জলধি / গল্প / ডুবুরি আম্বিয়া
Share:
ডুবুরি আম্বিয়া
জোয়ারের গাঙ্গ। বিলেতি নুন বোঝাই সওদাগারি ডিঙা তেকোনা রঙিন বড় বড় পাল খাটিয়ে  আসছে সাহেবদের দেশ থেকে। দেশে লবন আইন।  তাই লবন আসছে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ফিরিঙ্গীদের মুল্লুক ঠেঙিয়ে । কিনার ঘেষে পাছা দুলিয়ে দু'টি গোলপাতা বোঝাই  বেতনাই নাও আসছে। মাঝিরা গাদামারা গোলপাতার উপর বসে তামুক টানছে। কুলের নলখাগড়া ও  হোগলার ঝোপ ছোট ঢেউয়ে হেলছে আর দুলছে। আগাপশর ও গুফিয়া নদী এখানে মিলেছে। এই জায়গার নাম জাহাজঘাটা।
বহুকাল আগে এখানে রাঙামুখো ফিরিঙ্গিদের জাহাজ বাঁধা থাকতো। পর্তুগিজ ফিরিঙিদের সাথে কিছু মগেরাও থাকতো। এরা দলবেধে লম্বা নক্সাকাটা বন্দুক নিয়ে জমিদার,ধনী চাষীদের বাড়িতে হানা দিতো  সোনাদানা লুটপাট  করতো ও মানুষদের ধরে নিয়ে যেতো। সেসব মানুষ বার্মার মুল্লুক, মরিসাস ও আরো অনেক দেশে বিক্রি করতো। মেয়েদের ধর্ষণ করে পেটচিরে নদী, সমুদ্রে ফেলে দিতো। কিছু  পুতোর্ফিরিঙ্গি নারায়নখালির গাঙের পাশে জাবসো ও এই ত্রিমোহনির পাশের খাজুরো গ্রামে তাবু গেড়ে অস্থায়ী আবাস গেড়েছিলো। এইসব ঘটনা  এ তল্লাটে ইংরেজ আসার আগে। আম্বিয়া এইসব কেচ্ছা তার দাদীর কাছে প্রায়ই শোনে।
একবার এক ঝড়ে সোনাদানা, টাকাকড়ি, মনিমুক্তাসহ পুতোফিরিঙ্গিদের কয়েকটা পালতোলা জাহাজ এই ত্রিমুনিতে ডুবে যায়। ফিরিঙ্গিরা সেগুলো আর উদ্ধার করতে পারিনি। তখন গাঙ খুব বড় ছিলো। গাঙে স্রোতও খুব আর গহীন । 
আম্বিয়া অনেকবার স্বপ্নে দেখেছে। সে ডুব দিয়ে মনিমুক্তা উদ্ধার করে সওদাগার বনে গেছে। সেই থেকে সে  ডুবুরি হয়ে মনিমুক্তা উদ্ধারের কল্পনায় বিভোর থাকে। মেয়ে হয়েও সে গাঙ খালে ডুবিয়ে মাছ ধরে। আম্বিয়াদের পরিবারে তারা দুইজন। সে আর তার দাদী। তার আব্বা আম্মা, দুইভাই  দাস্তোবমি হয়ে মারা গিয়েছে । তা বছর আষ্টেক হবে। দাদীর বাতের ব্যারাম। বেশী হাটাচলা করতে পারেনা। মাছ ধরে,  আর গাছের কিছু নারকেল শুপারি বিক্রি করে তাদের সংসার চলে।
কোনো ধানের জমি নেই। যা কিছু ছিলো তা আম্বিয়ার আব্বা মারা যাবার পর কালু গোলদার জ্বাল কাগজ বানায়ে দখল নিছে।
নদীর খাড়িতে বসে এক দঙ্গল ডুবুরি জলজ শুশুকের মত ডুব দিয়ে মাছ ধরছে। কেউ ডাঙ্গর মাছ ধরলে মেছো কুমিরের মতন পানি তোলপাড়  করে মাছসমেত ডাঙায় উঠছে। গাঙের টেকে বসে কিছু আধবুড়ো আর ফুর্তিবাজ চেংড়ারা  মাছধরা দেখছে। মাছরাঙা ও গাঙচিল এসে ভিড় জমিয়েছে। একঝাঁক মাছরাঙা  বৃত্তাকারে নদীর উপরে ঘুরে ঘুরে  পাক মারছে।
কার্তিকের শুরু মাথার উপর সূর্য  তেজহীন, ম্যাদামারা।  নদীর পানিতে জাড় এসেছে। আম্বিয়া মাঝারি  সাইজের একটা আইড় ধরে ডাঙ্গায় উঠেছে। মাছটির কানকোর ভিতর হাতের আঙুল গলিয়ে মাছটিকে সে ধানক্ষেতে ছুড়ে মারে।
ছোট খাজুরার মুছো ফারাজী টাক মাথা এগিয়ে এসে আম্বিয়ারে কয়, এই ছিমড়ি মাছ আমার কাছে বেঁচপি?
আম্বিয়া বলে, কাকা এই আইড় আমি ব্যাঁচপোনা। আমার দাদির হাউস সে আইড় মাছ খাবে।
মুছো ফারাজী মাথার গামছা খুলে মাথার উপর এক ঘুল্লি দিয়ে বলে, মরণকালে বুড়ির হাউস ফানাইছে। তা তুই ছিমড়ি মানুষ হয়ে গাঙখালে গাবায়ে বেড়াইস ক্যান?
আম্বিয়া চুপ করে থাকে। 
তুই আইড় আমার কাছে বেঁচপিনে?
না কাকা। তোমারেতো কলাম দাদীর জন্যি বাড়ি নিয়ে যাবো।
তুই যদি এই আইড়মাছ আর কারোর  কাছে বেঁচিস তালি তুই কিন্তুক ঠাপান খাবি।
এই বলে সে রাগে গজর গজর করে ধান ক্ষেতের আইল ধরে হাটতে শুরু করে।
মুছো ফারাজি জমিদারদের টেন্ডল আর লুচ্চো। সে আগে একবার আম্বিয়ারে ফাঁকা পেয়ে মাই চেপে ধরেছিলো। 
কিছুদিন ধরে আম্বিয়ার দাদী বায়না ধরেছে তাকে একটা আইড় মাছ খাওয়াতে হবে। আম্বিয়া  কইছিলো, দাদী আমি মায়েজিহুত আইড় কী আমি ধত্তি পারবো?
পারবি বুগো পারবি আমি দোয়া এত্তিছি। পানির পয়গম্বর খোয়াজ খিজিরের নাম নিয়ে  ডুব মারবি, তালি ঠিক  আইড় ধরতি পারবি।
গাছপালার মাথার উপর রোদ ঝলকালে সে নদীতে পড়েছে। এতো  বেলাঅব্দি সে ডুবিয়েছে। এখনো আইড়ের খবর হয়নি।  এর আগে সে কয়েকটা গলদা ধরেছে। আশা প্রায় ছেড়েই  দিয়েছিলো। জোয়ারের পানি বাড়ছে।  এবার শেষ চেষ্টা। এর আগের ডুবে খাড়িতে আইড়ের সন্ধান পেয়ে সে বাগে আনতে পারিনি। আর পারবেও কী করে। তার বয়স সবে মাত্র চৌদ্দ। নমপাড়ার জগা, বাজনাদার বাড়ির বাহের, মালোপাড়ার নালা বড় আইড় ধরিছে। এতে আম্বিয়ার আরো মন খারাপ হয়েছে। তার দাদীর ব্যাথাভরা মুখ তাকে তাড়া করে। তাই সে শেষ চেষ্টা করে। সে গাঙের কিনারে এসে পরনের ছ্যাবটে কাছা মেরে খাড়ির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গাঙের অতলে জলস্রোত, কানের উপর পানির প্রবল চাপ। কর্ণমূল কটকট করছে। খাড়ির অতলে খোড়লে সে আইড় মাছটার ঠাহর পায়। ছোট জলদানবটা একটু নড়াচড়া দিলো। উত্তেজনা প্রশমনে সে পানির ভিতর মুতে নেয়, তার গা শিরশির করছে। মুহুর্তেই সে তার বাপের শেখানো কৌশল প্রয়োগ করে। শিরদাড়ায় বল্লমের ফলার মত কাটা। আইড় মাছটার দুর্দমনীয় তেজ পানির ভিতর দাপাদাপি কোস্তাকুস্তি।  আম্বিয়া তার কৈশোরের শক্তিমত্তা  ও কৌশলে জলজন্তুটাকে পরাস্ত করে। সে আইড়টাকে নিয়ে ডাঙায় উঠে কিছুদুর হেটে কচি ধানক্ষেতের ভিতর ছুড়ে মারে। মাছটি কয়েক লাফ দিয়ে পাটায় পড়ে। 
 
মাছ দেখার জন্য চেংড়া বুড়ো সবাই ছুটে আসে। বাহের গাজী তার  পিঠে থাবা দিয়ে  বলে, তুই বাপকা বেটি। 
আম্বিয়া হাত দিয়ে মুছো ফারাজিকে সরায়ে দেয়। তবু তার বাপের স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে।
আইড় ধরার পর আম্বিয়া  হাঁপিয়ে  গেছে। এখন সে  মাটিতে জাবড়িয়ে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।
বিলের ও মাথায় মিত্তিরদের কালীমন্দিরের সামনের কাঁগভাঙা ঝাউগাছ থেকে মাছালের কর্কশ ডাক ভেসে আসছে। নদীপাড়ে মুচিবাড়ির সামনে একপাল কার্তিকের হ্যাক্কামার কুকুর সমানে ডেকে চলছে। মাছরাঙা জোয়ারের জলে গাবানো খরসুন্নো মাছের ঝাঁকে ছো মারছে। কয়েকটি ফিঙ্গে হামজুম গাছের উপর বসে  লেজ নাড়াছে।
 
ক্ষুধায় আম্বিয়ার পেট চোঁচোঁ করছে। বাড়িতে এই ডাঙর আইড় মাছ নিয়ে গেলে তার দাদী কত খুশী হবে সে কথা ভাবছে। তার দাদী বাসন ভর্তি নতুন চালের ভাত মাখিয়ে তাকে গালে তুলে খাওয়াবে।
আম্বিয়া এবার উঠে নদীর কিনার থেকে টানমেরে দুইটা হোগলার ডাটা তোলে। তারপর ধানক্ষেত থেকে আইড় মাছটাকে তুলে এনে ভেড়ির পরে রাখে। হোগলার ডাটা কয়েক পাক মেরে মাছটির কানকোর ভিতর ঢুকিয়ে গিট দেয়। তারপর একটা জিওলের ডাল ভেঙে এনে তার ভিতর ঢুকিয়ে কাঁধে  বাধিয়ে ছিরুখালি জোলার কিনার ধরে হাটতে  থাকে। কয়েকটা উদোম শিশু  হাতে তাদের চ্যাগা পাখি। তাদের পানি জোকের মত কালো  ছোট্ট নুনু দুলিয়ে কোমরের ঘন্টি বাঁজিয়ে আইড় মাছের লেজ ছুয়ে  আম্বিয়ার পাশ দিয়ে দৌড়ে চলে যায়।
সে এবার ডিষ্টিক বোর্ডের বড় রাস্তায় ওঠে। রাস্তা ফাঁকা। একটা বাগদাশ আমগাছের ডালের উপর দিয়ে দৌড় মারে।  রাস্তার দুই ধারে নারকেল সুপারির বাগান। আম,জাম, গাব গাছও আছে। বাগান থেকে একনাগাড়ে ঝিঁঝিঁ  পোকা ডেকে চলছে। চারদিক নজর দিয়ে আম্বিয়া তার বুকে পেচানো গামছা খুলে নিংড়ে আবার বুকে পেঁচিয়ে নিলো। তার পরনে ছ্যাবট। ভিজা ছ্যাবট থেকে এখনো দুই এক ফোটা পানি পড়ছে।
রাস্তার বাঁক ঘুরলে লাল ঘোড়া হাঁকিয়ে জমিদারের নায়েব তার সামনে চলে আসে। ঘোড়ার লাগাম টেনে নায়েব লাফিয়ে নেমে হাঁক ছাড়ে।
এই কুত্তার বাচ্চা আইড় মাছ কারে বলে ধরিছিস?
জাহাজঘাটার খাড়িতে ডুব মেরে ধরিছি।
এবার নায়েব চাবুক ঘুরিয়ে আম্বিয়ার দিক তেড়ে আসে। নায়েব আবার গালি দিয়ে বলে,  ফকিরের বাচ্চা মাছ রাখ।   জমিদার শৈলেন ঘোষের এলাকায় হুকুম ছাড়া গাঙের থেকে মাছ ধরিস। তোর সাহস কতো।
 
ভয়ে আম্বিয়ার আত্মা সুখিয়ে যায়। আবার তার মনে দাদীর কষ্টমাখা মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। এক সেকেন্ডে তার ঘিলুতে বিদ্যুৎ চমক দেয়।
সে আইড়মাছ কাঁধে নিয়ে লাফ মেরে রাস্তার পাশের  ছোট্টনালা পার হয়ে উর্ধ্বশাষে বাগানের ভিতর দৌড় মারে। জার্মনিলতা, আশসেওড়া, বুনোকুল, নাটা, বিছুটিবন ভেঙে আম্বিয়া  ছুটতে থাকে। আর আধবুড়ো  নায়েব চাবুক হাতে আইড় মাছের লোভে চেঁচাতে থাকে। আম্বিয়া দৌড়ে বাগান পেরিয়ে কান্দরে পড়ে। কান্দর পাড়ি দিয়ে সে ছোটখাজুরায় তাদের বাড়ি চলে আসে। সে দাদী বলে জোরে ডাক ছাড়ে।  তারপর  মাছটাকে উঠানে ছুড়ে ফেলে ধুলিমাটির উপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ে।
 
 


অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন