জলধি / গল্প / নিখোঁজ ভেলপুরিওয়ালার সুলুক সন্ধানে
Share:
নিখোঁজ ভেলপুরিওয়ালার সুলুক সন্ধানে

‘এই ছোটলোকেরা শহরের মানুষের টাকার ঘ্রাণ পেয়েছে নাকি ?’ একরাশ বিরক্তি নিয়ে কথাটি বলেই দামি কাপড়ে সজ্জিত ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন সমর্থনের আশায়। ঘটনার আকস্মিকতায় ইতস্তত বোধ করলাম। ভদ্রলোক একদৃষ্টে চেয়ে আছেন। ইচ্ছাকৃত হোক কিম্বা মুখ ফসকে; তার বলা কথাটিকে মহৎ ও সঠিক করে তুলতে দুয়েকটি সহমতের প্রয়োজন পড়েছে হয়তো। কী এক মুসিবত। ভদ্রলোকের কথায় একাত্মতা বোধ করতে পারছি না , বেচারাকে আশাহত করতেও খারাপ দেখা যায়। আপাতত রহস্যময় হাসির মাধ্যমে ক্ষান্তি দিলাম। জোর করে সহমত আদায়ের ধরণ দেখে মনে মনে বিরক্ত হই। কী আশ্চর্য! এ যেন আমাদের ভদ্রলোক সমাজের একটি অলিখিত নিয়ম! 
মসজিদের সংস্কার কাজে চলমান থাকায় সদর দরজা ব্যতীত সবগুলো গেট বন্ধ। সামনের লোকগুলো কচ্ছপ গতিতে এগুচ্ছেন। সদর দরজায় প্রচন্ড ভিড়। নামায শেষে সবাই একসাথে বের হতে গেলেই ইদানীং এই অবস্থা তৈরি হচ্ছে। ভিড়ের পিছনে অনুঘটক হিসেবে সংস্কার কাজকে উপস্থাপন করা গেলেও কিছুটা দায় ভিক্ষাবৃত্তিরও। ফরজ নামাযের অবব্যিহত পরেই ভিক্ষুকরা গেটের দুইপাশে মৌমাছির ন্যায় জড়ো হতে থাকে। বিরক্তির সূত্রপাত মূলত এখান থেকে। জনতার মন্তব্যগুলোও তাই ভীষণ নির্মম। 
খানিক পূর্বের মন্তব্যের রেশ বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বে, ডান প্রান্ত থেকে আরেক ভদ্রলোক চড়া গলার আওয়াজ কানে এল, ‘তামাশা পেয়েছে নাকি ? প্রত্যেক ওয়াক্তে ওয়াক্তে ভিক্ষাবৃত্তির নামে এরা গেট আটকে দাঁড়াবে? নামাজিদেরকে জিম্মি করার অধিকার কে দিয়েছে ? খানিকটা বিরতি নিয়ে দার্ঢ্যময় ভঙ্গিতে বললেন, এই সমস্যা কার কাছে বলব, কে সমাধান দিবে ? ’ আশার কথা, এই ভদ্রলোক আমার নাটুকে মুখের দিকে না চেয়ে প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়েছেন আম জনতার বিবেকের উপর। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। 
আমি জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখতে থাকি। আরো দেখি তার কলকব্জা, নাড়ি নক্ষত্র। মানুষের মধ্যে কত বিচিত্রতা আর রকমফের। ইদানীং চারপাশের পরিবেশ, মানুষের রুচি, সমাজ বাস্তবতা; দেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাত সহ নানান বিষয় খুঁটিয়ে দেখার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আমি ভাবনার অতলান্তিকে ডুবে যাই। নানান বিষয়ের অবতারণা হয় করোটিতে। শুধু ভাবতেই থাকি। এ-ও ভাবি, দরিদ্র মানুষের মোকাবেলায় আমাদের শহুরে ভদ্রলোকেরা একেকজন যেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এই ক্ষমতা আমাদেরকে কিভাবে অপ্রকৃতিস্থ করেছে সেটাও দেখি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে। আজিব কায় কারবারই বটে।  
যাদেরকে নিয়ে শহুরে ভদ্রলোকদের এহেন মন্তব্য, সমাজের সেই দরিদ্র ভাসমান শ্রেণীর প্রতি মায়া লাগে। আব্বু আর দাদাজান যুগ্মভাবেই আমার কৈশোরে এই সহানুভুতশিলতার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন। ভিক্ষাবৃত্তি আমি পছন্দ করি না আবার উপরের মন্তব্যগুলোর সাথেও একাত্মতা বোধ করতে পারছি না। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যাই।  
ধীর গতির লাইনে দাঁড়িয়ে নানা ধরণের মন্তব্য আসতে থাকে একের পর এক। সবগুলো মন্তব্য যে নেতিবাচক তা নয়। এক ভদ্রলোক গুরু গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ ভিড়ের এই সমস্যাটি সাময়িক, একটু ধৈর্য ধরেন সবাই। তাড়াহুড়ো ভালো নয়। ’ ভদ্রলোক এ-ও বললেন, ‘যাদের সামর্থ্য আছে, দান করি; সক্ষমতা না থাকলে মন্তব্য না করি।’ কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘প্রতিটি ফুলের সুবাস ভিন্ন ভিন্ন হয়। হার গুলে রা রঙ্গে বূয়ে দীগারাস্ত।’ মনটা ভালো হয়ে গেল। এই মন্তব্য সহনশীলতার একটি নিদর্শন, উৎসাহব্যাঞ্জকই বটে।
এত এত মন্তব্য সত্ত্বেও ভিড় কমার লক্ষণ নেই। মন্তব্যের বিষয়টি অবশ্য ভিক্ষুকদের গাঁ সওয়া হয়ে গেছে। পাত্তা দেয় না, থোরাই কেয়ার করে। মসজিদের সামনে ভিক্ষারত একজন ষাটোর্ধ মুরুব্বী চড়া গলায় মনের সমস্ত ক্ষোভ ঝেড়ে দিলেন অবলীলায়, ‘দুনিয়ার হোকোল (সকল) বৈষম্য খালি আমাগো ভিক্ষুককে লগে। মানুষ পাইছেডা কী ? ’ বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে স্বগতোক্তি করে বাকি কথাটুকু শেষ করলেন এই বলে ‘আল্লাহ, তুমি কত কিছু যে দেহায়লা এই এক জীবনে। আরো কত কিছু যে দেখতে হবে! ’ 
আব্বু একদিন কী এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে সমাজের ভাসমান শ্রেণীকে যথাযথ টেকসই উপায়ে পুনর্বাসিত করলে আমাদের দেশটা সুন্দর ও সমৃদ্ধ হত। সরকারের মুখোশ উন্মোচিত করতে গিয়ে এ-ও বলেছিলেন, পুনর্বাসনের যে সংবাদ পত্রিকায় পড়ি, তা অনেকাংশই বানোয়াট এবং যতটুকু হয়েছে , ষোল আনাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। একটা উন্নয়নশীল দেশ এভাবে চলতে পারে না।’  

২ 
ভিক্ষুক বিষয়ক পক্ষে বিপক্ষে নানান মন্তব্য মসজিদের গেট সরগরম। উক্ত কথাবার্তায় ছেদ পড়ল মসজিদের বাইরে থেকে ভেসে আসা একটি জোর আওয়াজে, ‘বেলবুরি নেন বেলপুরি, প্রতি পিছ, মাত্র তিন টাকা।’ ভ্রু কুঁচকে উঠল। মসজিদের ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যতার বিপরীতে রীতিমত হাঁকডাক। টনক নড়ল। অল্প বয়সী এক ছোকরা। একহারা গড়ন। রুগ্ন ক্লিষ্ট অনুত্তেজিত চেহারা। একটি ভগ্ন কাঠের টুলের উপর বড় বলে ভেলপুরির পসরা সাজিয়ে পিছে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। আর থেকে থেকে বলছে , ‘বেলবুরি নেন বেলপুরি, প্রতি পিছ, মাত্র তিন টাকা।’ ভেলপুরি বিক্রেতার উপর মুহূর্তে সবার নজরগুলো ঝেটিয়ে পড়ল। 
আমাদের ট্রাডিশনাল ঢাকাই ভেলপুরি সমগ্র ঢাকা শহরে প্রতি পিস পাঁচ টাকা। এই ছোকরা বিক্রি করছে সুলভ মুল্যে, দুই টাকা সাশ্রয়ে! বোকা না-কি ? ছেলেটির শারীরিক এটুচুয়েট আর শহুরে ভেলপুরি বিক্রেতাদের চুপচাপ নীতির বিপরীতে বেমানান হাঁকডাক দেয়া অনুমান করলাম, শহরের নয়া আগন্তক হবে হয়তো।
আমার সাশ্রয় প্রবণ মনে আগ্রহ জন্মাল। স্ট্রিট ফুড পারতপক্ষে খাই না। ছোটবেলা থেকেই স্নেহময়ী মা অপরিস্কার, অপরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে এসবের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি করেছেন। তবুও আজ কেন জানি, সকাল থেকে জমানো ক্ষুধা আর সাশ্রয় প্রবণতার নিকট শৈশবের শিক্ষা একপ্রকার পরাভূত হল। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, শহুরে মানুষের সাশ্রয় প্রবণতার দিকে ঝোঁক বেশি। কৈশোর থেকেই এই শহরে বেড়ে উঠেছি সংক্রমিত রক্ত নিয়ে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম ভেলপুরি বিক্রেতার দিকে। সত্যি বলতে, তামাম স্ট্রিটফুডের মধ্যে ভেলপুরি একটি লোভনীয় খাবার। 
ছেলেটি হাসি মুখে সম্ভাষণ জানাল, ‘ খাইয়া দেখেন স্যার, ভাল লাগবে।’ পুলকিত হলাম। 
ছেলেটি তার সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান দিয়ে,খুব যতœ সহকারে, সাবধানী হাতে একটার পর একটা প্রস্তুত করছে। শক্ত বাদামি রঙের পুরি মাঝখান থেকে ভেঙ্গে পেয়াজ, মরিচ ও ধনিয়া পাতা মিশ্রিত ডালের ঘুগনি ভরছে। আশপাশে কেউ নেই। কিছু ফরমাশ করলাম। বাধ্য ছেলের মত মানল। 
বললাম, ‘এগুলো এখন খাবো না, পার্সেল নিবো।’ 
জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে আছে। ক্ষীণ কণ্ঠে, লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, ‘পছন্দ হয় নাই স্যার ?’ 
বুঝেছি, পার্সেল শব্দটার সঙ্গে পরিচয় নেই। 
ভেঙ্গে বললাম, ‘সেটা বলি নি, প্যাকেট করে দাও, বাসায় নিয়ে যাবো।’  
হাসি ফুটল। নত ভঙ্গিতে বলল,‘জে, আচ্ছা। ’  
ছেলেটি তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয়বারের মত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছেলেটির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করি। মুখের অক্ষয়, অমলিন হাসিটা নিরন্তর লেগে আছে। কথায় খানিকটা জড়তা থাকলেও বিনয় নম্রতার দরুন জন্মগত এই দোষটা ঢাকা পড়ে যায়। ছয় পিছের মূল্য আঠারো টাকা। বিশ টাকার নোট দিলাম। দুই টাকা ফেরত পাবো। ভাংতি নেই। ছেলেটি টাকা দুইটি দেয়ার জন্য সাঙ্ঘাতিক রকমের ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ব্যাপারটি দেখার মত। বললাম, ‘রেখে দাও।’ কুণ্ঠাবোধ করল। দ্বিতীয়বার বললাম, ‘এখন রেখে দাও, পরবর্তী কোন সময় টাকা কম থাকলে যোগ করে নিও।’ 
মানুষের নিকট ছেলেটির কৃতঘ্ন না থাকা আর নম্র ব্যবহার আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কটা অনন্তকাল অভিমুখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার খানিকটা রসদ যোগাল। নাম জিগ্যেস করলাম। বলে, ‘সুবহান, আব্দুস সুবহান। বাড়ি ঠাকুরগাঁও।’  
সামান্য কথোপকথনে যা বুঝলাম, ভাগ্যান্বেষণের তাগিদে এই অপরিণত পড়াশোনার বয়সে ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। সাথে সাথে এ-ও জানলাম, নিত্যপণ্যের দাম ও সংসারের অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় কোন উপায় ছিল না। সংসারে বাবা-মা আর দুইটি ছোট বোন। বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্থ। বয়স ৪২ ছুঁইছুঁই। প্রায় তিন বছর কোন উপার্জন নেই। আহা, জীবনের বাস্তবতা কত নির্মম! 
ভিতর থেকে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ঠেলে বেরিয়ে আসে আব্দুস সুবহানের। আরেকজন কাস্টমারের ফরমাশ পাওয়ার ব্যস্ততায় কষ্ট আপাতত হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অনিঃশেষ ব্যস্ততার মধ্যেই ওর যাবতীয় শান্তি, কষ্ট লাঘব হয়। গভীর দীর্ঘশ্বাসগুলো অন্তত শুনতে হয় না। আব্দুস সুবহানকে ব্যস্ততায় বিভোর রেখে বাসা অভিমুখে রওনা হই । 
সপ্তাহ দেড়েকের মাথায় আব্দুস সুবহানের সঙ্গে আবার দেখা। অন্তর্মুখী এবং লাজুক স্বভাবের ছেলেটির অন্তর্জগতে সামান্য কয়েকদিনের ব্যবধানে বিরাট রূপান্তর ঘটে গিয়েছে। সময় মানুষকে কতটা পরিবর্তন করে তার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে আব্দুস সুবহানের চাল-চলনে। হাত দুখানা ভীষণ গতি পেয়েছে। আচার-আচরণ, কথাবার্তায় ঢাকাইয়্যা ভাব চলে এসেছে। সবাইকে মামা মামা করছে। শহুরে বহুল পরিচিত মামা সম্বোধনটি যথাযথ চলে এসেছে কণ্ঠস্বরে। আমার বেলায় অবশ্য সম্বোধনে হেরফের হয় নি। স্যার ডাকে। কারণ জিগ্যেস করলাম। আব্দুস সুবহান বলে, ‘যারা কথা কম কয়, তারা জ্ঞানী। মুরুব্বীরা কয়, জ্ঞানীগো স্যার কয়তে হয়।’ নিজের প্রশংসা আমি ঠিক নিতে পারি না, অনভ্যস্ত। ভিতরে ভিতরে কিছুটা শরমিন্দা হই; কিন্ত প্রকাশ করি না। ঠাকুরগাঁও থেকে আসা সরল ছেলেটির জীবন থেকে সারল্য আর সাদাসিদে জীবনযাপন শিখি একদৃষ্টে। ঈর্ষান্বিত হই এই ভেবে, এক জীবনে যদি ওর সবটুকু সরলতা ধারণ করতে পারতাম! 

একদিন অত্যন্ত হন্তদন্ত হয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে ছুটে এসে জানাল, ‘বিপদে পড়েছি বড় ভাই। মসজিদের সামনে বসলে কালকো থেকে হামাক পয়সা দিতে হবে। বুঝতে পারতেছি না, কি করবো!’  
ওর কাছ থেকে খুঁটিনাটি যে বার্তা পেলাম, তাতে শুধু অন্ধকারাচ্ছন্ন আর হতাশার চিত্র। ভিক্ষুক আর শহরের ভাসমান ব্যবসায়ীদের জন্য মসজিদ চত্বর লাভজনক স্থান। এখানে ট্যাক্স দেয়ার ঝামেলা নেই। মালপত্র সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। 
সাময়িক সময়ের জন্য এই খেঁটে খাওয়া মানুষগুলো দোকান স্থাপন করে সামান্য আয়-রোজগার করে তবুও চাঁদাবাজির কবল থেকে বেচারাদের রেহাই নেই। জীবন হয়ে উঠেছে অনিশ্চয়তার। ভীষণ খারাপ লাগে দরিদ্র মানুষগুলোর দুর্দশা দেখে। আব্দুস সুবহান উদ্ধারকর্তা হিসাবে আমার শরণাপন্ন হয়েছে। আমরা ফ্ল্যাট ক্রয় করে এই এলাকায় অনেক বছর যাবত স্থায়ী জিন্দেগী যাপন করছি ; কিন্তু আজতক অত্র মহল্লার ওজনদার বা কেউকাটা কোন বিশেষণ অর্জন করতে পারি নি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এড়িয়ে গিয়েছি সন্তর্পণে। জেনেবুঝে অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দেওয়ার কোন মানে হয় না, উটকো ঝামেলা মনে হয়েছে সবসময়; কিন্ত আজকে, এই অচেনা অজানা ছেলেটার জন্য কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করি মনের ভেতর। আব্দুস সুবহান নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। এই মুহূর্তে কিছু করতে না পারার যে অসহায়ত্ব তা যেন আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছে। বললাম, ‘ ধৈর্য ধর, একটা ব্যবস্থা হবে। আল্লাহ ভরসা। তুই, আগামীকাল সকালে দেখা করিস।’ 
বাসায় পরামর্শ করলাম। প্রভাবশালী কারো নিকট প্রতিকার বা নতজানু হওয়ার পরিবর্তে আপাতত আমাদের বাসার সামনে বসার ব্যাপারটি অনুমোদিত হল। আব্বু কিছু অর্থকড়ি দিয়ে চেয়েছিলেন, বারণ করে বললাম, ‘ আব্দুস সুবহানের দরকার পায়ের নীচে কিছু শক্ত মাটি আপাতত সেটার বন্দোবস্ত হোক।’ আব্বু আমার যুক্তি মেনে নিলেন। ওর আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে আমি জানি, প্রচন্ড রকমের জেদি। এ পর্যন্ত একটু-আধটু যা সহযোগিতা করেছি, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব রেখেছে। একদিন চুকিয়ে দেবে। হা হা। কৃতঘ্ন হয়ে থাকার চেয়ে গায়ে গতরে খেঁটে খাওয়ার প্রতিজ্ঞা অস্বাভাবিক রকমের। সর্বশেষ একটি লুঙ্গি দিয়েছিলাম। গ্রহণ করবে কি, করবে না তা নিয়ে কত তালবাহানা। সেই ঘটনার ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না, অনেক বিস্তৃত পরিসর দাবি করে। 
আমাদের বাসার সামনে আব্দুস সুবহানের ভেলপুরি ব্যবসাটা জমে গেল। বিক্রিবাট্টা সন্তোষজনক। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছিলাম ওর উদ্দীপ্ত কথাবার্তায়। ওর সাফল্যের নেপথ্যে অনেকগুলো গুণ চোখে পড়েছে। বিনয়, সততা, ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা, কঠোর ত্যাগ, অবিশ্রান্ত পরিশ্রম এবং বিচিত্রতার মাধ্যমেই ক্রেতাদের হৃদয়ে পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নিল, অল্প কয়েকদিনের মধ্যে। মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারার সহজাত এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে আব্দুস সুবহান। মহল্লার ছোট-বড় সকলের সাথেই তার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। একদিন হাসতে হাসতে বলল, ‘আল্লায় দিলে কাস্টমার আসতেছে ধুমায়া। খোদার কসম স্যার, আপনার বাসার এইখান থেকে কোনদিন যামু না। দরকার হয় আপনারে জায়গার ট্যাক্স দিমু।’  
আব্দুস সুবহানের শিকড় গেড়ে গেল আমাদের মহল্লায়। গ্রামের প্রতি এক অন্য রকমের দরদ ও দায়বদ্ধতা ছিল তাঁর মনে; কিন্তু ঋণের টাকা পুরোপুরি শোধ না হওয়া ইস্তক ঘনঘন গ্রামে যাওয়া ওর মত স্বল্প আয়ের ছেলের জন্য একপ্রকার বিলাসিতা ; কিন্ত দেশে যাওয়ার বাসনা প্রচন্ড। অভাবের সংসারে কত রকমের হিসাব নিকেশ; টানাপোড়নের অভিজ্ঞতা ব্যতীত বোঝা অসম্ভব। বাড়ির প্রসঙ্গ উঠলেই আব্দুস সুবহানের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যেত। কিছুদিন পূর্বে অর্থাৎ জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বলেছিল, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাড়িতে যাবে। হাঁটাচলা, কথাবার্তায় বাড়িতে যাওয়ার একটা গোছগাছ পরিলক্ষিত দেখতে পেয়ে স্বয়ং আমার নিজেরই ঈর্ষা হয়েছিল। প্রিয়জনের মুখ দেখতে পাওয়ার আনন্দ জগতের অন্য সবকিছুর তুলনায় তুচ্ছই বটে। 

৪ 
এই শহরে ওর থিতু হওয়ার ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। এতোটাই নিশ্চিত, আব্দুস সুবহানের গ্রামের ঠিকানা কিম্বা মোবাইল নাম্বার রাখার প্রয়োজন বোধ করি নি কখনো। প্রত্যেকদিন সকাল বিকাল দেখা হয়। কুশল বিনিময় করে বিনীত ভঙ্গিতে। এভাবেই কেটেছে অনেকদিন। হঠাৎ দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া বিরূপ হয়ে উঠল। জুলাই আন্দোলনে দানা বাঁধল। সর্বনাশা জুলাই এতোটা অকস্মাৎ দরজায় কড়া নাড়বে কে ভেবেছিল ? সত্যি বলছি, কল্পনাতেও ছিল না। স্বৈরাচারীর জুলুমের মাত্রা যখন বেড়ে যায়, মানুষের সাহস ডাকাবুকো রুপ ধারণ করে। অবশেষে সেই সাহস লেলিহান আগুনে রূপান্তরিত হয়। সর্বনাশা আগুন। ইতিহাস সাক্ষী, মানুষের বুকের আগুনে কত শত রাজত্ব জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে গেড়ে বসা একনায়কদের ক্ষমতার উৎপাটন হয়েছে কালের গর্ভে, তার ইয়ত্তা নেই। তবুও কেউ শিক্ষা নেয়নি। 
আমাদের এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে জনগণের সংঘর্ষ বেঁধেছে জায়গায় জায়গায়। বন্দুকের মুখোমুখি হলে যেখানে মানুষের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়; অসম সাহসী ছাত্র-জনতা সেই বন্দুকের সামনেই বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তারুণ্যের দুঃসাহসই যা শুধু সম্ভব করতে পারে। সাহসের তারিফ করতে হয়। 
আমাদের পুরো মহল্লার অলি গলি স্কুল, কলেজের ছাত্রদের পদভারে মুখরিত। বাসার দারোয়ান জুলফিকার, ভয়ডরহীন উচ্চ আওয়াজে সেদিন আমাকে বলে, ‘শোনেন ছোটভাই, এমন তুমুল একটা আন্দোলন দরকার ছিল।’ তার কথার যৌক্তিকতা বোঝাতে গিয়ে অতীত নিপীড়নের কয়েকটি ঘটনা বলল। হুবহু না মিললেও অনেকটা আব্দুস সুবহানের চাঁদাবাজির সেই পুরনো ঘটনার প্রতিধ্বনি। আব্দুস সুবহানের বেদনা ক্লিষ্ট চেহারা, হন্তদন্ত পদক্ষেপ, আমি এখনো ভুলতে পারি না। 
৩ আগস্ট দিবাগত রাত থেকে আব্দুস সুবহান নিখোঁজ। কোথায় যাবে ও ? যতদূর জানি, ঢাকায় তেমন কোন আত্মীয়স্বজন নেই। দূর সম্পর্কের যে খালুর মাধ্যমে ঢাকায় এসেছিল, ব্যবসায় মন্দা যাওয়ায় তিনি মাস চারেক পূর্বে গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। 
দেশের এই সংকটকালে জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত বাসা থেকে পারতপক্ষে বের হই না। আব্দুস সুবহানের জন্য মনটা ভারি উথালপাথাল করে। হৃদয়ের গহীনে উঁকি দেয় পুরনো সময়। এই অচেনা অজানা শহরে মনেপ্রাণে আমার মত ক্ষুদ্র ব্যক্তিকে আশ্রয়স্থল মনে করেছিল। ছেলেটির প্রতি ভালোবাসার টানে শেষমেশ পথে নামতে হল।  
ওর মেস বাসার ঠিকানা ছিল। গেলাম। কেউ সন্ধান দিতে পারে নি। 
চব্বিশের গণবিপ্লবে বহু নিখোঁজ মানুষের তালিকায় তবে কি আব্দুস সুবহানকেও রাখতে হবে ? পুরোপুরি নিখোঁজও বলা যাচ্ছে না। আব্দুস সুবহানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নের চেয়ে বেশি আশাবাদী। মন কেন যেন বলে, অত্র মহল্লার বেগতিক রণ অবস্থা দেখে হয়তো অন্য কোথায় থিতু হয়েছে। ফিরে আসবে কোন এক সকালে বা মধ্যাহ্নে। অথবা পশ্চিম আকাশে সূর্য যখন হেলে পড়ার অপেক্ষায়, এমনই এক শেষ বিকেলেই আনন্দময় ভোর এনে দিয়ে আব্দুস সুবহান বলবে, ‘স্যার, ব্যবসা জইম্যা উঠছে, খোদার কসম কাটছি, এই মহল্লা থেকে আর কোনদিন ফিইর‌্যা যামু না। খোদার কসম।’  
ছেলেটির অল্পদিনের বিনম্র ব্যবহার একটি দারুণ সংযোগ হয়েছিল পর¯পরে। তৈরি হয়েছে কত সব হিরন্ময় স্মৃতি। থেকে থেকে সব ভেসে ওঠে হৃদয় অলিন্দে। প্রথম সাক্ষাতে আব্দুস সুবহানের আনাড়ি হাতে তৈরি ভেলপুরির স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে।
কল্পনার জগৎ সবসময় পরিবর্তিত হয় এবং বিকশিত হয়। আমি মনে করি না যে, আমার কল্পনা শেষ হয়ে যাবে। আমি কল্পনায় দেখতে পাই আশার আলো। আব্দুস সুবহান ফিরে আসছে পড়িমরি করে। দুঃসংবাদ নয় বরং আশার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে, ‘ স্যার, আইজকা থেইক্যা আর চান্দাবাজি নাই দেশে। শান্তি ফিরছে দেশে স্যার, শান্তি ফিরেছে।’ 



অলংকরণঃ তাইফ আদনান