
এখন আর কারো ভালবাসা গুরুত্বপুর্ণ নয়
এই রচনাগুলো মুলত Publishers for Palestine নামের সংগঠনটির উদ্যোগ। অক্টোবর ২০২৩ এ প্রতিষ্ঠিত, Publishers for Palestine হলো একটি বিশ্বব্যাপী প্রকাশক সংগঠন, যারা ন্যায়বিচার, প্রকাশনার স্বাধীনতা ও ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতির পক্ষে কাজ করে।
তাদের সংহতি বিবৃতি, যা একাধিক ভাষায় অনূদিত, বিশ্বের চারশোর অধিক প্রকাশকের স্বাক্ষরিত। তাদের সংকলনটি আরো বিস্তৃত। সংক্ষেপে তার থেকে কিছু দ্যুতি কবিতার বিচ্ছুরিত। যা অনন্ত বর্তমান যা কখনো অতীত হয় না যায় না ভবিষ্যতের দিকে। যা ঝুলে থাকে একটি টাইমবোমা হয়ে।
ভাষাবদল করেছেন: জাহেদ সরওয়ার
যদিও কবিতা নিসঙ্গতার ভেতরে রচিত হতে পারে, কিন্তু এটি এমন এক শিল্পরূপ যা আমাদের পারস্পরিক সংযোগের প্রতিফলন: বর্তমানের বিকল্প ও সম্ভাব্য ভবিষ্যতের সঙ্গেও তার সম্পর্ক । আমরা খুব কম মানুষই হয়তো পুরো একটি প্রবন্ধ বা গল্প মুখস্থ রাখতে পারি, কিন্তু কবিতা সহজেই মুখে আসে, উচ্চারণযোগ্য —সমাবেশে আবৃত্তি করা যায়, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা যায়, পুনরায় ছড়িয়ে দেওয়া যায়। কবিতা আমাদের মাঝে কম্পিত হয়, ভাষার সীমা অতিক্রম করে চলে, স্মৃতি থেকে স্মৃতিতে সেতু তৈরি করে।
তবে কবিতা শুধু শ্রুতির নয়, দৃশ্যমানতার মাধ্যমও বটে—স্টিকারে লেখা হয়, বাসের আসনের পাশে বা ল্যাম্পপোস্টে সেঁটে দেওয়া হয়; মোটা কাগজে ছাপিয়ে প্রতিবাদি হাতে তোলা হয়; জানালায় ঝুলে থাকে সৌন্দর্যের সাথে, লেখা বার্তা হয়ে।
কবিতা যতটা দ্রুত লেখা যায় একটি সংবাদ প্রতিবেদন, ততটাই দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, অথচ তা স্বাভাবিকীকৃত নিপীড়নের ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করে। আধুনিক সংবাদ পরিবেশনার নিষ্ক্রিয় কণ্ঠকে অতিক্রম করে, কবিতা আমাদের নতুনভাবে দেখার ক্ষমতা দেয়—একটি সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করে।
এই সংক্ষিপ্ত সংকলনের কবিতাগুলো ২০২৩ সালের মাঝ অক্টোবর থেকে মাঝ ডিসেম্বরের মধ্যে লেখা, ফিলিস্তিনি কবিদের দ্বারা—গাজা, পশ্চিম তীর, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কবিগণের। এই কবিতাগুলো একদিকে যেমন গভীর নিঃসঙ্গতার কথা বলে (যেমন সামের আবু হাওয়াশের এখন আর কারো ভালোবাসা গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং হিবা আবু নাদার শুধু হেঁটে যাওয়ার মতো নয় অন্যদিকে আন্তঃসংযুক্ততার কথাও বলে।
ফিলিস্তিনি-মার্কিন কবি ফাদি জুদাহ একটি নতুন কবিতা লিখেছেন, যেটি রিফাত আল-আরিয়র If I Must Die কবিতার প্রতিক্রিয়া—এই কবিতাটি ছিল তার টুইটার প্রোফাইলে পিন করা, যখন ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর তিনি একটি ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। তিনি মারা যান তার ভাই, বোন এবং বোনের চার সন্তানের সঙ্গে।
এভাবেই, কবিতার শেয়ার করা ভাষার মাধ্যমে যখন আমরা সংযুক্ত হয়ে যাই, তখনই সময় আসে কাজ করার। এই সংকলনের শেষে আমরা কিছু পৃষ্ঠা রেখেছি—কিভাবে আমরা সকলে সরাসরি পদক্ষেপ নিতে পারি দখলদারিত্ব বন্ধ করতে এবং ফিলিস্তিনিদের জীবনের, স্বাধীনতার ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে।
রিফাত আল-আরিয়র
রিফাত আল-আরিয়র ছিলেন গাজা স্ট্রিপের একজন প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি লেখক, কবি, অধ্যাপক ও এক্টিভিস্ট। তিনি ৭ ডিসেম্বর ২০২৩ সালে নিহত হন, যখন একটি ইসরায়েলি যুদ্দ বিমান শাজাইয়ার তার বাড়িকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়, যেখানে তিনি তার ভাই, তার বোন, এবং বোনের চার সন্তানের সঙ্গে ছিলেন, যারা সবাই নিহত হন।
যদি আমাকে মরতেই হয়
তবে তুমিই বেঁচে থাকবে
আমার গল্প বলার জন্য
আমার জিনিসপত্র বিক্রি করার জন্য
একটু কাপড় আর কিছু সুতা কেনার জন্য,
(সাদা রঙের হোক, লম্বা লেজসহ)
যাতে গাজায় কোথাও কোনো শিশু,
আকাশের চোখে চোখ রেখে,
অপেক্ষা করে তার বাবার জন্য—
যিনি আগুনের শিখায় হারিয়ে গেলেন
বিদায় বললেন না কারও কাছে
নিজের কাছেও না—
সে যখন দেখে, তোমার বানানো ঘুড়িটা উড়ছে আকাশে
এক মুহূর্তের জন্য ভাবে,
একটি ফেরেশতা এসেছে
ভালবাসা ফিরিয়ে আনতে।
যদি আমার মরতেই হয়
তবে সেটা যেন আশার বার্তা হয়ে ওঠে
একটি গল্প হয়ে বেঁচে থাকে।
ফাদি জুদাহর কবিতা
ফাদি জুদাহ একজন ফিলিস্তিনি-মার্কিন কবি, চিকিৎসক এবং অনুবাদক। তিনি "The Earth in the Attic" (২০০৮), "Alight" (২০১৩), এবং "Tethered to Stars" (২০২১) সহ একাধিক কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। তিনি মাহমুদ দারবিশ এবং ঘাসান জাকতানের কবিতার অনুবাদও করেছেন। তার কাজের মাধ্যমে তিনি ফিলিস্তিনি অভিজ্ঞতা, স্থানান্তর, এবং মানবিকতার বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
হঠাৎ আমি
"আগুনে জ্বলে" মরে গেলাম।
হঠাৎ সময়
থেমে থাকা ছেড়ে দিল।
হঠাৎ তুমি
খুঁজে পাও না আমার শরীর,
কবর দিতে পারো না
যাকে খুঁজে পাও না।
আমার শেষ কবিতা,
আমি লিখেছিলাম বহু বছর আগে
আমার সময় আসার আগেই।
হঠাৎ আমার কণ্ঠ,
যা ছিল নির্বাক
কারণ রাষ্ট্রহীন,
কণ্ঠ দিল
এক গর্জনময় পৃথিবীকে।
হঠাৎ "একটি ঘুড়ি"।
হঠাৎ আমি।
সুর্যের পাখি
আমি উড়ি
ঝলমলে নদী থেকে
চমকম করা সাগরের দিকে,
আমরা থেকে
শুধু আমির মাঝে,
তাজা পূর্বরাগ থেকে
লবণাক্ত পশ্চিমে,
দক্ষিণের মধুরতা,
উত্তরের মুক্ত বাতাসে।
তোমার আর আমার মাঝে
একটি হ্রদ,
ক্যাকটাসের তলায়
জমা জলাধার,
এবং এনিমোনির
নৃত্যভরা উপত্যকা।
নদী থেকে
সমুদ্র অবধি,
জঠর থেকে
শ্বাসে, এবং এক
নির্বিচারে
আমি একাকার,
নদী থেকে
সমুদ্র পর্যন্ত।
হিবা আবু নাদা (১৯৯১–২০২৩)
হিবা আবু নাদা ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, পুষ্টিবিদ, এবং নারী অধিকারকর্মী। তিনি গাজা শহরের খান ইউনিসে বসবাস করতেন এবং ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর এক ইসরায়েলি বিমান হামলায় শহীদ হন। তার উপন্যাস "অক্সিজেন ইজ নট ফর দ্য ডেড" ২০১৭ সালে শারজাহ অ্যাওয়ার্ড ফর আরব ক্রিয়েটিভিটি-তে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে।
হিবা আবু নাদার কবিতা “I Grant You Refuge” হুদা ফাখরেদ্দিনের ইংরেজি অনুবাদে, ফিলিস্তিনি জনগণের যন্ত্রণাময় বাস্তবতা, প্রেম, এবং আত্মত্যাগের এক গভীর প্রতিচ্ছবি। এই কবিতাটি ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর রচিত হয়েছিল এবং ২০ অক্টোবর গাজায় এক ইসরায়েলি বিমান হামলায় হিবা আবু নাদা শহীদ হন।
কবিতাটি পাঁচটি অংশে বিভক্ত, যেখানে কবি প্রার্থনা, মাতৃত্ব, পিতৃত্ব, এবং দুঃখের মধ্যেও আশার বার্তা তুলে ধরেছেন। তিনি শিশুদের, পিতামাতাদের, এবং পুরো সম্প্রদায়কে বোমা হামলা থেকে রক্ষার জন্য আশ্রয় দান করেন—শব্দের মাধ্যমে, প্রার্থনার মাধ্যমে, এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে।
আমি তোমাকে আশ্রয় দিচ্ছি
১.
আমি তোমাকে আশ্রয় দিচ্ছি
প্রার্থনা ও দোয়ার ভেতর।
আমি আশীর্বাদ করি পাড়া ও মিনারকে
তাদের রক্ষা করার জন্য
রকেট থেকে,
যখন এটা একজন জেনারেলের আদেশ
থেকে একটি হামলায় পরিণত হয়।
২.
আমি তোমাকে এবং ছোট ছোট শিশুদের আশ্রয় দিচ্ছি,
যারা এখন বাসার ভিতরে ঘুমিয়ে আছে
একটি বাসার নীড়ে ছানাদের মতো।
তারা ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের দিকে হাঁটে না।
তারা জানে, মৃত্যুর ছায়া ঘরের বাইরে ওত পেতে আছে।
৩.
আমি পিতাকে আশ্রয় দিচ্ছি,
যিনি বোমার পর ঘর হেলে পড়লে
তাকে সোজা করে রাখেন।
তিনি মৃত্যুর মুহূর্তকে অনুরোধ করেন:
"দয়া করো। আমাকে একটু সময় দাও।
তাদের জন্য, আমি জীবনকে ভালোবাসতে শিখেছি।
তাদের এমন একটি মৃত্যু দাও
যেমন তারা সুন্দর।
৪.
আমি তোমাকে আশ্রয় দিচ্ছি
আঘাত ও মৃত্যুর থেকে,
আমাদের অবরোধের গৌরবে আশ্রয়,
এখানে তিমির পেটে।
আমাদের রাস্তাগুলো প্রতিটি বোমার সাথে
আল্লাহর গুণগান করে।
তারা মসজিদ ও ঘরগুলোর জন্য প্রার্থনা করে।
এবং যখন উত্তরে বোমা বর্ষণ শুরু হয়,
আমাদের দোয়া দক্ষিণে উড়ে যায়।
৫.
আমি তোমাকে আশ্রয় দিচ্ছি
আঘাত ও কষ্ট থেকে।
পবিত্র ধর্মগ্রন্থের শব্দ দিয়ে
আমি কমলালেবুগুলোকে ফসফরাসের দংশন থেকে রক্ষা করি
এবং মেঘের ছায়াগুলোকে ধোঁয়া থেকে।
আমি তোমাকে আশ্রয় দিচ্ছি এই জেনে যে
ধুলা সাফ হয়ে যাবে,
এবং যারা প্রেমে পড়ে একসাথে মারা গেছে
তারা একদিন হাসবে।
শুধু সময় পার হওয়া নয়
গতকাল, একটি তারা বলল
আমার হৃদয়ের ছোট আলোকে,
আমরা শুধু অস্থায়ী নয়,
যারা কেবল চলমান।
মরো না। এই আলোর নিচে
কিছু পথিক এখনও হেঁটে চলছে।
তুমি প্রথম সৃষ্টি হয়েছিলে ভালোবাসা থেকে,
সুতরাং শুধু ভালোবাসাই বয়ে যাও
তাদের কাছে যারা কাঁপছে।
একদিন, সব বাগান ফুটবে
আমাদের নাম থেকে, যা থেকে বেঁচে আছে
অনুরাগী হৃদয়গুলো।
আর এই প্রাচীন ভাষা, যা পরিণত হয়েছে,
আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে অন্যকে নিরাময় করতে হয়
আমাদের তৃষ্ণার মাধ্যমে,
কিভাবে হওয়া যায় স্বর্গীয় সুগন্ধি,
তাদের সঙ্কুচিত ফুসফুসকে আরাম দিতে:
একটি স্বাগত শ্বাস,
একটি অক্সিজেনের আহ্লাদ।
নরম করে, আমরা পার হয়ে যাই ক্ষতগুলোর ওপরে,
যেমন উদ্দেশ্যমূলক গজ, স্বস্তির আভাস,
একটি অ্যাসপিরিন।
ও ছোট আলো আমার মধ্যে, মরো না,
যদিও বিশ্বের সমস্ত নক্ষত্রসমূহ
অন্ধ হয়ে আসছে।
ও ছোট আলো আমার মধ্যে, বলো:
আমার হৃদয়ে শান্তিতে প্রবেশ করো।
তোমরা সবাই এসো!
আমাদের একাকিত্ব
কতটা একাকী ছিলো,
আমাদের একাকিত্ব,
যখন তারা তাদের যুদ্ধ জিতেছিলো।
শুধুমাত্র তুমি একা রেখে গিয়েছিলে,
নগ্ন, এই একাকিত্বের সামনে।
দারবিশ,
কোনো কবিতাই কখনো ফিরিয়ে আনতে পারবে না—
যা একাকী মানুষ হারিয়েছে।
এটি অন্য এক অজ্ঞতার যুগ,
আমাদের একাকিত্ব।
শপথ থাক সেই জিনিসের যা আমাদের বিভক্ত করেছিলো
তারপর তোমার জানাজায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
এখন তোমার ভূমি নিলামে বিক্রি হচ্ছে
এবং পৃথিবী
একটি মুক্ত বাজার।
এটি এক নিষ্ঠুর যুগ,
আমাদের একাকিত্ব,
যেখানে কেউ আমাদের পক্ষে দাঁড়াবে না।
সুতরাং, আমার দেশ,
তোমার কবিতাগুলো মুছে ফেলো,
পুরনো ও নতুন,
এবং তোমার অশ্রু,
এবং নিজেকে গুছিয়ে নাও।
ওলিভিয়া এলিয়াস
ফিলিস্তিনি ডায়োস্পোরা কবি যিনি ফরাসিতে লেখেন। ১৯৪৪ সালে হাইফায় জন্মগ্রহণ করেন, ১৬ বছর বয়সে লেবাননে স্থানান্তরিত হন, যেখানে তাঁর পরিবার ১৯৪৮ সালে আশ্রয় নেয়। পরে তিনি মন্ট্রিয়াল ও ফ্রান্সে বসবাস করেন। তাঁর কাজ ইংরেজি, আরবি, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বহু সংকলন ও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ২০২২ সালে তিনি প্রথম ইংরেজি অনুবাদ বই Chaos, Crossing (World Poetry), কারীম জেমস আবু-জেইদের অনুবাদে প্রকাশ করেন।
অলিভিয়া এলিয়াসের কবিতা Day 38, Nov. 14, I Didn’t See the Fall This Year জেরেমি ভিক্টর রবার্টের অনুবাদে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়। এই কবিতাটি গাজায় চলমান সংঘাতের প্রেক্ষাপটে রচিত, যেখানে কবি শরতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেননি, বরং বোমা হামলা ও ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেছেন।
এই বছর আমি শরৎ দেখিনি
আমি দেখিনি আকাসিয়ার আগুনরঙা দ্যুতি
না দেখেছি সারসদের আকাশপানে ওড়া
শুধু বোমা, আরও বোমা ধ্বংসস্তূপে ঢাকা গাজার উপর
না পানি, না খাবার, না জ্বালানি, না বিদ্যুৎ
গেটোর বন্দিদের জন্য কিছুই নেই
ঔষধও না—সম্পূর্ণ বঞ্চনা
এই তো নির্ধারণ করেছে বিজয়ীরা
তাদের শক্তিশালী মিত্রদের অব্যর্থ সমর্থনে
প্রথমেই সেই আমেরিকার বড় শীর্ষনেতা
যিনি উদগ্রীবভাবে বোবাদের অভিনয় করেন
এই শরতে আমি কিছুই দেখিনি
না আকাসিয়ার দীপ্তি, না সারসের ওড়া
শুধুই বোমার বন্যা, নেমে আসে
মৃত্যুর ফাঁদের উপর
এই উন্মত্ততার মাঝেই উপচে পড়ে
এক বিশাল, জীবন্ত নদী
অনেক শাখা-প্রশাখা নিয়ে—গাজার শিশুরা
তোমাদের ক্ষুদ্র দেহ—যা বড়ো হওয়ার সুযোগ পেল না
তোমাদের স্বপ্ন—যা বিকশিত হবার আগেই ঝড়ে পড়ল
তোমাদের ক্ষুদ্র দেহ—রক্তে ভেজা ফুল
তোমাদের স্বপ্ন—উড়ে গেল হাওয়ায়
এই বছর শরৎ আসলেও আমি দেখিনি
সোনালি পাতাদের বিদায় বলিনি
না বলেছি সারসদের
আমাকে বিদায় জানাতেই হবে—
সব কিছুকেই
যেমনটা ওখানে করে সবাই, প্রতিরাতে
ঘুমাতে যাওয়ার আগে—
পিতা-মাতা আর সন্তানরা জড়িয়ে ধরে বলে—
“বিদায়, হয়তো আবার দেখা হবে—
একদিন, অন্য এক জীবনে,
যেখানে থাকবে না গেটো, বান্তুস্থান,
কারাগার, বোমা, আর বিলুপ্তি।”
সামির আবু হাওয়াশ
একজন ফিলিস্তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক ও অনুবাদক, যিনি লেবাননে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দশটি কবিতার সংকলন প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Ruins and Other Poems। তিনি ইংরেজি ভাষার সাহিত্যিকদের, যেমন উইলিয়াম ফকনার, সিলভিয়া প্লাথ, চার্লস বুকাওস্কি, ল্যাংস্টন হিউজ, জ্যাক কেরুয়াক, ইয়ান মার্টেল, হানিফ কুরেইশি, ডেনিস জনসন, এবং মেরিলিন রবিনসনের রচনাসমূহ অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে তিনি স্পেনের বার্সেলোনায় বসবাস করেন এবং Almajalla ম্যাগাজিনের সংস্কৃতি ও সমাজ বিভাগের পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন।
সামির আবু হাওয়াশের কবিতা It No Longer Matters If Anyone Loves Us হুদা ফখরুদ্দিনের ইংরেজি অনুবাদে, ফিলিস্তিনি জনগণের বেদনা, ক্লান্তি ও বিচ্ছিন্নতার গভীর প্রতিচ্ছবি। এই কবিতাটি প্রথমে ২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর লেবাননের দৈনিক an-Nahar-এ প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীতে ArabLit ও Poems for Palestine সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়।
আর কেউ আমাদের ভালোবাসে কিনা, তা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়
আর কেউ আমাদের ভালোবাসে কিনা,
তা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।
উজ্জ্বল সাদা আকাশে দাঁড়ানো
মহান এক ফেরেশতার ভালোবাসাই
এখন যথেষ্ট।
আমাদের শিশুরা দেখে তাঁকে—
দূরে দাঁড়িয়ে, দুই হাত হৃদয়-আকারে গড়ে তুলেছেন—
ওরা হাসে।
আমাদের নারীরা তাঁকে দেখে—
সাদা জুঁইয়ের ডাল হাতে নাড়ান—
তারা একবার চোখ বন্ধ করে... চিরতরে।
আমাদের পুরুষেরা দেখে তাঁর নীল ডানা—
স্বচ্ছ আকাশের মতো বিশুদ্ধ—
তাদের হৃদয় থমকে যায়,
তারা এগিয়ে চলে তাঁর দিকে।
আর কেউ আমাদের ভালোবাসে কিনা,
তা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বোমা আমাদের কান থেকে কেড়ে নিয়েছে—
যা দিয়ে আমরা ভালোবাসার কথা শুনতাম।
রকেট আমাদের চোখ থেকে কেড়ে নিয়েছে—
যা দিয়ে আমরা প্রেমাস্পদের দিকে তাকাতাম।
ঘৃণায় ভরা শব্দ আমাদের হৃদয় থেকে ছিন্ন করেছে—
যেখানে একদিন ভালোবাসার জাদু লুকিয়ে ছিল।
আর কেউ, এই পৃথিবীতে,
আমাদের ভালোবাসে কিনা—
তা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।
“যতটুকু মনে পড়ে,
এ ভালোবাসা কখনই পারস্পরিক ছিল না,”—
বলছেন আমাদের বৃদ্ধেরা,
এখন যাদের মনে ‘ভূমি’ শব্দটাই ক্লান্তির কারণ।
আমাদের কবি দাঁড়িয়ে থাকে দূর দিগন্তে আর ঘোষণা করেন:
“তোমাদের নিষ্ঠুর ভালোবাসা থেকে আমাদের রক্ষা করো!”
তারপর ধীরে বলে, আগের সেই শিশুসুলভ আশাবাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে:
“এই পৃথিবীতে,
কিছুই জীবনের যোগ্য নয়।”
আর কেউ আমাদের ভালোবাসে কিনা,
তা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আমরা ক্লান্ত—শব্দ থেকে,
যা বলা হয় কিংবা যা বলা হয় না,
হাত থেকে, যা বাড়ানো হয় কিন্তু ছোঁয় না,
চোখ থেকে, যা দেখে কিন্তু তাকায় না।
আমরা ক্লান্ত নিজেদের থেকেই—
এই অনন্ত রাতের মাঝখানে।
আমাদের মায়েরা,
যা কিছু অবশিষ্ট আছে আমাদের, তা আঁকড়ে ধরে আছে—
আমরা ক্লান্ত,
এই পাথর বয়ে চলেছি আমাদের পিঠে—
এই চিরন্তন অভিশাপ।
গহ্বর থেকে গহ্বরে,
মৃত্যু থেকে মৃত্যুতে—
আমরা তা টেনে নিয়ে চলেছি
কিন্তু কোথাও পৌঁছাতে পারি না।
এখন আর কেউ আমাদের ভালোবাসে কিনা,
বা আমাদের জানাজায় কারো উপস্থিতি—
তা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আমরা এগিয়ে চলেছি—
নীরবে—
চূড়ান্ত এক গহ্বরের দিকে।
আমরা পরস্পরের হাত ধরে—
এই মরুপৃথিবীর জগতে
একাকী পা ফেলছি।
এক সময়, আমাদের কেউ—একটি শিশু—
পেছনে ফিরে তাকাবে ধ্বংসস্তূপের দিকে,
একটি অশ্রু ফেলবে,
আর বলবে:
“আর কেউ আমাদের ভালোবাসে কিনা,
তা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।”
মায়া মেরির কবিতা
মা, আমি ভালো আছি
’মানচিত্রগুলো আর আগের মতো নেই’
শাস্ত্রক্রিয়াবিদ বললেন, আমার নগ্ন শরীরের ওপর ঝুঁকে।
ধাতব টেবিলটা ছিল এক জ্যান্ত শিকড়ের বিছানা,
যেখানে কোনো গোলাপ জন্মাতে পারে না,
আমার মা শুধু আমার ঝরে পড়া তালুটা ধরতে পারত,
মরে যাওয়া কবুতরের মতো, যাকে দেবতা জলপ্রপাতে ছুঁড়ে ফেলে
শোনার জন্য আমি কিভাবে মহাসাগরের ঢেউয়ে মিশে যাচ্ছি:
মা, আমি ভালো আছি
মা, আমি ভালো আছি
আমি শুয়ে পড়ছি
ছোট্ট ফিলিস্তিনে
আমার অন্তঃসত্তার গল্প, বিতর্কের বিষয়:
কেউ জানত না কি একটি গর্ভ কখনো ২৬ বার দখল হওয়ার পর বেঁচে থাকতে পারে কিনা।
তারা বলল,
তার নীল নালি কখনো শিখেনি সাগরকে শ্বাসরোধ করতে,
আগে যে শিখতে হতো তার চিৎকার ভালোবাসতে।
আমি বলেছিলাম মাকে,
মা, আমি ভালো আছি মা, আমি ভালো আছি
আর সে স্মরণ করতে পারল শুধু আমার ছোট্ট মেরুদণ্ডের স্মৃতিটা
ভাঙা গ্লাস ওয়াইনের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখতে,
কারণ তার নীল চোখকে কান্না করতে দেয়া হয়নি,
যখন সে তার প্রজাপতি উরু ছড়িয়ে দেয় এক ধাতব চাঁদের আকাশের নিচে,
আমার অন্তরপিণ্ড কেটে ফেলে যেন আক্কাদীয় আগুনের পোকা:
দেখল, সে আমাকে চাবির ছিদ্রের ছুরি দিয়ে খুলছে
শুধু নিশ্চিত হতে ছোট্ট আসিরিয়া সভ্য কিনা,
শুধু শুনতে ওয়াদিয়া আল-ফায়ুম বলছে,
মা, আমি ভালো আছি
মা, আমি ভালো আছি
২৬ বার ছুরিকাঘাত-!
কারণ সে লাফিয়ে উঠতো
ছোট্ট ফিলিস্তিনে।
আহলাম বশরাতের কবিতা
তিনি একজন ফিলিস্তিনি উপন্যাসিক, কবি, শিশু সাহিত্যিক এবং সৃজনশীল লেখার শিক্ষিকা।
আমি দেখেছি, বাবা, আপনি যা দেখেছেন
আমি একটি ছবি দেখেছি, হে বাবা,
যেখানে এক মানুষ যুদ্ধের মধ্যে তার চার সন্তানকে বহন করছে।
এটি তোমার সহিষ্ণুতা তুলে ধরে ফিলিস্তিনে:
যুদ্ধ এবং বেঁচে থাকার দেশ।
তুমি আটজনকে বহন করেছিলে, হে বাবা,
কোনো আর্তনাদ ছাড়াই।
যখনই আমি আমার হাতের তালুতে
একটি জীবনের রেখা দেখি,
একটি খোদাই,
আমি হাসিমুখে বলতাম:
আমরা এমন জাতি যারা দীর্ঘজীবী।
হ্যাঁ, আমার বাবা একশ বছর বেঁচে ছিলেন।
আমার বন্ধু বলল:
একশ বছর বেঁচে থাকা মানুষের মেয়ে হওয়া তোমার জন্য মানায়।
আমি জানি না, হে বাবা,
এক সপ্তাহও বাঁচতে না পারা শিশুটিকে কী বলব।
তাদের জন্মনিবন্ধনের আগে
তার মৃত্যুসনদে তার নাম লেখা হয়েছিল।
আমি জানি তোমার প্রস্থান ত্বরান্বিত হয়েছিলো,
একশ বছর ফিলিস্তিনির জন্য যথেষ্ট নয়।
কিন্তু আমি কি বলব এই শিশুটিকে?
যদি তুমি এখানে থাকো,
আমি তোমাকে বলতাম তার সাথে তোমার জীবন ভাগ করে নিতে,
তুমি সম্মত হবে,
কারণ তুমি উদার ছিলে।
তোমার মুখে থাকা ক্ষুদ্র অংশ তোমার জন্য নয়,
তাই তুমি তাকে ত্রিশ বছর দিলে, আর নিজে সত্তর রাখলে।
অথবা তোমার জীবন তার সাথে সমান ভাগ করেছো;
পঞ্চাশ তার জন্য, পঞ্চাশ তোমার জন্য!
হয়তো সে আমার বাবা ছিল,
আর তুমি সেই শিশুটি, যার নাম জন্মনিবন্ধনের আগে মৃত্যুসনদে লেখা হয়েছিলো,
একটি শিশু, ১৯৪৮ সালে জন্মানো, যে বাঁচার আগেই মারা গেছে।
বাসমান আলদিরাওয়ির কবিতা
ভাবনা ব্যর্থ হয়েছে
আমি ঈশ্বরের প্রতি অনেক সহানুভূতিশীল:
আমার হৃদয়ও ধোঁকা খেয়েছে।
যদি তখন আমরা একসাথে বসতাম,
আমরা একটি সিগারেট ভাগ করে নিতাম।
আমি হাত রাখতাম তাঁর কাঁধে, এবং
আমরা একসাথে কাঁদতাম যতক্ষণ না হালকা বৃষ্টি পড়ত,
গাজার ওপর থেকে ওই ধোঁয়ার মেঘ ধুয়ে নিয়ে যেত,
যা আকাশের নয়,
ওরা ফিলিস্তিনে আরেকটি শিশুকে হত্যা করছে,
আর রক্ত বইছে পৃথিবীর হাত আর মুখ থেকে।
জীবন গাজার বুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে, এবং পুনর্জন্ম হবে:
না কোনো ক্ষত, না কোনো দাগ।
কিন্তু দাগ কখনো মরে না, হে আল্লাহ।
আমি শুনি তাঁর কান্না: “এক বিলিয়ন নীরব, এক মিলিয়ন নিহত।”
বিষণ্ণতার শব্দ বাজে,
আর আমি যদিও বাধ্যতামূলক ইবাদতি নই, আমি প্রার্থনা করি।
আমি স্মরণ করি পরিবার ও বন্ধুদের মুখ,
রাস্তা, শহর, সাগর,
গাজার প্রতিদিনের মুখ।
আমি প্রার্থনা করি এবং শুনি তাঁর কণ্ঠস্বর, প্রতিটি বিস্ফোরণ আর বিচ্ছিন্ন অঙ্গের সাথে চেঁচিয়ে:
ভাবনা ব্যর্থ হয়েছে
ভাবনা ব্যর্থ হয়েছে।
এই রুটি জন্মেছিল,এই রুটি মারা গিয়েছিল
পরিষ্কার হাতে,
সে সাবধানে চাল মাখে,
এবং এক মুঠো খামির যোগ করে।
সে গরম পানি ঢেলে দেয়
খামিরের জীবিত থাকার জন্য,
তারপর গুঁড়ো গড়ায় আর মথে,
আর গড়ায় আর মথে।
সে নরম মিশ্রণকে বিশ্রাম দিতে দেয়।
দৃঢ় কিন্তু কোমল হাতে,
সে সেটিকে গোল গোল বানায়,
ফলক হিসেবে চেপে মারে,
এবং প্রতিটা আলতো করে
চুলায় দেয়।
শীঘ্রই, হয়ত আধা ঘণ্টার মধ্যে,
তাজা, সুস্থ এবং সোনালী রুটি জন্ম নেবে।
নতুন জন্মানো রুটিগুলো শ্বাস নেয়,
তবুও ধুলো বাতাস গলায়,
দাহ্য গ্যাস প্রবেশ করে
তাদের পাতলা, ভঙ্গুর খোসায়।
জন্মের দিনেই, একটি ক্ষেপণাস্ত্র,
একটি বেকারি, ছড়িয়ে থাকা
রুটি, মাংস, এবং রক্ত।
ঘাসান জাকতানের কবিতা
ঘাসান জাকতান (Ghassan Zaqtan) একজন খ্যাতিমান ফিলিস্তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক ও সংস্কৃতিকর্মী, যিনি আরবি সাহিত্যে তার কাব্যিক শৈলী ও রাজনৈতিক গভীরতা দিয়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি ফিলিস্তিনি জাতির সংগ্রাম, উদ্বাস্তু জীবন ও অস্তিত্ব সংকটকে তার লেখায় শক্তিশালীভাবে তুলে ধরেছেন। ঘাসান জাকতান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৪ সালে, পশ্চিম তীরের বাথেলহেম শহরের কাছে অবস্থিত বেইত জাল্লা (Beit Jala) শহরে। তার পরিবার ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় মূলত জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত হয়। তিনি বিভিন্ন সময় জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও তিউনিসে বসবাস করেছেন, যা তার লেখায় এক বহিরাগত চেতনার ছাপ ফেলেছে।
ঘাসান জাকতান কেবল একজন কবিই নন, তিনি ফিলিস্তিনি সংস্কৃতির একজন গুরুত্বপূর্ণ ধারক ও প্রচারক। তিনি দীর্ঘদিন ফিলিস্তিন লিটারারি ম্যাগাজিন ও সাংস্কৃতিক প্রকাশনার সাথে যুক্ত ছিলেন, এবং ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাহিত্য বিভাগে কাজ করেছেন।
ঘাসান জাকতান প্রায় ১০টি কবিতার বই লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কিছু বই হলো:
Like a Straw Bird It Follows Me (২০১২) — এটি ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্বাচিত কবিতার সংকলন, যেটির অনুবাদক ছিলেন ফাদেল আল-আজম ও ট্রান্সলেশন সম্পাদক ছিলেন মাহমুদ দরবিশ। এই বইটির জন্য তিনি আন্তর্জাতিক Griffin Poetry Prize (2013)-এ মনোনীত হন এবং জয়ী হন।
The Silence That Remains — এটি তার আরেকটি ইংরেজিতে অনূদিত কবিতার বই।
আরবি ভাষায় তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে A Description of the High Plateau, Old Reasons for Night, Weightless Sky, ইত্যাদি।
Griffin Poetry Prize (International category) বিজয়ী হন। বহুবার ফিলিস্তিনি ও আরব সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৭ সালে তিনি ফিলিস্তিনের সংস্কৃতির জন্য “Palestinian Medal of Culture, Science and Arts” লাভ করেন।
সব কিছু জানে তুমি উঠে দাঁড়াবে
এখন তুমি একা,
বলছে রাতের দেয়াল,
কেউ দরজায় কড়াকড়ি করবে না,
কেউ কাঁধে হাত দেবে না,
যে পথগুলো তোমার স্বপ্নের দিকে নিয়ে যেত
তারা ছিন্নভিন্ন, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে
মরুভূমির মাটির ওপর মরণশীল দেহের মতো।
যে পথে তুমি কখনো বা নির্ভয়ে হাঁটতেও পারতে,
ভাইবোন আর প্রতিবেশীদের দেখতেও পারতে,
যখন ঋতু কঠিন হতো,
যখন জীবন কঠোর ও শুষ্ক ছিল,
সেই পথগুলো এখন পাথর,
অপূরণীয়তা আর অন্ধকার উদ্দেশ্যে আটকে গেছে।
যে সেতুগুলো তোমার পিতাদের স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে করতো,
সেগুলো শুকনো উপত্যকায় পড়ে গেছে অনেক আগেই।
সেখান থেকে আর কারো আশা করো না।
কিন্তু সব কিছুই জানে তুমি উঠে দাঁড়াবে।
সময় শেষ হয়েছে
যখন দূর থেকে ধুলো
আসা-যাওয়া বুঝাতো,
ভাইবোন রাস্তা দিয়ে যেতো,
বা তোমার পরিবারের কাছ থেকে একটা চিঠি আসতো।
এখন তোমার চোখে ধুলো
তোমার ঘর-বাড়ি ধ্বংসের ধুলো,
আর তোমার পরিবারের বাসভবনের ধুলো।
পাহাড়ের ওপারে ধোঁয়া
কোরবানের রান্না নয়,
না মানুষ ফেরার,
এটা তোমার চাচাদের মাঠে আগুন,
আর সেই বাগানগুলোর জ্বালা যেখানে তুমি এক সময় উল্লসিত ছিলে।
এই ধারনাগুলোতে, যেগুলো তুমি জমিয়ে রেখেছ,
সেখানে কোনো স্বপ্ন জন্ম নিতে পারে না।
কিন্তু সব কিছুই জানে তুমি উঠে দাঁড়াবে।
তোমার আর ভাইবোন নেই,
শুধু এই মরুভূমি যা তুমি পেয়েছ,
যেখানে তোমাকে ফেলা হয়েছে,
এই মরুভূমি তোমার ধৈর্যের পুষ্টি পেয়েছে,
যা এগিয়েছে
তোমার নীরবতার মাঝে।
প্রতিবার দেয়াল অতীত নিয়ে আসে,
রাস্তার জায়গায় দেয়াল।
দেয়াল ঘর ও জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে,
শয়নকক্ষগুলোতে চিৎকার নিয়ে আসে
যা সে বিছানা ও শবখানার উপর ছুঁড়ে দেয়,
ছেলেমেয়েদের চাদরের ওপর:
‘তোমার আর ভাইবোন নেই’
‘এখন তুমি একা।’
কিন্তু সব কিছুই জানে তুমি উঠে দাঁড়াবে।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান