জলধি / গল্প / কুৎসিত আঁধারের গান
Share:
কুৎসিত আঁধারের গান

’জানি, জানি গো জননী!

কোন পাষাণের মেয়ে

আমারই অন্তরে থাক মা,

আমারে লুকায়ে।’

গাইতে গাইতে নদীর ঘাটে এসে দাঁড়াল জটাধারী ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের শাক্ত। এলাকায় কম-বেশি পরিচিত মুখ সে। লক্ষণের বউ দেবী তখন স্নান করছিল। তার বুকে কাপড় ছিল না; আঁচল জলে ফেলে দু’হাতে কচলাচ্ছিল। কচুপাতা রঙের ব্লাউজ উঠে এসেছিল গ্রীবায়। ব্লাউজের নিচ দিয়ে গলে পড়া টসটসে স্তনদুটো জলের উপর মাছের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো হলেও বেশ আকর্ষণীয়া সে। দেহের মজবুত গঠনের কারণে হয়ত। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে কোনও আফ্রিকান ভাস্করের হাতে গড়া নিগ্রো রমণীর ভাস্কর্য বললে বাহুল্য হবে না।

শাক্ত কখন যে ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে, দেবী তা এতক্ষণ খেয়াল করেনি। তার দিকে চোখ পড়ামাত্র প্রথম লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও শাক্তদের প্রতি অপার শ্রদ্ধাবোধের কারণে রাগ না করে বরং প্রশ্রয়ের সুরে বলল সে, ’ওমন হা করে দেখছ কী! আমাকে, না কোনও জলদেবীকে?’

থতমত খেয়ে পিপাসার ভান দেখিয়ে শাক্ত বলল, ’বড্ড তেষ্টা পেয়েছে রে মা। এক ঘটি জল নেব?’

দেবী এবার বেদেনীর মতো শরীর দুলিয়ে বলল, ’তা নদীর জল কেন? বাড়িতে গিয়ে জলের সাথে নাড়ু-মুড়কিও না হয় দিয়ে দিব।’

শাক্ত এরকম একটা প্রস্তাবের অপেক্ষায় ছিল যেন। প্রথম যেদিন দেবীকে দেখে সে, সেদিন থেকেই দেবীর ভরাট যৌবন তার মনে গেঁথে আছে চিরুনির তীক্ষ্ণ দাড়ের মতো। সেই দাড়ে ময়লা জমে না, বরং দিনকে দিন ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসে।

লক্ষণ থাকলে উদ্দেশ্য হাসিল হবে না, তাই সে চালাকির সুরে বলল, ’হ্যারে মা, অকর্মার ঢেঁকিটা কী বাড়িতে আছে? ওর মুখ দেখলে কেন জানি পিত্তি জ্বলে!’

ঘাটে উঠে দেবী বলল, ’ব্যাটা মানুষের ওই এক দোষ; বিয়ের তিনমাস, চারমাস বউয়ের পিছনে খু-উ-ব ঘুরঘুর করবে, স্বাদ নেওয়া হলেই দে ছুট। ঘরের বউ তখন চোখের বিষ।’

ভরা কলস কাঁখে ছিল দেবীর, গৃহমুখি হয়ে আবার বলল, ’বাড়িতে চলো, তোমাকে আগে জল দিই।’

দেবীর পিছু নিল সে। ভেজা শাড়িতে দেবীর থলথলে মাংসাল পাছার দিকে তার চোখ আটকে গেল। দুধের বলক ওঠার মতো কামনার বলক উঠল। চারদিক দেখে নিল। কেউ নেই। ধর্ষপ্রবৃত্তি মনের মধ্যে শিস দিলো; কিন্তু না। নিজেকে সংবরণ করল সে। আমবাগানের মধ্যে এসে গলায় কৃত্রিম দরদ ফুটিয়ে তুলে বলল, ’হ্যারে মা, লক্ষণ তোকে ভালোবাসে না?’

দেবী উদাস সুরে বলল, ’বাসে।’

’তাহলে?’

’সেই বাসার কি দাম আছে? ঘরে বউ-বাচ্চা থাকতেও সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে তাড়ি-গাঁজা-ভাং খেয়ে সাঁওতাল যুবতিদের নিয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকে। এমন স্বামীর প্রতি কার না ঘেন্না হয়?’

তার শেষ কথায় শাক্ত ধরে নিল দেবীর মনের মধ্যে একটা খালি জায়গা আছে। সেই জায়গা দখল করবার ফন্দি আঁটল সে। কৌশল নিল, ’তুই যদি শুনিস, তোর দেবতা সুবোধ বালকের মতো ফিরে আসবে। আসতেই হবে তাকে। নইলে ধর্ম মিথ্যা! মা কালী মিথ্যা!’

দেবী থমকে দাঁড়াল। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ’তুমি পারবে? পারবে আমার দেবতাকে কুপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে?’ পরক্ষণে ভারাক্রান্ত গলায় বলল, ’আমি বড়ো দুঃখীনি। হিন্দু নারীর কাছে পতি পরম গুরু। সেই গুরু যখন ষোলশ গোপীনি নিয়ে আনন্দ-লীলায় মত্ত থাকে, তখন কী এ জগত-সংসার ভাল্লাগে? মনে হয়, গলায় দড়ি দিয়ে মরি। পারি না শুধু সন্তানের কথা ভেবে।’

শাক্ত কালীর দোহাই দিয়ে তার ষড়যন্ত্রের বীজ দেবীর মধ্যে বপন করতে পেরে ফিকে হাসি দিয়ে বলল, ’মহাদেব মায়ের পদতলে; আর লক্ষণ তো তার নখেরও যোগ্য না। চিন্তা করিস না। এই শাক্তবাবা আছে না!’

তার আশ্বাসে দেবী কিছুটা ভারমুক্ত হলো। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো তারা বাড়ির কাছে। মাটির বাড়ি, খড়ের ছাউনি। দেউড়িতে পা দিয়ে দেবী তার উদ্দেশ্যে বলল, ’কষ্ট করে একটু দাঁড়াও! কলস রেখে এক্ষুনি আসছি। কোথাও যেয়ো না।’

কোথায় আর যাব? আবারও ফিকে হাসি দিলো সে। এই ফিকে হাসির রহস্য নিজের মধ্যে গোপন রেখে একটা কাঠের গুঁড়ির উপর বসে আপাতত বিশ্রাম নিচ্ছিল সে; তাকে দেখে লক্ষণের ছেলে গোপাল ছুটে এলো। খুব দুষ্ট সে। তার হাত-পা সারাক্ষণ দাপায়। শাক্ত আনমনা হয়ে পড়েছিল, সেসুযোগে গোপাল কাঠের গুড়ির একপ্রান্ত ধরে গড়ানোর চেষ্টা করলে চিৎপটাং হয়ে ভ’পাতিত হলো সে। ততক্ষণে একঘটি জল ও লাড়ু-মুড়কি নিয়ে দেবী উপস্থিত। শাক্তকে চিৎপটাং দেখে চিৎকার দিলো সে, ’কী হয়েছে? কী হয়েছে তোমার?’

ব্যথা যে পায়নি, তা না। লজ্জা-শরমের কথা ভেবে উহু-আহ শব্দ বেমালুম চেপে গেল। কোমর ধরে উঠতে উঠতে বলল সে, ’তোমার ছেলেটা না, তোমার ছেলেটা না...’

গোপাল একটু দূরে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসছিল, দেবীর বুঝতে দেরি হলো না তার ছেলেই কুকীর্তিটা ঘটিয়েছে; তাকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিলো সে। একটা বাচ্চা ছেলের কাছে এমন অপদস্থ হওয়া অপমানজনক মনে করে শাক্ত সত্যটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, ’মা কালীর দিব্যি, ওর দোষ না। শালা কাঠের গুড়িটা কঠিন বেয়াদপ।’

শাক্ত অপসৃত হওয়ার পরপরই লক্ষণ বাড়ি ফিরল। পুরোপুরি মাতাল হয়ে। কত গ্যালন তাড়ি তার পেটে চালান করেছে তার হিসাব শুঁড়িখানার মালিক জানে। তাড়ির সঙ্গে গঞ্জিকাসেবনও বাদ যায়নি। চোখ রক্তজবার মতো টকটকে লাল। পাদুটো টলটলায়মান। ছেলের উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়ল, ’এই বেটা গোপাল! তুই কাঁহা?’

উঠোনের একপাশে খাটিয়ায় চিৎ হয়ে শুয়েছিল সে; বাবার হাঁকডাকে বিরক্ত হয়ে এবার উপুড় হলো। বাবাকে গুরুত্ব দিচ্ছিল না, আর তাতেই লক্ষণ রেগে ফায়ার, ’এই বেটা, তোর কানে কথা ঢোকে না, অ্যাঁ! কার খাস, কার পরিস, জানিস না? তোর বাপ কি ফাউল লোক?’

গোপাল তবুও সাড়াশব্দ করল না। আর তাতেই লক্ষণ ভয়াবহ চটে গেল। তার ঝালটা এসে পড়ল খাটিয়ার উপর। তাগদ দেখিয়ে ছেলেসহ খাটিয়া উল্টে ফেলল সে।

গোপাল খাটিয়ার নিচ থেকে বেরোবার চেষ্টা করছিল, এমন সময় দেবী ঘর থেকে বেরিয়ে ছেলেকে এ অবস্থায় দেখে তার মাথায় রক্ত উঠল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সে, ’দিন নাই, রাত নাই, ক্ষণ নাই, বাড়িতে এলেই যেন ডাকাত পড়ে! অসভ্য, বর্বর কোথাকার?’ কপাল ঠুকে আবার বলল, ’কপাল, সব আমার কপাল! নইলে এমন তাড়িখোর, ভাংখোরের সাথে বিয়া হবেই বা ক্যান? হায় ভগবান!’

লক্ষণ তার চোখের পাতা যত টেনে তোলার চেষ্টা করে তত ঝুলে পড়ে। দেহে ঘুমের অস্বাভাবিক ক্রিয়া। ঢুলুঢুলু চোখে বলল সে, ’এই মাগী, তুই আমার মা না বোন? চিল্লায়ে চিল্লায়ে কথা বলিস! চিনিস না, আমি কে?’ হেঁচকি তুলে পরক্ষণে বলল, ’আমি তোর ভাতার! ফাউল লোক না।’

যে খাটিয়াটা উল্টে দিয়েছিল সে, সেই খাটিয়া সোজা করে তাতেই চিৎ হয়ে পড়ল।

 

সন্ধ্যেয় টিপিস টিপিস করে বৃষ্টি হচ্ছিল। লক্ষণ আজও হাটে গেছে। শাক্ত এসে কাঁঠাল গাছের নিচে দাঁড়াল। মানুষের আনাগোণা নেই। একাকী সে। খোলা জানালা দিয়ে দেবীর ঘরের ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছিল শুধু। একাকিত্ব ঘোচাতে গান ধরল সেঃ

’হের হর মনোমোহিনী, কে বলে রে কালো মেয়ে!

আমার মায়ের রূপে ভুবন আলো,

চোখ থাকে তো দেখ না চেয়ে।

বিমল হাসি ঘরে শশী, অরুণ পড়ে নখে খসি,

এলোকেশী শ্যামা ষোড়শী;

ভ্রমর ভ্রমে কমল-ভ্রমে

বিভোর ভোলা চরণ পেয়ে।’

 

ঘরের মধ্যে দেবী সন্ধ্যা-আহ্নিকে ব্যস্ত। গানের মাদকতা তার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। কণ্ঠটা কেমন পরিচিত! শাক্ত না তো! উপাসনা সেরে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। লন্ঠন উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করল। আলো কিছুদূর পর্যন্ত গেল; ফলে কাঁঠাল গাছের অন্ধকার আরও ঘনীভূত হলো। এবার লন্ঠন নামিয়ে আলো কমিয়ে দেখল। ঝাপসা অন্ধকার বিভ্রান্ত ছড়ালেও মনের আলো তীব্র হলো: এ শাক্তই হবে। মোহময়ী কণ্ঠে ডাকল, ’ভেতরে এসো। বিষ্টিতে অসুখ করবে যে!’

শাক্ত বাড়িতে ঢুকল।

তাকে বারান্দার জলচৌকিতে বসতে দিয়ে দেবী আবার ঘরে ঢুকল। গামছা নিয়ে ফিরে এলো সে। শাক্তর হাতে তুলে দিয়ে বলল, ’দেহেরও তো ভালোমন্দ আছে। মাথা মোছো।’

’হ্যাঁরে মা, এ দেহের কী দাম আছে? দেহ নশ্বর, আত্মা অবিনশ্বর। আত্মার সুখই প্রকৃত সুখ। আত্মার সুখের জন্যে মা কালীর মহিমা প্রচারে পিছপা হইনি। সংসার-ঝড়-বৃষ্টি-রোদ তুচ্ছজ্ঞান করেছি,’ মাথা মুছতে মুছতে বলল শাক্ত।

’সংসার ছিল বলে তো কোনোদিন শুনিনি।’

’ছিল বটে, কিন্তু তাকে নিয়ে সুখী হতে পারিনি। যে কদিন ঘরে ছিল, না পেয়েছে নিজে সুখ, না দিতে পেরেছে আমাকে। ’

’কেন, পারেনি কেন? নিশ্চয় কোনো কারণ ছিল।’

’কারণ ছাড়া কার্য ঘটে না রে মা!’

’কারণটা কী? শুনতে পারি?’

’নিশ্চয়! একটা মোছলমান ছেলেকে ভালোবাসত সে।’

’তারপর?’

’তারপর আর কি! একরাতে আমার ঘর ছেড়ে পালাল। প্রচণ্ড আঘাত পেলাম মনে। মায়া-মহব্বত মন থেকে উঠে গেল। সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মালো। অতঃপর বেরিয়ে পড়লাম উদ্দেশ্যহীন। মন্দিরে মন্দিরে রাতযাপন করলাম। একরাতে হঠাৎ স্বপ্ন দেখে আমার ভুল ভাঙল।’

বৃষ্টির ফোঁটা কমেনি, আবার বাড়েওনি। লক্ষণের বাড়িটার চারপাশ গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত। বৃক্ষরাজির পাতা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির শব্দ দূর প্রাসাদ থেকে ভেসে আসা বাঈজির ঘুঙুরের মতো সুরের ইন্দ্রজাল ছড়াচ্ছিল। এমন বৃষ্টিমুখর সুরেলা পরিবেশে শাক্তর স্মৃতিরোমন্থন দেবীকে পাগলপারা এবং ভেঙেচুরে ’নতুন দেবী’-তে রূপান্তরিত করল। আবেগে থরথর ও অত্যোৎসাহী ভাব নিয়ে বলল, ’তারপর? তারপর কী হলো?’

’সে এক কঠিন প্রশ্ন,’ দেবীকে প্রভাবিত করবার উদ্দেশ্যে আবার বলল সে, ’মা কালী বললেন, হ্যারে মূর্খ, তুই কীসের আশায়, কার জন্যে দেশান্তরী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস? আমাকে ভুলে গেছিস? ফিরে আয় আমার কাছে। আমাকে পূজো কর, বলি দে! তোর মনোবাসনা পূরণ হবে। তোর ঘরছাড়া বউ আবার সুড়সুড় করে ফিরে আসবে।’

এবার কপট দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, ’ফিরে এলাম মায়ের কাছে। পাঁঠাবলি দিলাম। মায়ের পদতলে পড়ে থাকলাম। আমার সুললিতা সত্যি সত্যিই একদিন ফিরে এলো। ক্ষমা চেয়ে বলল, আমাকে গ্রহণ করো দেবতা! ক্ষমা করেছিলাম, তবে গ্রহণ করিনি। জাত-ক’ল খোয়ালে সে আর হিন্দু থাকে না। যে ধর্মে সীতা-সাবিত্রীর জন্ম, সেই ধর্মে থেকে কোনো ক’লটার সঙ্গে ঘর করা যায় না।’

কালীর ক্ষমতা সম্পর্কে দেবীর ভেতরের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বেড়ে গেল কয়েকগুণ। অফুরন্ত ভক্তিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করল সে, ’মা কালীর পূজো দিলেই কী স্বামী ঘরমুখো হবে?’

শাক্ত হালকা মেজাজে বলল, ’ঘরমুখো! লক্ষণ তোর পায়ের কাছে পোষা বিড়ালের মতো ঘুরঘুর করবে; চারটে খেতে দিলে খাবে, না দিলে নাই।’ পরক্ষণে শক্ত হয়ে বলল, ’তবে সাবধান! তোর গোপন অভিলাষ আমি ছাড়া কাকপক্ষীও যেন টের না পায়।’

দেবী তাকে অভয় দিলো, ’কেউ পাবে না।’

 

লক্ষণের হাট থেকে ফেরার সময় পেরিয়ে গেলেও ফিরছিল না সে। বাবার জন্যে গোপাল রাত জেগে আছে। হাটে যাবার আগে গোপাল বাবার কাছে আবদার করেছিল রসগোল্লার রসে ভেজানো পাউরুটি আনতে। পাউরুটি খেয়ে এরপর ঘুমোতে যাবে সে; কিন্তু তার নিদ্রা-জাগরণ বৃথাই গেল। বাবা সরাসরি বাড়িতে না এসে প্রতিরাতের মতো সাঁওতাল পাড়ায় গিয়েছিল। সেখান থেকে রীতিমতো লোড হয়ে ফিরল। কিন্তু ফিরেও ফিরতে পারল না সে। তাদের কাঁঠাল গাছের পশ্চিমপাশ ঘেঁষে কচুরিপানার যে অগভীর ডোবা শরীরের ভারসাম্য রাখতে না পেরে সেখানে পড়ে গিয়ে কাদায় লেপ্টালেপ্টি। অভ্যেস মতো ডাক পাড়ল সে, ’এই বেটা গোপাল! তুই কাঁহা?’

বাবার ডাক শুনে গোপাল উত্তেজনায় দৌড়ে বাইরে এলো। লন্ঠন উঁচিয়ে বাবাকে খুঁজল; কিন্তু দেখতে না পেয়ে হতাশায় ডুবে গেল তার মন। লক্ষণ লন্ঠনের আলো টের পেয়ে অস্ফুট স্বরে আবারও ডাকল, ’এই বেটা গোপাল! তু-ই--’

কথা শেষ করতে না পারলেও তার ছেলে তার অস্তিত্ব ঠিকই টের পেল। ডোবার মধ্যে বাবাকে বিধ্বস্ত দেখে মাকে ডাকল সে। দেবী বাইরে এসে স্বামীকে উদ্ধারের আগে নিজের কপালের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করল। তারপর কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে স্বামীকে টেনে তুলল ডোবা থেকে। ততক্ষণে বৃষ্টির ফোঁটায় লন্ঠনের তাতানো চিমনি ফেটে মানচিত্র। বাবার হাতে বাজারের থলেটা দেখতে না পেয়ে গোপালের শিশুমন ফুটো বেলুনের মতো চুপসে আছে। বাবার উপর যেমন অভিমান তেমনি রাগ। সেই রাগের বহিপ্রকাশ ঘটাল সে দোষ চাপিয়ে। বলল, ’মা, বাবার কারণে চিমনিটা ফেটে কী হয়েছে, দ্যাখো- দ্যাখো-’

দেবী কপাল চাপড়িয়ে বলল, ’চিমনি নয়, বল আমার কপাল ফেটেছে।’

রাতে শুয়ে দেবী এপাশ-ওপাশ করল। তার ঘুম তার চোখ থেকে ছুটে গেছে। অসংখ্যবার ভাবল শাক্তর কথা। শাক্ত বলেছিল, ’মহাদেবও কালীর পদতলে। আর লক্ষণ তো মহাদেবের নখেরও যোগ্য না। মা কালীর তপস্যা করতে হবে।’ কী ধরনের তপস্যা? মা কালী কী পেলে খুশি হবে? বিনিময়ে তার স্বামীকে ঘরমুখো, সংসারী, স্ত্রীবত করবে।

 

পরদিন বিকেলে শাক্তর সঙ্গে ’কালী তপস্যা’র বিষয়টা দেবী চূড়ান্ত করল। গভীর রাতে কালীমন্দিরে তন্ত্রমন্ত্র পাঠ করবে। সঙ্গে থাকবে শাক্ত; এবং সেই যাবতীয় বিষয়গুলো তত্ত্বাবধান করবে। কিভাবে মা কালীর নৈকট্য লাভ করতে হয়? কিভাবে মনোবাসনা অর্পণ করতে হয়?

কৃষ্ণপক্ষের রাত। আকাশের অন্ধকার জমিনে নেমে এসে কালসাপের মতো ঘাপটি মেরে আছে। শাক্তর সঙ্গে পা টিপে টিপে অতি সাবধানে আমবাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল দেবী। সর্পিল পথ। পাখিদের পাখসাট ভয় ধরালেও দমে যাচ্ছিল না সে। যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কামিয়াব হতেই হবে তাকে। আমবাগানের পরই প্রকাণ্ড বটগাছ আর শিমুল; ঠিক তার মাঝখানে কালীমন্দির। বটের শেকড়-বাকড়ের সঙ্গে বিভিন্ন লতাগুল্ম মন্দিরের দেয়ালের একাংশে থাবা মেরে আছে। স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে ভয়জাগানিয়া ব্যাপারস্যাপার।

সাঁওতাল পাড়া থেকে ভেসে আসছিল ঢোলের অবিরাম শব্দ; যেখানে সুরা ও সাঁওতাল যুবতির ওম নিতে গেছে লক্ষণ।

সুপ্রাচীন কালের মন্দির। ভেতরে ঢুকে মেঝের মাঝখানে পোঁতা মশালে আগুন ধরাল শাক্ত। দপ করে জ্বলে উঠল মশালটা। এতক্ষণ ভয় দেবীকে খুব একটা শাসন করতে পারেনি; এবার তার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। ভয়ার্ত চোখে তাকাল কালীর দিকে। মহামেঘ বর্ণ কালী। এলোমেলো চুল। লাল টকটকে জিহ্বা বাইরের দিকে ঝুলানো। উপরের বাঁ হাতে খড়গ, নিচের বাঁ হাতে নৃমুণ্ডু। উপরের ডান হাতে বর, নিচের ডান হাতে অভয়। কোমরে পুরুষ হাতের আচ্ছাদন। পদতলে শয়ান মহাদেব; উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত তার নিষ্প্রাণ দেহ।

শাক্ত তাকে অভয় বাণী শোনাল, ’ভয় নেই মা। মায়ের কাছে এসে  মেয়ের আর ভয় কি!’

তারপর সে হরিণছালের আসন পেতে দিয়ে দেবীকে বসতে বলল। দেবী তার নির্দেশ মান্য করল। এবার সে হোম জ্বালিয়ে দেবীর ডান পাশে বসল। চোখ বুজে মন্ত্র পাঠ করল, ’ওঁ সহবল্লীং...।’

সম্মোহনী-উচ্চাটনী-আকর্ষণী ক্রিয়ায় মগ্ন হলো শাক্ত। এ মুহূর্তে দেবী তার হাতের পুতুল। তার নির্দেশে হোমের আগুনে পুরনো ঘি ঢালছিল সে। দপ করে জ্বলে উঠছিল আগুন, আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছিল; এ যেন জ্বলা-নেভার খেলা।

দেবী ঘি ঢালা শেষ করে তন্ময় হয়ে লক্ষ করছিল শাক্তকে। তন্ময়তা ধীরে ধীরে বাড়ছিল তার। শাক্ত যেন ছড়িয়ে দিচ্ছিল চুম্বকাবেশ। দেবী লোহার গুঁড়োর মতো আকর্ষিত হচ্ছিল সেদিকে। ক্রমশ লোপ পাচ্ছিল তার হিতাহিত জ্ঞান।

শাক্ত মন্ত্রপাঠে এমন মগ্ন, মনে হচ্ছিল ভোগবাদী দুনিয়ার কোনও বস্তুই তার মনে ক্রিয়া করছে না। নিবিষ্টচিত্ত সে। লক্ষণকে দেবীর পদতলে ফিরিয়ে দেওয়াই অভীষ্ট লক্ষ্য তার।

আসলে লক্ষণের জন্যে ধ্যান-মন্ত্র-জপ করছিল না সে; করছিল তার নিজের জন্যে। নিজের চাহিদা, ভালোলাগা, কামনা-বাসনা দেবীর মনের উপর প্রতিস্থাপন করতেই সচেষ্ট সে।

মশালটা আগেই নিভে গিয়েছিল। হোমের আগুনের তেজও কমে আসছিল ধীর প্রবণতায়। শাক্তর গলার স্বরও নামছিল ক্রমে ক্রমে। যত নিচুর দিকে নেতিয়ে আসছিল, কোত্থেকে যেন অপূর্ব মাদকতা হু হু করে ঢুকছিল তত! দেবী কামনাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠছিল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় সে। একসময় শাক্তর কাঁধে ঢলে পড়ে।

শাক্ত যেন গোখরো সাপের মতো ফুঁসছিল। ভয়ঙ্কর ও দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে উঠছিল ছোবল মারতে। শিকার তার সম্পূর্ণ আয়ত্বে। মুচকি হেসে এবার শিকারকে শুইয়ে দিলো হরিণছালের উপর।

দেবীর চোখে কুঁচচোখা শাক্তর কুৎসিত, ভাটাপড়া চেহারাও কন্দর্পের মতো সুন্দর, সুপুরুষ ও কামিনীমোহন হয়ে উঠল। দু’হাতে প্রচণ্ড আকর্ষণীয়ভাবে আহ্বান করল শাক্তকে। শাক্ত তাকে দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে চুরমার করুক। সে এখন ভাঙতে চায়। খুঁজতে চায় জীবনের নতুন অর্থ।

শাক্তর উদগ্র কামনার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে গভীর আনন্দে গোঙাতে থাকে সে। চোখের সামনে দুলতে থাকে কামদায়িনী কালী। এমন পুলকিত বোধ কোনোদিন করেনি সে। শাক্তর কাছে কী এমন জাদুর কাঠি আছে, যা তাকে ছুঁয়েছে।

বিবাহিত জীবনের প্রায় দশটি বছর স্বামী তাকে যা দিতে পারেনি শাক্ত এই মুহূর্তে তারচে’ অনেক অনেক বেশি দিয়েছে। যে স্বামীকে বশীভূত করে আরও কাছে পাবার আশায় শাক্তর পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছে, সেই স্বামীকে জঞ্জাল মনে হলো তার। ’হৃদয়’ নামক টুকরো জমিনে তার স্বামী এখন আগাছামাত্র; এর বেশি কিছু নয়।

দেবী ভুলে গেল তার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, স্বামী-সন্তান। সে এখন যন্ত্রীর অর্থাৎ শাক্তর করায়ত্ত। সে বাজালে বাজবে; নচেৎ ধুলোবালিতে ধূসর পড়ে থাকবে।

 

দেবী মা কালীর পাঁড় ভক্ত বনে গেল। তার মন্দিরে গিয়েই সে পেয়েছে চরম তৃপ্তি, চরম সুখ। আর এর বাহন শাক্ত। ফলে তার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে; আরও-আরও। শাক্ত তাকে উদ্বুদ্ধকরণের খেলায় অংশীদার করে। মওকা পেলেই বলে, ’সংসারের সুখ ক্ষণস্থায়ী, স্বর্গের সুখ চিরস্থায়ী। মা কালীর সাধনায় জীবনকে নিবিষ্ট কর। নরকের দরজা চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে, স্বর্গের দরজা উন্মুক্ত থাকবে।

সময়ে-অসময়ে দেবী কালীমন্দিরে যায়। পূজো দেয়। রুদ্রাক্ষের মালা পরে হোম জ্বেলে জপ করে। একমাস-দুমাস-তিনমাস চলে জপ-তপ-মন্ত্র। শয়নে-স্বপনে আরাধ্য হয়ে ওঠে মা কালী। তারপর! তারপর!

দেবীর মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের পর, ভূমিকম্পের পর একটা জনপদ যেভাবে আমূল পাল্টে যায়, সেরকম। তার মাথায় জট পাকাতে শুরু করে। ক্রমশ রূপান্তরিত হয় ভিন্ন নারীতে, ভিন্নরূপে; যেন সাক্ষাৎ কালীমূর্তি।

দেবীর উপর মা কালী ভর করেছে, এমন গুজব বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে। কালীভক্তরা জড়ো হতে থাকে তার বাড়িতে। টাকা-পয়সার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের উপঢৌকন নিয়ে আসে তারা। দেবীর আশীর্বাদ নিতে।

লক্ষণের পোয়াবারো। ঘরে নগদ লক্ষ্মী ভিড় করছে। গাঁজা-ভাং-তাড়ির টাকা দেদারছে মিলছে। বাড়িতে বসেই সেসবের মোচ্ছব করতে পারছে। কাজেই বউয়ের উপর তার কর্তৃত্ব যা ছিল, তা-ও গুটিয়ে নিল সে।

মা কালী ভর করেছে বিধায় সেও বউয়ের প্রতি ভক্তিতে গদগদ; পারলে সকাল-বিকেল ষাষ্টাঙ্গে বউকে প্রণাম করে। সাঁওতাল পাড়া ছেড়ে বাড়িতেই বেশি বেশি সময় দেয় সে। তার এই আকস্মিক পরিবর্তনে তাড়ির আড্ডার বন্ধুরা আশাহত হয়। টিটকারি মারে, ’কি রে বন্ধু, শেষমেষ বউয়ের ভাঁড় হলে নাকি?’

লক্ষণ জবাব দেয় না। মুচকি হেসে এড়িয়ে যায় তাদের প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু তার এই ঘরমুখো প্রবণতা স্থায়ী হয় না। কর্পূরের মতো উবে যায় খুব শিগগিরই। সে আবার ফিরে আসে আগের বন্ধুদের মাঝে; নরক গুলজার করতে।

এরজন্যে সিংহভাগ দায়ী অবশ্যই দেবী। শাক্তর সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত মাখামাখি সহ্য করতে পারছিল না সে। প্রতিবাদ করেছিল; কিন্তু তাতে ফল হয়নি। উল্টো অভিশাপের ভয় দেখিয়েছিল তাকে।

 

দেবীর যশ-খ্যাতি যত বাড়ছিল তান্ত্রিক হওয়ার উদগ্র বাসনা তত পেয়ে বসছিল তার মধ্যে। এ ব্যাপারে পুরোপুরি ইন্ধন জোগায় শাক্ত। তান্ত্রিকসাধনা সম্বলিত কিছু বইপত্র এনে দেয় তাকে। ক-অক্ষর গোমাংস নয় সে। মোটামুটি পড়তে পারে। যত শীঘ্রম তত মঙ্গলম, এরকম চিন্তা নিয়ে পড়ে ফেলে বইগুলো। কিন্তু তন্ত্রসাধনা বড় জটিল, ভয়াল, ঝুঁকিপূর্ণ। শ্মশানেও যেতে হয়। মরা মানুষের খুলি নিয়ে রক্তের হোলি খেলতে হয়। একরাতে শাক্তকে সঙ্গে নিয়ে শ্মশানেও গেল। কুৎসিত আঁধারে বসে তন্ত্রসাধনার পরিবর্তে দেহসাধনা করে ফিরে এসেছিল তারা।

বিখ্যাত তান্ত্রিক হওয়ার অদম্য বাসনা দেবীকে দাবড়িয়ে বেড়াত সারাক্ষণ। ফলে তার অবচেতন মনে গভীর ক্রিয়া করত সেসব বিষয়। একরাতে স্বপ্ন দেখল এরকম, মা কালী ভয়ানক তৃষ্ণার্ত। রক্তের নেশায় হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিল; কিন্তু কোথাও একফোঁটা রক্ত মিলছিল না তার। ক্ষুব্ধ হয়ে দেবীকে বলে, আমার রক্ত চাই! তোর প্রিয় কারও রক্ত! তরতাজা রক্ত!

পরদিন শাক্তর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে সে তার মুখ ঘোর অন্ধকার করল। মহাসংকটের আভাস তাতে। দেবী খুব উৎকণ্ঠা নিয়ে তার মুখের দিখে তাকাল। শাক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ’সামনে তোর কঠিন পরীক্ষা!’

’কী পরীক্ষা?’

’মা হয়ে পারবি নে।’

দেবীর ভেতরে কৌতূহল জেঁকে বসল। ’মা হয়ে পারবি নে।’ স্বপ্নের সঙ্গে মা হওয়ার কী সম্পর্ক? মনে মনে ভাবল, এটা শাক্তর ভাঁওতাবাজি না তো! পরক্ষণে মনের মধ্যে আবার তোলপাড় উঠল তাকে জানতেই হবে। শাক্ত পরিষ্কারভাবে কিছু বলছিল না; পেটের মধ্যে রেখে দিচ্ছিল। যা বলছিল তা-ও ইনিয়ে-বিনিয়ে। দেবী ধৈর্য হারাল। তাকে চেপে ধরল শক্তভাবে, ’সব খুলে বলো! শুনতে চাই আমি!’

স্বপ্নের গূঢ়ার্থ ব্যাখ্যার সুবিধার্থে শাক্ত ইতিহাসবেত্তার ন্যায় ইসলামের ইতিহাস টানল। ’মোছলমান ধর্মে আত্মত্যাগের বিরল ঘটনা আছে। তুই শুনেছিস কিনা, জানি না। হযরত ইব্রাহিম তোর মতোই স্বপ্নে দেখলেন ভগবান তার কাছে তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি চাচ্ছেন। তখন তিনি তোর মতোই বেকায়দায় পড়লেন। তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী? অনেক ভেবেচিন্তে শেষে আবিষ্কার করলেন, তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস তার ছেলে ইসমাইল।

তার স্বপ্নের কথা ইসমাইলকে জানালে ইসমাইলও রাজি হোন। এক পবিত্র দিনে হযরত ইব্রাহিম তার চোখ বেঁধে স্বীয় পুত্রকে বলি দিচ্ছেন, এমন সময় ভগবানের ইঙ্গিতে স্বর্গের দূত ছেলের স্থলে দুম্বা এনে ছেলেকে নির্বিঘ্নে সরিয়ে ফেলে। বলি সম্পন্ন হবার পর চোখের বাঁধন খুলে ইব্রাহিম দ্যাখেন, তার ছেলে দিব্যি বেঁচে আছে। বলি হয়েছে ভগবানের প্রেরিত দুম্বা। একটা কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন ইব্রাহিম।’

লম্বা শ্বাস টেনে আবার বলল সে, ’আমরা কজন পারি তার মতো ভগবানকে তুষ্ট করতে। যারা পারে তারাই তো নিকৃষ্ট মানব হয়েও হয়ে ওঠে দেব-দেবীর ন্যায় সমুজ্জ্বল।’

দেবী তার চোয়াল লোহার মতো শক্ত করল। সাপের মতো ফুঁসে উঠল। ’মোছলমান পারলে হিন্দু নারী হয়ে আমি পারব না কেন? শুধু রক্ত কেন, কলজে-মাংসও দিয়ে দেব। আর কী চায়? জীবন? তা-ও দিয়ে দেব।’

শাক্ত তাকে উত্তেজনার অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে তিরস্কার করল, ’তুই দুর্বল চিত্তের! পারবি নে!’

’পারতেই হবে আমাকে!’

’তাহলে শোন, তোর প্রিয় হলো তোর সন্তান। তোর চোখের মনি গোপাল। পারবি? পারবি তাকে...?’

দেবী থরথর করে কেঁপে উঠল। চোখের সামনের পৃথিবীটা দুলে উঠল। ’মাতৃত্ব’ নামক অমোঘ শক্তি তার সামনে এসে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াল। কঠিন অবস্থায় পড়ে চোখে অন্ধকার দেখল সে।

শাক্ত তাকে প্ররোচিত করবার জন্যে বলল, ’রাজস্থানের এক সাধু তান্ত্রিক হওয়ার আশায় তার দুই সন্তানকেই মা কালীর মন্দিরে বলি দিয়েছিল। মা কালী খুশি হয়ে এমন বর দিয়েছিল সাধুমশাই ভারতখ্যাত তান্ত্রিক হতে পেরেছিল।’

পরক্ষণে মায়াকান্নার ভান করে বলল, ’মায়ের কাছে প্রিয় জিনিসটা তুলে দিবি, এর চেয়ে গর্বের, এর চেয়ে খুশির আর কি হতে পারে? তোর রাশিতে বৃহস্পতি তুঙ্গে। নইলে মা আমার কাছে কিছু না চেয়ে তোর কাছে কেন চাইল? আমার কাছে চাইলে প্রাণটা ছুরি দিয়ে বের করে থালায় সাজিয়ে তার সামনে তুলে দিতাম।’

ডিনামাইট বিস্ফোরণে সেতু যেমন ধ্বসে পড়ে তেমনি ভাবনার বিস্ফোরণে গুড়িয়ে গেল দেবী। মূর্ছা গেল সে। দাঁতকপাটি লাগল তার।

মূর্ছা যখন ভাঙল, চোখ মেলে দেখল শাক্ত নেই। গোপাল তাকে ধরে কাঁদছে। তাকে বুকে টেনে নিয়ে চোতমাসের কড়ইপাতার মর্মর ধ্বনির মতো হু হু করে উঠল সে।

খানিকক্ষণ পর চোখ মুছতে মুছতে বলল, ’হ্যারে গোপাল, তুই কাকে বেশি ভালোবাসিস? বাবাকে না মাকে?’

গোপাল তার প্রশ্নটাকে অত গুরুত্ব সহকারে নিল না। বলতে হয় তাই বলল, ’বাবাকে।’

’কেন, আমি তোকে ভালোবাসি না?’

’বাসো। কিন্তু তোমার জট দেখলে ভয় পাই। সবাই বলে, গোপাল রে তোর মা একটা ডাইনি।’

দেবী কালীমন্দিরে গিয়ে তপস্যায় বসে। সন্তানকে ভিক্ষে চায়। বিনিময়ে একশ পাঁঠা বলি দেবে সে। কিন্তু শত চেষ্টাতেও তপস্যায় মন বসাতে পারছিল না; বিক্ষিপ্ত ঝড়ে তার মন উড়ে যাচ্ছিল কোথাও।

ফিরে এলো বাড়িতে। তার অগণিত ভক্ত ভিড় করছিল, তাদেরকে বিদেয় করে দিলো। অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটল তার। রাতে আবারও দুঃস্বপ্ন দেখল। এই স্বপ্ন আগের চাইতে বিপজ্জনক। মা কালী এবার তার সন্তানকে সরাসরি চেয়ে বসল। না পেলে ক্ষতির হুমকিও দিলো

দেবী তার মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করল; কিন্তু পারল না। মনোবল একেবারে তলানিতে ঠেকল। শেষে মায়ের ইচ্ছের কাছে নত হলো। শাক্তকে ডেকে সম্ভাব্য সময়ও নির্ধারণ করল। সাঁওতালদের ধর্মাচারের উদ্দেশ্যে নিবেদিত বিশেষ রাত বেছে নিল তারা।

 

সাঁওতালরা আজ পচাই খেয়ে মাতাল হয়ে ঢোল বাজাবে, জংলি নৃত্য করবে। ক্লান্ত হয়ে একসময় এলোমেলোভাবে শুয়ে পড়বে। লক্ষণদের আজ বড়ো সুবিধে। পছন্দমাফিক কোনও সাঁওতাল যুবতি অথবা বধূর সঙ্গে রসেবসে রাতটা কাটাতে পারবে। সে আশায় লক্ষণ বাড়ি ছেড়েছে সেই সন্ধ্যা

রাত গভীর হলে গোপালকে সঙ্গে নিয়ে শাক্ত ও দেবী কালীমন্দিরে উপস্থিত হলো। গোপালের স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পেয়েছে। শাক্ত কী যেন খাইয়ে দিয়েছে তাকে।

মন্ত্রপাঠ করে গোপালকে জলের ছিটা দিলো শাক্ত। সঙ্গে সঙ্গে সে নিদ্রায় ঢলে পড়ল। তাকে ধরাধরি করে বেদির উপর শুইয়ে দিলো তারা। অতঃপর বীরাচার সম্পন্ন করল।

এবার গোপালকে বেদির উপর থেকে নামাল; ঠিক কালীমূর্তির সামনে আনল। তার ঘাড়ের নিচে গোলাকার লম্বা কাঠের গুঁড়ি স্থাপন করল। তারপর শাক্ত চকচকে ধারালো খাঁড়াতি তুলে দিলো দেবীর হাতে।

শাক্ত এবার ধূপচির ধূপে আগুন জ্বালিয়ে কালীর সামনে দাঁড়াল। আরতি দেওয়ার ভঙ্গিতে ধূপচি ঘোরাতে লাগল; তৎসঙ্গে মন্ত্রপাঠ। ধূপচি থেকে উত্থিত সুগন্ধি ধোঁয়া ছড়িয়ে যাচ্ছিল মন্দিরের সর্বত্র।

দেবী খাঁড়াতি উঁচিয়ে গোপালের ঘাড় বরাবর হাঁটু গেড়ে বসা। বলি দেবার নেশা চোখে-মুখে। শাক্তর সঙ্কেত পেলেই বসিয়ে দেবে কোপ। ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হবে মুণ্ডুটা। ঠিকরে পড়বে রক্ত। রক্তগঙ্গা বইবে। মন্দির লালে লাল হয়ে উঠবে।

লক্ষণ পচাই খেয়ে মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফিরছিল। ভয়-ডর নেই তার কলিজায়। এ রাস্তা তার ভীষণ পরিচিত। প্রতিরাতে এ রাস্তায় তা পা পড়েই। কারণ, এ রাস্তার ঘাস মাড়িয়ে সাঁওতাল পাড়ায় যেতে হয় তাকে। আবার এ রাস্তার ঘাস মাড়িয়ে ফিরতে হয় তাকে। নেশা না কাটলেও একেবারে জ্ঞানশূন্য মাতাল হয়ে পড়েনি সে। মন্দিরের কাছে আসতেই শুনতে পেল মন্ত্রপাঠ। থমকে দাঁড়াল সে। ঘোর অন্ধকারে বাদলা-বরষার রাতেও গা ছমছম করে না তার; কিন্তু আজ করল। এত রাতে কে মন্ত্রপাঠ করছে? উদ্দেশ্য কী? ভয়ে ভয়ে এগুলো মন্দিরের দরজা পর্যন্ত।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল সে। কিন্তু হায়! একি সর্বনাশ! মরা আলোয় তাদের চিনতে কষ্ট হলো না তার। দেবী, তার বউ, খাঁড়াতি হাতে। কাকে কতল করবে? ঠা-ঠা চোখে আর একটু ভালোমতো দেখার চেষ্টা করল। হায়! খাঁড়াতির নিচে গোপাল, তারই ছেলে। এক সেকেন্ড দেরি করলেও সর্বনাশ হতে পারে; সে আশঙ্কা থেকে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল সে, ’এই বেটা গোপাল...।’

লক্ষণের চিৎকারে হুঁশ হলো শাক্তর, হুঁশ হলো দেবীর। বিখ্যাত তান্ত্রিক হওয়ার সমস্ত আয়োজন ভেস্তে যাবে, তা হতে পারে না। লক্ষণ তাদের অপকর্ম দেখে ফেলেছে। কাজেই তাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায় না। তাকে খতম করতে পারলেই আবার তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।

লক্ষণের দিকে তেড়ে এলো শাক্ত, পিছু পিছু দেবী।

’বাঁচাও- বাঁচাও-’ চিৎকারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলল লক্ষণ। দৌড়াচ্ছিল সাঁওতাল পাড়ার দিকে; বেশিদূর যেতে পারল না সে। পা জড়িয়ে আসে। জীবনপ্রদীপ ফুরিয়ে এসেছিল তার। দুর্ভাগ্যক্রমে ক্ষেতের আইলে হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র কাপালিকদের মতো শাক্ত ও দেবী ঘিরে ফেলে তাকে। দেবীর খাঁড়াতির অনবরত কোপে, শাক্তর ত্রিশূলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলো সে। মৃত্যুর শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা করল সজোরে চিৎকার করতে; যেন তার চিৎকার সাঁওতালদের কানে পৌঁছে।

ছেলেকে বাঁচানোর লক্ষণের অন্তিম প্রচেষ্টা বিফলে য়ায়নি। দলে দলে সাঁওতাল এসে ঘিরে ফেলল তাদের। সে নিজে মরে অলঙ্ঘনীয় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে গেল তার একমাত্র সন্তানকে। 



অলংকরণঃ তাইফ আদনান