জলধি
/ কবিতা
/ পীযূষকান্তি বিশ্বাসের তিনটি কবিতা
পীযূষকান্তি বিশ্বাসের তিনটি কবিতা
আমি দাঁড়িয়ে আছি সিরিফোর্টের আড়ালে। আকাশ জড়ানো ফারসির আঁধারচাদর, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সিন্দুরের ধোঁয়া। প্রদীপ নিভছে ধীরে ধীরে, অথচ আমার চোখে জেগে উঠছে এমন এক আগুন, যা ইতিহাসের কোনো প্রমাণে ধরা যায় না—প্রেমের অগ্নিকুণ্ড, কামনার গোপন দীপ্তি। আমার সোনালি নূপুর থেকে ঝরে পড়ে অদৃশ্য সুর, বুকের গভীরতর কম্পন বাজে সুলতানি ঐক্যতানের মতো।
আমার শরীরের গুহায় এক ঝড় বাস করছে। অশান্ত আর্তনাদে সেই ঝড় শুধু মিলনেই মুক্তি খুঁজে। আমি সুলতান কন্যা ফুরফুরে এক শাহজাদী । আমি চাই - আমাকে ছুঁক এমন এক প্রেমিক, যে আমার দেহকে ভোগ করবে না, বরং পড়বে এক পবিত্র গ্রন্থের মতো। প্রতিটি রেখা থেকে সে খুঁজে নেবে অজানা শ্লোক, প্রতিটি ভাঁজ থেকে তাৎক্ষণিক উচ্চারিত হবে নতুন আয়াত।
আমি ভাবি—ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিতে হয়তো আমার নাম লেখা হবে সাম্রাজ্যের কালি দিয়ে, বিবাহের প্রতীকী গাম্ভীর্যে। কিন্তু সেই কালির তলদেশে দমে থাকবেও এক গোপন ফিসফিসানি—আমার দেহের ফিসফিসানি, যেখানে প্রেমিকের নাম কখনো লেখা হয় না, লেখা থাকে কেবল এক দীর্ঘ অনন্ত ছায়া। বিবাহ আমার কাছে খাঁচা, রূপালি কারুকাজে বাঁধা অন্ধকার কারাগার। অথচ কামনার মহাসমুদ্র আমাকে ঠেলে নিয়ে যায় দূর বন্দরে, অপরিচিত অথচ মুক্ত বন্দর, যার প্রশান্তি রাজপাট জানে না।
তিনমুখী আয়নার কক্ষে নিজের আমি তিন রূপ দেখি—এক রূপ রাজকন্যা, অন্য রূপ প্রেমিকা, আরেক রূপ ভিখারিন, যে কেবল দেহ চাইতে জানে। সেই ভিখারিনই আমাকে সত্যি করে তোলে। মিলনের ক্ষণ আমার কাছে এক বিদ্রোহী দ্বার—শরীর যখন উন্মুক্ত হয়ে যায়, মনে হয় নতুন এক শিলালিপি খোদাই হচ্ছে ইতিহাসে, সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছে আমার সাক্ষ্য।
আমার যৌনতার অন্ধকার তাই এক অনন্ত বিদ্রোহের কবিতা। আমি চাই, আমার দেহ হোক মুক্ত ক্ষেত্র; যেখানে কোনো সুলতানের আইন নেই, নেই বিবাহের শপথ, নেই সাম্রাজ্যের বাণী। কেবল ঝড় থাকবে, বিদ্যুতের ছুটে আসা ধ্বনি থাকবে, আর সেই ধ্বনি আমাকে ফিরিয়ে আনবে নিজের দেহের সাম্রাজ্যে—কামনার রাজ্যে।
চোখ মেললে আবার দেখি প্রাসাদের চূড়ায় উড়ে যাচ্ছে কালো ঘুঘু। তারা ইতিহাসের সাক্ষী—যেখানে প্রেমে জড়ানো দুই শরীর আসলে এক গোপন সিন্দুক। লোহার দরজা বন্ধ হয়, সৈন্যরা পাহারা দেয়, সুলতান মত্ত থাকে, অথচ আমার দেহের ভেতরে তখনো বেজে চলে শিহরণের অদৃশ্য ধ্বনি। সেই ধ্বনি আমার গোপন প্রাসাদ, এবং সেই প্রাসাদেই আমি চিরজীবী।
রজনীগন্ধা
চাঁদের আলো ঝরে পড়ছে কুতুবমিনারের গম্বুজে। সেই মুহূর্তেই নিজেকে খুঁজে পাই প্রার্থনার মসজিদের ভেতর। ধূপের ধোঁয়া উঠছে ধূসর সর্পিল কুণ্ডলীতে, অথচ আমার বুকের ভেতরে জেগে উঠছে অন্যরকম ধূপ—অশান্ত কামনা, যা লতাগুল্মের মতো উঠানামা করে আমার পাঁজরে। আমার মেহেদি আঁকা আঙুল থেকে জন্ম নিচ্ছে গোপন ভাষা, নখের আঁচড়ে শিলালিপিগুলো বেঁকে যাচ্ছে, যেন আমি নিজেই ইতিহাসকে নতুন করে লিখছি।
আমার শরীর কোনো ফুলের মতো কোমল নয়। আমার শরীর সেই ফুলের অদৃশ্য আত্মা—শুধু সুগন্ধ। কোনো আকার নেই, কোনো রূপ নেই। আমি বায়বীয়, আমি স্পর্শাতীত। আমাকে দেখা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। আমি যখন হাঁটি, পায়ে নূপুর বাজে না, বরং শোনা যায় পাপড়ি ঝরে পড়ার মৃদু শব্দ। আমি যখন কাঁদি, চোখ থেকে অশ্রু ঝরে না, বরং চন্দন কাঠের নির্যাস ঝরে পড়ে আমার গালে।
হঠাৎ সে আসে—ছত্রভঙ্গ আলোয় উদ্ভাসিত এক প্রেমিক। তার ছায়া নগ্ন অক্ষরের মতো ছড়িয়ে যায় আকাশের কালো পাতায়। মেহেরউন্নিসার বুক কম্পিত হয় দগ্ধ আগুনের ঢেউয়ে। মিলনের মুহূর্তে দেহ আর আলো একাকার হয়ে গলে যায়, শিরায় শিরায় জন্ম নেয় নক্ষত্রপুঞ্জ। কামনার উন্মত্ততা আমাদের দেহে লিখে দেয় নতুন আয়াত—যা কোনো ধর্মগ্রন্থে নেই, কিন্তু সত্যের চাইতেও বেশি সত্য।
আমাদের শয্যায় বিছানো থাকে রজনীগন্ধা ফুল। একে একে পাপড়ি ঝরে পড়ে, প্রতিটি খসে পড়া পাপড়ি আমার পূর্ণতার স্বাক্ষর হয়ে থাকে। মিলনের শেষে অন্ধকার দেয়ালে ছায়াগুলো নেচে ওঠে, যেন সৃষ্টির অনাধি মুহূর্তে প্রথম নারী ও পুরুষের মিলন থেকে জন্ম নিচ্ছে জনপদ, জন্ম নিচ্ছে সভ্যতা।কিন্তু সুলতান আমাকে চিরকালের জন্য ধরে রাখতে সর্বশ্রেষ্ঠ আতর নির্মাতাদের ডাকিয়েছে। তারা ব্যাকুল হয়ে চায় আমাকে শিশিরভেজা কাঁচের শিশিতে বন্দী করতে। যদি কোনো নারী নিজেই সুগন্ধ হন, তাকে বোতলে বন্দী করলেই তিনি আর নারী থাকেন না, হয়ে যান কেবল এক মহাজ বস্তু।
তাই আমি অপেক্ষা করি সেই দিনের, যেদিন খুশবুখানার জানালা ভুলক্রমে হঠাৎ খুলে যাবে। আর আমি এক নিঃশ্বাসে ভেসে যাব মুক্ত হাওয়ায়, ছড়িয়ে পড়ব দিল্লির প্রতিটি বাগানে, প্রতিটি রাত্রিশ্বাসে, প্রতিটি প্রেমিক প্রেমিকার দেহে। তখন আর আমি বন্দী থাকব না, আমি নিজেই হব বাতাস, আমি নিজেই হব রজনীগন্ধার চিরন্তন গোপন।
আয়না ঘরে বসে আছি, চার দেওয়াল পাথর সাজিয়ে । সুলতানি সাম্রাজ্যের মেহেরুন্নিসা, চুলের মণিমুক্তো ছড়িয়ে পড়ছে মেঘের মতো, কপালে সোনালি আধাঁরে বন্দী এক শকুনের উড়ান। আয়নার কাছে আমি জেনেছি, কামনার আগুন ধূপদানি থেকে নীল কুণ্ডলীর মতো উঠে প্রাসাদের সিলিংয়ে থরে থরে ঝুলে থাকে। ভেলা ভাসিয়ে দেয়া হয় রাত্রির যমুনায়, সোনার দাঁড় টেনে প্রিয়তম উঠে আসে, মুখে তার জাফরান ঘ্রাণ। আমার মহল ভেদ করে বুকের স্পন্দনে নেচে ওঠে দরজার পাল্লা। মিলনের শয্যাকে মনে হয যুদ্ধক্ষেত্র— যেখানে শরীর রক্ত ঝরতে ঝরতে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে । উরুর কম্পন থেকে ইতিহাস লিখে যায়।
ভাবি—আমার শরীর কেন শুধুই সাম্রাজ্যের অলঙ্কার? প্রেমিক এসে হাত রাখতেই সেই প্রশ্নের উত্তর জ্বলে ওঠে। তার স্পর্শে আয়নার ফ্রেম কেঁপে ওঠে, করিডোর ভেসে যায় অদৃশ্য অশ্রুতে। মিলনের মুহূর্তে বুঝি, আমি নিজেই এক সাম্রাজ্য—যেখানে প্রতিটি পেশি নগরী, প্রতিটি ধ্বনি রণতূর্য, প্রতিটি শ্বাস ইতিহাস।
আয়নামহল বাস যেন এক দীর্ঘশ্বাস, সোনা-রুপোর কারুকাজে বাঁধা প্রতিজ্ঞা আমাকে রুদ্ধ করে। তবু আড়ালে, সুলতান দরবারের সঙ্গীত থেমে গেলে, কবির কণ্ঠে ভেসে আসে মহাজাগতিক মন্ত্র: প্রেম মানে বন্দিত্ব নয়, খোলা আকাশে পাখির কামনার মতো ডানা মেলা। আমি শুনে সেই সুরে শরীর ঠেলে দিই প্রেমিকের দিকে।
স্বপ্ন আবেশে প্রাচীন সুলতানের রক্তরেখা মিশে যায় তার ঠোঁটের ধূসরতায়, ঠোঁট আবার মিশে যায় অজানা করিডরে হেঁটে আসা এক গোপন সৈনিকের ঠোঁটে। ইতিহাসের বিরুদ্ধে সে গড়ে তোলে শরীর-রাজ্য, যেখানে রাণীর ভূমিকা আসলে এক বহুমুখী আয়না— প্রতিটি ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন মিলন।
দেখি, ঘোড়সওয়ারের পিঠে বসে, গ্যালোপ করতে করতে হাওয়ার কুঁড়েঘরে নেমে আসছি। গায়ে তখন গজল, আঙ্গুলে বসছে কাতানা। বহু পুরাতন মিনারে আমার কল্পনা করে কামনাকে শিলালিপি করে রাখা হবে, যেমন রাখা আছে ফারসির কবিতা মসজিদের প্রাচীরে। আর সেই কামনাই হবে শাশ্বত ইতিহাস— যেখানে শাহজাদীর শরীর অক্ষরে অক্ষরে লেখা। আমার ইতিহাস লিখব আমার দেহের উত্তাপে, আমার অপূর্ণ বাসনার বিদ্রোহে। আমি সেই মালিকা-ই-জাহান, আমার শরীরই আমার রাজ্য, আমার কামনাই আমার স্বাধীনতা।
প্রাসাদ অন্তরালে
আমি দাঁড়িয়ে আছি সিরিফোর্টের আড়ালে। আকাশ জড়ানো ফারসির আঁধারচাদর, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সিন্দুরের ধোঁয়া। প্রদীপ নিভছে ধীরে ধীরে, অথচ আমার চোখে জেগে উঠছে এমন এক আগুন, যা ইতিহাসের কোনো প্রমাণে ধরা যায় না—প্রেমের অগ্নিকুণ্ড, কামনার গোপন দীপ্তি। আমার সোনালি নূপুর থেকে ঝরে পড়ে অদৃশ্য সুর, বুকের গভীরতর কম্পন বাজে সুলতানি ঐক্যতানের মতো।
আমার শরীরের গুহায় এক ঝড় বাস করছে। অশান্ত আর্তনাদে সেই ঝড় শুধু মিলনেই মুক্তি খুঁজে। আমি সুলতান কন্যা ফুরফুরে এক শাহজাদী । আমি চাই - আমাকে ছুঁক এমন এক প্রেমিক, যে আমার দেহকে ভোগ করবে না, বরং পড়বে এক পবিত্র গ্রন্থের মতো। প্রতিটি রেখা থেকে সে খুঁজে নেবে অজানা শ্লোক, প্রতিটি ভাঁজ থেকে তাৎক্ষণিক উচ্চারিত হবে নতুন আয়াত।
আমি ভাবি—ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিতে হয়তো আমার নাম লেখা হবে সাম্রাজ্যের কালি দিয়ে, বিবাহের প্রতীকী গাম্ভীর্যে। কিন্তু সেই কালির তলদেশে দমে থাকবেও এক গোপন ফিসফিসানি—আমার দেহের ফিসফিসানি, যেখানে প্রেমিকের নাম কখনো লেখা হয় না, লেখা থাকে কেবল এক দীর্ঘ অনন্ত ছায়া। বিবাহ আমার কাছে খাঁচা, রূপালি কারুকাজে বাঁধা অন্ধকার কারাগার। অথচ কামনার মহাসমুদ্র আমাকে ঠেলে নিয়ে যায় দূর বন্দরে, অপরিচিত অথচ মুক্ত বন্দর, যার প্রশান্তি রাজপাট জানে না।
তিনমুখী আয়নার কক্ষে নিজের আমি তিন রূপ দেখি—এক রূপ রাজকন্যা, অন্য রূপ প্রেমিকা, আরেক রূপ ভিখারিন, যে কেবল দেহ চাইতে জানে। সেই ভিখারিনই আমাকে সত্যি করে তোলে। মিলনের ক্ষণ আমার কাছে এক বিদ্রোহী দ্বার—শরীর যখন উন্মুক্ত হয়ে যায়, মনে হয় নতুন এক শিলালিপি খোদাই হচ্ছে ইতিহাসে, সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছে আমার সাক্ষ্য।
আমার যৌনতার অন্ধকার তাই এক অনন্ত বিদ্রোহের কবিতা। আমি চাই, আমার দেহ হোক মুক্ত ক্ষেত্র; যেখানে কোনো সুলতানের আইন নেই, নেই বিবাহের শপথ, নেই সাম্রাজ্যের বাণী। কেবল ঝড় থাকবে, বিদ্যুতের ছুটে আসা ধ্বনি থাকবে, আর সেই ধ্বনি আমাকে ফিরিয়ে আনবে নিজের দেহের সাম্রাজ্যে—কামনার রাজ্যে।
চোখ মেললে আবার দেখি প্রাসাদের চূড়ায় উড়ে যাচ্ছে কালো ঘুঘু। তারা ইতিহাসের সাক্ষী—যেখানে প্রেমে জড়ানো দুই শরীর আসলে এক গোপন সিন্দুক। লোহার দরজা বন্ধ হয়, সৈন্যরা পাহারা দেয়, সুলতান মত্ত থাকে, অথচ আমার দেহের ভেতরে তখনো বেজে চলে শিহরণের অদৃশ্য ধ্বনি। সেই ধ্বনি আমার গোপন প্রাসাদ, এবং সেই প্রাসাদেই আমি চিরজীবী।
রজনীগন্ধা
চাঁদের আলো ঝরে পড়ছে কুতুবমিনারের গম্বুজে। সেই মুহূর্তেই নিজেকে খুঁজে পাই প্রার্থনার মসজিদের ভেতর। ধূপের ধোঁয়া উঠছে ধূসর সর্পিল কুণ্ডলীতে, অথচ আমার বুকের ভেতরে জেগে উঠছে অন্যরকম ধূপ—অশান্ত কামনা, যা লতাগুল্মের মতো উঠানামা করে আমার পাঁজরে। আমার মেহেদি আঁকা আঙুল থেকে জন্ম নিচ্ছে গোপন ভাষা, নখের আঁচড়ে শিলালিপিগুলো বেঁকে যাচ্ছে, যেন আমি নিজেই ইতিহাসকে নতুন করে লিখছি।
আমার শরীর কোনো ফুলের মতো কোমল নয়। আমার শরীর সেই ফুলের অদৃশ্য আত্মা—শুধু সুগন্ধ। কোনো আকার নেই, কোনো রূপ নেই। আমি বায়বীয়, আমি স্পর্শাতীত। আমাকে দেখা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। আমি যখন হাঁটি, পায়ে নূপুর বাজে না, বরং শোনা যায় পাপড়ি ঝরে পড়ার মৃদু শব্দ। আমি যখন কাঁদি, চোখ থেকে অশ্রু ঝরে না, বরং চন্দন কাঠের নির্যাস ঝরে পড়ে আমার গালে।
হঠাৎ সে আসে—ছত্রভঙ্গ আলোয় উদ্ভাসিত এক প্রেমিক। তার ছায়া নগ্ন অক্ষরের মতো ছড়িয়ে যায় আকাশের কালো পাতায়। মেহেরউন্নিসার বুক কম্পিত হয় দগ্ধ আগুনের ঢেউয়ে। মিলনের মুহূর্তে দেহ আর আলো একাকার হয়ে গলে যায়, শিরায় শিরায় জন্ম নেয় নক্ষত্রপুঞ্জ। কামনার উন্মত্ততা আমাদের দেহে লিখে দেয় নতুন আয়াত—যা কোনো ধর্মগ্রন্থে নেই, কিন্তু সত্যের চাইতেও বেশি সত্য।
আমাদের শয্যায় বিছানো থাকে রজনীগন্ধা ফুল। একে একে পাপড়ি ঝরে পড়ে, প্রতিটি খসে পড়া পাপড়ি আমার পূর্ণতার স্বাক্ষর হয়ে থাকে। মিলনের শেষে অন্ধকার দেয়ালে ছায়াগুলো নেচে ওঠে, যেন সৃষ্টির অনাধি মুহূর্তে প্রথম নারী ও পুরুষের মিলন থেকে জন্ম নিচ্ছে জনপদ, জন্ম নিচ্ছে সভ্যতা।কিন্তু সুলতান আমাকে চিরকালের জন্য ধরে রাখতে সর্বশ্রেষ্ঠ আতর নির্মাতাদের ডাকিয়েছে। তারা ব্যাকুল হয়ে চায় আমাকে শিশিরভেজা কাঁচের শিশিতে বন্দী করতে। যদি কোনো নারী নিজেই সুগন্ধ হন, তাকে বোতলে বন্দী করলেই তিনি আর নারী থাকেন না, হয়ে যান কেবল এক মহাজ বস্তু।
তাই আমি অপেক্ষা করি সেই দিনের, যেদিন খুশবুখানার জানালা ভুলক্রমে হঠাৎ খুলে যাবে। আর আমি এক নিঃশ্বাসে ভেসে যাব মুক্ত হাওয়ায়, ছড়িয়ে পড়ব দিল্লির প্রতিটি বাগানে, প্রতিটি রাত্রিশ্বাসে, প্রতিটি প্রেমিক প্রেমিকার দেহে। তখন আর আমি বন্দী থাকব না, আমি নিজেই হব বাতাস, আমি নিজেই হব রজনীগন্ধার চিরন্তন গোপন।
আয়নামহল
আয়না ঘরে বসে আছি, চার দেওয়াল পাথর সাজিয়ে । সুলতানি সাম্রাজ্যের মেহেরুন্নিসা, চুলের মণিমুক্তো ছড়িয়ে পড়ছে মেঘের মতো, কপালে সোনালি আধাঁরে বন্দী এক শকুনের উড়ান। আয়নার কাছে আমি জেনেছি, কামনার আগুন ধূপদানি থেকে নীল কুণ্ডলীর মতো উঠে প্রাসাদের সিলিংয়ে থরে থরে ঝুলে থাকে। ভেলা ভাসিয়ে দেয়া হয় রাত্রির যমুনায়, সোনার দাঁড় টেনে প্রিয়তম উঠে আসে, মুখে তার জাফরান ঘ্রাণ। আমার মহল ভেদ করে বুকের স্পন্দনে নেচে ওঠে দরজার পাল্লা। মিলনের শয্যাকে মনে হয যুদ্ধক্ষেত্র— যেখানে শরীর রক্ত ঝরতে ঝরতে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে । উরুর কম্পন থেকে ইতিহাস লিখে যায়।
ভাবি—আমার শরীর কেন শুধুই সাম্রাজ্যের অলঙ্কার? প্রেমিক এসে হাত রাখতেই সেই প্রশ্নের উত্তর জ্বলে ওঠে। তার স্পর্শে আয়নার ফ্রেম কেঁপে ওঠে, করিডোর ভেসে যায় অদৃশ্য অশ্রুতে। মিলনের মুহূর্তে বুঝি, আমি নিজেই এক সাম্রাজ্য—যেখানে প্রতিটি পেশি নগরী, প্রতিটি ধ্বনি রণতূর্য, প্রতিটি শ্বাস ইতিহাস।
আয়নামহল বাস যেন এক দীর্ঘশ্বাস, সোনা-রুপোর কারুকাজে বাঁধা প্রতিজ্ঞা আমাকে রুদ্ধ করে। তবু আড়ালে, সুলতান দরবারের সঙ্গীত থেমে গেলে, কবির কণ্ঠে ভেসে আসে মহাজাগতিক মন্ত্র: প্রেম মানে বন্দিত্ব নয়, খোলা আকাশে পাখির কামনার মতো ডানা মেলা। আমি শুনে সেই সুরে শরীর ঠেলে দিই প্রেমিকের দিকে।
স্বপ্ন আবেশে প্রাচীন সুলতানের রক্তরেখা মিশে যায় তার ঠোঁটের ধূসরতায়, ঠোঁট আবার মিশে যায় অজানা করিডরে হেঁটে আসা এক গোপন সৈনিকের ঠোঁটে। ইতিহাসের বিরুদ্ধে সে গড়ে তোলে শরীর-রাজ্য, যেখানে রাণীর ভূমিকা আসলে এক বহুমুখী আয়না— প্রতিটি ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন মিলন।
দেখি, ঘোড়সওয়ারের পিঠে বসে, গ্যালোপ করতে করতে হাওয়ার কুঁড়েঘরে নেমে আসছি। গায়ে তখন গজল, আঙ্গুলে বসছে কাতানা। বহু পুরাতন মিনারে আমার কল্পনা করে কামনাকে শিলালিপি করে রাখা হবে, যেমন রাখা আছে ফারসির কবিতা মসজিদের প্রাচীরে। আর সেই কামনাই হবে শাশ্বত ইতিহাস— যেখানে শাহজাদীর শরীর অক্ষরে অক্ষরে লেখা। আমার ইতিহাস লিখব আমার দেহের উত্তাপে, আমার অপূর্ণ বাসনার বিদ্রোহে। আমি সেই মালিকা-ই-জাহান, আমার শরীরই আমার রাজ্য, আমার কামনাই আমার স্বাধীনতা।
অলংকরণঃ তাইফ আদনান
