জলধি / গল্প / জানাজা
Share:
জানাজা

দবির সাহেব অত্যন্ত বিরক্তমুখে বাতাবিলেবু গাছটার নীচে খালি পায়ে বসে আছেন। থানা থেকে বেশ খানিকটা দূরে জায়গাটা। কোন এক বুদ্ধিমান মানব নিজ গরজে বাতাবিলেবু গাছের চারপাশটাতে গোল করে সিমেন্ট দিয়ে উঁচু চত্বরের মতো করে বাঁধাই করে দিয়েছে এই গাছটা এলাকার দুই রাস্তার ঠিক মাথায়। লোকজন আড্ডায় বসে যায় এখানে যখন তখন। আজ কেউ নেই। বাতাবিলেবু গাছটা থেকে থেমে থেমে দমকা হাওয়ার সাথে খুব মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে। এটা কি শরৎ নাকি হেমন্তকাল এসে গিয়েছে? দবির সাহেবের ঠিক মনে পড়ছে নাএকটা লেবু ফুল ঝরে পড়লো ঠিক দবির সাহেবের বাম হাতটা ঘেঁষে। অদ্ভুত কি অদ্ভুত! কোনোদিন তার এভাবে দেখা হয় নি। সাদা লেবু ফুলের মাঝে গাঢ় হলুদ রংগের পরাগরেণুগুলো কি সুন্দর করে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, দুলে দুলে পরম এক দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছে। যা অনেকটা রহস্যময়। দবির সাহেব অত্যন্ত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ফুলটার দিকে। অপলক চাহনি কখনো কখনো মানুষের অন্তর আর মনকে এতোটাই শান্ত করে দেয়, যে বাস্তবের জীবনের আগুনের আঁচটা আর কিছুকেই স্পর্শ করতে পারে না। খানিক আগেই ভ্রু কুঁচানো মন খারাপ লাগাটা কিভাবে যেন হারিয়ে গেলো ছোট্ট একটা অপার সুন্দর লেবু ফুলের মাঝে।

দবির সাহেব বেশ বেখেয়া্লে ছিলেনকিছুটা নিঃশব্দে হেঁটে আসা একটা পঁচিশ বা ছাব্বিশ বয়সের সুন্দর মেয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ফেরাতেই দেখতে পেলেন মেয়েটাকে। এলোমেলো করে একটা খোপা করা, সাধারণ বেগুনি একটা সুতির শাড়ি পরনেকোনো বাড়তি সাজসজ্জা নেই। বেশ উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে চেহারাটাকাঁধে একটা সবুজ ঝোলানো ব্যগ। সব মিলিয়ে অসাধারণ কিছু একটা আছে মেয়েটার চোখে। ব্যাপারটা আবিষ্কার করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো দবির সাহেবের।

দবির সাহেবকে প্রয়োজন না থাকলে, মেয়েটি নিশ্চয়ই তাকে পাশ কাটিয়ে গ্রামের সরু পথটা ধরতো। যেহেতু তার ডান দিকটার থেকে কিছুটা দূরত্বে থেমেছে এবং স্থির হয়ে আছে তাই বাধ্য হয়ে দবীর সাহেবই প্রথম প্রশ্ন করলেন,

-কিছু বলবেন?

-জ্বী আমার মা গত এক ঘন্টা আগে মারা গিয়েছেন!

একটা মেয়ে তার মায়ের মৃত্যুর খবর এত শান্তভাবে দিতে পারে! দবির সাহেব ঠিক ঠাওর করতে পারছিলেন না। যেখানে তার নিজের জীবনেই এমন এক ঘটনার আসন্ন আশংকায় বড় অস্থির মন নিয়ে তিনি লেবু গাছের নীচে বসে আছেন। আরেকবার লেবু ফুলটার দিয়ে চাইলেন। তিনি ফুলটাকে আনমনে বিদায়টাও জানিয়ে দিলেন কিন্তু তুলে নিলেন না। মনে মনে বললেন,

"যে গাছের তরে জন্ম হে পুষ্প!

তারই তলে হচ্ছো যে শুষ্ক

বিদায়বেলাতে তোমার ঘ্রাণে 

দীপশিখা মেলে এই মননে!"

দবীর সাহেব মেয়েটিকে বললেন,

-চলুন তাহলে থানায় চলুন

দবির সাহেব এই এলাকার থানায় দুইদিন হলো বদলি হয়ে এসেছেন ওসি হিসেবে। মনটা অস্থির হলেই মাঝে মাঝে লেবু গাছতলায় এসে বসে থাকেন। ব্যাপারটা এখনো তেমন কেউ জানে না। কিন্তু ছোট জায়গা তাই  খবর হতে খুব বেশি সময় লাগে না। হয়তো মেয়েটাকে কেউ বলে দিয়েছে, তিনি এখানে। এটা নিয়ে তিনি আর কোন প্রশ্ন করলেন না। থানা থেকে বেশ খানিকটা দূরে জায়গাটা। হেঁটে যেতে যেতে মেয়েটাকে তিনি প্রশ্ন করলেন,

- আপনার নামটা?

- ফুল

বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা খুব বেশি কথা বলতে ইচ্ছুক না। দবির সাহেব বললেন,

- কোথায় আপনার আম্মা?

- পতিতাপল্লিতে!

এবার আর কোন কথা বললেন না দবির সাহেব। বুঝতে পারছেন জটিল একটা সমস্যায় পড়তে যাচ্ছেন। তার নিজের মা মৃত্যুপথ যাত্রী।সারাজীবন নিজের পেশা আর কাজকে এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন দবির সাহেব যে, নিজের মা, স্ত্রী, সন্তানকে তেমন সময় দিতে পারেন নি। আজ তার মা এর প্রতিশোধ নিচ্ছেন। তিনি দবির সাহেবের মুখ মৃত্যুর আগে দেখতে চান না, জানিয়ে দিয়েছেন। মৃত্যুর খবরের অপেক্ষা করাটা খুবই ভয়ংকর কষ্ট, দবির সাহেব বুঝতে পারছেন। সেই তুলনায় এই মেয়েটা বাচ্চা। আর তার মায়ের মৃত্যু সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ঘটনা  হয়তো আরও ভয়ানক কষ্টের।

থানায় দবির সাহেবের কক্ষে মেয়েটা বসে আছে। দবির সাহেব কাউকে কক্ষে প্রবেশ করতে নিষেধ করে দিলেন। মেয়েটার জন্য দুই গ্লাস পানি দিতে বললেন। মেয়েটা দুই গ্লাস পানিই ঢকঢক করে খেয়ে নিল। দবির সাহেব কিছুক্ষণ ধাতস্থ হতে সময় দিলেন মেয়েটিকে। এরপর মেয়েটি শুরু করল তার বক্তব্য,

-আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছি। স্কলারশিপ পেয়েছি জাপানের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পিএইচডি করতে যাব। আজ রাতে আমার ফ্লাইট।   

 এই পর্যায় ফুল দবির সাহেবকে অন্য রকম একটা অনুরোধ করল,

- স্যার আমি আপনার বাসায় গিয়ে কথাগুলো বললে চাই

দুপুরে আজ খাওয়া হয় নি দবীর সাহেবের অবশ্য তেমন খিদে বোধ ও করছেন না প্রায় বিকেল গড়াচ্ছে তিনি কিছুটা চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নিলেন,

‘ঠিক আছে, আপনি দাঁড়ান’ বলে তিনি কক্ষ থেকে বের হলেন।

এরপর ফুলকে নিয়ে তিনি বের হয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। দবির সাহেব বাসায় কাউকে আনেন না। আসাটাও পছন্দ করেন না। কিন্তু আজ বিনা বাক্যে তিনি ফুলকে এনে ফেলেছেন। আসরের নামাজ পড়বার সময় চেয়ে পনের মিনিটের জন্য তিনি ভিতরে গেলেন। এর মাঝে মায়ের খবর নিলেন মোবাইলে, স্ত্রীর কাছ থেকে। অবস্থা খুব একটা ভাল না কিন্তু জ্ঞান আছে, কোনো ভাবেই তাঁকে হাসপাতালে নিতে রাজি করানো যায় নি। একজন ডাক্তার বাসাতেই তাঁর খেয়াল রাখছেন। ফোনটাকে নীরব করে দিয়ে তিনি ফিরে আসলেন ফুলের সাথে কথা বলবার জন্য।

মেয়েটা খুবই শান্ত ভঙ্গিমায় বসে আছে বেতের চেয়ারটিতে। বিছানাতে বসলেন দবির সাহেব। ফুল তাকিয়ে আছে তার টেবিল ঘড়িটার দিকে। মনে হচ্ছে মন দিয়ে সেকেন্ডের কাঁটা চলার টিকটিক শব্দটা শুনছে। কোনো রকম ভণিতা ছাড়া সে শুরু করলো আবার তার কথা। মাঝে একবাবের জন্য দবির সাহেব তাকে থামালেন না, কোনো প্রশ্নও করলেন না।

-আমার মায়ের নাম হাসনাহেনা খাতুন। রেল স্টেশন রোডের পতিতাপল্লীর একজন পতিতা ছিলেন আমার মা। পতিতাপল্লিতে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে মায়েরা খুব খুশি হোন। আশা করি বুঝতে পারছেন, কেন খুশি হোন তারা!  কিন্তু আমার মা আমাকে নিয়ে হলেন চিন্তিত। কারণ তিনি চাইলেন আমি এই জীবনে যেন প্রবেশ না করি। ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়, কথাটা আংশিক ঠিক। আমার মা তার এক কাছের বিশ্বস্ত ব্যাক্তির মাধ্যমে আমার জন্মের পর পরই দূরে সরিয়ে দিলেন। আমি মারাত্মক মেধাবী একজন মেয়ে। সারাজীবন ভাল ফলাফল করেছি। বৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা চালিয়েছি। আমি একটা পরিবারের সাথে ছিলাম। তারা আমাকে খুবই ভালবাসে। আমাকে ছোটবেলা থেকে জানিয়েছিল তারা, আমি এতিম। আমার আত্মীয় স্বজন কেউ তাদের জানা পরিচিত নেই। আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম আর তারা আমাকে পেয়ে, পালক হিসেবে নিয়ে নেন সরকারি রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে।

ফুল একটা বড় দীর্ঘশ্বাস নিল।

-এতক্ষণ যে কথাগুলো বলেছি আমার মা সম্পর্কে সেটা আমার অজানা ছিলো প্রায় চব্বিশ বছর। মায়ের স্মৃতি আমার একদমই মনেই নেই। বাবা বলে তো কিছুই নেই। আমি এতিম সন্তান হিসেবে, আজীবন আমার পড়ালেখা, চাকরি সব জায়গাতেই বাবা মাকে মৃত লিখেছি। একদিন হঠাৎ সেই ব্যাক্তিটি, যিনি আমার মায়ের পরিচিত। আমার সাথে দেখা করেন, আমাকে সব খুলে বলেন। আমি খুব একটা অবাক হই নি। জীবন আমাকে অবাক হতে শিক্ষা দেয় নি কখনোই। আজীবন ভেবে নিয়েছি কঠিন যা কিছু আছে, তার সব বাস্তব ঘটনাগুলো আমার জন্য বরাদ্দকৃত। 

দবির সাহেব একটু অন্য প্রসঙ্গে গেলেন,

-আপনার ফ্লাইট কি আজ ধরতে পারবেন?

-স্যার ফ্লাইট ধরাটা তো আর জরুরি কিছু না। কপালে থাকলে যাওয়া হবেই। কিন্তু মাকে তো আর পাব না। যদিও জীবিতও কোন দিন পাই নি। আমার আপনাকে সব বলতে খুব ভাল লাগছে। এত কথা কাউকে বলতে আমার কোনদিন ইচ্ছা হয় নি। ইচ্ছা থেকে বড় আমি জানি এগুলো আপনাকে আমার বলাটা খুব দরকার। আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?

-একদম না, তুমি বলো।

দবির সাহেব নিজের অজান্তেই ফুলকে তুমি বলে ফেলেছেন। কিন্তু সেটা নিয়ে দুইজনের কারও মাঝেই কোন বিকার দেখা গেল না। বরং এখানে আন্তরিকতা আর বিশ্বাসের খানিক জায়গা বেড়ে গেল ফুলের জন্য।

-আমার মাকে মাত্র সাত বছর বয়সে তার সৎ বাবা বাসা বাড়িতে কাজের কথা বলে এই পল্লিতে বিক্রি করে দেন। অনেকবার পালানো চেষ্টা করেছেন। আবার তাকে ধরে আনা হয়েছে। জীবন তাকে মাফ করে নি। একবার নাকি এই পল্লি থেকে একজনের সাথে বের হয়ে কয়েক মাস সংসারও করেছিলেন। কিন্তু লোকটা তাকে ফেলে চলে যায়। পতিতাপল্লির মেয়েদের এই সমাজে তো স্থান হয় না। কেউ অন্য কাজ দিয়ে সাহায্যও করতে চায় নি। আমাকে পেটে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে। লাভ হয় না। দুইটা পেটের দায়ে আবার ফিরলেন এই নিষিদ্ধ পল্লিতে। বাবা নামক বস্তুটা আর কোনদিন ফিরে নি। আমার মায়ের নিষিদ্ধ অন্ধকার জীবনটা তো শেষ। এখন কেমন জানি,  আমার জীবনটাও একদম হতাশাপুর্ণ হয়ে যাচ্ছে

-তুমি তো সমাজে ভাল একটা অবস্থানে আছো ফুল। তোমার একটা আন্তরিক পরিবারও আছে। তবে তুমি কেন অস্থির হচ্ছো? মা পতিতা এটা জানবার পর?

মৃদু হাসল ফুল,

-স্যার আমার সার্টিফিকেটে কোথাও ফুল নামটা নেই। আমার নাম সাবিত্রী দাস। আমার পালক বাবা মা হিন্দু ধর্মালম্বী। তাই আমিও সেই ধর্মেই দীক্ষিত এবং অনুশীলন করি। ফুল নামটা রেখেছিলেন আমার নিজের মা। আমি সেই ব্যক্তিটা থেকে জেনেছি।

-আচ্ছা ফুল, বার বার বলছো সেই ব্যক্তি! উনি আসলে কে?

-আমার মাকে সে খুব ভালবাসত। একটা সময় নাকি আমার মায়ের নিয়মিত ক্লায়েন্ট ছিল সে। সমাজের অনেক উঁচু শ্রেণির ব্যক্তি। একটা মানুষ মানেই তো দোষ গুণের সংমিশ্রণ। নিজের স্ত্রীকে ঘরে রেখে যেমন পতিতাপল্লিতে আসাটা পাপ। আবার একজন পতিতাকে ভালবাসা। তার মেয়েকে আশ্রয় দানে সাহায্য করা, একটা নরকের জীবন থেকে মুক্তি দেওয়া, এটা তো পাপ নয় হয়তো। ভগবান কোনটার জন্য কাকে নরকে দিবেন আর কোনটার জন্য স্বর্গে দিবেন। সেটা যদি আমি নাই জানি তাহলে তাকে বিচার করি কোন ক্ষমতায়? সাথে তার পরিচয় প্রকাশ করি কোন মুখে বলুন! মানুষ গল্পের নেতিবাচক দিকটাতেই বেশি আরাম পায়, আর ইতিবাচক দিকে খেয়ালই দেয় না।

-হুম, মাগবীরের আজান দিচ্ছে ফুল। আমি নামাজটা পড়ে আসি?

-জ্বী অবশ্যই।

মাগরিবের পর দবির সাহেব বেশ কিছু আমল করেন। সুরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াত, সূরা ইখলাস, সূরা কদর, সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতসহ আরও কিছু দোয়া। আজ মায়ের জন্য বেশি বেশি দোয়া পড়তে খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু তা শর্তেও তিনি নামাজের সূরা সহ সব আমল খুব সংক্ষিপ্ত করলেন। কারণ একটা মায়ের লাশ, তার জন্য অপেক্ষা করছে আর তার নিজের মা এখনও জীবিত আছে। তাকে খোদার উপর ছেড়ে দেওয়াটাই বেশি পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত হয়তো

দবির সাহেব দুই কাপ চা বানিয়ে আনলেন চট করে। মেয়েটা চুপ করে বসেছিল। এমন ভাবে কথা শুরু করল যেন অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছিল দবির সাহেবের জন্য।

-আমার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে মাস ছয়েক আগে। ওই মানুষটা চেষ্টা করেছেন তার ভাল চিকিৎসা করাতে। কিন্তু আমার মায়ের এত অভিমান, তিনি উনার টাকা নেন নি। মা কারও থেকেই সাহায্য নিতেন না একদম।  আমাকেও কোনদিন নাকি একটাবারের জন্য দেখতে চাননি। তাই বছর খানেক আগে আমি মায়ের কথা জানতে পারলেও, মায়ের কাছে আসতে পারিনি। মায়ের অনুমতি ছিল না, তার ঠিকানা আমাকে দেবার।

- তোমার ভালোর জন্যই তাই না? চা ঠাণ্ডা হচ্ছে ফুল, খাও।

ফুল সেই কথাটার পাল্টা উত্তর দিল,

- আমার মায়ের লাশটা পচা ধরছে।

-এবার বল আমি কি করতে পারি? আমি কিভাবে তোমাকে সাহায্য করবো?

-শেষদিকে খুব অসুস্থ হবার পর মা নাকি শুধু ফুল ফুল করে চিৎকার করেছেন। এটা জেনেই আমি এখানে আসি। তবে যখন আসি তখন তার আর জ্ঞান নেই। তার ঘরেই শোয়ানো ছিল। একদম কঙ্কালসার একটা মানুষ। তার আসল চেহারাটা ভেবে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আশেপাশের সবাই যখন বলছিল আমাকে দেখে, এতো পুরা হাসনাহেনার মতোই দেখতে! তখন বুঝলাম নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড়া করালেই তো মাকে দেখা যাবে। মা তো আমার ভিতরেই বসবাস করে। শুধু আমার জানা ছিল না এই আর কি! যাই হোক, আমি আসার কয়েক ঘণ্টা পর মা মারা যায় তার নিজের ঘরটিতেই। মাত্র বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ বছরের একজন একাকি পতিতা নারির মৃত্যু হলো। কিন্তু কিছুটা সে ভাগ্যবতী কারণ তার অজান্তেই তার মেয়েটা তার সামনে ছিল। আমি ভাবছিলাম তার জানাজা, দাফন সব একবারে শেষ করে তারপর ফিরব। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তারা আমাকে জানাল, আমার মায়ের লাশটা...

হঠাৎ দবির সাহেবের ফোনটার স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল। তিনি বুঝতে পারলেন। একটা খবর এসেছে। একটা শুভ্র লেবুফুল পতনের ঘ্রাণ তিনি পাচ্ছেন। দবির সাহেবের আম্মা ইন্তেকাল করেছেন। উনার মেয়ে খবরটা দিল। উনি ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন’ পড়লেন। একে তো হালকা শীতের আমেজ তার উপর মফস্বল এলাকা। মাগরিবের পরেই সব নিশ্চুপ হয়ে যায়। বাইরে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। দবির সাহেব একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। দোয়াটা পড়া শুনেই ফুল বুঝেছে, কারও মৃত্যু সংবাদ এসেছে। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। দবির সাহেব নিজেই নিজেকে আবার হিসেবের ভিতর নিয়ে নিলেন। কারণ তিনি একটা বড় দায়িত্বে আছেন। মৃত মায়ের জন্য দোয়া করাটাও দায়িত্ব। কিন্তু সন্তানের সব ভাল কাজ যদি মৃত মা বাবাদের জন্য উপকারে আসে তো এই মেয়েটিকে এখন সাহায্য করাটাও একটা ইবাদতের শামিল হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। দবির সাহেবই শুরু করলেন,

- হ্যা কি বলছিলে তোমার মায়ের লাশ?

- জ্বি স্যার আপনি ঠিক আছেন?

- হ্যা হ্যা, তুমি বলো।

- হুম, ঐ পল্লীর যারা হত্তাকর্তা তারা জানাল, পতিতাদের লাশের নাকি  জানাজা আর দাফন হয় না। আমি আসলে এটা জানতাম না।

- আমি কিন্তু এটা জানি ফুল মানে তাদের এই রীতিনীতিটা

খুব অবাক হলো ফুৎ,

- আপনি বা আপনারা জানেন কিন্তু কেউ এটা নিয়ে কোন প্রতিবাদ করেন নি? এটা কত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন সেটাও নিশ্চয়ই জানেন।

- ফুল কিছু কথা বলি, মনে কষ্ট নিও না। সারা দুনিয়া জুড়ে প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায়, প্রতি ঘরে বাইরে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েই চলেছে। কিছু করার নাই আমাদের। এগুলো এতোই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে এই সমাজে যে, সেটা রীতি রেওয়াজে পরিণত করে আরও পাকাপোক্ত করা হয়েছে শত বছর জুড়ে তাই এটাকে ভাঙ্গার সুযোগ অনেক কম।

- মানে আপনি আমাকে সাহায্যটা করছেন না, তাই তো?

- আমি কি এটা বললাম?

- আমি আমার জীবন থাকতে আমার মায়ের লাশের অসম্মান হতে দিব না। আমি সাংবাদিক সম্মেলন করব, মন্ত্রী নেতা, বুদ্ধিজিবি, আইন যার কাছে যেভাবে যেতে হয় যাব। মায়ের লাশ আমি বস্তায় ভোরে নদীতে ফেলতে দিব না স্যার।

- মাথা ঠাণ্ডা কর ফুল। এত কিছু করার সময় পাবে তুমি? লাশ তো না পচে তোমার বিচার পাবার অপেক্ষায় বসে থাকবে না। হ্যা একটা উপায় ছিল, যদি তুমি আগে ব্যাপারটা জানতে আর মায়ের মৃত্যুর অনেক আগেই আসতে পারতে তাহলে এটা নিয়ে একটা প্রতিবাদ করতে পারতে,তবু জানি না সেটা কতটা ফলপ্রসূ হত। আর এরপর এটা নিয়ে তুমি কাজ করতে পারো, তাতে যদি সামাজিক সচেতনতা বাড়ে।

ফুলের মেজাজ অত্যন্ত খারাপ হচ্ছে। মায়ের লাশ রেখে এসে এইসব তত্ত্বকথা তার ভাল লাগছে না। অথচ মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনেও, ঠাণ্ডা মাথায় দবির সাহেব কেন ফুলকে এইসব বলছেসেই আবেগটা ফুল ধরতে পারল না। মূলত এখানে দুইজন মানুষেরই মা হারা হয়ে, দিশেহারা হবার কথা থাকলেও দুইজনই বাস্তবতার চাকায় পিষ্ট হচ্ছে। নিজেদের মাঝে কথাগুলোকে এমন পর্যায় নিচ্ছে যেখানে যুক্তি, আবেগ, তর্ক সব এসে যাচ্ছে। যাতে সঠিক একটা সিদ্ধান্ত আসেআর এটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ দুইজনের জন্যই। আবেগ, ধর্ম আর আইনগত জায়গা থেকে সঠিক বিচার বিশ্লেষণের জায়গাটা তাৎক্ষণিক খুঁজতে হয়তো সাহসি ফুল উঠে দাঁড়াল। সাথে দবির সাহেবও দাঁড়ালেন,

- চল, আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে। দেখি কিছু করা যায় কিনা।

পতিতাপল্লি, নদী পার হয়েও আরও খানিক পথ ভ্যানে করে যেতে হয়। প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা। বিরাট সোরগোল দেখা যাচ্ছে হাসনাহেনার ঘরের সামনে। তার লাশ পড়ে আছে। একটা লাল প্রিন্টের চাদরে ঢাকা হয়েছেএখানে আগরবাতিও জ্বালাতে দেওয়া হয় না। কারণ পতিতাদের মতো পাপিদের লাশের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই। যদিও এখানের প্রচুর পতিতা জীবিতকালে যার যার ধর্ম কর্ম ঠিকঠাক পালন করে থাকেন। যার অর্থ দাঁড়ায়, মানুষ নিজে তার স্রষ্টার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে কিন্তু সমাজের কাজ হলো, মানুষ আর স্রষ্টার মাঝে ফারাক সৃষ্টির নিত্যনতুন নিয়ম তৈরি করা

দবির সাহেব সিভিল জামাতে এসেছেন বলে, কেউ বুঝতে পারে নি প্রথমে যে উনি থানার ওসি! এখানের হোমরাচোমরা মানুষগুলো খুব বাজে গালি দিচ্ছিল ফুলকে কারণ সে লাশ আটকে রেখেছে। দবির সাহেবের পরিচয় জেনে খানিক ঠাণ্ডা হল। কিন্তু তারা লাশের জানাজা আর দাফন দিবে না, এক কথা।

কাছাকাছি মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডাকলেন দবির সাহেব। প্রথমে সে আসতে রাজি হয় নি। কিন্তু মোটামুটি হালকা হুমকি ধামকি শুনে আসলেন। তবে পল্লির ভিতরে না, বাইরে এসে দবির সাহেবের সাথে কথা বললেন। এর মাঝে দবির সাহেব তার কিছু পুলিশ ফোর্স এখানে আনালেন যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কানেমুখে প্রচুর বাজে কথা শুরু হয়ে গেল দবির সাহেবের নামে। “নিশ্চয়ই এই লোকের এইসব পতিতাদের সাথে সম্পর্ক আছে, নাইলে এত মাথা ব্যথা কেন! আগের ওসি সাহেব খুব ভাল মানুষ ছিলেন, তাদের ভাষ্যমতেএই পতিতাপল্লি থেকে টাকা নিতেন কিন্তু তাদের নিয়ম শৃঙ্খলা আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন।”

ইমাম সাহেবের সাথে প্রায় ঘণ্টা খানিক একদম আড়ালে এবং একাকি কথা বললেন দবির সাহেব। কারও বাজে কথা আর মন্তব্যের উত্তর করলেন না।

- ইমাম সাহেব জানাজা পড়াবেন না কেন?

- স্যার আপনিও মুসলমান, আমিও। এরা পাপি, এদের কিভাবে জানাজা পড়ানো সম্ভব? তাছাড়া আমি যদি জানাজা পড়াই, এরপর সাধারণ মানুষ আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলব। আমার পিছে আর নামাজে দাঁড়াবে না।

মেজাজ খারাপ হলেও নিজেকে ধরে রেখে দবির সাহেব কিছু কথা বললেন, যার সারমর্ম দাঁড়ায়।

‘ইমাম সাহেব আপনি তো দেখি আল্লাহ থেকে মানুষ আর আপনার পেটের চিন্তা বেশি করেন। আপনি সাধারণ মানুষ হয়ে কে পাপি কে পূণ্যবান, তাও দেখি জানেন! আপনি আগে তওবা পড়েন। আচ্ছা, এরা পাপি মানলাম কিন্তু একটা বিখ্যাত ধর্মীয় কিতাব আছে নাম, ফাতহুল বারি। সেখানে কিন্তু বলা আছে, “পাপাচারে লিপ্ত ব্যাক্তিরও জানাজা হবে।” আর প্রত্যেক মুসলিম যে কিনা আল্লাহ রাসুলে বিশ্বাস করে, তাকে তো আমাদের কবর দিতেই হবে। মুসলিম লাশ নদীতে ভাসানোর নিয়ম কোথায় আছে দেখান? যদি তাই করা হয় আমাদের সামনে, তো আল্লাহ্‌র হুকুমের অবমাননা করার কারণে কত বড় পাপি আমরা হবো বুঝেন আপনি? হাদিসে কিন্তু বলা আছে, পতিতার টাকা মালিক নিবে নাকারণ এই পেশাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু এখানে পতিতাদের মালিক মানে কি জিনিস জানেন তো! কত মানুষ এই পাপের কালি মাখছে, সেটার খবর নেন কি? খালি পতিতাদেরই দোষ সব? সুরা নূরে বলা আছে, কাউকে পতিতা হতে বাধ্য করতে না আর এখানে তো মোটামুটি আটকে রেখে নারিদের দিয়ে এই কাজ করানো হয়। একজন ধর্মীয় নেতা হিসেবে এইসব নারীদের কোনদিন হেদায়েতের পথ দেখিয়েছেন বা সৎ কাজের সন্ধান দিয়েছিলেন? কত পাপ জমাচ্ছেন হুজুর? নবী (সা) যেখানে পাপিদের আল্লাহপাকের ক্ষমার সুসংবাদ দিয়েছেন, আর আপনারা শোনান হতাশার ওয়াজ! হারাম কাজে লিপ্ত মানেই তো কাফের না। পতিতারা কাফের না। তারা আল্লাহতে বিশ্বাসী হলে তাদেরও ক্ষমা পাবার সুযোগ আছে। হুজুর আপনার মসজিদে তো অনেক পয়সাওয়ালা লোকেরা চাঁদা দেয়, সোয়াবের আশায়। আমি যদি খোঁজ নেই এদের হাঁড়ির খবর। দেখা যাবে বহু দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসি আর পতিতালয়ের ক্লায়েন্ট এরা। এদের টাকায় ইবাদতের ঘরে এসি লাগে, তলার পর তলা বাড়ে। কিন্তু এদের বড় করে জানাজা হয় আর পতিতাদের না হবে জানাজা, না হবে দাফন। বাহ! আপনি না পড়াতে চাইলে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে বলেন যে, তারা যেন জানাজা পড়ায়। শুদ্ধ ধর্ম আর সঠিক আইন একত্রে এমন এক শক্তি, যা ইতিহাস তৈরি করতে পারে। ইমাম সাহেব আমাকে সাহায্য করেন, প্লিজ!’

কথাগুলোর মাঝে ইমাম সাহেব কোন কথাই বলেন নি। পেটের হিসাব আসলে তিনি করেন নি। লোকলজ্জার ভয়টাই বড় ছিল তার জন্য। হঠাৎ সেখান থেকে নিজের মনকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারলেন তিনি। রাজি হলেন নিজেই হাসনাহেনা খাতুনের জানাজা পড়াতে।

লাশ গোসল করানো নিয়ে সমস্যা হল। কেউ গোসল করাতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু পল্লির একজন বয়স্ক নারি বলল, সে করাবে। কিন্তু একা তো সম্ভব না। ফুল বলল, সে সাহায্য করবে মাকে গোসল করাতে। ফুল হিন্দু ধর্মালম্বীর হলেও হাসনাহেনার সন্তান তাই হুজুর বললেন, সে লাশের গোসলে অংশ নিতে পারবে। কারণ আলী (রা) তার বাবা আবু তালিব ,যিনি অমুসলিম ছিলেন। তার সৎকারে, নবী (সা) এর অনুমতিক্রমে অংশ নিয়েছিলেন।

খুব বেশি মানুষ সেখানে উপস্থিত না হলেও, দবির সাহেব ও তার পুলিশ ফোর্সের কিছু অংশ এবং পল্লির কিছু মানুষ অংশ নিল জানাজাতে। কেউ কেউ গো ধরেই রইল। দবির সাহেব আর ইমাম সাহেব বুঝাতে পারলেন যৌনকর্মীদের যে, পরবর্তীতে আপনাদের সবার মৃত্যুর পর একটা সম্মানজনক বিদায় আমাদের সবার কাম্য। তাই একটা করবস্তান হোক, আর সেটা হাসনাহেনাকে দিয়েই সেটা শুরু হোক।

এরপর আসলে আর তেমন কিছু বলার নেই। সুন্দর ও পবিত্র একটা সমাপ্তি নিয়ে ভেজা চোখে ভোরে বিদায় নিল ফুল অথবা সাবিত্রী দাস। আর পরদিন ছুটি নিয়ে মায়ের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন দবির সাহেব, নিজের মায়ের জানাজাটা তার আর পড়া হয় নি



অলংকরণঃ তাইফ আদনান