জলধি / গল্প / কথোপকথন
Share:
কথোপকথন

আলাপের শুরুতেই ক্ষেপে উঠে কঙ্কণা। তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বলেই যায়, সকল দোষ, অক্ষমতা, লজ্জা পুরুষের। যে দেশে নারীর জন্য বাইরের পৃথিবী নিষিদ্ধ, যে দেশে নারীর বার ঘন্টায় একদিন সেখানে নারীর বুদ্ধি, মেধা স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোল কিভাবে! নিজেদের অক্ষমতার দিকে তাকাও শামীম। তোমার পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে তাকাতে বলো নারীর চোখে। যদি মানুষ হও উপলব্ধি হবে, যা তোমরা শক্তি ভাবো তা শক্তি নয় অসহায়ত্ব। নারীকে ঘর থেকে বের না হওয়ার যড়যন্ত্র হাজার বছর ধরে করে রেখেছ নানাবিধ ছলনা দিয়ে৷

শামীম চুপ হয়ে যায়। কিছু বলতে পারে না। সে জানে সভ্যতার হাজার বছর পেড়িয়ে গেলেও নারী বহু অধিকার থেকে বঞ্চিত। কঙ্কণার কথা শামীমের বুকে বজ্রপাতের মতো আঘাত হানে।

তার পৌরুষ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সে নিজের অবস্থানকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাহলে কি সব দোষ শুধু পুরুষের?

কঙ্কণা দৃঢ় কণ্ঠে বলে, দোষ আর অবিচারের দায় কে নেবে? নারী কি কখনো পুরুষের সমান সুযোগ পেয়েছে? তুমি কি জানো, বিশ্বজুড়ে আজও কতো নারী শুধু নারী হওয়ার অপরাধে বঞ্চিত? কঙ্কণার চোখে আগুনের ঝিলিক!

শামীমের ভেতরে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সমাজের মুখোশ খুলে দেখতে ইচ্ছে করে। তার ভেতরের পুরুষতান্ত্রিকতা তাকে টেনে ধরে।

কঙ্কণা আবার বলে, তোমাদের সমাজ নারীকে স্ত্রীর ভূমিকা দিয়েছে। তার বাইরেও যে জীবন আছে, চাওয়া-পাওয়ার অধিকার আছে, বোঝো? নারী তোমাদের কাছে মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যা। কিন্তু তার নিজের পরিচয়? নিজের সত্ত্বা? নিজের স্বপ্ন? তার কোনো মূল্য আছে?

শামীম উত্তর দেয় না। সে উপলব্ধি করে তার মধ্যে

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ছাপ রয়েছে। কঙ্কণার কথা তার মনোজগতকে নাড়া দেয়। নারী সামাজিক বিনির্মাণ। কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে। পুরুষ নারীকে সাজিয়েছে অসংখ্য কুৎসিত অভিধায়। বন্দী করার জন্য তৈরি করেছে পরিবার, সমাজ রাষ্ট্র। পৃথিবীতে শুধু নারীই শোষিত নয়, অধিকাংশ পুরুষ শৃঙ্খলিত শোষিত। শোষিত শৃঙ্খলিত নারী পুরুষের মধ্যে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। সব পুরুষ বন্দী কিন্তু শোষিত নয়। সব নারীই বন্দী শোষিত। নারী নিরাপদ নয়। চলাফেরা অবাধ নয়। তার প্রধান কারণ পুরুষের আধিপত্য দৃষ্টিভঙ্গি। নারী দুর্বলতার অংশই রয়ে গেছে। অত্যাচারিতের হাতে অত্যাচারিত হচ্ছে। নারী-পুরুষ সমান, অধিকার অভিন্ন ইহাই নারীবাদ।

কঙ্কণা নিজের কথা শেষ করে চেয়ার থেকে উঠে। যদি পরিবর্তন চাও নিজেকে বদলাও। সমাজ বদলাও। নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করো।

কঙ্কণা পেছনে ফিরে তাকায় না। তার দৃঢ় পদক্ষেপে হাজার বছরের শৃঙ্খল ভাঙার প্রতিজ্ঞা। মনের গভীরে নতুন ভাবনার জন্ম হয়। সে কি পারবে নিজেকে বদলাতে? পুরুষতন্ত্র কি ছিন্ন করা সম্ভব?

কঙ্কণার চোখের আগুনের ঝিলিক শামীম অনুভব করে। নারীর মুক্তি শুধু নারীর লড়াই নয়। সমগ্র সমাজের সংগ্রাম। সমাজের কাঠামো, প্রথা, সংস্কৃতি পুরুষতন্ত্রের জটিল নকশায় গাঁথা। নারীকে যেভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, পুরুষও সেভাবেই তৈরি হয়েছে। কেউ নারী হয়ে জম্মায় না,ক্রমশ নারী হয়ে উঠে। নারীত্ব, মাতৃত্বের মত প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নয়। সমাজ কর্তৃক নির্মিত। শামীম উপলব্ধি করে পুরুষের আধিপত্য শারীরিক বা অর্থনৈতিক নয় বরং মানসিক সাংস্কৃতিক দাসত্বের সৃষ্টি নারী দুর্বল, নারীর স্থান ঘরে, সুরক্ষার জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীল জাতীয় ধারণা ক্ষমতারই অংশ যা পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষা করে। নারী মুক্তি মানেই নারীর স্বাধীনতা নয় বৃহত্তর মানবিক মুক্তির আন্দোলন। নারীবাদ কেবল নারীর জন্য নয়, পুরুষ মুক্তিরও আন্দোলন। নারীর জন্য সমধিকার নিশ্চিত করা মানে, পুরুষের অবসাদ, দায়িত্ব, অপ্রয়োজনীয় পুরুষত্বের বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়া।

শামীম বলে, ধর্ম নারীর অধিকার দিয়েছে।

কঙ্কণা জবাব দেয়, নারী অধিকার শুধু সমান বেতন বা ভোটাধিকারে সীমাবদ্ধ নয়। ইউরোপ আমেরিকায় নারী একদা মানুষ হিসেবে গণ্য হতো না। আঠার শতক পর্যন্ত বিবাহিত নারী সম্পত্তির মালিক হতে পারত না। কো-চেম্বারডক্টরিন অনুসারে স্ত্রীকে স্বামীর মালিকানাধীন সম্পত্তির অংশ বিবেচনা করা হতো। ইসলাম নারী নেতৃত্ব সীমিত করলেও অধিকারের ভিত্তি দিয়েছে। সমস্যা ধর্মে নয়, সমস্যা পুরুষতন্ত্র পুরুষতন্ত্রের ব্যাখ্যায়। পুরুষতন্ত্র নিজের মত ধর্মকে ব্যবহার করেছে। মধ্যযুগে ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে সাংস্কৃতিক কুসংস্কার বৃদ্ধি পায়। নারীর শিক্ষাসুযোগ দমন করে বাইরে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। বিশ্বব্যাপী নারী পুরুষের চেয়ে কম বেতন পায়? গৃহকর্মের কাজে নারীর স্বীকৃতি নেই। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত  কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে নারীকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দিলে সে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করবে।

কেবল পুরুষকে দোষ দিলে কি সমাজে পরিবর্তন আসবে? শামীম বলে।

কঙ্কণা দৃঢ় স্বরে বলে, পুরুষ যদি নারীকে বন্ধু সমানভাবে দেখে তাহলে সে নিজেও সামাজিক চাপ মুক্ত হবে। গৃহস্থালি কাজ, সন্তান পালনকে নারীর কাজ না ভেবে পারিবারিক দায়িত্ব হিসেবে মূল্যায়ন প্রয়োজন। নারী অধিকার শুধু নারীদের ইস্যু নয় বরং মানবাধিকারের প্রশ্ন।

শামীম কিছু বলে না। কঙ্কণা বলে যায়, ইসলাম পুরুষের সামন অধিকার দেয়নি নারীকে। খ্রিস্টধর্মের শুরুতে নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মধ্যযুগে চার্চ নারীর ক্ষমতা সংকুচিত করে। ক্যাথলিক চার্চে এখনো নারীর পুরোহিত হওয়া নিষিদ্ধ। প্রোটেস্টটান্টদের অনেক নারী ধর্মগুরু হয়েছে। হিন্দুধর্মে নারী দেবী হিসেবে পূজিত হলেও

সমাজে নারীর অবস্থান ভিন্ন। বেদ নারীকে জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে দেখে। মনুসংহিতা নারীকে অধীনস্থ রাখার বিধান করে। নারী কখনো স্বাধীন হতে পারে না। শিশুকালে সে পিতার অধীন, বিবাহিত হলে স্বামীর এবং বৃদ্ধ হলে পুত্রের।। বৌদ্ধধর্মে নারীকে সমতা দেওয়া হয়নি। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মে নারী-পুরুষ সমানভাবে সাধনা করতে পারে।

শামীম গভীর চিন্তায় পড়ে।

কঙ্কণা বলে, দার্শনিক জন লক প্রায় চারশত বছর আগে বলেছেন, মানুষের টি প্রাকৃতিক তথা জন্মগত অধিকার রয়েছে। জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তি। নাগরিকদের জন্মগতভাবে প্রাপ্ত অধিকারের সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্র নৈতিকভাবে বাধ্য।

বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিক নারীর জীবন তাদের নিজেদের কাছে নেই। পিতা, ভাই, স্বামী ছেলের নিকট বন্ধক। তাদের স্বাধীনতা আজীবনের জন্য বিনে পয়সায় কিনে নিয়ে নিয়েছে পিতৃতন্ত্র, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আর সম্পত্তি? প্রায় নেই বললেই চলে। স্বামী পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। নিজেদের অর্জিত নয়। সম্পদের প্রকৃত মালিক এবং খরচের অধিকারী তারা নন।

মুসলিম পারিবারিক আইনে নারী পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেও পুরুষের তুলনায় নারী কম সম্পত্তি পায়। একজন পুত্র যেখানে সম্পত্তির দ্বিগুণ অংশ পায়, সেখানে কন্যা একগুণ অংশ পায়। প্রচলিত হিন্দু আইনে কন্যা সন্তান পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হয় না। খ্রিস্টান ধর্মে উত্তরাধিকার সম্পত্তির ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েতে কোন বিভেদ নেই। কন্যা পিতার সম্পত্তিতে পুত্রের সমান অংশ পায়।  চাকমা সমাজে পুত্র না থাকলে কন্যা উত্তরাধিকারী হয়। গারো সমাজে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত। নারী জমির মালিক হলেও তা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সাঁওতাল সমাজে নারী পিতার সম্পত্তিতে কোনো ভাগ পায় না।

মুসলীম আইনে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকারী হয়। যদি স্বামীর সন্তান বা পুত্রের সন্তান না থাকে তাহলে স্ত্রী এক-চতুর্থাংশ অংশ পাবে। এখানেও স্ত্রী স্বামীর অর্ধেক পায়।

হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে বিধবা নারী স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকারের স্বীকৃত নেই। খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইনে স্বামী স্ত্রী উভয়েই একে অপরের সম্পত্তিতে সমান অধিকার ভোগ করে।

দেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিককে কখনো আইনগতভাবে, কখনো প্রায়োগিকভাবে জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের প্রকৃত বিকাশ সম্ভব নয়।

শামীম বলে, কেবল আইন পরিবর্তনে কি সমঅধিকার বাস্তবায়ন হবে?

কঙ্কণা দৃঢ়স্বরে বলে, সমস্যা আইনে নয়। সমস্যার মূলে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার অপব্যবহার। সব ধর্ম আইনে নারীর ইতিবাচক দিক রয়েছে। সামাজিক কাঠামো নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে ধর্মকে ব্যবহার করছে। নারী যদি নিজ ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা অবগত হয় তাহলে সে নিজেই নিজের অধিকার আদায় করতে পারবে। নারী মুক্তি কেবল ধর্মীয় সংস্কারে নয় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পুরুষতন্ত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব।

শামীম দৃঢ় হয়। সত্যিকার পরিবর্তন তখনই সম্ভব যখন ধর্ম, রাষ্ট্র সমাজের পাশাপাশি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সাথে সাথে মানবিক মূল্যবোধের উদ্ভব হবে। পুরুষ ভক্ষক হিসেবে নয় রক্ষক হিসেবে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করবে।

কথোপকথন থেমে যায়। কথোপকথন থেমে গেলেও পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের স্বপ্ন দেখা কঙ্কণা শামীমের থামে না।



অলংকরণঃ তাইফ আদনান