতে বাড়ি ফিরতো। সন্ধায় কখনো গুড়-মুড়ি, পিঠা কিংবা ছোট খাটো নাস্তা জুটতো। এশার নামাজ শেষ হতেই রাতের খাবার প্রস্তুত। ভর্তা ভাত। ভাগ্যে থাকলে অতিরিক্ত হিসাবে সকালের বাসি তরকারী। এভাবে রাত নয়টার মধ্যে কেরোসিনের বাতি নিভিয়ে সারা গ্রাম চলে যেত ঘুমের রাজ্যে।
রুপা আর মাস্টারের কথার মাঝে চোখ ডলতে ডলতে দোদুল এসে হাজির। দোদুলকে মাষ্টারের জিজ্ঞাসা- কিরে আজকে যে স্কুলিরতে আসেই যে শুয়ে পড়িছিস? মাইর খাইছিস নাকি?
দাদার কথায় ভেংচি কেটে দোদুল উত্তর দিল, “মাইর খাইছিস নাকি! মারবে কেন? এখন টিচাররা মারে না। না মেরে উল্টো আমরা বলে- শিশুদেরকে হ্যাঁ বলুন।”
দাদা নাতির বাহাস শুরু হলে রুপা চায়ের ট্রে টা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
 
(৩)
সিদ্দিক মাষ্টার আঞ্চলিক বাংলায় কথা বললেও ইংরেজীর শিক্ষক হিসাবে যখন কথা বলেন কিংবা ক্লাস নেন তখন একদম নেটিভ স্পিকারদের মতোই বলেন। আঞ্চলিক বাংলা বলার পিছনে তার যুক্তি, তিনি মাতৃভাষা হিসাবে আঞ্চলিক বাংলাটাই শিখেছেন। শুদ্ধ বাংলা যা শিখেছেন সেটা কিতাব পড়ে, যার প্রয়োগ আমরা জীবনে খুব কম। কারন তিনি লেখক কিংবা বক্তা নন। তার আশপাশের লোকেরা আঞ্চলিক বাংলায় বলে। তাদের সাথে আলাপকালে তিনি আঞ্চলিকতাতেই তৃপ্তি পান। পাশের ঘর থেকে দোদুলের পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমেরিকা শব্দটা কানে লাগতেই মাষ্টার চেচিয়ে বললেন- কি পড়ছিস? আমেরিকা না, বল  ‘ামেরিখা’।
শিক্ষকতার প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি বিয়ে বাড়ির গেইটে ইংরেজীতে বাহাস করতে হারায়ে যেতেন। আগে গ্রামে কনের বাড়ির গেইটে দু’পক্ষের মধ্যে ইংরেজীতে তর্ক হতো। অধিকাংশ পরিবারে ইংরেজীতে ডিবেট করার মত লোক ছিল না। যেকারনে ইংরেজীতে কথা বলায় পারদর্শী ব্যক্তিদের হায়ার করা হতো। গ্রামের মূর্খ লোকেরা শুদ্ধ বাংলা ঠিকমত না বুঝলেও ইংরেজীর বাহাস শুনে বেশ মজা পেত।

আরেকটি ইংরেজী শব্দের ভুল উচ্চারন শুনে মাষ্টার দোদুলের ঘরে ঢুকে গেলেন। পড়ার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই বলে ইনজিনিয়র হবি? যা হতি চাস সিডা ঠিকমত উচ্চারন করতি না পারলি প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবি তো, ভাই।
দোদুল ক্ষেপে উত্তর দিল- কেন আমি তো ইঞ্জিনিয়ারই বলছি। আমাদের টিচারও তো তাই বলে।
-যেমন ‘গরু’ তেমন শিষ্য। ইঞ্জিনিয়ার না, হবে “এঞ্জিনিয়র”।

(৪)
সন্ধার পর হতেই দোদুলদের বাসায় আত্মীয় স্বজনদের ভীড় বাড়তে লাগলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই কাঙ্খিত লোকজন এসে পড়লো। বাকি রইল শুধু দোদুলের ছোট ফুফুর ফ্যামিলি। তারা আসলেই কেক কাটা হবে। ডাইনিং টেবিলেটা রুমের মাঝখানে রেখে চারপাশে সবাই দাড়ানোর উদ্দেশ্যে ফাঁকা করা হয়েছে। সাদা-সবুজের চেক লুঙ্গীর সাথে নতুন হলুদ পাঞ্জাবীতে মাষ্টারকে বেশ মানিয়েছে। তিনি শুধু কেক সামনে নিয়ে বসে আছেন। বাকিরা দাঁড়িয়ে। এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ। দোদুল দরজা খুলে তার ছোট ফুফুদের রিসিভ করে সরাসরি ডাইনিং টেবিলে এনে হাজির করলো। যেখানে কেক কাটার অপেক্ষায় সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কে যেন লাইটটা অফ করে দিল। কেকের পাশের মোমবাতি জালানোর ফাঁকে রুপা ফয়েল পেপারে মোড়ানো একটা বাসন ফ্রিজ থেকে বের করে এনে মাষ্টারের সামনে রাখলো। মোমবাতি জ্বালানো শেষে সবার চোখ পরলো মাষ্টারের সামনে রাখা পাত্রটির দিকে। সকলের জিজ্ঞাসা- এটা কি?
রুপাা উত্তর দিল- এটা আসলে বাবার জন্য স্পেশাল গিফ্ট। সবার মন উৎসুক করছে। দাবী উঠলো গিফটটা খোলার। বউমা বললো- ঠিক আছে, এটা বাবাই খুলুন।

উপস্থিত বাচ্চাদের তর সইছে না। তারা প্যাকেট খুলতে যে যারমত মাষ্টারকে সাহাজ্য করছে। প্যাকেট খোলা শেষে সবার চোখতো চড়কগাছ। মাষ্টারের চোখে পানি আর রুপার চোখে হাসি। দু’জন চোখাচোখি। এই দৃশ্য দেখে সবাই চুপ। পিনপতন নিরবতা। মাষ্টারের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো- শুধু পেটে ধরলেই মা হয়না, আরো অনেকেই মা।
মাষ্টারের কথা শেষ না হতেই রুপা মাটির পাত্রটা হাতে নিয়ে বললো- তোমরা কেক দিয়ে শুরু কর, আমি এটা দিয়ে শুরু করি।
মরিচের কিছু অংশ ভেঙ্গে নিয়ে এক লোকমা পান্তা ভাত মাষ্টারের মুখে তুলে দিয়ে বললো-হ্যাপি বার্থ ডে টু বাবা।
অন্যরা কেকের টুকরা হতে নিয়ে সম্মিলিতভাবে যে যার মত চিৎকার করল। তার মধ্যে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু’ পর্যন্ত কোরাস আকারে ভালোই বোঝা গেল, কিন্তু বাকিটা বোঝা গেল না। কারন কেউ বলল, বাব, কেউবা, দাদু, কেউবা, নানু, কেউবা আঙ্কেল। কেক হাতে নিয়ে যার যার মত খোস গল্প আনন্দে মেতে উঠেছে। সিদ্দিক মাষ্টার নিজ হাতে পান্তা খেতে খেতে গ্রামের পুরনো স্মৃতির মাঝে হারিয়ে গেলেন।



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন