জলধি / কবিতা / ধারাবাহিক দীর্ঘকবিতা শূন্যতা এক-কালোজাদুকর
Share:
ধারাবাহিক দীর্ঘকবিতা শূন্যতা এক-কালোজাদুকর
পর্ব ৭।।

পোয়াবারো সর্বনাশা সবখানে মায়ার ছদ্মবেশে তার কায়ার আশ্লেষ বিছিয়ে রাখে। পিতৃহন্তারক হবে জেনেও, সম্রাট তার সন্তানকে দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক হবার কৌশল-শিক্ষা দান করেন। সাবধানতাকে কি আমরা সবচেয়ে দামি হীরকখণ্ড ভেবে যত্ন করতে শিখি নি? যা আমাদেরকে প্রতিরক্ষার প্রভা ছড়াবে প্রতিদিন! ভারতীয় গণিতবিদ্যার মতো প্রাচীন চন্দ্রমল্লিকা এখনো কি শোভা ম্যালে সাক্ষাৎ নৈশবিদ্যালয়ের সামর্থ্যবান দীপশিখা হয়ে?

 বয়ে যায় আলো-আঁধারির মুখর মুখপাত্র সপ্তঋষিমণ্ডল। চাঁদের মতো উজ্জ্বল একটি অনন্ত ভূগোলক হৃদয়ে ঝিকিয়ে উঠল। সে-রকম উচ্ছলতা তোমার মুখের অবয়বে আমাকে এক- হুলুস্থুল মুগ্ধতাতে অবগাহন শেখায়।

 রেখায়-রেখায় বিব্রত কিছু দিগন্ত অবহেলা নামের ছেলেখেলায় মেতেছিল সেই গত শ্রাবণ থেকে। তাই প্যালিক্যানদের কাছ থেকে তাদের সাবেক ছায়াগুলোকে চেয়ে নেয়া হয় নি। সঘন অজুহাতে পাখির পালক-পরিহিত রাজাদেরকে অরণ্যে ফিরে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কে ওই বর্ণচোরা সমাজপতি? দূরপাল্লার ইগল পাহাড়ের শীর্ষদেশ ছুঁয়ে দিতে-দিতে ভাবল, একদিন পিরামিডের দেশ পরিভ্রমণে যাবে। তার জানতে দারুণ ইচ্ছে হয়– ফারাও-দেবতাদের কেউ-কেউ তৃণভোজী ছিল কিনা!

বীণার মতো আকাশের নীল বেজে উঠল কি? অপার্থিব আত্মার উত্তরাধিকারী পানকৌড়ির ভেজা ডানা থেকে তরল হীরে গড়িয়ে পড়তে বাকি। 

ফাঁকির প্রসঙ্গ মোটেও আসছে না। পরিপূর্ণ পাগড়ীর দাপুটে আলস্য উজিরের মাথায় চেপে বসতেই পারে। আর ওই অহেতুক নির্লিপ্ততার কিছুটা অগোচরে কেবলি চুরি করে নেয় ম্রিয়মাণ রাজবাড়ির একটি ঢ্যাঙা গাছ। আজো সেই-কখন থেকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে ক্লান্তশ্রান্ত পাঁচটি প্রজাপতিকে।

দিকে-দিকে আদিপিতারা ছড়িয়ে গিয়ে কখন-কীভাবে জলপাই-বনের রক্ষণাবেক্ষণে মনোনিবেশ করেছিলেন? ক্যাপ্টেন, কী-এমন অনিশ্চয়তার দংশন হাঙ্গররূপী জলোচ্ছ্বাস হয়ে তোমাকে গ্রাস করতে চায়? নষ্ট বাতাসের গ্রেনেড কি ঘূর্ণাবর্তের সন্ত্রাস ছড়িয়ে শীতার্ত প্রেতপুরীতে নিক্ষেপ করার ভয় দেখায়? হৃদয় তো এক নীলমণির কৌটো! ওকে উন্মুক্ত করো। ওর থেকে ছলকে-পড়া প্রভা খরগোশের উচ্ছ্বাস নিয়ে তীব্র আবেগে তোমাকে তোমার আকাঙ্ক্ষিত সৈকতে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

পরশ্রীকাতরতার প্রভাবে, স্যাঁতসেতে রঙের খুলিতে আশ্রয় নিতে পারে আসন্ন শ্মশানের শ্যাওলারা। ওরা কি কোনো স্পর্ধিত পুরুষের দ্ব্যর্থহীন ঊরুর ব্যর্থতাকে কামনা করেছিল কুয়াশাচ্ছন্ন দ্যোতনা হিসেবে? ভেবেছিল, এই তো পেয়ে গেছি কাম্য অপ্সরাদেরকে স্বর্গচ্যুত করার জন্যে প্রান্তিক উছিলা।

শিলালিপির দুর্বোধ্যতা মেঘের শরীরে থমথমে উল্কি এঁকে দিলে কি শীত নেমে আসে? গায়ের লোম কখনোই বুঝতে শিখল না, কম্বলের কাছ থেকে চেয়ে-নেয়া উম কীভাবে ফেরত দেবে। এভাবে শবযাত্রার প্রচ্ছায়াজুড়ে বেড়ে-ওঠা অদৃষ্ট পলেস্তারা আরো ঘনীভূত হবে বুঝি! শোকের তীব্র ঘূর্ণিপাকে টকটকে ভগ্নাংশে রূপ নেয় জীবননদীর নাব্যতা। 

সম্ভাব্য স্বেচ্ছাচারিতার সুউচ্চ দুর্গে অবসরযাপনে বড়ো আগ্রহী প্রেতসাধকের শিষ্যরা। আর ওখান থেকে ক্রমশ বাস্তুহারা হয়েছে দুর্দান্ত শুকুন আর চিল?

তিলতিল করে বাড়ে অনিশ্চয়তার ঔপনিবেশিকতা। স্বাধীনতার মর্গে পরাধীনতার পাকাপোক্ত ডোম চিরকালই হয় মূক ও বধির।

পাখির নীড়ের মতো প্রশান্তিও নদীর অঞ্চলকে গ্রাস করতে শিখুক। প্রতিবেশী রাজাধিরাজের উঠানে সাজানো দূরপাল্লার কামান একদিন লতা-গুল্মে পুরোদস্তুর ছেয়ে গেলে, দেবশিশুরা সেখানে রাজহাঁস হয়ে জয়ন্তীতে মেতেছিল একাদশীর রাতে।

হাতে-নাতে ব্যগ্রতার বাঘকে হরিণ-শিকারের মহড়া থেকে পাকড়াও করা বড়ো কঠিন। বিষণ্ণতার সমরাস্ত্রে সজ্জিত উদ্বেগ প্রফুল্লতার পৃষ্ঠপোষক পায়রাকে খুঁজে-ফেরে তীব্র ব্যাকুলতা নিয়ে। কোষবদ্ধ আত্মবিশ্বাসের তরবারি সহজলভ্য মসনদের স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে।

দীর্ঘশ্বাসে অলঙ্কৃত হীরক রাজার দেশ। অবসন্নতার মতো উজ্জ্বল রাজ-কোষাগার।

আর অন্ধকার গুহার মতো দেদীপ্যমান সংসদে পানশালার আবহ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল রঙিন মুখোশ-পরা আশ্বাসবাণীর উৎসবে।

তবে, অনুভবে, কোন সে-উড়নচণ্ডী এই পরিচর্যাহীন আকাঙ্ক্ষা পুষেছিল অবলীলায়, তুরকি নাচের মধ্যমাজুড়ে শিশিরের ফুল ফুটুক না কোনো এলোমেলো বর্ষাতে! আহা। সে কী! কাঠের পুতুলও কথা বলে নাকি জোছনার অভিঘাতে সংশয়হীন রাতে? (চলবে…) 



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন