জলধি / কবিতা / বেনজির শিকদারের তিনটি কবিতা
Share:
বেনজির শিকদারের তিনটি কবিতা
প্রাণকৃষ্ণ

একদিন ভীষণ উদার হতে ইচ্ছে হয়েছিল!

ঠোঁটে ঠোঁট রেখে খুব কাছে ডেকে

ঘন নিঃশ্বাসে পুড়িয়ে অনায়াসে বেচে দিয়ে গেলে 

তোমার বারোমাসি দুঃখগুলোর পালপোষ। 

সে আমি যত্নেই রেখেছি। 

 

একদিন খুব করে সবুজ হতে ইচ্ছে হয়েছিল!

শরীরে শরীর ছেনে আদ্যপান্ত জেনে

অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে গেলে

বুকের কার্নিশে পোষা ডানাভাঙা পাখির অবাধ মুক্তি!

সে আমি প্রেমেই পুষেছি। 

 

একদিন তুমুল প্লাবন হতে ইচ্ছে হয়েছিল!

ভালোবাসার সম্মোহন আর মিলনের মর্মমুখরতায় 

গোটা আমিটাকে লুট করে নির্লিপ্তভাবে রেখে গেলে 

তোমার শতাব্দী সঞ্চিত সর্পেভরা এক পদ্ম-মায়াদিঘি!

সেও আমি মরমেই ধরেছি। 

 

একদিন কীর্তিনাশার মতো বিদায়ের গানে সুর মিলিয়ে

আততায়ী তুমি চলে গেলে দূর থেকে আরও বহুদূর। 

 

এখন ঘনরোদ কিংবা দুর্বিনীত বৃষ্টি হতে দেখলেই

বুকের আগল খুলে ভীষণ ভাবুক হতে ইচ্ছে করে!

 

প্রণয়ের গাঢ় আবেদনে—-

বারবার শতবার ফিরি নিজেরই অক্ষমতার কাছে!

ঢেকে নিয়ে ভূচ্ছায়ায় আমার আমি,

আলোহীন অন্ধকারে প্রাঞ্জলতায় হেসে কুটিকুটি;

একআকাশ মুগ্ধতা আর অহংকারে 

তোমার নাম দিইপ্রাণকৃষ্ণ!


অবহেলার বারান্দা

মরদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো আবেগকে খাঁমচে ধরেছি

ভাঙছি নিজেরে নিজেরই হাতে।

বারকয়েক উড়তে চাওয়া খুশি আর

বুকতড়পানো আহাজারিগুলোর কী অদ্ভুত সমীকরণ!

ডানা ঝাপটায়থেকে থেকে অতি ঈপ্সার পুলকরাগে ভাসে!

যে স্বপ্নগুলো হতে পারতো দীর্ঘজীবি

মরে যেতে যেতে তারাও

সাপের খোলসের মতো বদলে নিয়ে 

নিজেরে বেচে দিলো বহুবার। 

 

সভ্যতা আঙুল উঁচিয়ে বেশ করে দেখিয়েছিল 

বুড়ো বটের ছায়া। 

হালচাল বলতে জেনেছিলাম অমীমাংসিত অন্ধকার। 

অনেক সুখের পর যেমন অনেক বেশি ঋণ

তার চেয়েও অধিক এগিয়ে পাশ্চাত্যের ক্লীব অভিজ্ঞতা। 

কুড়িয়ে কালো বেড়ালের ছায়া খরস্রোতা নদী

নিয়তির বাটখারায় অপেক্ষমাণ তিতিক্ষার মুখ;

হৈদরী হাঁকে মেপে দিতে যাপনের সুতীব্র বিয়োজন 

যে আয়ুরেখায় দুঃখ জড়িয়ে যায়;

নাগরিক নিভাঁজ ক্ষত সারিয়ে ভেড়ে না সে প্রেমের বন্দরে। 

 

পেরিয়ে বিনিদ্র মহাকাল— 

হেঁটে গেলে দরদামের জীবনঅদেখায় আরও কিছু যুগ;

প্রত্যাবর্তন এক অমৃতের অনিশ্চিত অনুচ্ছেদ। 

নিদারুণ বিভায় খুলে গেলে চোখের আগল

যদিওবা ছুঁয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত ভদ্রাসন

আজন্মের বুভুক্ষায় মাস্তুলে পড়ে থাকে পলাতক ঘুম। 

সহস্র জোছনায় সাজে যদি অভূত সম্ভাবনার ঢেউ

অনাসক্ত অভিঘাতে মরে যায় অমৃতের প্রেম। 

 

হাতে ধরে খুচরো হিসেবের এমনতর অজস্র আধুলি-পাই

অবহেলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজ বহুকাল। 

অথচ দুধমিশ্রিত চায়ে চুমুক দিতে দিতে 

কলহাস্যে কেটে যায় তার রোজকের রগরগে সময়। 


অনুভব চাষি 

ফুটেছে সফেদ বেলিঘ্রাণে ভাসে মনপ্রাণদোলা লাগে বোধে।

ফুলেরা মেঘের মতোশুষে নেয় ঘন ক্ষতচাপ চাপ রোদে!

গাছেরা ঘুমের ঘোরে সবুজাভ কাছেদূরেমেলে দেয় পাখা;

পাখিদের মায়াচোখে কতকিছু দেখে লোকেঅনাবিল খাঁখাঁ!

 

ফাঁকি যদি ধ্রুব হয়আঁকি তবে কার মুখদিনমান ভাবি,

জীবনের মানে নেইমরণের কাছে তবু সামান্য  দাবী।

নিয়ে যেও মায়াপুরেযেখানে আনন্দ ঘোরে বিষাদের কাছে।

সেখানে ফুলের ঘ্রাণেফুটবো অলীক-টানে নামহীন গাছে।

 

অনুমিত ফলাফলে চরণের চলাচলেবায়ুযোগে দুলি;

আমার আমিত্ব ভরেস্বরে-সুরে গান ধরে মায়া বুলবুলি!

বিবিধ  বিশ্বনীতিজুড়ে আছে দুর্গতিদ্বিধার শহর। 

মানুষেই ধ্রুবজ্যোতিমানুষ আপন অতিহয় তবু পর!

 

প্রেমের মাধুর্যফুলে জগতের মায়ামূলেমানুষের হাসি!

বিষাদে বিরহ আঁকিনীরবে কাছেই থাকিঅনুভব চাষি।



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন