জলধি / কবিতা / খৈয়াম কাদেরের তিনটি কবিতা
Share:
খৈয়াম কাদেরের তিনটি কবিতা
প্রেমতোয়া নারী


মুখ ফেরালেই যদি মনও ফেরাতে পারো
তবে তাই করো,তবে তাই করো
হে জলের গন্ধমাখা কামরাগ শোভনের
প্রেমতোয়া নারী।

আমাদের চারদিকে আগুন-হাওয়া
বাতাসে কার্বন আর পানিতে আর্সেনিক ভাসে
দূষণ-দহনে ভাসে নিসর্গ লাস্যের
স্বর্গস্নাত কায়া।

প্রাণকোষ বয়ে চলে ফরমালিন ও কার্বাইডের বিষ
কোনখানে নেই কোনো সুখের আশিষ
জীবনের মাঠে তাই সৌখিন শঠতা এসে
কপট আখ্যান গড়ে,কুজন দখলে পোড়ে
সুজন নগর।

এমন ঊষরে বসে মানুষের মন বলো
কোন গীত্ গাহে,কোন ধামে কার কাছে
কোন সুখ চাহে! তাইতো প্রেমিকজন
রমনীর রূপঘরে ভালবাসা খোঁজে
মননে নির্মাণ করে হৃদরতি রমনের কুলিন নিবাস।

সেই নারী এইভাবে যদি তার মুখ ফিরে নেয়
নটকে সরিয়ে রাখে নিঃসঙ্গ পাড়ায় আর
খেয়ালে গুঁড়িয়ে দেয় কুসুম মিনার
তাহলে কোথায় আর সুখজননের মর্মর মৃত্তিকা পাই
কোথায় বানাই বলো স্বপ্ন-পবনের মখমল ঠাঁই!

তবুও বিশ্বাস করি
নারীই তো শীলিত সত্যের প্রিয়তোষ ছবি
ফসলের গন্ধ জলধির ছন্দ আর
পাহাড়ের সবুজ ও বরফের শুভ্রতা মাখা
জোছনার বিভা।

অতএব হৃদয় ফিরিয়ে এনে
সংবেদসিক্ত আত্মার গণিত পাঠ করো
সংখ্যা-তত্ত্বের গড়ফল কষে
সাগরের জলধোয়া শৈবল-আর্শিতে দেখো
রমনী স্বৈরিণী নয়,নয় সে নির্জ্যোতি নিকেলের নিভা।

দু'হাত বাড়িয়ে তাই গাঙচিল বিকেলের  এই
দিনাস্ত দীঘল-আহবান,চাঁদের সখির মতো
বাতাসের সাঁকো বেয়ে আমার সত্তায় নেমে এসো
শিশিরের স্নান সেরে বৃক্ষ-বালকের
পাগল পরাগে মাখো সবুজের সংলাপ।


কুসুম-গোলায় রাখি গোপন ফসল

আমি এক কবিতার সখা,কাব্যকুমারীর কাছে
নিশিপ্রেম চাই; তারাদের স্বপ্নলোকে
বাচ্যবুননের বর্ণ খুঁজি, তোমার শরীরে খুঁজি
বোধের আশ্রয়।

ভাবের নগরে আমি আশিক বাউল
পানির কীর্তনসুখে তাজমহলের স্মৃতি পাঠ করি
বেহুলার দহে খুঁজি নারীতাপ জল!
বিগত বিবাদ ধুয়ে পথেই নির্মাণ করি বৃন্দাবন
কামের কলসে ঢালি রাগের প্রলয়:
পেছনে তাকিয়ে আর কালক্ষয় কেন,কেনই বা
দ্বিধা সংকোচ, বসন কষণ খুলে জলের শ্রাবন
খেলা করো,নদীর বয়নে মাখো জ্বরের বিস্ময়!

বরষা ফুরিয়ে গেলে বালুচর জাগে,সেখানে থাকে না
আর সারসের ঝাঁক, মাছরাঙা উড়ে যায় অন্য খালে
আম কুড়বার এই ভরাধুম কালে আমরাও সারি চলো
রাতের গোসল,আলোকে আড়াল ক'রে
পৃথিবীর নাম লিখে রাখি
কুসুস-গোলায় রাখি গোপন ফসল!!


ধারাপাত প্রেম

উড়াল দীঘির জলে হলো না মিত্রতা কোনো
ঢেউয়ের সাথে, শত্রুতাও হলো না আমার
তার মিহিরঙ বাসনার সাথে ;
রাতের জোছনা থেকে এখানে উত্তাপ নামে
বিমুগ্ধ মন্ত্রের টানে, এখানে বিহঙ্গ ভণে
বৃক্ষ-সজীবের শশীকান্ত শান্তগীতি।

আবার সহসা এখানে প্রচণ্ড ঝড় নেমে আসে
নেমে আসে বিনামেঘ নিনাদের ত্রাসের তুফান
নেমে আসে পারদ পেরুনো এক জ্বরের সাম্পান :
কিন্তু আমি তার পাই না হদিস
বুঝি না গহনে গুপ্ত কতো অপঠিত রহস্য-অধ্যায়
বুঝি না বাউল কেন ছটফট করে
সসঙ্গ রাখাল কেন
ঘাসে-ভরা মাঠে তড়পায়!

তবুও তথাস্থ বাক্যালাপ করি
মনতারে টেলিপ্যাথি সেরে নির্ঘুম নিদ্রায় ডুবে যাই
ডুবে যাই মথুরার বীথিবন ঘাটে
তার ছায়াচিত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে: অতঃপর অহক্ষণ
ঘুমঘুম স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নের মিনারে দেখি
বিভঙ্গ মেঘের ঘনরস।

এভাবেই এখানে নির্মাণ করি এক ধারাপাত প্রেম
অসাংজ্ঞিক ভালবাসা-ঘর; যেখানে যজ্ঞের
সমাহার আছে কিন্তু সমাপন নেই
যেখানে যোগী ও যোগীনির কামাবেগ আছে
কিন্তু কামকুত্য নেই, নেই কোনো উপসংহার
তার সোমসিক্ত নিত্য-কবিতার!

তাইতো এখানে এক গঞ্জের গেদা তার
পথ ভুলে যায়, উদাস পরীও ভোলে
সারেং বাড়ির ঘাটা: দিনে দিনে দিনগুলো
ভাটার কবলে পড়ে হারায় দিশা
তবুও মেলে না তার
অন্তিম অক্ষের ভিসা।

গণতন্ত্র পুঁজিবাদ কিংবা সমাজতন্ত্র এবঙ
মুক্তবাজারের শঙ্খসংবিদা
কিছুতেই নেই তার দীক্ষা কোনো
নেই কোনো সঠিক ঠিকানা কোনখানে;
সে যেনো হাওয়াচক্র শকট এক
যেনো এক নির্দিক উড়াল-পাখি!

আঁখিতে মাখিয়ে নির্নাম সুরমা কালো
বেণিতে গুঁজিয়ে নিয়ে অদৃশ্য ফুলের দ্যুতি
সে শুধু স্বপ্নের ঘুড়িতে উড়ে চলে
সে শুধু প্রাচীন পুরাণের দুর্বোধ্য সুক্তের রূপকথা বলে
তাই আর আমাকে ডাকে না তার মধুকুঞ্জপুরে
ডাকে না সন্ধের সৌম্য-নগরের ধামে:

সে শুধু আবেগ নিয়ে নিষ্ঠুর পিয়ানো-খেলা করে
আমাকে সরিয়ে রাখে বহুদূর বিজনের
সনাতন মাঠে, সেই ঘাটে আমি এক
চণ্ডীদাস ব'নে যাই! অনুভবে শুনি তার
জঙ্গিমিছিলের মতো নৃত্যরত কেশবেণিকার ধ্বনি
শুনি তার কৃষ্ণ-বন্দনার প্রীতিপর্ণো বাণী।

অম্লান নয়নে তবু শৃঙ্গের চূড়ায় চেয়ে দেখি
অনাগত মিলন কখন হাতছানি দেয়
কখন আমাকে ফের
রজকিনী-প্রেম এসে কাছে টেনে নেয়!!



অলংকরণঃ আশিকুর রহমান প্লাবন