জলধি / গল্প / উত্তরাধিকার
Share:
উত্তরাধিকার
খুলনার সদর হাসপাতালের করিডোর, নির্জন হয়ে থাকে বিকেল হলে। যেন সময় থেমে যায় ঠিক ওই কোণের জানালায়। যেখানে একদিন শেষ শ্বাস ফেলেছিলেন সিরাজ আলী। পঁয়ষট্টি বছরের গর্বিত পিতা, জমি-জমার রমরমা অবস্থাকে পেছনে ফেলে বাঁচতে চেয়েছিলেন সন্তানের ভালোবাসায়, অথচ... । তিন ছেলে, এক মেয়ে তার। বড় বড় ঘর, ঠাণ্ডা মেঝে, ছাদের ধারে সিঁড়ি, সবকিছুর মাঝে পরিবারভিত্তিক সচ্ছলতা।

জীবনের এই পরিণত বয়সে এসে হঠাৎ তার ভীষণ জ্বর, সঙ্গে হালকা কাশি, আর তারপর দিন না পেরোতেই প্রবল শ্বাসকষ্ট। চারদিকে করোনা প্রকোপ চলছে। অপেক্ষা না করে পরীক্ষা করালেন। পজিটিভ রিপোর্ট । তিনি ভাবলেন তবে কি মৃত্যুর ওয়ারেন্ট দরজায়? অবস্থা আরও খারাপ হলে তাকে ভর্তি করানো হয় খুলনার সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে। প্রথম দিন বড় ছেলে কামাল এসেছিল। দরজায় দাঁড়িয়ে বাবাকে এক ঝলক দেখে বলেছিল— আল্লাহ ভরসা, বাবা। আমরা আছি। তারপর আর আসেনি। মেজো ছেলে ফোনে জানায়— বাচ্চারা ছোট, রিস্ক নিতে পারবো না বাবা। মন খারাপ করোনা। দোয়া করছি দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসো। স্ত্রী মিনোয়ারা নিজেও বয়সে দুর্বল। জানালেন- বাড়িতে সবার ভয়, আমিও খুব অসুস্থ, তাই আসতে পারলাম না। আশেপাশে অনেকে বলল— করোনা হলে তো নিজেকেই বাঁচাতে হয়। হঠাৎ কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সিরাজ আলীর অসুস্থ চোখ মলিন হলো। তিনি ভাবতে পারেননি যাদের জন্য তার বিগত দিনের অর্জন, তারা এতো দ্রুত তাকে ত্যাগ করবে।  সিরাজ আলী গত দু'দিন এতটুকু পারিবারিক ছোঁয়ার জন্য ছটফট করছিলেন। তৃতীয় দিন ঢাকা থেকে ট্রেন ভর্তি অস্থিরতা নিয়ে ছোট মেয়ে এলো। নার্সিং পেশায় থাকা লুনা, বাবার দিকে তাকিয়ে বুকটা শূণ্য হয়ে গেল। বেডের পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে বলল- বাবা আমি এসেছি। তোমার আর কোন ভয় নেই। সিরাজ আলী ঘোলা চোখে তাকিলেন। তার মুখের চামড়া আবেগে সংকুচিত হলো। তিনি কিছু বলতে চান। বলা কথাগুলো দলাপাকিয়ে কণ্ঠে গোঙানির শব্দ তোলে। মুখে অক্সিজেন মাস্কের আড়ালে শব্দগুলোকে করুন শোনায়। সেই শব্দ লুনার বুক ভেঙে, হাসপাতালের করিডোরের দেয়াল গুঁড়িয়ে ঢুকে যাচ্ছিল মানুষের ভেতরে। আর লুনা সমস্ত ভয়, অভাব, অনিচ্ছা, সব কেটে বাবার বুকের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সে জানে, মৃত্যু কোনো সম্পর্ককে শেষ করে না, বরং সম্পর্কের সত্যতা প্রকাশ করে। যার পাশে তুমি শুয়ে মরতে চাও, সেই তোমার আপন। বাকিরা সামাজিক পরিচিতি মাত্র। আজ সিরাজ আলীর অসুস্থতার সময় সমাজ নেই, ভাই, বোনেরা, স্ত্রী, ছেলেরা ছিল না, ছিল একমাত্র কন্যা। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন্, সময় কম। অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত কমছে। সিরাজ আলী সব বোঝেন, তার সবাইকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। বড় বুর হাতের পায়েশ খেতে ইচ্ছে করে। মিনোয়ারাকে বলতে ইচ্ছে করে— তোমার হাতটা কপালে, চোখে রাখো। মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে করে— একদিন শপথ করেছি সব ঝড়ঝাপটা এক সাথে সামলাবো। কিন্তু এখন কেন তুমি দূরে? না তিনি কিছুই বলেন না। এমন কী লুনাকেও না। তার অভিমান বড় হয়। তিনি অবুঝ শিশুর মতো কাঁদতে চেয়ে নীরব হয়ে থাকেন। চোখ গলে পড়ে জলের ধারা। চোখে ক্লান্তির ঢেউ ভিড় করে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। লুনা তখন বারবার কপালে হাত রেখে বলছিল— তুমি পারবে, বাবা। প্লিজ, চোখ খুলে থাকো।

সিরাজ আলীর কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। তিনি মেয়ের অণুরোধ রাখার চেষ্টা করছেন। তার মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। তিনি ঠিক লুনার মতো। তিনি রুমার ভেতর মাকে খুঁজে পাচ্ছেন। তার মায়ের ঘামে ভেজা শাড়ীর গন্ধ নাকে লাগে। তিনি লম্বা করে দম নিতে চান। কিন্তু সময় তার বিপরীত। তিনি একটু হাওয়ার জন্য হাসফাস করেন। অথচ তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক ঠিকঠাক কাজ করছে। একসময় শরীর নিস্তেজ হয়ে এল। চোখ স্থির, বুকের আন্দোলন থেমে গেল। লুনা বাবার মাথা কোলে তুলে কান্নায় ভেঙে পড়লো। আর বলল— বাবা... প্লিজ... আরেকবার... এ যে শুধু তার কান্নাই  ছিল না, ছিল দীর্ঘশ্বাসের চিৎকার। লুনা ঢাকা শহরের এক হাসপাতালে কাজ করে। প্রতিনিয়ত রোগীর হাত ধরে বলে- আমি আছি। সে জানে, জীবনের কঠিনতম দিনেও  জিতে যাবার স্বপ্ন দেখাতে হয়। আজ মেয়ে হয়ে বাবাকে রক্ষা করতে না পারলেও তাকে ভালোবাসার শেষ ছায়ায় রাখতে পারছে। এটুকু ছাড়া কী করবে সে? সে দেখেছে এই মহামারিতে বাবার গল্পের মতো বহু গল্প ঘুরে বেড়ায় সমাজের কোঠরে। বাবার আলিঙ্গন যেন একটি আয়না, যেখানে সমাজ নেই, ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, ভয় নেই, স্নেহ পরম সত্য। সিরাজ আলী গোঙায় । ব্যাকুল হয়ে ওঠে লুনা। চারপাশের স্টাফ, নার্স, সবার চোখে জল। কেউ কাছে এসে হাত রাখলো লুনার কাঁধে। কিন্তু সে কিচ্ছু অনুভব করছিল না। শুধু বুঝতে পারছিল বাবার কোলের উষ্ণতা হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে তার সাহসের উৎস। সে জানে ভালোবাসা মৃত্যুর মুখোমুখি টেনে এনেও জয় করতে শেখায়। আরও জানত ঝুঁকি নিচ্ছে। তবুও তার পক্ষে একমুহূর্ত দূরে থাকা সম্ভব ছিল না। মেয়েরা এমনই হয়, ভালোবাসার ভেতরই তাদের সাহসের জন্ম।

পরদিন সকালেই দাফন হলো সিরাজ আলীর। বাড়ির কেউ চিৎকার করলো না, কেবল বিধবা মিনোয়ারা কিছুক্ষণ কান্না করলেন। ছেলেরা এসেছিল, ঠিক সময়ে দূরত্ব রেখে কবরের পাশ দাঁড়িয়েছিল। ওরা বলছিল— বাবা আমাদের অনেক দিয়েছেন। করোনা জন্য কিছুই করতে পারিনি তাকে। হ্যাঁ, সিরাজ আলী তাদের জন্য জমি, ঘর, অর্থ দিয়েছেন। কিন্তু যে সময় দরকার ছিল একজন মানুষের উষ্ণ স্পর্শ। তখন তারা কেবল মুখ ফিরিয়েছিল। উত্তরাধিকার কাগজে হয়, উত্তরসূরি হয় হৃদয়ে। কে কয় বিঘা জমি পেল, তা ইতিহাস মনে রাখে না। কে শেষ শ্বাসে পাশে ছিল, তা মানুষ মনে রাখে সারাজীবন। দাফনের পরে ভাইয়েরা বসে গেল বাড়ির বারান্দায়। কোন জমি কার হবে, কোন ঘর কার, কে কী দায়িত্ব নেবে, এসব নিয়ে আলোচনা। লুনা দাঁড়িয়ে শুনছিল। সে জানতো তার নামে কিছু থাকবে না। বাড়ির কোণেও তার ঠাঁই হবে না। তবুও সিরাজ আলীর শেষ শ্বাসের সাক্ষী একমাত্র সে।

ঢাকায় ফেরার আগে ভাইদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, কত দুর্ভাগা এরা। বাবার শেষ স্পর্শ পাবার কথা ভাবেনি কখনও, ভেবেছে সম্পদের কথা। উত্তরাধিকার কী জমি? নাকি ভালোবাসা?


অলংকরণঃ তাইফ আদনান