
আমাদের গ্রামের খোকা মন্ডল পরী নামাতে পারত। আমরা বলতাম ‘ফুল পাতানো’। কেন তার নাম ‘ফুল পাতানো’ তা আমাদের কোনদিন জানা হয়নি। ঘর বন্ধ করে আলো নিভিয়ে খোকা মন্ডল মন্ত্রতন্ত্র পড়ে পরীকে ডেকে আনত। আমরা বাইরের বারান্দায় মা-কাকিমাদের কোলে বসে পরীর কথা শুনতাম। কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম। রাত গভীর হলে পরীরা বিদায় নিত। তখন খোকা মন্ডল পরীদের আনা সন্দেশ বাতসা খাগড়াই আমাদের হাতে বিলিয়ে দিত। সন্দেশ হাতে পেয়ে আমাদের ঘুম জড়ানো চোখ খুলত। সবাই বলত সেই সন্দেশের স্বাদ ছিল অমৃতের মত। যদিও অমৃতের স্বাদ কেমন তা আমরা তখন জানতাম না। এখনও জানি না। তবে সেই অমৃত স্বাদের সন্দেশও অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে দুটুকরো স্কুলে নিয়ে যেতাম। সেটা ভালো কোন খাবার বন্ধুদের খাওয়ানোর জন্য নয়। বিশ্বাস করানোর জন্য। আমার অনেক বন্ধুই বিশ্বাস করত না। তারা বলত পরী বলে কিছু নেই। তারা বিশ্বাস করত জ্বিন আছে। জ্বিন হচ্ছে আগুনের তৈরী। তাকে দেখা যায় না। সেই নিয়ে আমাদের তুমুল তর্ক হতো। বলতাম আমি নিজ চোখে পরী দেখেছি। কথা বলেছি। পরী আমাকে অনেক আদর করে। পরীর গায়ের গন্ধ রজনীগন্ধা ফুলের মতো, রং গোলাপের পাপড়ির মত, চেহারা চাঁদের মত উজ্জল। পাখাগুলো এত্তো বড় বড়। এই সব কিছু শুধু বর্ণনাই করতাম না - রীতিমত ছবি এঁকে দেখিয়ে দিতাম। তর্কে জেতার জন্য মিথ্যা বলতে হতো। মিথ্য বলা অন্যায় জেনেও বলতাম। কারণ পরীর কথা তো আমরা শুনতাম, সন্দেশ বাতসা খেতাম, ঘুমিয়ে গেলে পরীর সাথে খেলাও করতাম। সেটাতো আর মিথ্যা না। যারা জ্বিনে বিশ্বাস করত তারা পরীর দেয়া সন্দেশ খেত না। কেউ কেউ লুকিয়ে খেত। তাদের ভেতর থেকে একবার দুই বন্ধু, বিরু আর মিলু জেদ ধরল তারা আমার সাথে পরী দেখতে খোকা মন্ডলের বাড়ী যাবে। যাব বললেই তো আর পরী এসে তাদের জন্য বসে থাকবে না। তার জন্য অনেক হিসাব নিকাশ আছে।
মাসের বিশেষ বিশেষ রাতে পরী নামত। কখনো অমাবষ্যার রাত, কখনও পূর্নিমার। কখনও শনি বার, কখনও বৃহস্পতিবার। সে সব দিনের হিসাব আমরা জানতাম না। খোকা মন্ডল জানত। সে মাটিতে দাগ কেটে হিসাব কষে বলে দিত পরী আবার কবে আসবে। তবে হিসাব কষে বলে দিলেও সবদিন আসত না। পরীদেরও হয়তো ব্যস্ততা থাকে, মন খারাপ থাকে। তখন পরী আসে না। আসে জেলেনি আর দৈ’য়ালা। তারা পরীর সাথেও আসে। পরির সাথে যে তাদের কিসের সম্পর্ক তা আমরা জানতাম না। জেলেনি ছিল খুব ঝগড়ুটে। উপস্থিত মানুষদের নাম ধরে ধরে গালিগালাজ করত। দৈ’য়ালার চরিত্র আলাদা। সে পরামর্শ দাতা। যেন ডাক্তারের কম্পাউন্ডার। পরী যেমন ডাক্তারের মত কম কথা বলত তেমনি দৈ’য়ালা বলত কম্পাউন্ডারের মত বেশি কথা। অবাক হয়ে ভাবতাম, পরীদের দেশে কি কেউ মাছ মারে নাকি দৈ কিনে খায়? এ নিয়ে আমাদের মনে অনেক দ্বন্দ্ব ছিল। জিজ্ঞাসা ছিল। জিজ্ঞাসা আরো অনেক কিছু নিয়ে ছিল। পরীদের দেশে কি সন্দেশের দোকান আছে? খোকা মন্ডল কি পরীদের দেখতে পায়? খোকা মন্ডল সে সব প্রশ্নের উত্তর না দিলেও বিরু উত্তর দিল। বিরু আর মিলু যেদিন পরী দেখতে এলো সেদিন জেলেনি বিরুকে খুব বকা দিল। বকা দিল পরী বিশ্বাস না করার জন্য নয় - বকা দিল বাবা-মাকে না জানিয়ে পরী দেখতে আসার জন্য। বাড়ী ফিরে গেলে বিরু ওর বাবার হাতে খুব মার খেয়েছিল। তারপর থেকে বিরুটা যেন কেমন হয়ে গেল। সে নাকি পরীকে দেখতে পায়। দিনের বেলাতেও দেখেতে পায়। ক্লাসে বসে বলত, ওই দেখ জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কেউ দেখতে পেতাম না। বিরু পরীর সাথে কথা বলত। আমরা বিরুর কথা শুনতাম কিন্তু পরীর কথা শুনতে পেতাম না। বিরু অবাক হয়ে বলত, পরী এত জোরে জোরে কথা বলছে তবু তোরা শুনতে পাচ্ছিস না? তোরা কি রে!
স্কুলের মৌলভী স্যার বিরুর হাতে তাবিজ বেঁধে দিল। বলল, ওসব কিছু না। জ্বিনে ধরেছে। হাতে তাবিজ রাখলে আর কাছে আসতে পারবে না। কিন্তু বিরু তাবিজ রাখলে তো! সে স্কুল থেকে বেরিয়েই টান দিয়ে তাবিজ খুলে ফেলে। বিরুর বাবা-মা খোকা মন্ডলের কাছে গেল। কবিরাজ দেখাল। ডাক্তার দেখাল। কোন কিছুতেই কোন ফল হল না। বিরু স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল। আমরা ওর বাড়ীতে একবার দেখতে গেলাম। দেখলাম শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। সে পরীর অনেক গল্প শুনাল। বলল, পরী তাকে পরীর দেশে নিয়ে যাবে। তারপর একদিন শুনলাম, বিরুকে পাবনা পাগলা গারদে ভর্তি করে দিয়েছে।
এমন কত ঘটনা, কত গল্পেরই যে জন্ম হতো খোকা মন্ডলের পরী বিদ্যা নিয়ে তা বলে শেষ করা যাবে না।গ্রামের লোকরা তাকে খুব একটা পাত্তা না দিলেও দূরের লোকরা তাকে বড় গুনিন বলে জানত। অনেক দূরদূর গ্রাম থেকে, শহর থেকে মানুষ আসত তাদের নানা রকম সমস্যা নিয়ে। কারও জমিজমার সমস্য, কারও স্বামী-স্ত্রীর সমস্যা, বউ-শাশুড়ীর সমস্যা, কারও সন্তান হয় না, আরও নানান রকম অসুখ বিসুখ। তার কয়টা ভালো হতো - কয়টা হতো না সে খবর আমরা জানতাম না। তবে ধারণা করা যায় কেউ কেউ নিশ্চয় খুব ভালো ফল পেত। তা না হলে তারা খোকা মন্ডলকে এতো টাকা পয়সা কেন দেব? টাকা-পয়সা যদিও খোকা মন্ডলের হাতে দিত না। দিত খোকা মন্ডলের বউয়ের হাতে- খুশি হয়ে। খোকা মন্ডলের কোন চাহিদা ছিল না। যার যা ভালো লাগত খুশি হয়ে তাই দিয়ে যেত।
মনে আছে, একবার একজন তার মেয়েকে নিয়ে এলো। যার বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে অথচ মেয়ে কোন কাপড় পড়বে না। কাপড় পরবে না মানে কিছুই পড়বে না। জোর করে পরিয়ে দিলে কাপড় খুলে দৌড় দেয়। তাকে দেখার জন্য সবাই তখন তার পিছনে ছুটতে থাকে। খোকা মন্ডলের লোকজন তাকে ধরে এনে ঘরে আঁটকে রাখে খোকা মন্ডল পরীর কথা মত তার চিকিৎসা দেয়। মেয়ের বাবা-মা কয়েকদিন পরে মেয়েকে নিয়ে চলে যায়। তারপর আবার ফিরে আসে। মেয়েটা খোকা মন্ডলের কাছে ফিরে এলে এলাকাতে বেশ সাড়া পড়ে। সবাই মেয়েটার উলঙ্গ শরীর দেখতে চায়। বড়রা বুড়োরা সবাই আমাদের মত ছোটদেরকে সাবধান করত, কাছে যেওনা - কাছে যেওনা। অথচ সবাই তাকে কত কাছ থেকে দেখা যায় সে চেষ্টার কোন খামতি রাখত না। খোকা মন্ডল ঘর বন্ধ করে দুই তিন ধরে তার চিকিৎসা করত। তখন কেউ তার ঘরের আশেপাশে যেতে পারত না। এমন কি মেয়ের বাবা-মাও না। খোকা মন্ডলের লোকেরা পাহারা দিত। নিয়ম ছিল চিকিৎসা শেষে রোগী কোন কথা বলতে পারবে না। হাসতে পারবে না। বাড়ী পৌঁছে তবে কথা বলতে পারবে। তবে এই উলঙ্গ রোগের মেয়েটা সে বিধান মানত না। সে ঘর থেকে বেরিয়েই খোকা মন্ডলকে খুব গালিগালাজ করত। খোকা মন্ডলের লোকেরা তার মুখ বন্ধ করার জন্য তাকে ধরে মারত। বাবা-মা কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে নিয়ে বিদায় নিত। যাওয়ার সময় খোকা মন্ডল তাদেরকে আবার আসার জন্য বলে দিত। মুখ বন্ধ না রাখার জন্য এবারের চিকিৎসা কোন কাজে দেবে না। তিন দিনের পরিশ্রম বৃথা গেল। তাতে কোন অসুবিধা নেই। পরীর কাছ থেকে সে সবকিছু ভালো করে জেনে রাখবে। আগামী মাসে আসলে ঠিকই ভালো হয়ে যাবে। তখন আর বিয়ে দিতে কোন বাধা থাকবে না।
মাসের পর মাস তারা আসতে থাকল। পরে অনেকদিন আর কোন খবর নাই। আমরা সবাই ধরে নিলাম মেয়েটা ভালো হয়ে গেছে। বিয়ে হয়ে গেছে। সুখে শান্তিতে ঘর করছে। তারপর একসময় আমরা তার কথা ভুলে গেলাম। তবে ভুলে গেলেই তো আর সব কথা ভুলে থাকা যায় না। আমাদের পাড়ার হারুর মা আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিল। সেই মেয়েটার বাড়ী ছিল হারুর মার বাপের বাড়ীর দেশে। বাপের বাড়ী থেকে ফিরে হারুর মা খবর দিল সে মেয়েতো বিষ খেয়ে মরেছে। পাগলি মানুষ কেন বিষ খেয়ে মরল তা নিয়ে কয়েকদিন খুব চাপা আলোচনা চলল। তারপর খোকা মন্ডলের বউ একদিন তার লোকজন নিয়ে হারুর মাকে শাসিয়ে এলো। যা কিছু হয়েছে সব পরীর নির্দেশে হয়েছে। পরীর কথার অবাধ্য হলে পরী তার উচিত শিক্ষা দেবে। সেই থেকে সবাই এ বিষয়ে মুখ বন্ধ করে দিল। শুধু হারু আমাকে বলেছিল, পরী নাকি বিয়ের আগেই মেয়েটার পেটে একটা বাচ্চা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেকথা জানাজানি হওয়ার পর মেয়েটার বিয়ে ভেঙে যায়। তারপর মেয়েটা নিজে বিষ খেয়েছিল নাকি ওর বাবা-মা জোর করে খাইয়ে দিয়েছিল সেকথা হারুর ছোট মামাও নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। আমেদেরও আর জানা হয়নি সেই গূঢ় রহস্য। তবে হাস্নাহেনার বিয়ের রহস্যটা আমরা কিছুটা জানতে পেরেছিলাম। একদিন পরী হাস্নার মাকে বলল, তুমি তোমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে এতো ভাবছ কেন? ফুলের নামে তোমার মেয়ের নাম। বিয়েও হবে ফুলের নামে কোন ছেলের সাথে। তার বাড়ীও ফুলে নামে কোন গ্রামে। সবাই বলল, বকুলপুর, বকুলপুর। কিন্তু ছেলেটা কে? খবর নিয়ে জানা গেল সে গ্রামে বিয়ের উপযুক্ত দুজন ছেলে আছে যাদের ফুলের নামে নাম, টগর আর বকুল। টগর দেখতে সুন্দর। ভালো লেখাপড়া জানে। বাপের যথেষ্ট পরিমান জমিজমা আছে। বেশ সচ্ছল পরিবার। বকুল সে তুলনায় দেখতে ততটা সুন্দর না। গায়ের রং চাপা। বি এ ফেল মেরে বাজারে দর্জিগিরি করে। তার ওপরেই সংসার। বাপের তেমন কোন জমি জায়গা নেই। হাস্নার মা-বাবা পরীর কথা মতো টগরের সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেলল। অথচ বেশ কয়েক বছর আগে থেকে প্রেম চলছিল বকুলের সাথ হাস্নাহেনার। বকুলের দর্জি দোকানে সালোয়ার-কমিজের মাপ দিতে গিয়ে তাদের পরিচয়। দুজনের চিঠি আদান প্রদান করত হাস্নাহেনার ছোটভাই আমাদের বন্ধু ববি। চিঠি ডেলিভারির আগে আমরা বন্ধুরা মিলে সেই চিঠি পড়তাম। সেসব চিঠির বিশেষ একধরণের ভাঁজ থাকত। সে ভাঁজ খোলা এবং আবার অবিকল ভাঁজ করা কাজটা সহজ ছিল না। আমি সেটা পারতাম। যার বিনিময়ে চিঠি পড়ার সুযোগ পেতাম। বকুল দর্জি পরীর সাহায্যের জন্য বেশ কিছুদিন খোকা মন্ডলের কাছে ঘোরাঘুরি করেছিল। তাতে ফলও ফলেছিল কিন্তু সে ফল যখন হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার জোগাড় হল তখন তাদের চিঠি পড়ে আমরাও খুব কষ্ট পেতাম। পরী কেন বকুলের নাম না বলে ফুলের নাম বলল? এখন পরীর কথায় তাদের প্রেম নষ্ট হয়ে গেল। বকুল আবার খোকা মন্ডলের কাছে গেল। খোকা মন্ডল হাস্নার বাপকে ডেকে বলল, পরী বলেছে টগরের বাপ মারা গেছে যক্ষায়। টগরের আয়ুও খুব কম। তোমরা মনে করলে বকুলের কথাও ভাবতে পার। পরীতো আর কারো নাম বলেনি। হাস্নার বাপ টগরের সাথে ঠিক হওয়া বিয়ে ভেঙে দিল। আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বকুল দর্জির সাথে ববির বোন হাস্নাহেনার বিয়ে হয়ে গেল। আমরা বুঝলাম খোকা মন্ডলের অনেক ক্ষমতা।
খোকা মন্ডলের কাছে সবচেয় বেশি আসত মহিলারা। যাদের বাচ্চা হয় না। বেশির ভাগ সময়ই তারা আসত শ্বাশুড়ি বা মায়ের সাথে। ফেরার সময় বউগুলো শাড়ীতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিত। হয়তো এমনই নিয়ম ছিল। তবে সাথে আসা মা বা শ্বাশুড়িরা হাসতে হাসতেই যেত। পরে অনেকেই বাচ্চা কোলে করে হাসতে হাসতে ফিরে আসত। খোকা মন্ডলকে বাচ্চা দেখানোর জন্য। পরীর কাছ থেকে দোয়া আশির্বাদ নেয়ার জন্য। সেসব বাচ্চা ছেলে হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নাম হতো খোকা বা খোকন আর মেয়ে হলে নাম হতো পরী, ফুলপরী বা পরীবানু, এরকমের কিছু একটা।
একবার এক মহিলা এলো, নাম সিলভিয়া। এরকম কোন নাম হতে পারে বলে তখন আমাদের কোন ধারণা ছিল না। দূরের কোন জেলা শহর থেকে এসেছিল। স্বামীর সাথে। স্বামীর নামটিও ছিল বিদেশীদের মতো। সে নামটি এখন আর মনে নেই। তারা খৃস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। খোকা মন্ডলের কাছে প্রথম কোন মহিলা এসেছিল প্যান্ট শার্ট পরে। তবে খোকা মন্ডলের কাছে যখন চিকিৎসা নিতে যায় তখন শাড়ী পরেছিল। সেই শাড়ীও ছিল অনেক দামী আর অনেক সুন্দর। মহিলাকে দেখতে পরীর মত মনে হচ্ছিল। সেই গল্প এখনও আমাদের এলাকায় লোকের মুখে মুখে ফেরে। লোকে বলে, মহিলা যখন ঘর থেকে বের হয় তখন তার চোখ মুখ রাগে লাল হয়েছিল। খোকা মন্ডল বারবার তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছিল। মহিলা দ্রুত তার স্বামীর হাত ধরে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে খোকা মন্ডলের বাড়ী ঘেরাও করে। খোকা মন্ডলের বউ আর তার পোষা লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তবে খোকা মন্ডলকে তারা ধরতে পারেনি। পরী নাকি তাকে পরীর দেশে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে। খোকা মন্ডলেকে তারপর থেকে আর কেউ কখনও দেখেনি। তবে আমি বড় হয়ে চাকরি জীবনে এসে আমাদের সেই ছোট বেলার বন্ধু বিরুর দেখা পেয়েছিলাম।
কাজের সুবাদে সেবার পাবনা মানসিক হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। হঠাৎ বিরুর কথা মনে পড়ল।খুঁজতে খুঁজতে খবর পেলাম বিরু সুস্থ হয়ে এখন পাবনা শহরেই বসবাস করে। মানসিক হাসপাতালের এক কেরানির মেয়েকে বিয়ে করেছে। শহরে একটি বেসরকারি অফিসে পিওনের কাজ করে। দেখা করলাম বিরুর সাথে। বিরু বলল, অনেকদিন আগেই সে সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে গিয়েছিল। ততদিনে বিরুর বাবা মারা গিয়েছে। ভাইয়েরা বিরুকে বাদ দিয়েই জমিজমা সব ভাগ করে নিয়েছে। তারা আর বিরুকে মেনে নিতে পারেনি। তাকে হাত-পা বেঁধে আবার পাবনা মানসিক হাসপাতালে রেখে যায়। আমি বললাম, তুই কি জানিস, আমাদের সেই খোকা মন্ডল তো উধাও। সে নাকি এখন পরীর রাজ্যে বসবাস করে। বিরু বলল, খোকা মন্ডল এখন কোথায় আছে জানি না তবে আমি তো এখন পরীর রাজ্যেই বসবাস করি। তোকে কিন্তু আজ অবশ্যই পরীর রাজ্য দেখে যেতে হবে। না করতে পারবি না। জানলাম, ওর বউয়ের নাম পরী। বিরুর শ্বাশুড়িও খোকা মন্ডলের আস্তানায় গিয়েছিল। খোকা মন্ডলের সেই পরীর কল্যানেই বিরুর বউ পরীর জন্ম। আমি বিরুর বাসায় ঢুকে পরীর চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। অবিকল খোকা মন্ডলের চেহারা। খোকা মন্ডলকে অল্প বয়সে মেয়ে সাজালে ঠিক এমনই চেহারা হতো। কয়েক মূহুর্তের জন্য চোখ ফেরাতেই ভুলে গেলাম। বিরু বলল, ও ভাবে দেখছিস কি? এই আমার পরী। দেখিস, পরীকে দেখে তুই আবার আমার মত পাগল হয়ে যাস না। বিরুর কথা শুনে বউটা লজ্জায় সামনে থেকে সরে গেল। বিরুর রসিকতায় আমি তেমন কিছু যোগ করতে পারলাম না। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করতে থাকলাম। লাজুক বউটি টানাটানির সংসারে সাধ্যমত আপ্যায়নের চেষ্টা করল। বিদায় নিয়ে ফেরার সময় মনে হল, আমাদের এই বিশ্বসংসারে এমন অনেক রহস্যই আছে যা না জানাই ভালো- না বোঝাই মঙ্গল।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান