জলধি / কবিতা / হাফিজুর রহমান এর পাঁচটি কবিতা
Share:
হাফিজুর রহমান এর পাঁচটি কবিতা
উৎসের সন্ধানে 
হৃদয় কা'বার উচ্চারণে প্রতিটি কবিতা 
মানুষের কন্ঠে শুনে শুনে খুব ভালবাসি
শব্দে ছন্দে গাঁথা যেন মণিমুক্তা রাশি রাশি 
কবিতা-শরীরে আঁকা বুঝি অনিন্দ্য মুগ্ধতা। 
 
স্মৃতির শরীরে খুঁজি লোবানের তীব্র ঘ্রাণ 
বেঁচে আছি নাকি মৃত,যেন বুঝতে পারিনা 
অন্তর্গত দৃষ্টিপাতে দেখে কেন যে বুঝিনা--
পৃথিবী কীভাবে বাঁচে, বাঁচে অনিন্দিত প্রাণ ! 
 
অক্সিজেন সর্বত্র রয়েছে জানি পৃথিবীতে 
তবু কেন বন্ধ হয়ে আসে দীর্ণ-দীর্ঘশ্বাস 
জীবনের পরতে পরতে খুঁজি রসাভাস, 
কিছু দিতে, আর কিছু তার অকাতরে নিতে। 
 
এই দেয়া-নেয়া মানুষের প্রাচীন অসুখ 
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে মুগ্ধ আমি টেনে তুলি সুখ। 

জননী জন্মভূমি
ভদ্রার চরের মতো নরম মাটিতে গড়া আমার মা
শ্যাম-রঙে মমতাময়ী শরীরে ছিল তাঁর লাবণ্য মাধুরি 
কিশোরী লতিফা বেগম যেনবা উচ্ছ্বসিত সুন্দরের আভা, 
কোমল হৃদয়ে ভরা প্রেমময় মাটির কলসি--
 
নদীতে জোয়ার এলে যেরকম ঝিকমিক আলো জ্বলে 
জ্যোৎস্নায় রোদ্দুরে, জলের শরীরে অতিন্দ্রীয় ঢেউ উঠে 
তীরের নরম মাটিতে আছড়ে পড়ে নন্দিনী স্বভাবে,
সময়ের স্রোত বয়ে চলে সম্মুখের সমুদ্রাভিমুখে...
 
লতিফা বেগম যেন ছলছল সেই নদীর কল্লোলধারা
নরম রোদের ফালি, একখন্ড জলভরা মেঘের শরীর 
ছায়া-অন্ধকারে আঁকা জীবনের কল্পতরু, অনিন্দ্য সকাল
দিনের আলোর মতো হাসিমুখ, প্রত্যাশার সবুজ জমিন।
 
স্বদেশ জননী ভাষা একদেহে কীরকম সঙ্গীতের সুধা 
সমাজ সভ্যতা গীতি মিলেমিশে অনন্য বন্ধনে বাঁধা, 
সময়ের সুরে সুরে জীবনের সমূহ সঙ্গীত উঠেছিল বেজে 
কবিতায় কতটুকু ছবি তার আঁকা সম্ভব বুঝিনি আদৌ ! 
 
এই গ্লানিবোধটুকু সর্বক্ষণ হৃদয়ের সানুদেশে বাজে 
এই অসহায়তার পীড়ন যাতনা সমস্ত পৃথিবী জুড়ে কাঁদে।

আলোর খোঁজে
জন্মেই এনেছিলাম এক হিরণ্ময় আলো !
জ্যোতির জগত থেকে নেমে জীবন-আঁধারে,
আজন্ম হারিয়ে খুঁজি সেই আলো জীবনের অলিতে গলিতে,
পৃথিবীর ওলোট-পালোট পথে, নদীজলে সমুদ্র-জঙ্গলে
হাওয়ার নৃত্যভঙ্গী আর মানুষের বিনিদ্র-ঢেউয়ে, ফেননিভ জলে !
 
রাতের পথিক যেন আমি
খুঁজে ফিরি অন্ধকারে আলোর প্রতিমা !
খুঁজি আলো পৃথিবীতে, অন্ধকারে, সূর্যের গভীরে
উজ্জ্বল তারার মতো যে আলো লুকিয়ে আছে—
সেই সে অভূতপূর্ব অচেনা প্রদীপ !
 
জ্বলে খুব অনিকেত বেদনার্ত সুরে, 
অন্তর্লোকে তারে খুঁজে ফিরি, খুঁজি পরিপার্শ্বে,
প্রকৃতির লতাগুল্মে, বৃক্ষশাখে, যুবতীর অনবদ্য চোখের তারায়
আঁধারের অনন্য স্বরূপ সেই অন্তর্গত আলো !
 
খুঁজে খুঁজে কেটে যায় জাগতিক দিন আর রাত !
দিনের ঘুর্ণনচক্রে জীবনের উন্মাতাল ব্যর্থ ভষ্মদানা !
তবু বেদনার ফুল ফোটে অলৌকিক টবে
তাই দেখি শুধু, অন্ধকারে নিষ্পলক দেখি !

এসো যাই
এমন অবাক জ্যোৎস্নাধোওয়া জলে 
এসো মাঠের পরে মাঠ পেরিয়ে যাই 
সাদা-কালো মেঘ-বালিকা দিলে ঠাঁই, 
হিমেল হাওয়া ভিড়বে তখন দলে দলে ! 
 
নদীর জলে ভাসলে চাঁদের আলো
থামবো নাহয় নরম-নদীর তীরে
বুকে তুলে নাও আঁধার-সঙ্গিনীরে,
পথের ধুলোয় হৃদয় প্রদীপ জ্বালো।
 
এমন অবাক বেরিয়ে পড়ার ছলে 
চেনা-অচেনা শীতল পুকুরগুলি
উঠুক নাহয় দোদুল দোলায় দুলি, 
স্বপ্নসুখে জাগুক জোয়ার নব্য-কৌতুহলে।
 
জীবনে-যাপনে আনন্দ-বেদনাগুলি
হৃদয় কাঁপানো পুষ্পঘ্রাণে ভরে তুলি।

সুখ
জীবন-নদীর ঢেউজল পারাপারে
পকেটে তো নেই এমনতর রসদ
বিপুল বৈভব, কিংবা অযুত সম্পদ,
পারানির কড়িও শূন্য যে একেবারে;
 
মুঠোভর্তি ম্লান-মৌন হাসির বারতা
বুক-পকেটেই থাকুক না ভরা তবে
ফুলময় সুখ পেয়েছি যাকিছু, রবে
জীবনে থাকুক সবটুকু সরলতা।
 
হৃদয়ের নদী কানায় কানায় ভরা
জীবনে-যাপনে একমুঠো সুখ আঁকা
থাকুক নাহয় থাকলে কিছুটা ফাঁকা—
এইটুকু বুকে অক্ষয়-কবচ ধরা !
 
ফুল-পাখি-বন, মানবিক স্বর্ণলতা
হোক তবে তাই জীবনের সার্থকতা !


অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন